রবিবার, ডিসেম্বর ০৫, ২০১০

প্রকৃতিপাগল ওরা


শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
গাছের নাম ‘পান্থপাদপ’। এর আগে দেখেছি অনেক, নাম জানা ছিল না। এমন অদ্ভুত নাম শেখর রায়ের মুখেই শুনলাম প্রথম। ভাবলাম তিনি ছাড়া বাকি সবার বুঝি আমার মতোই দশা। একবার দৃষ্টি ঘোরালাম নটর ডেম কলেজের ছাত্রদের দিকে। হতাশ হতে হলো। ২০ থেকে ২৫ জোড়া উজ্জ্বল চোখই বলে দিচ্ছে যে ওরা মোটেও এ ব্যাপারে অজ্ঞ নয়। আর অন্তর্ভেদী এ চোখগুলোর কাছেই ধরা পড়তে হলো আমাকে। অর্থাৎ হেলাফেলার পাত্র হয়ে গেলাম আর কি। ওরা যেন বলছে ‘এখনো এটাও জান না? এসব তো আমাদের কাছে পানির মতো সোজা।’
হ্যাঁ গাছ, পাখি, ফুলসহ প্রকৃতির সব ব্যাপার-স্যাপার ওদের কাছে পানির মতোই। কারণ ওরা নটর ডেম নেচার স্টাডি কাবের সদস্য। ওরা প্রকৃতিপাগল। প্রকৃতিকে জানতে বুঝতে ফিল্ড ট্রিপে বেরিয়েছে (২৬ নভেম্বর ২০১০) নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নটর ডেমের আঙিনায়। ঘুরে ঘুরে দেখছে এ গাছ ও গাছ। আর ওদেরকে এটা-ওটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন কাবের আজীবন সদস্য শেখর রায়। আমার কৌতূহল মেটানোর জন্যই পান্থপাদপ সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ একটি বক্তৃতা দিতে হলো তাকেÑ এর ইংরেজি নাম ঞৎধাবষষবৎ’ং। বাংলা ‘পান্থ’ শব্দটির অর্থ হলো পথিক। আর ‘পাদপ’ হলো গাছ। অর্থাৎ ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই ‘পান্থপাদপ’ অর্থ দাঁড়ায় পথিকের জন্য গাছ। কৌতূহল বেড়ে গেল আরো। গাছটি কি কেবল পথিকের জন্যই? তাহলে এটি নটর ডেম আঙিনায় কেন? আরামবাগ মোড়ে রোপণ করলেই হতো, প্রতিদিন অসংখ্য পথিক যাওয়া-আসা করে এ পথ ধরে। জটিলতা ভেঙে দিলো কাবের ইন্টারমিডিয়েট পড়–য়া সদস্যরাই। গাছটির পাতা দেখতে কলাপাতার মতো। কিন্তু কান্ডের ভেতরটা ফাঁপা, যেখানে পানি জমে থাকে। আগেকার দিনে এ পানিতে তিয়াস মেটাতো অনেক পথিক। কেবল আগেকার দিনেই কেন, এখনো এর কান্ডে তিয়াস মেটানোর মতো পানি পাওয়া যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে একটি সমস্যা আছে। জলবায়ুর উষ্ণতা আর বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে বিশ্বের পরিবেশ এখন ভীষণভাবে বিপন্ন। এখন পৃথিবীতে গাছের বড়ই প্রয়োজন। আর যেখানে গাছের প্রয়োজন সেখানে কেবল তিয়াস মেটানোর জন্য গাছটিকে কেটে ফেলবেন, এমনটি হওয়ার নয়। আর আপনি চাইলেও কাটতে দেবে না প্রকৃতিপ্রেমিকরা। ভাবতে পারেন এ গাছটি না হয় কাটতে মানা, অন্য কোথাও কি এমন গাছ পাওয়া যাবে না? হ্যাঁ, পাওয়া যাবে বটে, তবে সহজে নয়। কারণ এটি বিরল প্রজাতির। বাংলাদেশে নটর ডেম কলেজেই গাছটি প্রথম লাগানো হয় এবং এ ব্যাপারে নটর ডেম ছিল পাইওনিয়র। অনেক মানুষ গাছটিকে দেখতে নটর ডেম কলেজে আসেন।
পান্থপাদপের পর প্রকৃতিপাগল ওরা যে গাছের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো, তাতে আমার পিলে চমকে যাওয়ার অবস্থা। শুনেছিলাম পৃথিবীতে সে গাছ একটিই মাত্র আছে। আর সেটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। তাহলে নটরডেমে এলো কিভাবে?
বলছি সে কাহিনীইÑ গাছটির নাম ‘তালিপাম’। এর বৈশিষ্ট্য হলো একবার ফল দিয়ে মারা যায়। দেখতে একেবারেই সাধারণ তাল গাছের মতো, কেউ বলে না দিলে বোঝা প্রায় অসম্ভব যে, এটি তাল গাছ নয়। তাই একে ‘বন্যতাল’ বলেও ডাকা হয়। এ গাছ ফল দেয়ার পর সর্বোচ্চ এক বছর বাঁচে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছটিতে গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ফল পাকা শেষ হয়েছে। ফলে ধারণা করা হয় কিছু দিনের মধ্যেই গাছটি মারা যাবে। তাই এ গাছটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য উদ্যোগী হয় রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস্ লিমিটেড। এরা বীজ থেকে নতুন চারা উৎপাদনের প্রচেষ্টা চালায় এবং সফল হয়। গত ১ বৈশাখ, ১৪১৭ সালে এর অঙ্কুরোদগম ঘটে। বীজ থেকে চারা বের হতে দেড় থেকে আড়াই মাস সময় লাগে। এ পর্যন্ত প্রায় দু’হাজার চারা তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে রোপণ করে। আর এরই একটি হলো নটর ডেম আঙিনার ‘তালিপাম’।
প্রকৃতিপাগলদের সাথে প্রকৃতিকথন চলছিলো বেশ। হঠাৎ না বলে না কয়ে আমাদের দলে এসে ভিড়লেন নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা। সম্ভবত পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন কোথাও। প্রিয় ছাত্রদের দেখে খোঁজ নিতে দাঁড়িয়ে গেলেন। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন কাবের। উপদেশ দিলেন ছাত্রদের। তারপর আরো কথা-বার্তা হলো। বিদায় নিলেন তিনি এবং আলোচনা মোড় নিলো গাছ থেকে পাখিতে। বিপুল উৎসাহে ছাত্ররা দেখালো পাখিদের জন্য তাদের উদ্যোগ। আঙিনার গাছে গাছে শোভা পাচ্ছে কৃত্রিম পাখির বাসা। এগুলো টানিয়েছে ওরাই। মাঝে মাঝে পাখিরা উড়ে এসে বসে, ডিম দেয়, বাচ্চা ফুটায়।
প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করার জন্য ওদের চেষ্টার শেষ নেই। ওরা প্রকৃতিকে সময় দেয় তিনটি আঙ্গিক থেকেÑ ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও কাবের মাধ্যমে। রাকিব হাসান খান আবির। বর্তমানে নেচার স্টাডি কাবে ওর সদস্য নং ১১হ১২। নটর ডেম কলেজে ভর্তির ফরম তুলতে এসে কাবের একটি ক্যাটালগ হাতে পায় সে। আর এ ক্যাটালগের মাধ্যমেই কাবের সাথে ওর পরিচয়। সেই থেকেই শুরু। তারপর নটর ডেম কলেজে ভর্তি এবং নেচার কাবের সদস্য হওয়া। এ কাব তাকে শিখিয়েছে- প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে, প্রকৃতিকে শিখতে হবে, জানতে হবে। অযথা সময় নষ্ট করা যাবে না। পড়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যখন ভালো লাগবে পড়বে, যখন ভালো লাগবে না পড়বে না। ইত্যাদি ইত্যাদি।
এক ঝাঁক প্রকৃতিপ্রেমীর সাথে আড্ডা জমে গেল আরো। খোলা আঙিনায় গাছের কোমল ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমরা। বলছি-শুনছি, জানছি-জানাচ্ছি। কখনো বা উদ্বেগ প্রকাশ করছি সেসব কিশোরদের জন্য, যারা এই বয়সেই জড়িয়ে যায় নানা অপরাধে। হাতের সময়টুকু ব্যয় করে অনর্থক কাজে। কেউ কেউ বখাটেপনা আর মাদকাসক্ত হয়ে প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই শেষ করে দিচ্ছে নিজেকে। অথচ এ আড্ডার সবাই কিশোর। তাদের মাঝে এমন কেউ নেই যার হাতে অনর্থক কাজ করার মতো সময় রয়েছে।
উদ্যমী এ কিশোরদের একজন আবদুর রহিম। থাকে বাসাবোতে। নেচার স্টাডি কাবে সদস্য নং ১২হ৪০। সকাল সাড়ে ৫টায় সে বিছানা ছেড়ে ওঠে। প্রাতঃকাজ সারার পর প্রথম যে দায়িত্বটির কথা তার মাথায় আসে তা হলোÑ সে একজন মুসলমান। আর তাই তাকে ফজরের নামাজ পড়তে হবে। নামাজ শেষে পত্রিকা পড়া, নাশতা করা ইত্যাদি কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করে ঠিক ৭টার মধ্যে বেরিয়ে যায় স্কুলের উদ্দেশে। পৌঁছে সাড়ে ৭টায় এবং কাস শুরু ৮টা থেকে। আর শেষ হয় পৌনে ১টায় এবং বাসায় যেতে আধাঘণ্টা। দুপুরের খাওয়া সেরে বাবার জন্য ভাত নিয়ে যেতে হয় সবুজবাগ থানার পাশে। ফিরতে ফিরতে সাড়ে ৩টা বেজে যায়। কোনো কোনো দিন প্রাইভেট পড়তে যায়। আর যেদিন প্রাইভেট থাকে না সেদিন বিকেলে এবং ছুটির দিনে সে বেরিয়ে যায় প্রকৃতির কাছে দেয়া ওয়াদা রক্ষা করতে। প্রকৃতি যেন দূষিত না হয় সে জন্য কাজ করে। পরিবারের সদস্যদের সচেতন করে। সচেতন করে প্রতিবেশীদের। এই তো সেদিন স্কুলে আসার সময় দেখতে পেল, জবাই করা পশুর বর্জ্য পরে আছে রাস্তার মাঝখানে। নেচার কাবের সদস্য হিসেবে পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কাজ দেখেও না দেখার ভান করে চলে আসতে পারেনি রহিম। একটু সময় দিয়ে নিজেই চলার পথ থেকে সরিয়ে রেখেছে বর্জ্য। তারপর স্থানীয়দের বলে এসেছে যেন মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়।
রহিমের দৈনন্দিন কাজের মাঝে মগ্ন থেকেই আমরা পা বাড়ালাম ৩১২ নম্বর কক্ষের দিকে, যেখানে একটু পরই গঠন হবে নতুন বছরের জন্য কাবের নতুন কমিটি। সদস্যরা কক্ষে প্রবেশ করল। আর শেখর রায় আমাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন নটর ডেম কলেজের সাবেক ছাত্র এবং কাবের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ড. আশরাফুজ্জামন চৌধুরীর মুখোমুখি। বর্তমানে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টের সহকারী অধ্যাপক। তার পাহাড়সম স্বপ্ন নতুন প্রজন্মকে নিয়ে। নেচার স্টাডি কাবের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের মাঝে প্রকৃতি সংরক্ষণের চেতনা ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ রয়েছে বলেই তিনি এর সাথে রয়েছেন। ড. চৌধুরী বলেন, এখানকার ছেলেপেলেদের মাঝে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার যে বীজ প্রবেশ করানো হয়, তা ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হয়। তারপর এ ভালোবাসার বৃক্ষ গজিয়ে উঠতে থাকে স্ব স্ব পরিবেশে। এরই প্রমাণ বর্তমানে এর সদস্যরা প্রকৃতির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন দেশ-বিদেশে। এমনই একজন সদস্যের উদাহরণ টানলেন তিনি। নটর ডেম কলেজের সাবেক ছাত্র কাউসার মোস্তফা। সম্প্রতি নিতান্ত শখের বসেই থাইল্যান্ডের একটি বাঘের খাঁচায় ঢুকেছিলেন তিনি। কী সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড! বাঘ তো বাঘের মতোই ভয়ঙ্কর, মানুষকে কাছে পেলে ছেড়ে কথা বলার প্রাণী নয়। এ কারণেই যুক্তরাজ্যের চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের কাছে মুচলেকা দিয়ে ঢুকতে হয়েছিল তাকে। অর্থাৎ খাঁচার বাঘ তার ঘাড় মটকে দিলেও কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। কিন্তু সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে কাউসার মোস্তফা ঠিক ঠিকই খাঁচায় ঢোকেন এবং অক্ষতভাবে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। শুধু কি তাই, ডোরাকাটা শরীরে হাত বুলিযে হিংস্র বাঘকে বশ করেছিলেন তিনি। কাউসারকে দেখে হালুম করা তো দূরের কথা টু শব্দটিও করেনি। বরং জড়াজড়ি করে নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকতে দিয়েছিল তাকে। যেন প্রকৃতিপ্রেমিক হিসেবে কাউসার মোস্তফাকে যথার্থই চিনতে পেরেছিল সে।
আশরাফুজ্জামান চৌধুরীর সাথে কথা বলতে বলতেই ব্যস্তপদে এসে হাজির হলেন কাবের প্রতিষ্ঠাতা মিজানুর রহমান ভূঁইয়া। পরনে পাঞ্জাবি-পাজামা। পায়ে পুরো সোলের স্যান্ডেল। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। চোখে চশমা। মাথায় শুভ্র টুপি। আর নিশ্চিত করে বলে দেয়া যায় যে, তার ভেতরটাও ভীষণ শুভ্র। একদম কাশফুলের মতো। কারণ শুভ্র হৃদয় না থাকলে প্রকৃতিকে ভালোবাসা যায় না। এই মিজানুর রহমান ভূঁইয়াই কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃতি সংরক্ষণের চেতনা ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৮৪ সালে কাব গঠনের উদ্যোগ নেন। তিনি স্বপ্ন দেখেন সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব একটি পৃথিবীর। জলবায়ুগত উষ্ণায়ন, বনাঞ্চল ধ্বংস, বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির বিলুপ্তি পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলছে। রাসায়নিক ও কীটনাশকের অপরিকল্পিত ব্যবহার, পারমাণবিক অস্ত্রের অনৈতিক ব্যবহার, নদী ও সমুদ্রগর্ভে বর্জ্য নিক্ষেপ প্রতিনিয়ত ভাবায় তাকে। তাই এসবের বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন তিনি। কাজ করছেন নিভৃতে। পরিবেশের জন্য ঘাম ঝরাতে কোনো পিছুটান নেই তার। তবে এতসব উদ্যমের মাঝেও রয়েছে কিছু সীমাবদ্ধতা। এককালীন নামেমাত্র অঙ্কের রেজিস্ট্রেশন ফি ছাড়া আর কোনো টাকা তারা সদস্যদের কাছ থেকে নেন না। তাই কাবের কোনো আয়ও নেই। এর সদস্যরা গাঁটের পয়সা খরচ করে স্বেচ্ছাশ্রম দেন। অর্থনৈতিক এ সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের অনেক উদ্যোগই মুখ থুবড়ে পরে। তবে তিনি জানান, ‘মাঝে মাঝে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী সংস্থা আমাদের অর্থ দিতে চায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, ওরা নির্দিষ্ট ছক বেঁধে দেয়। আর সে ছক অনুযায়ী কাজ করতে গেলে আমরা আমাদের মৌলিকত্ব থেকে বিচ্যুত হবো।’ সে কারণে অনাড়ম্বরভাবেই কাজ করছেন তারা। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি বাজানোর পক্ষপাতী তিনি নন । অনেকেই প্রকৃতির জন্য কাজ করতে গিয়ে উল্টো প্রকৃতির ক্ষতি করে বসেন। তারা যতটুকু কাজ করেন তার চেয়ে বেশি ঢোল-পেটরা পেটান, এই মেলা সেই মেলার আয়োজন করে জনসমাগম ঘটাতে বেশি পছন্দ করেন। এতে করে প্রাণীদের অভয়াশ্রম বিনষ্ট হয়। এতটুকু বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শুভ্র হৃদয়ের এই মানুষটি। তারপর উদাস দৃষ্টি ফেললেন নটর ডেম আঙিনায়।

সোমবার, নভেম্বর ২৯, ২০১০

পাখিরা আত্মহত্যা করে যেখানে



শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
নিকষ অন্ধকার। টিপটিপে বৃষ্টি। সেই সাথে গাঢ় কুয়াশা। আর মৃদু বাতাসের প্রবাহ শুরু হলেই ঘটতে থাকে ঘটনাটা। অর্থাৎ সন্ধ্যা ৭ টা থেকেই পাখিগুলো ব্যস্ত হয়ে যায় আগুনে ঝাপ দিতে। উদ্দেশ্য আত্মহত্যা!
হ্যা, পাখিরা আগুনে ঝাপিয়ে আত্মহত্যা করে জাটিঙ্গা গ্রামে। আর গ্রামের নামেই নাম এ পাখিদের ‘জাটিঙ্গা’। ভারতের আসাম রাজ্যের গৌহাটি থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে উত্তর কাছাড় জেলার একটি গ্রাম এটি, হাফলং থেকে ৯ কি.মি. দক্ষিনে। প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্য আর পাখি রহস্যের কারণেই আসামের এ গ্রাম সারা বিশ্বে পরিচিত। এখানে মৌসুমী মাসগুলোর শেষের দিকে শুরু হয় পাখিদের আত্মহত্যার হিড়িক। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত।
অমাবস্যার রাত, টিপটিপে বৃষ্টি, গাঢ় কুয়াশা আর বাতাসের প্রবাহ এ কয়টির সমন্বয় ঘটলেই আলোর উৎসের দিকে ছুটে যাওয়া এদের অভ্যাস। জাটিঙ্গার লোকজনের এতে বেশ সুবিধাই হয়েছে। তাদের মাংসের প্রয়োজন হলে রাতে আগুন জ্বেলে বসে। ব্যস, পাখিগুলো ডানা ঝাপটিয়ে আসতে থাকে আত্মাহুতি দিতে। আলোর উৎসের ঠিক উপরে এসে পাখা আর পা ছেড়ে দিয়ে ধপ করে মাটিতে পড়ে যায় যেন ‘কান্ত প্রাণ এক’। মায়াবি চোখের এ পাখিগুলোকে তখন দেখে মনে হতে পারে অর্ধমৃত। জীবণের প্রতি বুঝি ভীষণ বিরক্ত। আর তাই এ জীবণ এরা রাখতে চায়না। আকাশ থেকে লুটিয়ে পড়ার সময় সব পাখিই যে আগুনের উপর পড়ে এমন নয়। বরং কিছু ইতস্তত ছড়িয়ে যায় আগুনের পাশে। কিন্তু এরা বেঁচে থাকলেও মরার মতো পড়ে থাকে এবং সহজেই ধরা দেয়। পাখি শিকারের জন্য এর চেয়ে সহজ উপায় আর কি হতে পারে গ্রামবাসিদের কাছে? অনেক সময় আলোর দিকে উড়ে আসতে থাকা পাখিদের বাঁশের লাঠি কিংবা গুলতি দিয়েও সহজে শিকার করে স্থানীয় লোকজন।
এসব পাখিদের কি কোন দুঃখ তাড়া করে? নয়তো কেন তারা আত্মহত্যা করতে আসে? এর জবাব কারো কাছে নেই। বহু বছর ধরে এমনটাই চলে আসছে। হৃদয়ে দুঃখ থাক আর নাই থাক এদের চোখে সব সময় বুনো ভাব আর দুঃখের ছায়া দেখা যায়। জাটিঙ্গা পাখি কখনো পোষ মেনেছে বলে কারো জানা নেই। আর পাখিবিষারদ ও গবেষকরা হলফ করে বলেছেন, পাখিরা কখনো মানসিক রোগে ভোগে না। তাহলে কেন আগুন ও আলোর প্রতি এদের অমোঘ টান?
এ রহস্যের জট আজ পর্যন্ত কেউ খুলতে পারেনি। এটাকে কেউ বলে আত্মহত্যা, কেউ বলে ভুতুড়ে ব্যাপার। কেননা জাটিঙ্গার পাশেই হাফলং। সেখানে এই পাখি কখনো যায় না অথচ জাটিংগা আর হাফলংয়ের আকাশের দূরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটার। স্থানীয় ‘জাইনতিয়া’ জনগোষ্ঠীর ধারণা, এমন ঘটনার পেছনে অশুভ আত্মার ভ’মিকা রয়েছে।
অনেক গবেষকরাই আপ্রাণ চেস্টা করেছেন জাটিঙ্গা পাখিরহস্যের কিনারা করতে। কিন্তু পারেন নি। তবে অধিকাংশের বিশ্বাস বৈরি আবহাওয়াই এর প্রধান কারণ। চাঁদহীন কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে টিপটিপে বৃষ্টির সাথে বাতাসের প্রবাহ প্রকৃতিতে একটি গোলমেলে অবস্থা তৈরি করে। যে কারণে পাখিরা আর স্বাভাবিক থাকতে পারে না, বাধ্য হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কিন্তু কি কারণে আলোর উৎস এদেরকে আকর্ষণ করে? এর কোন সদুত্তর না থাকলেও পাখিদের নিষ্ক্রিয় হওয়ার ব্যাপারে আরেকটি ধারণা রয়েছে, আলোর আকর্ষণে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এরা ছুটতে থাকে উৎস লক্ষ্য করে। পথে গাছগাছালিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। আর আহত অবস্থায় উৎসে এসেই নিঃশ্বেস হয়ে যায় শরীরের শক্তি। তবে এ ধারণার পেছনে কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ মেলেনি। তাছাড়া মাটিতে লুটিয়ে পড়া পাখিদের গায়ে কোন আঘাতের চিহ্নও পাওয়া যায়নি।
পাখি বিশারদ ড. এস সেনগুপ্ত, এ. রউফ এবং সলিম আলির গবেষণায় ৪৪ প্রজাতির পাখির আলোক উৎসের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়। কিন্তু দেখা গেছে, জাটিঙ্গা গ্রামের দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও দুইশ’ মিটার প্রস্তের নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া অন্যান্য এলাকায় আলোর প্রতি তাদের আকর্ষণ নেই। আবার আরো একটি অ™ভ’ত ব্যাপার হলো এ আত্ম্যহত্যার প্রবণতা কেবল স্থানীয় জাটিঙ্গা পাখিদের মাঝেই দেখা যায়, কোন অতিথি পাখি এমন আচরণ করে না। কাজেই পাখি বিশারদ আর তাবড় তাবড় গবেষকদের মাথা গুলিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তারা ব্যাপারটিকে ভ’তুরে বলে মানতেও রাজি নন, আবার রহস্যের জাল ভেদ করে বেরিয়েও আসতে পারছেন না।
ড. সুধীর সেনগুপ্ত ধারণা করছেন জটিল আবহাওয়ার কারণে হয়তো সেখানকার ভ’চুম্বকত্বের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর অত্যধিক ভ’চুম্বকত্ব এবং আলো একসাথে পাখিদের ওপর মারাত্মক কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ফলে সাইকোলজিকেলভাবে পাখিরা উদভ্রান্ত হয়ে যায় এবং অস্বাভাবিকভাবে আলোর উৎসের দিকে ছুটে চলে। তারপর অবশ হয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। তবে এসব কথাও প্রমাণিত হয়নি। মূলত বৈরী আবহাওয়ায় গাঢ় কুয়াশা আর টিপটিপে বৃষ্টিতে উড়ে যাবার সময় গ্রামবাসীদের আলোর ফাঁদে আকৃষ্ট হয়ে পাখিরা এ কান্ড ঘটায়, এটিই সব গবেষণার উপসংহার। এছাড়া ঐ এলাকায় পাখির ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। এ জন্য সংখ্যাগত সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে এটি হয়তো প্রকৃতিরই কোন না জানা খেলা।

রবিবার, অক্টোবর ০৩, ২০১০

চুলাচুলি সমাচার

কোমরে কাপড় বেঁধে অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে আঙ্গুরির মা। পিছিয়ে নেই আছিয়ার মাও। এতক্ষন কেবল অন্দর থেকে অন্দরেই ছুটাছুটি করছিলো গ্রাম্য গালাগালের তীর। এখন পরিস্থিতি এগুচ্ছে সম্মুখ সমরের দিকে। প্রথমে দেউড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো দুজনের মাথা। তারপর পুরো অবয়ব। ঝাড়– উঁচিয়ে নানা অঙ্গভঙ্গি করতে করতে এগিয়ে আসছে আঙ্গুরির মা। সসস্ত্র প্রতিপক্ষের বিপরীতে একমুহুর্ত থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হলো আছিয়ার মা, তবে হতাশ হতে হলোনা। তাৎক্ষনিক প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলো তার ছোট মেয়ে নুরেছা। চোখের পলকেই মায়ের হাতে চালান করে দিলো শক্ত-সামর্থ একটি ঝাড়–। এবার সমানে সমান। ক্রমশ কমে আসছে দুজনের মাঝের দুরত্ব। উত্তপ্ত হচ্ছে রণাঙ্গন। বাড়ছে দর্শকদের উত্তেজনা।
চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে ময়না। কী নিয়ে এ লড়াইয়ের সূত্রপাত এর কিছুই তার জানা নেই। এমনকি কথার তীরের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ শুনেও কোন সূত্র উদ্ধার করতে পারলো না সে। তবে পাশাপাশি বাড়ির এ দুই মহিলার মাঝে এমন বাক বিতন্ডা আজই নতুন নয়। কম করে হলেও সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন গালাগালি, চুলাচুলি না করলে সম্ভবত তাদের পেটের ভাতই হজম হয়না। আর এ কারনেই দর্শকরা নিরব দাঁড়িয়ে। কেউ এগিয়ে যাচ্ছেনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে।
- কিরে ময়না, খারইয়া খারইয়া বেইট্টাইন্তের (মহিলাদের) কাইজ্জা দেহস? খারঅ তর বাপের কাছে কইয়া লই।
সবুজের কথাতে লজ্জা পেল ময়না, ভয়ও হলো কিছুটা। এত দর্শকদের ভীরে সবুজ ভাই যে তাকে দেখে ফেলবে, ভাবতে পারেনি সে। কথার কোন জবাব না দিয়ে দ্রুত বাড়ির দিকে চলে যেতে উদ্যত হচ্ছিলো। কিন্তু তখনি ঘটে গেলো ঘটনাটা!
আছিয়ার মাকে চুলের মুঠি ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে এলো আঙ্গুরির মা। হাতের ঝাড়– ফেলে দিয়ে নিচ থেকে প্রতিপক্ষের চুলের মুঠিটিও ধরার চেস্টা করলো আছিয়ার মা। খুব একটা সুবিধা করতে না পারলেও চুলের নাগাল পেল ঠিকই। কিছুক্ষনের মাঝেই দুজন সমানে সমান। একজন আরেকজনের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে লাগলো। এবার কথার তীরের পরিবর্তে শুরু হলো যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদের প্রতিযোগিতা। তারপর হাউমাউ কান্না। কিন্তু কেউ কাউকে ছাড়তে রাজি নয়, যেন বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদেনি। চুলাচুলির তুমুল পর্যায়ে দু’জনেই লুটিয়ে পরলো মাটিতে। তারপর গড়িয়ে পড়তে লাগলো বাড়ির ঢাল বেয়ে।
ঘটনার শেষটা দেখে যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো ময়নার। কিন্তু আড়চোখে সবুজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আর দাঁড়াতে সাহস হলোনা। হাঁটা শুরু করলো বাড়ির দিকে। পেছন পেছন আসতে দেখলো সবুজ ভাইকেও।
- বেইট্টাইন্তের কাইজ্জা দেহুন বালা না বুজছস? এইগুলা অইল অশিক্ষিত মানুষের কাম। তুই তো ইস্কুলে পরস। তোর এইসবের দিকে মনযোগ দেওন উচিত না।
- আইচ্ছা ভুল অইয়া গেছে। আর এমুন অইত না।
- দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা শেষ করছস ভালোয়, ভালোয়। অহন সমাপনী পরীক্ষা ভালো কইরা দেওয়ার প্রস্তুতি নে। শিক্ষিত অইয়া মানুষের মতো মানুষ অওয়ার চেস্টা কর। শিক্ষার আলো মানুষের সব মূর্খতা দূর কইরা দেয়। মানুষরে বিচার-বিবেচনা শিখায়। আঙ্গুরির মা আর আছিয়ার মা পড়ালেহা করে নাই বইলা এরার কোনো বিচার-বিবেচনা নাই। আর এর লাইগ্যাই অতো লোকজনের সামনে চুলাচুলি করতেও এরার শরম লাগে না।
- আইচ্ছা সবুজ ভাই, শিক্ষাই কি মানুষরে মানুষের মতো মানুষ বানায়?
- হ-অ
- অহন আমার একটা কতার জবাব দেও দেহি। হেদিন পত্রিকার মইদ্যে ছবি দেখলাম, ঢাহা শহরে কলেজের ছাত্রীরা রাস্তার মাইদ্যে চুলাচুলি করতাছে! হেরা কি শিক্ষিত না?
‘শিক্ষিত’ শব্দটি উচ্চারণ করতে গিয়েও করতে পারলো না সবুজ। এই ছোট্ট মেয়েটির প্রশ্নে এমন বেকায়দায় পড়ে যাবে, ভাবতে পারেনি সে। প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন পালন করার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজের ছাত্রলীগ নেতৃদের চুলাচুলির ছবি সেও দেখেছে পত্রিকায়। মিছিলের সামনে থাকাকে কেন্দ্র করে তাদের এই চুলাচুলির সূত্রপাত। তখন প্রধানমন্ত্রীর ছবি পর্যন্ত দলিত হয় তাদের পায়ের নিচে।
একেবারেই চুপসে গেল সবুজ। বুদ্ধিমতি মেয়ে ময়নাও আর ঘাটাতে চাইলো না তাকে। তবে এ-ই প্রথমবারের মতো সবুজ ভাইকে ধরাশায়ি করতে পেরে তার চোখেমুখে আনন্দ ফুটে উঠল।

রবিবার, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১০

খেলার নাম ভাটিয়া

যে কেউ ভেবে বসতে পারে মধ্যবয়স্ক এ লোকগুলো বুঝি দাঁড়িয়াবান্ধা খেলছে। নুমানের ছোট চাচার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি শহরে থাকেন। স্বপরিবারে গ্রামে এসেছিলেন দু’দিনের জন্য। এখন আবার চলে যাচ্ছেন। ফিরতি পথে নৌকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন বাজারের কান্দায় (উন্মুক্ত উঁচু জায়গা)। এই আশিন মাসেও যে হাওর পানিতে টইটম্বুর থাকবে, তা তিনি ভাবতেও পারেননি। অবশ্য এতে ভালোই হয়েছে, দু’দিন বেশ উপভোগ করার সুযোগ হয়েছে তার। বাড়ির সবাইকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন নৌকা বাইসালিতে। দিগন্ত বিস্তৃত হাওরের জলে ঝরা ঝর ঝর বৃষ্টিতে মোহগ্রস্ত হয়েছিলেন তিনি; বাঁধভাঙা আনন্দে বৃষ্টিকে বরণ করেছিলেন। তারপর যখন উঁকি দিয়েছিলো বৃষ্টিধোয়া রোদ, তখন আকাশ নীলা অতিক্রম করেছিলো নীলের গণ্ডি। গোটা পৃথিবী যেন মেখেছিলো রঙধনুর সাত রঙ। আকাশের রঙের বাহার প্রতিফলিত হচ্ছিলো হাওরের শান্ত জলে। ছপাত ছপাত ডিঙি নৌকার বাইসালিতে তখন হাওরটাকে মনে হয়েছিলো রঙের ক্যানভাস। কিন্তু এখন এই যাবার সময় নৌকা না পেয়ে অনিন্দ্য সুন্দর হাওরের উপরই মহা বিরক্ত হয়ে উঠেছেন তিনি। কোনো রকমে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই হলো- ব্যস, আর যাত্রীবাহী নৌকার টিকিটিও পাওয়া যায়না।
কী আর করা! বাধ্য হয়েই তাকে মনযোগ দিতে হয়েছিলো মধ্যবয়স্ক লোকগুলোর ধুপধাপ দৌড়াদৌড়িতে। প্রথমে তো একে দাঁড়িয়াবন্ধা খেলা ভেবেই বসেছিলেন তিনি। কিন্তু এ খেলায় তো এতবড় কোট (খেলার বৃত্তবিশেষ) হওয়ার কথা নয়! ব্যাপারটি পরিষ্কার করে দিলো ময়না। তারপর থেকেই গভীর আগ্রহে তিনি ডুবে গেলেন খেলার ভেতর। খেলার নাম ভাটিয়া। বিশাল বড় করে চারকোনা একটি কোট আঁকা রয়েছে। আর চারটি কোনায় পাহারায় রয়েছে চারজন। কোটের বাইরে থেকে আরো চারজন ছলাকলা করছে ভেতরে ঢোকার জন্য। চার পাহারাদারের স্পর্শমুক্ত থেকে একবার ভেতরে ঢোকে, তারপর আবার বেরিয়ে আসতে পারাই নাকি তাদের লক্ষ্য। এভাবে একে একে চারজন যদি বেরিয়ে আসতে পারে, তবেই গোল্লা। এ ধরনের নিয়মই তাকে বুঝালো ময়না। কিন্তু এতকিছু ওনার মাথায় ঢোকছে না। তিনি মুগ্ধ হয়ে দেখছেন লুঙ্গি-ন্যাংটি কেঁচে কত অবলীলায়-ই না লোকগুলো খেলে যাচ্ছে! ওরা প্রত্যেকেই তাঁর সমবয়সী হবে। অথচ এখন তাকে খেলতে বললে কি তিনি রাজি হবেন? না, হওয়ার কথা নয়। আর ওদের মতো এতো পরিশ্রমও তিনি করতে পারবেন না। বাচ্চা ছেলেদের মতো বাতাস কেটে-কুটে এঁকেবেঁকে দৌড়াদৌড়ি করছে ওরা। সারা গায়ে ধুলি। দর দর করে ঝরতে থাকা ঘামে ধুলিগুলো ভিজে কাঁদা হওয়ার আগেই আবার মাটিতে গড়াগড়ি খেতে হচ্ছে ওদের। তারপর আবার তাজা ধুলি-মাটি মেখে শুরু করছে হুটিপুটি। হুস্-হাস্ শব্দ তুলে একেকজনের শ্বাস প্রশ্বাস বেরোচ্ছে যেন যন্ত্রের গতিতে। তবুও চেহারা থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে নির্মল আনন্দ। সে আনন্দ ভর করছে দর্শকদের মাঝেও। ভাটিয়ার কোটকে ঘিরে অগুণতি দর্শক। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে। আবার কেউ বা দূর্বাঘাসে কাত হয়ে শুয়েও আছে। খেলোয়াড়দের সাথে সাথে উত্তেজনায় টানটান ওরাও। দেউড়ির আড়াল সরিয়ে বাড়ির অন্দরমহল থেকেও উপভোগ করছে মহিলারা। সবার মাঝে বিপুল এক আনন্দ। এ আনন্দের ভাগ অন্যরা যতটুকু পাচ্ছে নুমানের ছোট চাচা হয়তো ততটা পাচ্ছেন না। কারণ ভাটিয়া খেলার নিয়ম-কানুন তার জানা নেই। তারপরও প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের এ খেলাটি উপভোগ করতে পেরে অন্যরকম এক উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত তিনি। সময়ের সাথে সাথে মানুষগুলোও সব যান্ত্রিক হয়ে উঠছে। তিনিও এর বাইরে নন। একসময় বৌচি, চি কুৎ কুৎ, গোল্লাছুটসহ কত খেলাই না দেখা যেত বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে। এখন দেখা যায় বটে, তবে তা খুবই কম। লাঠিখেলা দেখতে গিয়ে কত্তবার মায়ের বকুনি খেতে হয়েছিলো তাকে! ঢোল-কাঁসরের শব্দ আর লাঠির সাজ সাজ আয়োজন একত্রিত করতো গ্রামবাসীকে। রঙবেরঙের যোদ্ধার পোশাক পড়ে হাতে মেকি তরবারি, ছোড়া ও বড় থালা সাইজের ঢাল নিয়ে লাঠিয়ালরা বাজিয়ে দিতো যুদ্ধের দামামা। মাথায় থাকতো লাল কাপড়ের পট্টি। তাদের ঘুঙুরের উচ্চ শব্দেও মোহগ্রস্ত হতেন তিনি। উপভোগ করতেন লাঠির ভেলকি।
‘জল্লা-জল্লা....’ শব্দে চিৎকার করে উঠলো খেলোয়াড়দের একপক্ষসহ উপস্থিত দর্শকরা। সম্বিত ফিরে পেলেন নুমানের ছোট চাচা। বুঝতে পারলেন কোনো খেলোয়াড় খেলার নিয়ম ভঙ্গ করেছে। একটু আড়মোড়া ভেঙে আবার খেলায় মনযোগ দিতে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু পারলেন না ময়নার ডাক শুনে ‘চাচা আমহেরে (আপনাকে) চাচী ডাকতাছে।’
ঘাঢ় ঘুরিয়ে নৌকার জন্য অপেক্ষমান স্ত্রী-সন্তানের দিকে তাকালেন তিনি। তারপর তাকালেন হাওরের জলে ডুব দিতে উন্মোখ সূর্যের দিকে এবং বললেন, ‘ময়না, তোর চাচিরে কঅ বাড়িত যাইতগা। সইন্ধা অইয়া গেছেগা। আউজ্জা আর যাইতামনা।’
26.09.10

মঙ্গলবার, আগস্ট ৩১, ২০১০

ছুটির বিড়ম্বনা

হুরমুর করে আরো একগাদা লোক আছড়ে পড়ল বাসের উপর। তিল ধারণের জায়গাটুকু পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই। কিন্তু তবুও ঠেলে-ঠুলে ঠিকই ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে লোকগুলো। কেউ ঝুলে আছে দরজায়। আবার কেউবা উঠে যাচ্ছে ছাদে। ছাদ থেকে কয়েকজনের পা জানালার দিকে ঝুলে থাকতে দেখলো ময়না। ভাগ্যিস আগে আগে ওরা টিকেট কেটে সিটে বসতে পেরেছিলো। নাহয় ওদেরকেও হয়তো এভাবেই যেতে হতো। অবশ্য সিট না পেলে দাঁড়িয়ে যেতে রাজি হতেন না বাবা। শহরে যাবার পথেই যে এত ঝামেলা পোহাতে হবে তা ধারণাও করতে পারেনি সে। এমন জানলে কেনাকাটা করার জন্য বাবার সাথে আসার বায়না ধরতো না ময়না।
মুড়ির টিনের মতো বাসটি ঘট ঘট ঘট শব্দ তুলে এগুচ্ছে গরুর গাড়ির গতিতে। বেশি প্যাসেঞ্জার বোঝাই করেছে বলে নয়, এ বাসগুলোর প্রকৃতিই এমন। মাত্র ষোল কিলোমিটার দূরত্বের এ পথটুকু পাড়ি দিতে এক থেকে দেড় ঘন্টার মতো লেগে যায়। কারণ একটু পর পর থামরে, প্যাসেঞ্জার তোলরে, স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেলে ঠেলে ঠুলে স্টার্ট তুলরে ইত্যাদি আরকি। এখন মনে হচ্ছে রিকসায় গেলেই ভালো হতো। কিন্তু রিকসা যা ভাড়া চাইল তা শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো ওদের। ঈদের মৌসুমে ভাড়া তিন থেকে চারগুন হয়ে যায় কেন তা বুঝে আসছে না ময়নার।
ওহ্, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। বাসের গোমোট পরিবেশে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বাবা অবশ্য জানালার পাশের সিটেই বসিয়েছেন তাকে। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন বাবার গায়ের উপর যেভাবে হেলে পরছে, তাতে বাবাও খানিকটা চেপে বসেছেন ময়নার দিকে। লোকজনের ঘামের বোঁটকা গন্ধে পেট গুলিয়ে আসছে। ক্ষনে ক্ষনে উথলিয়ে উঠতে চাচ্ছে বমি। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে জানালার কাঁচ খুলে দিয়েছেন বাবা। এতে বাইরে থেকে বাতাস ঢোকছে বটে, সেই সাথে ঢোকছে ধুলো। মুহুর্তের মাঝেই ধুলোময় হয়ে গেল ময়না। ভেতর থেকে খ্যাট খ্যাট করে উঠলো কয়েকজন লোক
- এ্যাই ভাই জানালা খুলছুইন কেরে? বালু (ধুলি) আইতাছে।
- ছেরিডা বুমি করবঅ দেকতাছুইন না? মেয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলল তোতা মিয়া।
লোকজনের কটুক্তি আর ধুলির ঝড়ে বমি করতে ভুলে গেল ময়না। বন্ধ করে দিলো জানালার কাঁচ। চুপচাপ বসে রইলো জনারন্যের ভেতর।
- আহাইরে জানডা বাইরইয়া যাইতাছেগা। বিরক্তি প্রকাশ করল এক যাত্রী। তার কথাতে ধরলো অন্য আরেকজন
- জান বাইরইতনা, বাসের মইদ্যে মানুষ কট্টি (কতগুলো) লইছে দেখছনি। দুইন্নাইডার মাইদ্যে (দুনিয়াতে) যে কত মানুষ আছে ঈদের সময় অইলে দেহুন যায়।
- আরে অহনঅই মানুষের দেখছঅ কি, ঈদ তঅ আরো কয়দিন দেরি আছে।
- হেই কতা আর কইয়েননা ভাই। সারা দেশের মইদ্যে আউলাডাতঅ লাগবঅ ঈদের আগের দিন। অফিস আদালতে ছুটি থাহে মাত্র তিন দিনের। ঈদের আগের দিন সবাই শহর ছাইরা ছুডে গেরামের দিকে। কিন্তু কেউ ঠিক সময়ের মাইদ্যে যাইতে পারেনা। কেউ যায় ঈদের দিন। আবার রাস্তায় এক্সিডেন্ট কইরা কেউ পৌঁছতেই পারেনা।
- একবার না হুনছিলাম, সরকার নাকি এইবার থেইকা ঈদের ছুটি পাঁচদিনের করবঅ? হের পরেতো আর কোনঅ খবর-টবর হুনলামনা
- রোজার ঈদ অইল গিয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উৎসব। এই উৎসবের লাইগ্যা পাঁচদিনের ছুটি দিলে মানুষ ইকটু শান্তিতে গেরামের বাড়িতে গিয়া ঈদ করতঅ পারব।
- হুনছি অইন্য অনেক দেশে নাকি বড় উৎসবে বেশি দিনের ছুটি থাহে।
- অইন্য অনেক দেশে থাকলেই যে আমার দেশে থাকতে অইব, এমুন কোন কথা না। পাঁচদিনের ছুটি অইলে আমরার লাগি সুবিধা অয়, হেইডা অইল গিয়া বড় কতা।
যাত্রীদের একেকজনের একেক কথায় কান ঝালাপালা হয়ে উঠল ময়নার। গরম, বোটকা গন্ধ, বমির উদ্রেক সব মিলিয়ে চরম এক অস্থির সময় কাটছে ওর। আর এ অস্থিরতা নিয়েই সিটে বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছে ময়না। এগিয়ে চলছে বাস। বাড়ছে মানুষের কোলাহল
29.08.10

রবিবার, আগস্ট ১৫, ২০১০

উইল্লা চোরার উপলব্ধি

- তোতা মিয়া এক কেজি ছোলা দ্যাও।
বলে ধীরে-সুস্তে বেঞ্চিটায় বসল উইল্লা চোরা। শুনতে অশোভন এ শব্দটি ছাড়া তার সত্যি কোন নাম আছে কি না এ তথ্য ময়নার জানা নেই। এ নামেই সবাই তাকে চেনে। ‘উইল্লা চোরা’ অবশ্য তার নাম নয় বরং পরিচয়। ‘নামে নয় গুণেই পরিচয়’ আরকি। উইল্লা বিলাইয়ের (হুলো বিড়ালের) মত ছেঁচড়া চুরির অভ্যাস নাকি তার ছোটকাল থেকেই। অমুকের গাছের লাউটা, গাছ পাকা কাঁঠালটা, সব্জি ক্ষেত থেকে মুলাটা প্রায়ই উধাও হয়ে যেতো আগে। আর এসবের দায়ভার উইল্লা চোরার উপরই বর্তাতো। তার আতঙ্কে নাকি ঘর খালি রেখে গ্রামের মহিলারা পাড়া বেড়াতে পর্যন্ত পারত না। পাছে কোন জিনিসটা চুরি হয়ে যায়!
সেই হিসাবে এখন বেশ শান্তিতেই আছে গ্রামের মানুষ। কারণ আগের সেই ছ্যাঁচরা চুরির অভ্যাসটা ছেড়ে দিয়েছে উইল্লা চোরা। তাই বলে যে চুরি-চামারি থেকে অবসর নিয়েছে এমনটি নয়। এখনও দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে তার নামে দরবার আসে মাসে তিন কি চারবার।
- তুমি ছোলা দিয়া কি করবা? জিজ্ঞেস করল তোতা মিয়া
- কি করাম মানে, রোজা রমজানের দিন ছোলা ছাড়া ইফতার অয় নাকি?
- আসার্য্য কারবার! তুমি অইলা গিয়া চুর (চোর) মানুষ, তুমি হিবার রোজা রাখছ নাকি?
একটু যেন লজ্জ্বাই পেল উইল্লা চোরা। তারপর ঘাঢ় নুইয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল, আরে বেশতি কতা কইঅ না। আমি চোর অইতাম ফারি, কিন্তুক স্বভাব বালা আছে।
- তাইলে তুমি হাছাহাছি রোজা রাকছ! যেন আকাশ থেকে পড়ে প্রশ্নটি করল তোতা মিয়া।
- রোজা লইয়া কেউ মিছামিছি কতা কয় নাকি? চিন্তা করছি এইবার থেইকা রোজা থাহুনের অভ্যাস করাম।
- বেশ বালা চিন্তা। কিন্তুক রোজা থাইক্কা চুরি-চামারি করলে কি আর রোজা অইব?
- চিন্তা করছি এইসব ছাইরা দিয়াম। এই মাসটা দেহি ইকটু পাক-পবিত্র অইয়া আল্লা-বিল্লা কইরা কাডায়া দিতারি কিনা।
- তাইলে এইমাসে তোমার কুকাম বন্দ থাকব?
- হ
- খালি এই মাসে থাকবঅ নাকি সারা বছর? ঈদের পরেই হিবার পাপ কামানি শুরু করবা!
- আরে নাহ, কইলামনা বালা অইয়া গেছি।
- বালা অইয়া গেলে বালা কতা। হুনঅ একটা কতা কই, রমজান মাস অইল গিয়া সংযমের মাস। এই মাসে সংযমের অভ্যাস করনের লাই¹া আল্লায় কইছে। কারণ এই অভ্যাসের গতি যাতে সারা বছর থাহে। তুমি যুদি একমাস চুরি-চামারি ছাইরা বাঁচতে পার, তে সারা বছর পারতানা কেরে?
বাবার কথাটি বেশ ভালো লাগলো ময়নার। সাত্যিইতো একমাস ভাল হয়ে থাকতে পারলে সারাবছরইতো ভালো হয়ে থাকা যায়। দাদির কাছে সে শুনেছে রমজান মাস হলো অনুশীলনের মাস। রাতে সেহরি খাওয়া, ফজরের নামাজ পড়া, সকালে ঘুম থেকে উঠা, কাজে যাওয়া, ইফতার করা, তারাবির নামাজ পড়ার মধ্য দিয়ে মুসলমানদের সময় কাটে অনুশীলনের মধ্য দিয়ে। রমজান মাসে শয়তানকে নিয়ন্ত্রন করে রাখা হয় বলে মানুষের মাঝে খারাপ কাজ করার প্রবণতা কমে যায়। উইল্লা চোরাই এর জ্বলন্ত উদাহরণ।
ততক্ষনে এক কেজি ছোলার প্যাকেট তোতা মিয়ার কাছ থেকে বুঝে নিলো উইল্লা চোরা। তারপর হাত বাড়িয়ে দশ টাকার চারটি কড়কড়ে নোট এগিয়ে দিলো।
- আরও পাঁচ টেহা দেওঅন লাগবঅ। দাম অহন বাড়তি, তোতা মিয়ার এ কথাতে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো উইল্লা চোরা।
- আরে কি কও, ছোলার দাম অত বাইড়া গেছেগা!
- খালি ছোলার দাম কেরে, রোজা উপলক্ষে অনেক কিছুর দামঅই অহন বাড়তি।
- রোযা অইলঅ গিয়া সংযমের মাস। আর বাংলাদেশের ব্যবসায়িরা এই মাসে সংযম করবতো দুরের কতা, লুটপাটের উৎসব লাগাইয়া দেয়। রোজার মাইদ্যে আমি উইল্লা চোরা গেলাম বালা অইয়া, আর ব্যবসায়ীরা শুরু করল ডেহাইতি (ডাকাতি)। হায় আফসোস!

বুধবার, আগস্ট ১১, ২০১০

বিউটি বোর্ডিংয়ে এক দুপুর

আমি ও সোহেল অটল

মঙ্গলবার, আগস্ট ১০, ২০১০

বাতাস লাগছে বাতাস

মা সন্তানকে খুন করতে সহযোগিতা করে- কথাটা একদম বিশ্বাস করতে পারল না ময়না।
- আহা, কী ফুটফুটে চেহারা রে। বলতে বলতে পত্রিকাটা তোতা মিয়ার দিকে এগিয়ে দিল মন্তাজ উদ্দিন। ময়নারও কৌতুহল হলো তিন বছরের তানহাকে দেখতে। উঁকি দিলো পত্রিকার পাতায়। ইস, ডাগর চোখের কী মায়াবি চাহনি! ফোঁকলা দাঁত। কপালে কাজলের টিপ। মেয়েটাকে আদর করে এ টিপ কে পড়িয়ে দিয়েছিলো? ‘আয় আয় চাঁদ মামা/টিপ দিয়ে যা/চাঁদের কপালে চাঁদ/টিপ দিয়ে যা...’ ছড়া কাটতে কাটতে মায়েরাইতো এ কাজটি করে থাকে। তানহার ক্ষেত্রেও নিশ্চয়-ই এর ব্যতিক্রম হয়নি। হয়তো ছড়ার ছন্দে ছন্দে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ওকে কাজল কালো করেছিলো মা-ই। তারপর চুমুতে চুমুতে কপাল ভরিয়ে ভনিতা করে বলেছিলো, এইতো আমার চাঁদের (তানহার) কপালে চাঁদ এসে টিপ দিয়ে গেলো। হ্যা, তখন তো মায়ের কাছে চাঁদের মতোই ছিলো তানহা। অমাবশ্যার অন্ধকার দূর করে মায়ের কোল জুড়ে সে এসেছিলো পূর্ণিমার চাঁদ হয়েই। দ্যুতি ছড়িয়েছিলো মায়ের মনে। সত্যিই কি তাই? এমনটিই তো হওয়ার কথা। ময়নার দেখা সব মায়েরাইতো এমন । মায়ের উষ্ণতাই সন্তানের প্রথম আশ্রয়। মাকে ছাড়া একটি দিনও কল্পনা করতে পারে না ময়না। কিন্তু কী এমন ঘটনা ঘটল যে, তিন বছরের ছোট্ট শিশুর মৃত্যু হলো নিজের মায়ের কারণে! অপরাধটা ছিলো কার, শিশুর নাকি ওর মায়ের? অপরাধ যার-ই হোক। কী কারণে একজন মা নিজের কোল থেকে পূর্ণিমার চাঁদ দূরে ঠেলে দিতে চাইবে? কোন অমোঘ টানে? তাহলে কি এখন মায়েরাও বদলে যাচ্ছে। সন্তানরা কি এখন মায়ের কোলেও নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারবে না!
- ও পুতু (চাচা) পুতুগো, তানহা কি মা’রে (মাকে) ত্যক্ত (বিরক্ত) করতঅ?
- নাহ্। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এক কথায় জবাব দিলো মন্তাজ উদ্দিন। কিন্তু মন্তাজ চাচার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপারটা মোটেই আঁচ করতে পারলো না ময়না।
- তে (তাহলে) ছেরিডা কী দুষ করছিন (করেছিলো) যে একবারে মাইরালান লাগব (মেরে ফেলতে হবে)!
- এই ছেরি চুপ র্ক। মুরুব্বিরার কতার মইদ্যে কতা কওঅন (বলা) বালানা। ধমকে উঠল তোতা মিয়া।
বাবার ধমকে একেবারে চুপসে গেলো সে। আর কথা বলার সাহস হলোনা। তারপরও ক্ষীণ একটি আশা ধরে রেখেছিলো যে, অন্তত: ভদ্রতার জন্য হলেও মন্তাজ চাচা বুঝি তার কৌতুহল নিবৃত্ত করবে। কিন্তু ওদিক থেকেও কোন সাড়া না পেয়ে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো ময়নার। চুপচাপ বসে রইল বাবার পাশে। মনযোগ দিলো অন্য কাজে। ভাব দেখালো যেনো এদিকের কোনো কথাতেই তার কান নেই।
- কী কইবা তোতা মিয়া, খালি পরকিয়া আর খুন না, আমরার দেশটা অহন নানা অপরাধে ভইরা যাইতাছে। ‘সামাজিক মূল্যবোধ’ কইতে (বলতে) একটা কতা আছে। হেই মূল্যবোধ কইম্মা যাইতাছে। কইম্যা যাইতাছে মানুষের নীতি-নৈতিকতা।
- হ, বাইছা (ভাই সাহেব)। তুমি উচিত কতা কইছঅ। আমরার সমাজ কিমুন জানি বদলাইয়া যাইতাছে। সবচে আপন বন্ধনগুলাও অহন ভাইঙ্গা চুরমার অইয়া যাইতাছে।
- বাতাস লাগছে বাতাস। একটা কতা কই হুনঅ, তুমি যুদি কোনো জাতিরে ধ্বংস করতা চাও, পইলা (প্রথমে) হেই জাতির সংস্কৃতি আর মূল্যবোধগুলা ধ্বংস কর। হেরপরে দেখবা আপনা-আপনি হেই জাতি এক অমোঘ নেশায় বুঁদ অইয়া যাইব। মেরুদণ্ড খাড়া কইরা দুইডা কতাও কইতে পারবনা।
- আমরারেও এমুন নেশার বাতাসে পাইছে নাকি?
- লক্ষণ খারাপ। জিরজিরায়া (ঝির ঝির করে) আজইরা (অশুভ) বাতাস ঘিইরা ধরতাছে আমরারে। আমরা ঠ্যাঙ্গের উপরে ঠ্যাঙ্গ তুইল্লা ঝিমাইতাছি। আমরার সরকারের তঅ এইদিকে কোন মনযোগঅই নাই। হেরা অহন ব্যস্ত নানান আজাইরা কামে। আর হেই সুযোগে খুন, রাহাজানি, ডাকাইতি, পরকিয়ায় ভইরা যাইতাছে দেশ। আর মানুষের কাছেও এউগুলা গা সওয়া অইয়া গেছে।
- হঅ, আজাইরা কামে মানুষের টেহা (টাকা) খরচ করতাছে। আমরার চিন্তাভাবনা থেইকা নীতি-টিতি একবারে উইট্টা গেছেগা দেহি!
-নীতিটিতির কতা আর কী কও তুমি! হেদিন পত্রিকার মইদ্যে দেকলাম গত এক মাসে সারা দেশে খুনঅই অইছে ২৮০ জন! অইন্য কতা নাঅয় বাদ অই দিলাম।
- পাবলিক এক্কেবারে ত্যক্ত বিরক্ত অইয়া গেছেগা। হুনলাম আওমী লীগের (আওয়ামী লীগের) এক নেতাও নাকি ত্যক্ত-বিরক্ত অইয়া কইছে যে দেশ বিপদের দিকে আউ¹াইতাছে?
- হ, তুমি ঠিকঅই হুনছঅ। কতা তঅ হাছা। পুরা তাইজ্জব কাণ্ডকারখানা শুরু অইয়া গেছে। প্রধান বিচারপতির মুখ দিয়া পর্যন্ত বাইরঅইছে যে, দেশঅ অহন ন্যায্য কতাডা পর্যন্ত কওনের স্বাধীনতা নাই।
এতক্ষণে ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠলো ময়না। ভেবেছিলো কান খাড়া রাখলে হয়তো তানহা হত্যার রহস্য কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারবে সে। কিন্তু বাবা আর মন্তাজ চাচার কথাগুলো এমন দিকে মোড় নিয়েছে, যা ওর বোঝার কথা নয়। কিন্তু তবুও যে বোঝার চেষ্টা করে নি এমনটি নয়। আর চেষ্টা করলে কিছুনা কিছু তো সফল হওয়াই যায়।

রবিবার, আগস্ট ০১, ২০১০

জামাই আইছে আনন্দে

আজ ময়নার মেয়ের বিয়ে। আয়োজন নিয়ে মহা ব্যস্ত সে। এক মুহূর্ত অবসর নেই। মেয়েটাকে কিনে এনেছিল বৈশাখী মেলা থেকে। সেই থেকে ওর সংসারেরই সদস্য সে। নিজের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছে গয়না। তারপর চিকচিকে জরির একটি গয়না পরিয়েও দিয়েছিল গলায়। কিন্তু সেটা যে কবে উধাও হয়ে গেল, তা বলতেই পারছে না ময়না। এমনকি মেয়েটাও মুখ ফুটে বলছে না যে কেউ গলা থেকে খুলে নিয়েছে, নাকি খেয়ালের বশে নিজেই হারিয়ে ফেলেছে। না না, গয়না কথা বলতে পারে না এমনটি নয়। প্রতিদিনই ময়নার সাথে কত্ত কথা হয়। অবশ্য শব্দ করে কিছুই বলতে পারে না সে। শত হলেও পুতুল তো! তাই ওর মনের ভাষা বুঝে নিতে হয় ময়নাকেই। এর জন্য কোনো দুঃখ নেই ময়নার। কারণ সে জানে পুতুলরা কখনো কথা বলতে পারে না। তবে মায়ের কাছে তাদের থাকে হাজারো আবদার। এই যেমন খাইয়ে দাও, পরিয়ে দাও, আদর করো, ঘুম পাড়িয়ে দাও। এসবের কোনো কাজই বাকি রাখে না ময়না। একেবারে খাওয়া থেকে শুরু করে ঘুম পাড়ানো পর্যন্ত সবকিছু সে-ই দেখাশোনা করে।
এমন আদুরে মেয়েকে বিয়ে দিতে কিছু তো খারাপ লাগছেই ময়নার। খারাপ লাগলেই আর কী? মেয়ে যেহেতু আছে আজ নয় কাল বিয়ে তো দিতেই হবে। তবে এত বিচ্ছেদ-বিরহের মাঝেও বেশ আনন্দই হচ্ছে ওর। কারণ পাত্র হিসেবে পারভিনের ছেলেটা একেবারে রাজপুত্র। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো পারভিনের সাথে একটা সম্বন্ধ তৈরি হোক, এমনটাই চাইছিল সে। হঠাৎ সে দিন বলা নেই, কওয়া নেই পারভিনই প্রস্তাব করে বসল ময়নার সাথে সই পাতবে। আর যায় কোথায়, দু’জনে মিলে ঠিক করল দিনক্ষণ। আরো ঠিক করল এই দিনেই হবে ওদের পুতুল বিয়ে। এতে নিজেদের মাঝে সম্পর্কটা আরো গাঢ় হবে। ব্যস, যেই কথা সেই কাজ।
আজ সেই কাক্সিত দিন। মহা ধুমধামে চলছে আয়োজন। ময়নার সখীরা সবাই উপস্থিত। উপস্থিত এক দঙ্গল ছেলেমেয়েও। বাঁশের কঞ্চি আর পাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্যান্ডেল। একে ঘিরেই সবার ব্যস্ততা। এই বাটনা বাটরে, কুটনা কুটরে...। একটু বড়সড় টোপায় (খেলনা পাতিলে) ভাত চড়িয়েছে ময়না। টোপার ভেতরে যে ভাতের বদলে বালি ভর্তি, এ খবর কারো অজানা নয়। কিন্তু তবুও সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে কখন রান্না শেষ হবে, তারপর বর আসবে। আর ক্বল-অ, ক্বল-অ ধরনের অদ্ভুত শব্দ করে খাওয়ার ভান করবে সবাই। সেই সাথে হবে ময়না-পারভিনের সই পাতাপাতি। দু’জনের মাঝে তৈরি হবে নতুন একটি সম্পর্ক। প্রতিজ্ঞা করবে পরস্পরের সুখ-দু:খ, হাসি-কান্নার অংশীদার হওয়ার। বন্ধুত্ব গড়ার সেই আনুষ্ঠানিক মুহূর্তটিকে ত্বরান্বিত করতেই এত ব্যস্ততা। আশপাশের ঝোপে বাজার করছে কয়েকজন। এরই মাঝে কাল্পনিক নানা কেনাকাটা করে ফিরেও এসেছে দুলাল। ওর ঝুলি ভর্তি ইটের সুড়কির মাংস, পাতার মাছ আর নানা ধরনের তরকারি। মেলা থেকে কিনে আনা টিনের বঁটি দিয়ে তরকারি কাটায় ব্যস্ত হয়ে গেল একজন। তারপর চুলায় ফুঁ দাওরে, আগুন জ্বালরে...। অবশেষে রান্নাবান্না শেষ হলো ময়নাদের। এরই মাঝে খবর এলো বরযাত্রা শুরু গেছে। এক অনাবিল আনন্দে ভরে উঠল সবার চোখ। এবার ওরা ব্যস্ত হয়ে উঠল গয়নাকে নিয়ে। ইস্ লাল টুকটুকে শাড়ি পরে আছে ও। একদম চুপ মেরে বসে আছে। ময়নাও দৃষ্টি ঘুরালো ওর দিকে। ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল।
এলোমেলো বাদ্যের শব্দে কানে তালা লাগার মতো অবস্থা। বরযাত্রীদের মাঝে বেশ কয়েকটি ছেলের গলায় ঝুলানো রয়েছে ঢোল। কোরবানির গরুর পর্দা ভাঙা কলসের মুখে সেঁটে প্রতি বছরই ওরা এগুলো তৈরি করে। তারপর যখন ইচ্ছা তখন বাজায়। আজ কচুর ডাঁটা দিয়ে এমনভাবে বাজাচ্ছে যেন ঢোল এবং কানের পর্দা ফাটিয়েই ছাড়বে। কাছাকাছি চলে আসতেই পারভিনের ছেলেটাকে দেখতে পেল ময়না। ইস্ কি সাজে সেজেছে ও! রাজপুত্র যে একেবারে রাজপুত্রের মতোই। মাথায় টোপর, গলায় পুঁথির মালা। আসছে ঘোড়ায় চড়ে। আর ঘোড়াটা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে বিয়ারিংয়ের গাড়িতে। সবাই বিপুল উৎসাহে টেনে নিয়ে আসছে গাড়িটাকে। কনে পক্ষের তৈরি পাট শোলার তোরণের সামনে এসে থামতেই হলো ওদের। তারপর দরকষাকষি। অবশেষে কাঁঠালপাতার টাকা বিনিময়ের মাধ্যমে সমঝোতা।
তোরণ উন্মুক্ত করে দাঁড়ালো ময়নারা। রাজপুত্রের মতো বর প্রবেশ করল পাতার ছাউনিতে। কোরাস তুলল এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে ‘চম্পা ফুলের গন্ধে/জামাই আইছে আনন্দে/চম্পা ফুলের সুবাসে/জামাই আইছে আহাসে...’

রবিবার, জুলাই ২৫, ২০১০

আলী আক্কাসের অবস্থা ভালো নয়

আলী আক্কাস একজন রিকশা চালক। গ্রামগঞ্জে নয়, একেবারে রাজধানীর অলি-গলি চষে বেড়ায় তার বাহন। দুইদিন হলো বাড়িতে এসেছে সে। এখন আড্ডা মারছে তোতা মিয়ার দোকানের সামনে। হাতে প্রায় শেষ হয়ে আসা একটি বিড়ি। মুখ থেকে গল গল করে বাতাসে উড়িয়ে দিচ্ছে ধোঁয়ার গুলতি। যথেস্ট মনযোগ দিয়ে টানছে। কারণ শেষের দিকে যে কোন সময় আগুন খসে পড়তে পারে। আর শেষ টান মানে সুখ টান। সতর্ক আলী আক্কাস সুখ টান থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাত্র নয়। অবশ্য আরও অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হতে চায়না সে, তবুও হতে হয়। এই যেমন তিনবেলা খেয়ে-পরে থাকতে পারা আর রোগ বালাইয়ে ঠিক-ঠাকমতো চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রাখে সে। কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে এসব মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হতে হয় তাকে, আর বাকিগুলো নাহয় বাদ-ই থাকলো। কেবল বিড়ির উপরই তার যত অধিকার খাটে, অন্য কোথাও নয়। অবশ্য ধোঁয়ার একেকটি গুলতির সাথে যে একটু একটু করে জীবনীশক্তিও বাতাসে ভেসে যাচ্ছে-এ তথ্যও তার অজানা নয়। সেই ছোটবেলায় শুনেছিলো ‘আই এম এ ডিস্কু ড্যান্সার/বিড়ি খাইলে হয় ক্যান্সার’। বিড়ি খেলে ক্যান্সার হয় এটা শুনতে শুনতেই বিড়ির প্রতি আগ্রহ জন্মে। আর তখন থেকেই শুরু, এখন পর্যন্ত ছাড়তে পারেনি। কোনো দিন পারবে কি না জানা নেই।
- কীগো আলী আক্কাস, এমুন চুপচাপ বইয়া রইছ কেরে? ডাহার (ঢাকার) কিছু খবর-টবর হুনাও আমরারে। দেশের অবস্তা (পরিস্থিতি) কবে বালা অইব?
তোতা মিয়ার কথার জবাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে। কিন্তু কাশির দমকে ভেতরেই আটকে থাকলো কথা। খুক্ খুক্ করে নয়, কাশির শব্দটা হলো খন্ খন্ ধরনের, একেবারে খনখনে বুড়োদের মতো। অথচ তার বয়স খুব হলে চল্লিশ কী বিয়াল্লিশ হবে।
- আরে, আরে থাউক। দেশের অবস্তা কউন লাগদনা। তোমার নিজের অবস্তাই দেহি বালা না। বিড়ি খাইতে খাইতে শইলডারে আঙরা বানায়া দিছ।
প্রচন্ড শ্বাসকষ্টের মাঝেও না হেসে পারলনা আলী আক্কাস। খা.....ক্ করে একদলা কফ নিক্ষেপ করল দূরে। কথা বলার আগে ছুঁড়ে ফেললো বিড়ির শেষ অংশটুকু।
- দেশের অবস্তাও আমার মতোই। আমি যেমুন কবে বিড়ি খাওয়া ছারতারাম (ছাড়তে পারব) জানিনা। আমরার দেশের অবস্তাও কবে বালা অইব জানি না।
- এইডা হিবার কিমুন ঢঙের কতা হুনাইলা?
- ঢঙের কতা না গো ঢঙের কতা না। ডাহা শহর অইল বাংলাদেশের রাজধানী। অইহানে বইয়া থাইক্কা পুরা দেশের ছবি দেহুন যায়। দেশের অবস্তা অহন বালা না। মানুষে মানুষে ভাগ অইয়া যাইতাছে। মানুষের পইসা খরচ অইতাছে নানান আজাইরা কামে। আর এইসব কামের ভোগান্তিও যাইতাছে মানুষের ওপরে দিয়াই।
- হঅ, সব কিছু কিমুন জানি আউলা-ঝাউলা (এলোমেলো) অইয়া যাইতাছে। সায় দিলো তোতা মিয়া।
- আউলা-ঝাউলার কতা আরঅ কও তুমি! নিজের মতঅ চলন-ফিরনেরও অহন স্বাধীনতা নাই। তোমার মুহঅ দাড়ি থাকলে পুলিশে তোমার দিকে বেকা অইয়া চাইবঅ। মাথার মইদ্যে টুপি থাকলে মাথা নুয়াইয়া চলুন লাগবঅ!
- হঅ, এইডা কইছঅ ঠিক কতা। পুরা আসায্য (আশ্চর্য) কারবার শুরু অইয়া গেছে। খালি তোমরার ডাহা শহরঅই না, আমরার গাঁও গেরামের মাইদ্যেও এইরহম অইতাছে। শান্তি কি পুরাপুরি আরায়া (হারিয়ে) যাইবগা নাকি?
- শান্তির আশা আর কইর না। শান্তির মা মইরা গেছে। দেশঅ অহন মানুষ গুম অইয়া যাইতাছে, খুন অইতাছে, আর জিনিসপত্রের দামতঅ বারছেই।
- দিন যাইতাছে আর আমরা দেহি অনিরাপদ আর কঠিন জীবনের দিকে আউ¹াইতাছি (এগিয়ে যাচ্ছি)! দীর্ঘশ্বাস ফেলল তোতা মিয়া।
- আমি কি আর সাধে কইলাম যে, দেশের অবস্তা আমার মতই!
নিজেকে নিয়ে আলী আক্কাসের হেয়ালি শুনে গলা ছেড়ে হেসে উঠল তোতা মিয়া। হাসল এতক্ষন চুপচাপ বসে থাকা ময়নাও। দেশের অবস্থা কেমন তা ওর বোঝার কথা নয়। তবে আলী আক্কাসের অবস্থা যে খুব একটা ভালো নয়, এটা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে ময়না।
২৫ জুলাই ২০১০

শনিবার, জুলাই ২৪, ২০১০

বর্ষাযাপন!



বলুন তো আজ শ্রাবণের কততম দিন? পারছেন না তাইতো? আজকের নয়া দিগন্ত দেখুন, উত্তর পেয়ে যাবেনবর্ষা তো শেষ হতে চলল, বর্ষাযাপন করেছেন? করেননি! ক্যামনে করবেন? ‘ব্যস্ততা মোরে দেয় না অবসর’।
প্রিয় পাঠক, আপনার বর্ষাযাপন’র দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে দৈনিক নয়া দিগন্তের সাপ্তাহিক প্রকাশনা অবকাশ ও থেরাপি। এই দুটি ম্যাগাজিনের সকল লেখক ও আগ্রহী পাঠকদের নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে বর্ষাযাপনের। বলুনতো কোথায়? কোথায় আবার! কিশোরগঞ্জের দিগন্ত বিস্তৃত হাওরে!
চারিদিকে অথৈ পানি। মাঝখানে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। ওখানেই বড়শি ফেলে বোয়াল মাছ ধরার চেষ্টা করছেন আপনি। ভাবুন তো দৃশ্যটি! হ্যা, সত্যিই এ সুযোগ হবে বর্ষাযাপন এ। আরো থাকবে দিনভর হৈ-চৈ, জলকেলি, বিনোদন কত কিছু!
তাহলে যাচ্ছেন তো বর্ষাযাপন করতে? যেতে চাইলে নাম রেজিষ্ট্রশন করুন ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে। যাচ্ছি কবে? ৫ আগষ্ট রাতে। ঢাকায় ফিরব ৭ আগষ্ট সকালে।
যোগাযোগ- ০১৭১১১১৫১৬৫

রবিবার, জুলাই ১৮, ২০১০

মন্তাজ চাচার কথাই ঠিক

দক্ষিণ দিক থেকে সরু ঢেউ অলস খেলতে খেলতে ভীরছে ঘায়েলে (ভাঙন থেকে বসতভিটা রক্ষার জন্য কচুরিপানা আর খড়ের স্তর)। মৃদু বাতাসের ঠেলায় ঘায়েল ঘেষে কোণঠাসা হয়ে আছে কচুরিপানা, শ্যাওলা-ঝাউলা। এমনভাবে স্থির হয়ে আছে যেন পানির উপর তৈরি করেছে সবুজাভ সর। এ সবুজ সরকেই কেটে কোটে ঠেলা জাল ঠেলছে সবুজ। আর ডাঙায় ডোলা হাতে দাঁড়িয়ে ময়না। সবুজের একেকটি খেউয়ে জাল ভর্তি হয়ে উঠছে শ্যাওলা আর শ্যাওলা। তারপর এগুলো ঝেড়ে ফেলে চিংড়ির খনি আবিষ্কার করার দায়িত্ব ময়নার উপরই। শ্যাওলার ভাঁজ খুলে খুলে একটা-দুটো চিংড়ি ডোলায় ভরতে ভরতেই জালের টোনায় ঝিলিক দিয়ে উঠে ছিট পারতে থাকা এদলা চিংড়ি। এতক্ষনে ডোলা প্রায় অর্ধেক হয়ে এসেছে। আর কয়েকটি খেউ দিয়েই আজকের মতো ক্ষান্ত হবে, ভাবছিলো সবুজ। কিন্তু উঠাৎ উদয় হওয়া কোষা নৌকাটিই ঘটালো যতো বিপত্তি। বলা নেই কওয়া নেই, নি:শব্দে ভেসে এসেছে ঠিক সবুজের পাশেই। পানিতে বৈঠা ফেলার শব্দটি পর্যন্ত তার কানে আসেনি। চরম বিরক্ত হয়েই তাকালো কোষার মাঝির দিকে। তারপর ভ্যাবাচেকা খেলো। মাথা নুইয়ে নিলো সসম্মানে, বৈঠা হাতে বসে আছে স্বয়ং মন্তাজ উদ্দিন!
- কি সবুজ মিয়া, পড়ালেহা থুইয়া দেহি জাল ঠেলায় মনযোগ দিছস! কিশোরগঞ্জেত্তে কবে আইলি?
- পরশুদিন আইছি পুতু (চাচা)
- কলেজ বন্ধ নাকি?
- না বন্ধ না। এইচএসসি পরীক্ষার রিজাল্ট দিছে ত-অ, এর লাইগ্যা কয়দিন ডিলাডালা কাস অইতাছে।
- তরার কলেজের রিজাল্ট কিমুন অইছে?
- বালাই। জিপিএ পাঁচ পাইছে আঠারজন। দুইডা ছেরা খালি ফেইল করছে।
জাল ঠেলা বন্ধ হয়ে গেলো বলে উদ্দম্যে ভাটা পরেছে ময়নার। খানিকটা বিরক্ত হয়ে তাকালো মন্তাজ চাচার দিকে। কিন্তু তার বিরক্তিতে কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই দেখে আশাহত হলো সে। এমনিতেই বার বার ডাঙায় উঠে যেতে চাচ্ছিলো সবুজ ভাই, এখনতো আর কথাই নেই। যা ধারণা করেছিলো ঠিক তাই। পরিষ্কার পানিতে এপাশ-ওপাশ করে জাল ধুয়ে নিতে দেখলো সে। অর্থাৎ আজকের মতো মাছ ধরা এখানেই সমাপ্ত। বাধ্য হয়ে কাঠখোট্টা আলাপচারিতায় মনযোগ দিলো ময়না।
- আমার ত-অ খালি ডর করতাছে পুতু। আমরার মত গরিবের বালা রিজাল্ট কইরা কোন দাম নাই।
- আরে ডরের কি আছে বেক্কল। মনযোগ দিয়া পর, বালা রিজাল্ট কর।
- কি অইব বালা রিজাল্ট কইরা। এইবার দেহ সারা দেশ-অ আটাইশ হাজার ছয়শ’ একাত্তর জন জিপিএ পাঁচ পাইছে। এরার মইদ্যে কয়জন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি অইতে পারব? টেহাওয়ালারার লাইগ্যাতো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছেই। কিন্তু আমরা যায়াম কই?
- কতা তুই মন্দ কইছসনা। আমরার দেশে আছে খালি যত আউলা নিয়ম। এইযে পুলাপাইনগুলা পাস কইরা বাইর অইতাছে, এরা কই ভর্তি অইব, কি পড়ব, এরার ভবিষ্যৎ কি এইসব লইয়া সরকারের বিন্দু মাত্র চিন্তা নাই।
- এর লাইগ্যাইতো মাজে মইদ্যে পড়ালেহা ছাইরা দিতে ইচ্ছা অয় পুতু।
- আরে ধুরু, তুই খালি অলক্ষির মত কতা কছ। সমস্যা অনেক থাকব, হের লাইগ্যা কি ঘরে বইয়া থাহুন লাগব! মনে রাহিস উপরে আল্লাহ আছে। বালা কইরা পড়ালেহা কর, এইসএসসিতেও জিপিএ পাঁচ পাইয়া গেরামের মুখ উজ্জ্বল কর।
কি-সব জিপিএ পাঁচ-টাচ নিয়ে যে ওরা কথা বলে, একদম ভালো লাগেনা ময়নার। জিপিএ পাঁচ, এ প্লাস এসব শব্দ প্রায়ই কানে আসে ওর, কিন্তু কোন কিছুর অর্থ উদ্ধার করতে পারেনি। তার কাছে সোজা হিসাব, পাস-ফেল। অবশ্য গত এসএসসি পরীক্ষায় রেজাল্টের ব্যাপারটা ছিলো ভিন্ন। তখন সবুজ ভাই জিপিএ পাঁচ পেয়েছিলো, আর সারা গ্রামের মানুষের সেকি আনন্দ! আনন্দ হয়েছিলো তারও। সেই থেকে সে বুঝে গেছে জিপিএ পাঁচ হলো ভালো ফলাফল। কিন্তু সবুজ ভাইয়ের ভাল ফলাফল সত্ত্বেও তখন ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলো শাহজাহান আলী, সারা দেশে নাকি এত ছাত্র জিপিএ পাঁচ পেয়েছিলো যে তাদের ভিড়ে খেটে খাওয়া সবুজ ভাইয়ের কোন স্থানই হবেনা। শাহজাহান আলী বলেছিলো লেখাপড়া নাকি পয়সা ছাড়া হয়-ইনা। কই লেখাপড়াতো বন্ধ হয়ে যায়নি তার! কিশোরগঞ্জ শহরে লজিং থেকে, টিউশনি করে ঠিকঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে সবুজ ভাই। আসলে মন্তাজ চাচার কথাই ঠিক, উপরে আল্লাহ আছে।
- কিরে ময়না, মাছ কিমুন পাইলি?
জবাবের অপেক্ষা না করেই মারছার (পাটাতনের) নিচে বৈঠাটা চালান করে দিলো মন্তাজ উদ্দিন। তারপর এক লাফে নেমে এলো ডাঙায়। আমগাছের শেকড়ের সাথে কোষাটা বেঁধে ঢোঁ মারলো ডোলার ভেতর। তারপর সবুজের সাথে কথা বলতে বলতে হাটা ধরলো গোপাট (মেঠো পথ) ধরে। ঠেলা জালটা কাঁধে তুলে পেছন পেছন এগুলো সবুজ, গা থেকে নিংড়ে ঝরছে পানি। চিংড়ির ডোলা হাতে পা বাড়ালো ময়নাও, হাওরের জলে কোণঠাসা সবুজ রঙের শ্যাওলা-ঝাউলা পেছনে রেখে এগিয়ে চললো সবুজ এবং মন্তাজ উদ্দিনকে অনুসরণ করে।
১৮ জুলাই ২০১০

শনিবার, জুলাই ১৭, ২০১০

বেশি খেলে বাড়ে মেদ

ছেলেটা একেবারে হাড়জিরজিরে। বয়স কত আর হবে পাঁচ থেকে ছয় এর মধ্যেই। গায়ে এতটুকু কাপড় নেই। পাঁজরের সবগুলো হাড় একে একে গোনে ফেলা যাবে। মাথা থেকে খাপরি আলাদা হয়ে আছে। গর্তে লুকানো চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে টর্চ লাইটের মতো। নি®প্রাণ কিন্তু খানিকটা ভয় মেশানো দৃষ্টি মন্তাজ উদ্দিনের দিকেই।
ভীষণ অবাক ছেলেটা, তাকে এভাবে ডাকছে কেনো মন্তাজ উদ্দিন! লোকটার সাথে কখনও কোন বেয়াদবি করেছে বলেতো মনে পরছেনা। পাটকাঠির মতো দেহ দোলাতে দোলাতে নি®প্রাণ এগিয়ে আসছে ছেলেটা। চেহারায় শঙ্কা। আর বিব্রততো বটেই। চড়া গলায কাছে ডেকে ছেলেটাকে ভয় পাইয়ে দেয়ায় বিব্রত মন্তাজউদ্দিনও। তাই হয়তো অভয় দেয়ার জন্য বেঞ্চি থেকে পা নামিয়ে কিছুটা নরম স্বরে বললো
- ডরের কিছু নাই। কাছে আয়
তারপর দুই কাপ চা আর একটি বিস্কিট দিতে বললো তোতা মিয়াকে। কিন্তু আশ্বস্ত হতে পারলনা আপদমস্তক উলঙ্গ ছেলেটা। কোন ধমক-টমক শুনবে এমন শঙ্কায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষন পরই ঘটলো অস্বাভাবিক ঘটনাটাা। তোতামিয়ার বানানো দুই কাপ চায়ের একটি তার দিকে আসতে দেখে ছিটকে পরলো খানিকটা দূরে। যেন শাস্তি দেয়ার জন্যই গরম পানির লিকার ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে তাকে।
- আরে বেক্কল, চা ধর। তর লাইগ্যাই বানাইছি। বলল তোতা মিয়া।
খানিকটা ইতস্তত করে দুই হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে টেনে নিলো চা। দ্বিধাহীনভাবে বসে পরলো মাটিতে, ঠিক মন্তাজ উদ্দিনের পায়ের কাছে। তারপর ধুয়া উঠা চা ঠান্ডা করে খাওয়ার জন্য একের পর এক ফুঁ দিতে লাগলো কাপে।
- আহারে, না খাইতে না খাইতে পোলাডার কি অবস্থা! খুব কষ্ট লাগে মন্তাজ বাইছা (ভাই সাহেব)। সমবেদনা জানালো তোতা মিয়া।
- কষ্ট লাগলেই আর কি করতারবা তুমি, বড়জোর মাঝে মইদ্যে ডাইকা আইন্না দুইডা চা বিস্কুট খাওয়াইতে পারবা। এতে কি আর ুধার জ্বালা শেষ অইব?
- টেকা-পইসাওয়ালা মাইনষের পোলাপাইনগুলারে মা বাপে সারাদিন খাওয়ার উপরেই রাহে। খাইতে চায়না, এর পরেও মুহের মইদ্দে ঠেইল্যা দেয়।
- বালা কতা মনে করছ। সারা বিশ্বে অহন মানুষ গবেষণা করতাছে পোলাপাইনের মোডা (মোটা) অওয়ন কেমনে ফিরান যায়। কয়েকদিন আগে পত্রিকাত (পত্রিকায়) দেখলাম আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বউ (মিশেল ওবামা) পুলাপাইনের মোডা অওনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করছে।
- এমুন বেইক্কইল্লামি (বোকামি) কতা ত-অ আর হুনছিনা। হেরা যেইডা বেশতি খায়, এইডা আমরার মতো গরীব দেশের পুলাপাইনরারে দিয়া দিলেই ত-অ সমস্যার সমাধান অইয়া যায়।
- যত সহজে চিন্তা করতাছ, বিষয়ডা তত সহজ না। বলতে বলতে অর্ধেক শেষ করা কাপটা এগিয়ে দিলো তোতা মিয়ার দিকে।
- আরেক চামুচ (চামিচ) চিনি দেও তোতা মিয়া। চায়ে চিনি কম দিয়া আমারে কতায় বুলাইয়া রাকতাছ। এত কিপ্টামি কর কেরে? তোমার ঝি ময়নাই বালা, চিনি কম দেয়না।
ময়নাকে আরেক চামচ চিনি দেয়ার আদেশ দিলো তোতা মিয়া। তারপর বলল
- কিপ্টামি কি আর সাধে করি বাইছা। চিনির দাম গেছে গা বাইরা। কিন্তু তোমরার কতা চিন্তা কইরা চায়ের দাম বাড়াইতে পারতাছিনা।
- না তোমারে দুষ দেইনা। দুষ আমরার কপালের। ভোট দিয়া নেতা বানাই, আর হেরা ক্ষমতায় গিয়া আমরার পেটের কতা বুইল্লা যায়। নাইলে (না হয়) আলু, পটল, চাউল, ডাউল, নুন, তেলের দাম বাড়ার পরেও ডাহায় (ঢাকায়) বইয়া মন্ত্রিরা এইসব লইয়া রস করত-অ পারে? এক মন্ত্রী আমরারে চিনি কম খাওনের উপদেশ দিছে। চিনি কম খাইলে নাকি শরীর বালা থাহে। বহুত আগে হীরক রাজার সভা কবির গলয় হুনছিলাম এমুন কতা।
আশ্চর্য হলো ময়না। হীরক রাজা আবার কে? তার দেশ-ইবা কোথায়! কৌতুহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞেস করল
- পুতু হীরক রাজা কেডা?
- সত্যজিৎ রায় নামের একজন পরিচালক ছিনেমা বানাইছিলো ‘হীরক রাজার দেশে’ নামে। এই ছিনেমার মইদ্যে হীরক রাজ্যের মানুষ না খাইয়া থাকতো। আর রাজা তার সভা কবিরে দিয়া না খাইয়া থাহুনের উপকারিতা বুঝাইতো ‘ অনাহারে নাই খেদ/বেশি খেলে বাড়ে মেদ’
১১ জুলাই ২০১০

নেমে এলো ঝুম বৃষ্টি

ধুকপুক ধুকপুক করে পাশ কাটিয়ে গেলো একটি ট্রলার। বেপরোয়া পানি ধেয়ে এসে ধাক্কা খেলো কলার ভেলাটিয়। প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো ময়নারা। কিছুক্ষন তিড়িংবিড়িং এপাশ-ওপাশ দুলে তারপর শান্ত হলো ওরা। শান্ত বলতে একেবারে স্থির হয়ে গেছে এমনটি নয়। মৃদু বাতাসের দোলায় দুলছে পুরো হাওর। সেই সাথে দুলছে ময়নাদের ভেলা। এ দুলুনিতে ভেলার স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত হলেও এর মাঝে রয়েছে ছন্দ। পানিতে এলোমেলো আলোড়ন তুলে ছুটে চলা ট্রলারের ঢেউয়ের মতো বেপরোয়া নয়। তবে তুমুল বর্ষায় হাওরের বিচিত্র খেয়ালের হদিস পাওয়া ভার। এই হয়তো দেখা গেল স্থির জলধি। যেন জলজ চাদর বিছিনো রয়েছে আকাশ অবধি। আকাশ আর হাওরের নীলে মিলে-মিশে একাকার। আবার হয়তো মুহুর্তের মাঝেই ঘটে যেতে পারে পরিবর্তন। ক্ষ্যাপা বাতাসের উন্মত্ত শক্তিতে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলতে পারে শান্ত জলধিকে। ধেয়ে আসা একেকটা ঢেউ যেন দুই মানুষ সমান। হাওরের এ অগ্নিমূর্তি প্রতি বর্ষায়ই দেখে ময়না। আর এ কারনেই ছোট্ট কলার ভেলায় ভেসে খুব একটা দুরে যায়নি ওরা।
- লগ্যিডাত (লগিতে) একটু ভর দে দুলাল। আমি একটু জিরাইয়া লই।
এক টুকরো গামছার নেংটি ছারা আর কিছুই নেই ছিপছিপে শীরের এ ছেলেটার গায়ে। ময়নার একনিষ্ঠ চ্যালা হিসাবেই ওর পরিচয়। ভেজা শরীর নিয়ে এতক্ষন বসে কাঁপছিলো সে। তাই ময়নার আদেশ পেয়ে আর দেরি করলোনা দুলাল। প্রথমে ভেলার সামনের দিকটায় এগিয়ে গেল। তারপর পানিতে লগি ফেলে তলা নাগাল পেয়ে সজোরে ভর দিলো। ভরের বিপরীতে ভেলাটি এগিয়ে চললো সামনের দিকে। আর সম গতিতেই পেছাতে থাকলো সে। একেবারে শেষ মাথায় চলে এসেই ছপ করে তুলে নিলো লগি। তারপর আবার এগুলো সামনে। এভাবে একের পর এক লগির ভরে ঢেউ কেটে কেটে কেটে ভেলা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুলাল। আর দু’পা ছড়িয়ে আয়েস করে বসে আছে ময়না।
- এই দুলাইল্লা, একটা গান ধরছনা
উৎফুল্ল হযে উঠল দুলাল। লগির ভর কোমল করে দিয়ে বড় করে একটি শ্বাস নিয়ে নিলো। তারপর কচি গলা ভাসিয়ে দিলো হাওরের মৃদু বাতাসে ‘মন মাজি তঅর বৈডা নেরে/আমি আর বাইতে ফারলাম না.....’
তাচ্ছিল্ল করল ময়না
- আরে ধুরু তুই এইহান-অ বইডা (বৈঠা) পাইলি কই? বোরা (ভেলা) বাইতাছস লগ্যি দিয়া ভরাইয়া (ভর দিয়ে) আর গাণের মইদ্যে কছ বইডার কতা!
- লগ্যির কোন গাণ জানিনা আমি।
- কী ছাতা জানস তুই?
লজ্জায় মাথা নুইয়ে রাখলো কিছুক্ষন। তারপর হঠাৎই যেন উদ্যম ফিরে পেল দুলাল। দ্বিগুণ শক্তিতে লগিতে ভর দিয়ে তীর বেগে ভাসিয়ে চললো ভেলা। আর আবৃত্তি করতে লাগলো ‘স্বর-অ, স্বর-আ/লগ্যি দিয়া ভরাইয়া/মাস্টর গেছে আরাইয়া/হ্রস্য-ই, দীরগু-ঈ/মাস্টর পাইছি....”
হেসে কুটি কুটি ময়না। সংক্রমিত হয়েছে দুলালও। হাসির দমকে ভেলা থেকে পড়ে যাওয়ার অবস্থা আরকি। হাসছে, হাসছে আর হাসছে। চোখ থেকে গড়িয়ে পরছে জল। তারপর আকাশ থেকে নেমে এলো ঝুম বৃষ্টি। তুমুল বর্ষার এ বর্ষণ ওদের হাসি নি:সৃত জলকে একাকার করে দিলো আকাশ আর হাওরের নীলের সাথে।
৪ জুলাই ২০১০

পানি আবার কিনে খায় কিভাবে!

মোটরসাইকেলটা শাহজাহান আলীর কাছে এক স্বপ্নের যান। সারাদিনই যন্ত্রটার পিঠে চড়ে ভট ভট শব্দ তুলে ঘুরে বেড়ায় এখানে-সেখানে। কোনো কাজটাজের উদ্দেশ্যে যে তা নয়, ড্রাইভিংটা ভালো করে রপ্ত করা আর এই ফাঁকে মোটর সাইকেলের আভিজাত্য দেখিয়ে বেড়ানো আর কি! আগামী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়ার দাবি জানিয়ে নাকি গাঙ্গাটিয়া গ্রামের জনগণ তাকে সেকেন্ড হ্যান্ড এ বাহনটি উপহার দিয়েছে। কিন্তু ময়নার কাছে ভিন্ন খবর- কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করার শর্তে দশ বছরের ব্যবহৃত এ মোটরসাইকেলটি কিনে এনেছে শাহজাহান আলী। পুরনো হলে কি হবে, এর পিঠে চড়ার স্বাদ অমৃতসম। এমন কথা শাহজাহান আলীর মুখে শুনলেও ততটা বিশ্বাস করতে পারছে না ময়না। কারণ স্থান-কাল পাত্র বিবেচনা না করেই ভুঁ-ভুঁও-ভুঁওওওওক্ করে যন্ত্রটার স্টার্ট বন্ধ হয়ে যেতে দেখে সে। এতে অবশ্য এর মালিকের উৎসাহে কোনো ভাটা পরতে দেখা যায় না । এই ধরা যাক এখনকার কথাই, কাঁদা-পানিতে জ্যাম হয়ে যাওয়া মোটরসাইকেলটিকে ঠেলে নিয়ে যেভাবে এগিয়ে আসছে ওদের দোকানের দিকে, তাতে মনে হচ্ছে মহাপরাক্রমশালী কোনো দৈত্যের সাথে সম্মুখ সমরে সে এক বিজয়ী বীর।
- ময়নারে, তোতা মিয়া কই?
হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল শাহজাহান আলী
- বাপজান বাড়ির বিতরে আছে।
- ডাক দিয়া ক-অ আমি আইছি। আর আমার লাগি এক কাপ চা বানা
- বাপজন, শারজাহান পুতু ((শাহজাহান চাচা) তোমারে ডাকতাছে।
ময়নার ডাক শেষ হওয়ার আগেই ওদের দোকান আর ভেতর বাড়ির সংযোগের দরজাটি খোলে গেল। কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে অলস ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলো তোতা মিয়া
- আরে শারজাহান বাইছা (ভাই সাহেব) কইত্তে?
- বাজারেত্তে আইলাম আরহি, যানডা একবারে বাইরইয়া যাইতাছে। চিন্তা করলাম তর দোহানের এক কাপ চা খাইয়া যাই। একটু জিরানিও অইল আর তর লগে দুইডা আলাপ-অ অইল।
বলতে বলতে মোটরসাইকেলটাকে সমতল জায়গায় দাঁড় করিয়ে ধপ করে বেঞ্চিতে বসে পরল শাহজাহান আলী। তারপর মুখের হাসি অটুট রেখেই পরম মমতায় তাকিয়ে থাকল ওটার দিকে। মমতা ঝারলো তোতা মিয়াও
- প্যাক-কাঁদায় দেহি আপনের গাড়িডা মারা লাইগ্যা (একাকার হয়ে) গেছে।
- মারা লাগদনা! রাস্তাডার অবস্তা কী, দেখছস নি?
- বালা কতা মন-অ করছ-অ বাইছা, রাস্তাডা ঠিক করনের লাইগ্যা কোন সেঙশন (অনুদান) পাইছনি?
- আর কইছনা। এই রাস্তার লাইগ্যাইতো হেদিন ডাহা (ঢাকা) গেছিলাম এমপি সাবের লগে দেহা করতে।
- পরে এমপি সাব কী কইল?
- দেহা আর করতে পারলাম কই, ডাহা শহর-অ গাড়ি-গোড়ার জামের (জ্যাম) লাইগ্যা চলুন যায় নাকি? দেহা করার কতা আছিন এগারডার সময়, এমপি সাবের বাসাত গিয়া উঠলাম বারডা বত্রিশ মিনিডে। গিয়া দেহি ওনি বাসাত্তে বাইরইয়া গেছে গা।
- তুমি ইকটু আগে রওনা দিলেই পারতা।
- আগেই রওনা দিছিলাম। তারপরেও দেরি। ডাহা শহরের জামের কি কোন ঠিক-ঠিকানা আছে? একবার আটকাইয়া থাকলে আর ছারুনের নাম নাই। ঘন্টার পরে ঘন্টা ঠাডাপুড়া রইদের (প্রখর রোদের) মইদ্যে গাড়িগুলাইন খারইয়া থাহে, আর ডাইবার, প্যসেঞ্জার সবাইর মথার চান্দি গরম অইয়া যায়। আর এই গরম চান্দি লইয়া, কেউ কেউরে সইহ্য করত পারেনা। একটু হেত-ভেত (এদিক-সেদিক) অইলেই লাইগ্যা দেয় কাইজ্জা।
- আমি বুইজ্জা পাইনা, এই শহরের মানুষ বাঁচে কেমনে! নাই গাছ, নাই গাঙ, নাই পানি। শ্বাস ফালাইবার জায়গাডা পর্যন্ত নাই। খালি দালান আর দালান, গাড়ি আর গাড়ি। আমরার গেরাম অই বালা।
- খালি এইগুলা অইলে ত-অ বালাই আছিন। পানি পর্যন্ত কিইন্যা খাওন লাগে। হেদিন পত্রিকার মাইদ্যে লেকছে পানির অভাবে নাকি ডাহা শহর মাডির নিচে ডাইব্বা যাইবগা।
শিউরে উঠল ময়না। এ আবার কেমন শহর, পানি আবার কিনে খায় কিভাবে! ভারি অবাক মেয়েটি। পিপাসায় গলা শুকিয়ে আসে তার। ঢক ঢক করে এক জগ পানি গলায় ঢেলে স্থির হতে চেস্টা করলো। কিন্তু পারলনা। এমন কথা শুনলে স্থির হতে পারার কথাওনা। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। এই শহরেই থাকে মন্ত্রী-এমপিসহ বড় বড় লোকেরা। এদেরকেসহ যদি ঢাকা মাটির নিচে দেবেই যায়, তবে দেশ চালাবে কে? আর এই শহরের সাধারণ মানুষগুলারই বা কী অবস্থা হবে? জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হলো ময়নার। কিন্তু ততক্ষণে শাহজাহান আলী বেঞ্চি থেকে উঠে গিয়ে শখের বাহন পরিস্কারে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। লম্বা একটি কাঠি দিয়ে দুই চাকার ভেতর আটকে থাকা দলা দলা কাঁদা বের করে নিয়ে আসছে। এতে অবশ্য সামান্য ধকল যাচ্ছে তার উপর। কিন্তু বসবাসের অনুপযোগী ঢাকার পথের চেয়ে গ্রামের এই কাঁদায় ভরা মেঠো পথে শখের বাহন তাড়িয়ে বেড়ানোতেই হয়তো অনেক প্রশান্তি, ভাবল ময়না।
২৭ জুন ২০১০

ছায়ার মতো আগলে রাখে

- কী রে ময়না, বাপের লাইগ্রা অত উতলা অইছস কেরে?
পিঁড়িতে বসে মেয়ের মাথায় বিলি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করল মা।
- রেডুত (রেডিওতে) কইছে আউজ্জা (আজ) সারাডা দিন বাপজানের লগে থাহনের লাইগ্যা।
- কেরে আউজ্জা কী অইছে?
- আউজ্জা বুলে বাবা দিবস। পৃথিবীর সব মানুষই আউজ্জা বাবার লগে কাডাইব। কিন্তু আমারে ঘুমে থুইয়াই বাপজান যে বাইর-অইল, অহন-অতো আইল না।
- এই দেহ ছেরির মুহঅ (মুখে) যত আকাইম্মা কথা। তর বাপের কি আর কামকাইজ নাই যে সারা দিন তর লগে বইয়া থাকব!
ময়নার মাথায় ভর্ৎসনাসুলভ মৃদু একটি ঝাঁকি দিয়ে কথাগুলো বলল মা। তারপর আবার মনোযোগ দিলো বিলি কাটায়। দুই হাঁটু ভাঁজ করে লক্ষ্মী মেয়ের মতো সামনের পিঁড়িটায় বসে আছে মা। ঠিক বসে থাকা নয়, বেশির ভাগ সময় পায়ের পাতার সামনের দিকটার ওপর ভর করেই উঁকি দিয়ে থাকতে হচ্ছে তাকে। কান্তি পেয়ে বসলে ভরসা হিসেবে পিঁড়িটা নিচে রয়েছে এই যা। চুলের ভাঁজে ভাঁজে মায়ের কোমল হাতের সঞ্চালন বেশ ভালোই লাগছে ময়নার। আরামে চোখ লেগে আসছে। বেশ কয়েকবারই ডলে পড়ে যাচ্ছিল। রাজ্যের ঘুম এসে চোখে ভিড় করলে কী-ই বা করার আছে ওর। কিন্তু মায়ের ঝাঁকুনি খেয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শক্ত হয়ে বসতে হয়েছে তাকে। একটু-আধটু ঝাঁকুনি আর বকুনি দিলেও মা-টা তার ভীষণ ভালো। আদর আর ভালোবাসা দিয়ে একেবারে আঁচলে আগলে রাখতে চায় ময়নাকে। আর এ কারণেই মাকে ছাড়া কোথাও গেলে এক দিনের জন্যও ভালো রাগে না ময়নার। ইস্! বাবাটাও যদি এমন হতো, তাহলে আর কোনো দুঃখই ছিল না ময়নার। একদমই বাড়িতে থাকে না বাবা। আর থাকলেও দোকানের কেনা-বেচা নিয়েই সময় পার করে। মাঝে মধ্যে ময়নাকেদোকানে বসিয়ে উধাও হয়ে যায়। সারা দিন ব্যস্ত থাকে হাটবাজারে। পৃথিবী ফর্সা হওয়ার আগেই হাওরে চলে যায় ক্ষেতের কাজে। এসব একদমই ভালো লঅগে না ওর কাছে।
- আইচ্ছা মায়া (মা), বাপজান তোমার লাহান (মতো) অইল না কেরে?
ময়নার আচমকা প্রশ্নে হাতের সঞ্চালন থামিয়ে ঝুলে থাকা কাপড়ের আঁচলটা নিজের কাঁধে ছুড়ে দিলো মা। তারপর আরাম করে পিঁড়িটায় বসে বলল,
- দেহ আমার ছেরির ঢঙের কথা! তর বাপ হিবার আমার লাহান অইত কেরে?
- তুমি যেমুন সারাক্ষণ আমার পাশে থাহ, বাপজান তো থাহে না। সারা দিন খালি এইহানে ওইহানে যায়।
- বেক্কলের (বোকার) কথা হুনছনি! সারাদিন বাইত বইয়া থাকলে, কামাই না করলে আমরার সংসার চলব কেমনে?
কথাটা ঠিকই বলেছে মা, ভাবল ময়না। বাবার এত ব্যস্ততা, এত ম্রম সব তো তার জন্যই। এটা এনে দাও, ওটা কিনে দাও এসব আবদার তো বাবার কাছেই করে সে। ওর ভালো লাগায় বাবাকে উৎফুল্ল হতে যেমন দেখেছে, তেমনি ওর মন ভার থাকলে বাবাকেও মন বার করে বসে থাকতে দেখেছে। কিন্তু যেমনভাবে মায়ের ভালোবাসার স্পর্শ অনুভব করে ময়না, বাবার বেলায় তেমনটি নয়। তবে বাবার বলিষ্ঠ হাত আর দূর থেকে ভালোবাসা যে সারাক্ষণ ছায়ার মতো আগলে রাখে তাকে, তা বেশ ভালোভাবেই অনুধাবন করে ময়না।
- বাপজান কোন সুময় আইব মায়া? বাবা দিবস-ত শেস অইয়া যাইতাছে।
- অইছে হুনছি, বেঢঙের কথা, এক দিনের লাইগ্যা অত দরদ ইতলাইয়া পড়ন বালা না (ভালো না)।
বলতে বলতে পায়ের পাতার ওপর ভর করে উঁচু হলো মা। পাশে রাখা টিনের বাটি থেকে তেল নিয়ে মাখতে লাগল ময়নার মাথায়। আর সেও বুঝে গেল এখন আর কথা বাড়ানো ছলবে না। অর্থাৎ চুপ করে মাকে মায়ের কাজ করতে দিতে হবে।
২০ জুন, ২০১০

আজ মন্তাজউদ্দিন বড়ই উৎফুল্ল

আজ মন্তাজউদ্দিন বড়ই উৎফুল্ল। কিন্তু কী কারণে এ সম্পর্কে কোন ধারণা করতে পারছে না ময়না। গোঁফের আড়ালে মুচকি হাসি নিয়েই দোকানে প্রবেশ করল মন্তাজ পুতু (চাচা)। তারপর বেঞ্চিটায় বসে এক কাপ চা দিতে বললো ময়নাকে। একজন লোক আপন মনে হেসে যাচ্ছে- ব্যাপারটা কিছুটা ব্যাখাপ্পা মনে হল তার কাছে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো, থাকনা ঠোঁটে হাসি। তাতে তো ময়নার কোন সমস্যা হচ্ছে না। কাউকে হাসতে দেখলে ভালোই লাগে তার। মন্তাজ পুতুর উৎফুল্ল মনের হাসিটা মুচকি হলেও এতে কোনো কুটিলতা কিংবা কৌতুক নেই। এটা-সেটা নিয়ে কৌতুক করতে অভ্যস্ত এ লোকটার হাসির সাথে ময়নার পরিচয় নেই, এমনটি নয়। তবুও আজ বেশ অপরিচিতই মনে হচ্ছে তাকে। কারণ এমন নির্মল ও তৃপ্তির হাসি এর আগে কে-ও হাসতে পেরেছে বলে মনে হয়না। নি:শব্দ উৎফুল্লতার হিল্লোল স্পর্শ করল ময়নাকেও, নিজের অজান্তেই অ™ভ’ত এক ভালোলাগার ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাকে। অর্থাৎ উৎফুল্ল হয়ে উঠল ময়নাও।
- একলা একলা পিটপিটায়া হাসতাছ কেরে পুতু?
- তুই হাসতাছস কেরে?
- তুমার হাসি দেইখ্যা।
- আমি হাসতাছি বাংলাদেশের মাইনষের তৃপ্তির হাসি দেইখ্যা।
কথাটা ঠিক বুঝতে পারলনা ময়না। বাংলাদেশের মানুষ আবার কখন হাসল! মন্তাজ পুতুই তো সেদিন বলেছিল এই দেশের মানুষকে ঘিরে রেখেছে কেবল সমস্যা আর সমস্যা। এত সমস্যার মাঝে থেকে কি কেউ হাসতে পারে! ব্যাপারটা জানার আগ্রহ হলো তার
- কী এমুন ঘটল চাচা?
- হুনছ নাই, আমরার দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে দায়িত্ব নিয়া স্বজনহারা তিন কন্যার বিয়া দিয়া দিছে।
-না হুনার কী আছে? এইডাতো সবাই হুনছে।
- এই কারণে সবার ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি।
এমনভাবে তো ভেবে দেখেনি সে। সত্যিইতো কয়েকদিন যাবত দোকানে চা খেতে আসা লোকজনের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রসঙ্গটি। আহা! বিয়ে বাড়িতে আগুন লেগে কত্ত মানুষই-না মারা গেল। প্রাণ হারালো পাত্রীদের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনসহ আরও কত্ত লোক। খবরটি শুনে খুব মায়া হয়েছিলো ময়নার। ভেবেছিলো আপনজন হারানোর সাথে সাথে বুঝি ভবিষ্যতটাও হারালো ওরা। কিন্তু যখন শুনল স্বজনহারা এ মেয়েদের মায়ের ভ’মিকায় এসে দাঁড়িয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, তখন অন্যদের মতো ভালো লাগার অনুভূতি হয়েছিলো তারও।
- বুঝলি মায়া (মা), প্রধানমন্ত্রী এই মহৎ কামডা কইরা একটা নজির দেহাইল। অহন তারে অনুসরণ কইরা আমরা যুদি একজনের দু:খরে দশজনের মইদ্যে ভাগ কইরা লই, তাইলে কি এই দেশের কোনো মানুষ নিজেরে অসহায় মনে করব?
বলতে বলতে তৃপ্তির হাসি নিয়েই চায়ে শেষ চুমুক বসাল মন্তাজ উদ্দিন। তারপর খালি কাপটি বেঞ্চিতে রেখে উঠে দাঁড়ালো এবং জবাবের অপেক্ষা না করেই হাটা ধরল বাড়ির পথে। তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলো ময়না। আর অপেক্ষায় রইলো অন্য আরো দিনের, যখন মন্তাজ পুতুর হাসিটা হবে ঠিক আজকের মতো নির্মল ও তৃপ্তির।

শুক্রবার, জুলাই ০২, ২০১০

কবি জাকির আবু জাফর এর ৩৯তম জন্মদিনে



গতকাল কবি জাকির আবু জাফর এর ৩৯তম জন্মদিনে

সোমবার, জুন ২১, ২০১০

ভিনদেশি পতাকায় সয়লাব বাংলাদেশ

‘ছলাৎ’ করে একটি শব্দ হলো মাত্র। সাথে সাথে কাঁদা-পানিতে একাকার হয়ে গেল ময়না। কিছু বুঝে উঠার আগেই লক্ষ করল তার ঠিক সামনে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে একটি ফুটবল। আর সেটা নেয়ার জন্য দ্রুত এগিয়ে আসছে এক দল পুঁচকে ছেলে। ওরা ভালোভাবেই জানে যে ময়নার কাছে একবার বল আটক হলে ফেরত পাওয়া সহজ নয়।
এ দিকে ময়নার মেজাজ দেখে কে! মনে হলো গোটা প্রকৃতিই যেন টিটকিরি করছে ওর সাথে। ঘাসের ফাঁকে জমে থাকা পানিতে সূর্যের খাড়া রশ্মি পড়ে চিকচিক করছে। কিন্তু ওর মনে হলো এই পানিও বুঝি চিকচিকে দাঁত বের করে হেয়ালি করছে। আর দেরি করল না ময়না। ফুট বলটা পুঁচকেদের আয়ত্তে চলে যায় যায়, এমন সময় ছুঁ মেরে নিয়ে নিল।
-হ্যাই পোলাপাইন, চ্যাপচ্যাইপ্পা পানি (জমে থাকা পানি) ছাড়া খেলনের আর যাইগা নেই?
আচমকা ধমকে ভয় পেয়ে গেল ওরা। হাত কাঁচুমাচু করে মাটির মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল সবাই। ওদের পায়ের আঙুল থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ঢাকা পড়েছে কাঁদায়। চাপচাপ কাঁদার ভারে চোখের পাতা পর্যন্ত মেলতে পারছে না কয়েকজন। আর যারা পাড়ছে তাদের চোখের ভাষায় ফুটে উঠছে ফুটবলটি ফেরত পাওয়ার আকুলি বিকুলি। মুখ ফুটে বলার সাহস নেই, ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে তবু। পরনে হাফপ্যান্ট থাক বা না থাক, প্রায় সবার কপালেই আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের পতাকার মতো ফিতা বাঁধা রয়েছে। ব্যাপারটা গোচরে আসার পর ফুটবলটাকে নিজের সাথে আরো সেঁটে নিলো কাঁদা-পানিতে কিম্ভুত ময়না। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল ন্যাংটা ছেলেদের কপালে কপালে। নাহ্! আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল ছাড়া অন্য কোনো দেশের পতাকাই নেই। অবশ্য থাকলেও চিনতে পারত না একমাত্র লাল সবুজ পতাকাটি ছাড়া। কিছুটা অবাকই হলো সে। ফুটবল বিশ্বকাপ উপলক্ষে বাড়িতে বাড়িতে, দোকানে দোকানে পতাকা উড়ছে, কিন্তু কোথাও বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা চোখে পড়ছে না। অথচ খাতার পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে সবুজ জমিনে লাল বৃত্ত এঁকে একটি পতাকা বানিয়েছিল সে। আহলাদ করে সেঁটেও রেখেছে দোকানের বেড়ায়।
-ভিইজা এইত্তো গেছগা ময়না বুবু, আমরার লগে খেলাত নাইম্যা পর। আমরা বিশ্বকাপ খেলতাছি
একজন একটু এগিয়ে এসে সাহস করে কথাটা বলল। তারপর আবার চলে গেল নিরাপদ দূরত্বে। কিন্তু খেলার আমন্ত্রণ পেয়ে যে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে ময়না, এতটা ভাবেনি ওরা।
-তুমি কোন পক্ষে আর্জেন্টিনা না ব্রাজিল?
-আমি বাংলাদেশের পক্ষে
ঠিক বুঝে উঠতে পারল না ওরা। বুঝার খুব একটা প্রয়োজনও মনে করল না। হই হই করে নেমে গেল মাঠে। কাঁদা-পানিতে আলোড়ন তুলে আবার শুরু হেয়ে গেল ফুটবল বিশ্বকাপ। আর ছোট্ট ফুটবলটি ঘুরতে লাগল আর্জেন্টিনা থেকে ব্রাজিল, ব্রাজিল থেকে আর্জেন্টিনা কিংবা স্বপ্নচারি বাংলাদেশের পায়ে পায়ে।

রবিবার, মে ৩০, ২০১০

মুসা ইব্রাহিম নামের লোকটি

এই তো সবুজ আইয়া পড়ছে।
বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো একজন। যেন তোতা মিয়ার দোকানের এই জটলাটা তার অপেক্ষাতেই ছিল। অনেকগুলো চোখের কৌতূহলি দৃষ্টিতে বিব্রত হলো সবুজ। এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে পাস করার পর লোকজনের কাছে কদর একটু বেশি-ই পাচ্ছে সে। মাঝে মাঝেই এ নিয়ে লজ্জায় পড়তে হয়। কী করবে বুঝতে পারল না সে, এমন সময় ভিড়ের মধ্য থেকে অন্য একজন হাঁক ছাড়ল...
-আরে, আগে বইতে দে সবুজরে।
চট করে একজন উঠে গিয়ে খালি করে দিলো বেঞ্চির একটা অংশ। সামান্য ইতস্তত করে মধ্যমণি হয়ে বসল সে। দোকানের সামনের পুরো জটলাটা ঘিরে ধরল তাকে। সবাই উৎসাহী। কারণ ওরা ভীষণ উদগ্রীব হয়ে আছে মুসা ইব্রাহিমকে নিয়ে।
ব্যস্ত হয়ে চা তৈরি করতে করতে তোতা মিয়া জিজ্ঞেস করল...
-মুসা ইব্রাহিম দেশে আইব কবে, এমুন কিছু লিখছে-টিকছে নাকি পত্রিকাত?
জবাবটা ভালো করে শুনবে বলে চোখ দুটো কচলে নিলো ময়না।
-কয়েক দিনের মইধ্যেই আইয়া পড়ব।
সবুজ ভাইয়ের জবাব শেষ হতে না হতেই প্রশ্ন করল অন্যজন
-হিমালয় উঁচা (উঁচু) কতখানি?
-এই ধরুইন, আপনের আমার মতো পাঁচ হাজার মানুষও যদি একজনের মাথার উপরে আরেকজন উইট্টা খাড়ই তবুও হিমালয়ের আগা (চূড়া) লাগুইল পাওন যাইত না (স্পর্শ করা যাবে না)।
-আরেব্বাইসরে, ছেড়ার বুকের পাটা দেখছনি, কত উপরে গিয়া উটছে!
বলল মুরব্বি গোছের একজন, তারপর ফুড়ুৎ করে কাপে চুমুক বসিয়ে ধীরে ধীরে মাথা তুলল অন্যজন।
-আমরার দেশের মাইনষের বুকের পাটা, চেষ্টা, বুদ্ধি-সুদ্ধি সব আছে। কিন্তু পথ দেহানোর মত মানুষ নাই। এই মুসা কত কষ্ট-মষ্ট কইরাই না টেহা জোগার করল হিমালয়ের আগায় উঠনের লাইগ্যা। সরকার কি কিছু সহযোগিতা করতে পারত না তারে? আছে ত খালি দুর্নীতি কইরা প্যাট মোটা করনের ধান্দায়।
অন্য একজন খেদ ঝাড়ল।
-আর সহযোগিতা! এসব কথা কইয়া কোনো লাভ নাই। জগতের নিয়মডাই এমুন। আমরার সবুজের কথাই ধর, সারা দিন ক্ষেতে কাম কইরা, খাইয়া না খাইয়া থাইক্কা এমুনভাবে মেট্রিক পাস করল যে অহন দশ গেরামে আমরা মাথা উঁচা কইরা কথা কইতে পারি। কিন্তু পরীক্ষার আগে ক্ষেতে কাম করার সময় কয়জন খোঁজ লইছিলা যে সবুজ কয় বেলা খাইছে কী খাইছে না?
-হ, একবারে খাঁটি কথা কইছ। অহন সবুজরে লইয়া আমরাই তো নাচানাচি করি।
তারপর একসাথে কথা বলতে শুরু করল সবাই। সৃষ্টি হলো শোরগোল। তবে এ জটলার সব কথা ঘুরপাক খেতে থাকল মুসা ইব্রাহিম আর সবুজকে ঘিরে।
পরিচিত মানুষদের উল্লাস, কাপে ফুড়–ৎ-ফাড়–ৎ চুমুকের শব্দ আর জটলা থেকে কুণ্ডলি পাকিয়ে উপরে উঠতে থাকা বিড়ির ধোঁয়া পর্যবেক্ষণ করতে করতে অ™ভূত এক ভালোলাগায় ডুবে গেল ময়না। পাহাড়ের উপরে উঠে দেশের জন্য কী সুনাম অর্জন করা যায়, তা স্পষ্ট না হলেও মুসা ইব্রাহিম নামের লোকটি যে কিছু একটা অর্জন করেছে এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত।

মঙ্গলবার, মে ২৫, ২০১০

লেহাপড়া করতে পইসা লাগে

শাহজাহান আলী লোকটা ভালো কি মন্দ এ সম্পর্কে ময়নার তেমন ধারণা নেই। তবে লোকমুখে শুনেছে তার বাবা রাশিদ মেম্বার নাকি নিজ হাতে তিন তিনটা ডাকাত জবাই করেছিল। সঙ্গত কারণেই শাহজাহান আলীকে সমীহ করে চলা প্রয়োজন। অনেকে করেনও। তবে ময়নার কাছে সমীহ পাওয়ার যোগ্য সে নয়। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কি কারণে? কোন সদুত্তর দিতে পারবেনা সে। লোকটাকে ভালো লাগেনা, ব্যস। কিভাবে আর ভালো লাগবে! দোকানের বেঞ্চিটায় বসে আছে ঘন্টাখানেক হলো। এর মধ্যে এক কাপ চা-ই কেবল খেয়েছে। আর সদ্য মেট্টিক পাশ করা সবুজ ভাইকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে ঝাঁজরা করে দিচ্ছে।
বাবা দোকানে নেই। বেচাকেনা সামাল দিতে হচ্ছে ময়নাকে একাই। এটা দাও ওটা দাও। এমনিতেই মেজাজ টঙ হয়ে আছে। তার উপর এতক্ষন ধরে একটা লোক বেঞ্চি দখল করে থাকলে কার সহ্য হয়। শুধু বসে থাকলেও হতো, একেবারে পা তুলে দিয়ে আরাম করে পরীক্ষা নিচ্ছে সবুজ ভাইয়ের। শহরে ভর্তি হতে গেলে নাকি অনেক কিছু জানা থাকতে হয়।
- আচ্ছা বলতো আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলো কে?
হঠাৎ-ই বইয়ের ভাষা (শুদ্ধ ভাষা) শুনে কৌতুহল হল ময়নার। অবশ্য শাহজাহান আলীর মুখে এমন ভাষা আজই প্রথম শোনা গেছে তা নয়। পর পর ছয় বার মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে না পারলেও শিক্ষিত ও নেতৃত্বের গুণাবলীসম্মন্ন লোক হিসাবে এলাকায় যথেস্ট যশ রয়েছে তার। সে হিসাবে মাঝে মাঝে বইয়ের ভাষায় কথা বলা দায়িত্বের আওতায় পরে।
প্রশ্ন করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জবাব দিয়ে দিলো সবুজ ভাই। কি বলেছে সঠিক বুঝতে না পারলেও ‘কলাম বাঁশ’ ধরনের একটা শব্দ ময়নার কানে এলো। এমন বাঁশের নাম সে জীবনে শোনেনি।
আগ্রহ হারিয়ে গেলো ময়নার। মনযোগ দিলো কেটলির দিকে। জ্বালানি পেয়ে উসকে উঠল চুলার আগুন। সেই সাথে উথলে উঠল সবুজ ভাইয়ের প্রতি তার দরদ। আহা, বেচারা কত কষ্ট করেইনা লেখাপড়া করেছে। রোদে-বানে সারাদিন ক্ষেতে কামলা খেটেছে। তারপর শ্রান্ত শরীর নিয়ে রাতে কোথায় ঘুমাতে যাবে তা নয়, বই নিয়ে বসেছে নুমানদের বাংলা ঘরে। নিজের বাড়িতে কুপি জ্বালানোর সাধ্য না থাকলেও হারিকেনের আলোতে নুমানকে পড়াতে পড়াতে নিজের পড়াটাও চালিয়ে গেছে। নুমানের বাবা-ইতো বইপত্র কিনে দিলো তাকে।
- এই ছেরা, চাকরি করবিনাতো কি করবি? তোর বাপের কি পইসা আছে? কলেজে লেহাপড়া করতে পইসা লাগে, পইসা।
শাহজাহান আলীর উচ্চবাচ্চে ধ্যান ভাঙল ময়নার। লক্ষ্য করল একেবারেই চুপসে গেছে সবুজ ভাই। মাথা নুইয়ে এমনভাবে বসে আছে যেন একশ’একটা খুনের আসামি।
- জ্ঞানবুদ্ধি-ত দেখলাম বালাই আছে। তো সহজ কথা সহজে বুঝসনা কেরে (কেন)! জিপিএ পাঁচ কি তুই একলাই পাইছস ? সারা দেশে এমুন রেজাল্ট করছে বহুত পোলাপান। এরার (এদের) ভীরের মইদ্যে তর মত সবুজের কোন পাত্তা থাাকবোরে?
সবুজ ভাইয়ের শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝড়ছে, লক্ষ্য করল ময়না।
- তর বাপেরে ক’ কিছু টেহা যোগার করতে, দেহি পুলিশের চাকরিতে ঢোকায়া দেয়ন যায় কিনা।
বলতে বলতে পাঞ্জাবির হাতা দুটো ভাঁজ করে নিল শাহজাহান আলী। উঠে দাঁড়ালো এবং জবাবের আশায় শেষবারের মত তাকালো সবুজের দিকে। তারপর আশাহত হয়ে পা বাড়ালো বাড়ির পথে।

সোমবার, মে ১৭, ২০১০

আগুন বেয়ে পড়ছে

‘.... ডুক্কু ডুক্কু লাই/পাতা কাটা যাই/পাতার ঝুম ঝুম/বেহালা বাজাই/বেহালার তরে/মৌমাছি ঘুরে/মৌমাছি ঘুরে...হ’
এই দম ছাইড়া দিছে, দম ছাইড়া দিছে, ময়না বুবু দম ছাইড়া দিছে। বলতে বলতে ময়নার গা ছুঁয়ে দিলো একজন। অর্থাৎ ময়না তখন মরা (খেলায় নিষ্ক্রিয়)।
ভ্যাপসা গরমে আমগাছের ছায়ায় বৌচি খেলছে এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে। মাথার ওপর ছায়া আছে বটে, বাতাসের নামগন্ধ নেই। ভাটার মতো জ্বলছে সূর্য। চোখ তুলে তাকানো যায় না। এদকি-ওদিকের স্পষ্ট রশ্মিগুলোতে উড়ন্ত ধুলোর চিক চিক। খড়ের নতুন পুঞ্জি আর রোদে শুকাতে দেয়া ন্যাড়ার ভাপ আরো চিটচিটে করে তুলছে শরীর। সেই চিটচিটে শরীর নিয়েই লুটোপুটি খাচ্ছে ওরা। দৌড়ে বেড়াচ্ছে পুরো মাঠ।
খেলায় মরে যাওয়ার পর অনেকটা হতাশ হয়েই আমগাছের শেকড়ে এসে বসেছে ময়না। পর্যবেক্ষণ করছে অন্যদের খেলা। সেই সাথে কামনা করছে নিজের দলের বিজয়। ভ্যাপসা গরমে ঘাম তো নয়, যেন আগুন বেয়ে পড়ছে শরীর থেকে।
গাছের শেকড়গুলো প ুরুষ্ট, আর বসার জন্যও বেশ। মনো হলো যেন রাজার সিংহাসনে বসে আছে সে। এখন একটু ফুরফুরে বাতাস এলেই ষোলকলা পূর্ণ হয়। ওপরের দিকে তাকায় ময়না। নাহ, গাছের একটি পাতারও নড়াচড়া নেই। ডাঁসা ডাঁসা আমগুরো জুলে আছে নির্জীব। কয়েকটি পেকে হলদেটে রযও ধরেছ্ েইস, একট া আম যদি খাওয়া যেত। একবার ইচ্ছে হলো ঢিল ছুঁড়ে...। পরক্ষণেই মনে হলো মন্তাজ চাচার কথা। বাতাসে ঝরা আম কুড়িয়ে নিতে কখনো বাধা নেই চাচার। কিন্তু গাছে ঢিল পড়েছে তো সেরেছে।
- ময়না বুবু, লও গাঙের পানিতে যাই।
হঠাৎ লক্ষ করল ছেলেমেয়ের দঙ্গল তাকে ঘিরে দঁইড়য়ে আছে। আমের তেষ্টায় বিভোর হয়ে ওঠায় কখন যে খেলার গোল্লা উঠে গেল, খেয়ালই করল না সে।
- গাঙে জুয়াইরা (নতুন) পানি আইছে, অহন ডুবাইলে (দাপাদাপি করলে) জ্বর আইব।
ময়নার কথাতে মোটেই নিরুৎসাহিত হলো না ছেলেমেয়েরা।
- শইল জুড়াইয়া পানিতে নামলে কিচ্ছু অইত না।
- আইচ্ছা অহন বইয়া থাক, আগে জিরাইয়া লই, পরে গাঙে যায়াম (যাবো)।
ময়নার এক কথাতেই শেকড় ঘিরে বসে পড়ল প ুরো দঙ্গল। শরীরের ঘাম ঝেড়ে ফেলতে ফে লতে ভাঙা কণ্ঠে গান ধরল একজন- ‘আল্লা মেঘ দে/পানি দে/ছায়া দে রে তুই/আল্লা মেঘ দে।’ এতট ুকু বলতেই ধমকে উঠল ময়না।
- অইছে হুনছি। গাছের ছেমাত (ছায়ায়) বইয়া থাইক্কা আল্লার কাছে ছেমা চাস। আর গাঙের প ানি আইয়া ক্ষেতের (জমির) ফসল সব তলাইয়া দিলো, তার পরেও পানি চাস।
লজ্জায় গানের গলা ক্ষীণ হয়ে এলো ছেলেটার। তারপ র একেবারে থেমে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপই কাটল ওদের। এক সময় ময়না আবিষ্কার করল সবার দৃষ্টিই গাছে ঝুলে থাকা আমের প্রতি।
- আম খাইবি? খাইতে চাইলে আল্লার কাছে রোদন কর তুফানের (ঝড়ের) লাইগ্যা। বৈশাখ মাস চইল্যা গেল, অহন-অ বৈশাইজ্ঞা তুফান (বৈশাখী ঝড়) আইল না।
তারপর ময়না নিজেই সুর তুলল- ‘আল্লা তুফান দে/তুফান দে...রে.../আল্লা তুফান দে.... স থে সাথে একই কথার কোরাস ধরল সবাই।
হইচই শুনে মন্তাজ চাচা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ধীরে ধীরে এসে বসল ্ ামগাছের শেকড়টায়। ঠিক ময়নার পাশেই।
- দোয়া কর, বালা কইরা দোয়া কর। তরার (তোদের) দোয়া কবুল অইব।
তার কথা শুনে আরো উৎসাহিত হলো ছেলেমেয়ারা। গাইতে গাইতে মন্তাজ চাচাকেও ইঙ্গিত করল ধুয়া তুলতে।
- বুইড়া মাইনষের দোয়া কি আল্লায় হুনব? আমার পাপের কারণে বৈশাখ মাসের তুফান আর বৈশাখে অয় না, ধান দাওয়ার (কাটার) আগে ধানি জমি পানিতে তলায়। আমরা পৃথিবীর হিসাব-কিতাব বদলাইয়া দিছি। আমরা বাড়াইয়া দিছি পৃথিবীর তাপ। মাথার ওপর অহন গনগনে তাপে সূর্য জ্বলে। পর্বতের বরফ গইলা ডুইবা যাইতাছে পৃথিবী।
শিহরিত হয়ে উঠল ময়না। থেমে গেল কোরাস। পৃথিবী আবার ডুবে যায় কিভাবে!
- তুমি এই সব কী কইতাছ পুতু? মানুষরা কি পৃথিবীর তাপ বাড়াইতে পারে?
- পারে, পারে। প্রকৃতির নিজের একটা নিয়ম আছে। আমরা প্রকৃতিরে দূষিত কইরা তুলতাছি। এর াকরণে নিয়মের লগে তাল রাখতে পারতাছে না প্রকৃতি। দেখস না বৈশাখে অহন ঝড় অয় না, কিন্তু যহন অয় তহন সিডর অইয়া লন্ডভন্ড করে মানুষের প্রাণ। কামের সময় গাঙে পানি থাহে না, কিন্তু যহন থাহে বন্যায় ভাসাইয়া নেয় ভিটা। এইগুলো অইল প্রকৃতির প্রতিশোধ। অহন তুফানের লাইগ্যা আরো বেশি কইরা রোদন কর আল্লার কাছে। তুফান আইলে তরাও আম খাইতে পারব্ িআর পৃথিবী কিছুটা অইলেও আপন গতি ফিইরা পাইব।
এতটুকু বলে থেমে গেল মন্তাজ চাচা। হঠাৎই ছন্দপতন হওয়ায় একট ু নড়েচড়ে বসল সবাই। তারপর আবার সুর তুলল ময়না- ‘আল্লা তুফান দে/তুফান দে...রে.../আল্লা তুফান দে....’ সাথে ধুয়া তুলল মন্তাজ চাচাসহ এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে।

সোমবার, মে ১০, ২০১০

হুঁশিয়ার সাবধান খবরদার


গাঙ পারের হিজল গাছটায় বসে সেই কখন থেকে ডাকছে পেঁচাটা। একবার ‘মীমম’ ধরনের ভয়ঙ্কর শব্দ তুলে, তারপর কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার। ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ ঝিমমম লহরিতে ছেদ ঘটাচ্ছে শেয়ালের হাঁক। সব মিলিয়ে যেন প্রকৃতির এক ভুতুড়ে ঐকতান। সে ঐকতানের ছন্দ ভেঙে তীক্ষ্ম আওয়াজ তুলছে চৌকিদারের বাঁশি। থেকে থেকে ভেসে আসছে চিৎকার, হুঁশিয়ার-সাবধান-খবরদার। রাত যত গভীর হচ্ছে রহস্যধ্বনিও তত স্পষ্ট হয়ে আঘাত করছে ময়নার কানে। সেই সাথে আতঙ্ক ছড়িয়ে অবস করে দিচ্ছে তাকে। শিরশির করে উঠছে শরীর। শঙ্কিত হয়ে ভাবছে সে চৌকিদারের সাহসের কথা। একেকবার বাঁশির আওয়াজ কানে আসছে আর চৌকিদারের স্থলে নিজেকে ভেবে মেরুদণ্ড ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে তার।
গভীর রাতে জিন-ভুতের বিচরণ থাকে অবাধ। ঘরের বাইরে তো বটেই এমনকি ভেতরে এসেও মানুষের উৎপাত করতে ছাড়ে না এরা। কিন্তু কি তাজ্জব ব্যাপার, এই চৌকিদার হুঁশিয়ার সাবধান বলে বলে মধ্যরাতে পাহারা দিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো গ্রাম! ভাবতেই অবাক লাগছে ময়নার। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেও চোখের পাতা এক করতে পারছে না মোটেই। ময়নার ছটফটানিতে ঘুম ভেঙে গেল পাশে শুয়ে থাকা দাদীরও
- ও ময়না, ময়নারে। নড়াচড়া করতাছস কেরে?
- আমার ডর করতাছে খুব।
আতঙ্কিত হয়ে উঠে দাদী। ঘুমের জড়তা কাটিয়ে ধরমড়িয়ে ওঠে বসে চৌকির ওপর। তারপর নাতনীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে অস্বাভাবিক কিছু না দেখে অভয় দিয়ে বলে
- আরে ডর কিয়ের, আমি তো আছি লগে।
- অই চৌকিদারের লাগি ডর লাগতাছে আমার। মাইজ রাইতে (মধ্যরাতে) একলা একলা গেরাম পর (পাহারা) দিয়া বেড়ায়। যদি জিন-ভুতে পায়?
কোনো জবাব বেরোলনা দাদীর মুখ থেকে। এক পশলা ভয় মেশানো বাতাসের ধাক্কায় ধপ করে শব্দ তুলল টিনের জানালার পাল্লায়। সেই সাথে ধপ করে কেঁপে উঠে দাদীর ভেতরটাও। পরক্ষণেই দূর থেকে অস্পষ্ট ভেসে আসে চৌকিদারের হাঁক, হুঁশিয়ার-সাবধান-খবরদার। সাথে সাথেই যেন হুঁশিয়ার হয়ে যায় দাদী। তারপর ময়নাকে আশ্বস্ত করার জন্য বলে
- জিন-ভুতের চৌদ্দ গোষ্ঠীর সাধ্যি নাই যে চৌকিদারের কোনো ক্ষতি করে।
- ভুতেরা কি চৌকিদারগরে ডরায়?
- না ডরাইলে কি এত রাইত যাইগা এরা গেরাম পর দেয়? খালি এই চৌকিদারগরেই না, সরকারি পোশাক পরইন্যা (পরিহিত) হগল সান্ত্রী, সেপাই, পুলিশগরে তারা (জিন-ভুতেরা) ডরায়।
- ও আইচ্ছা, ভুতেরাও বুঝি সরকার আর সরকারি পোশাকরে মাইন্য কইরা চলে?
জবাবে ছোট্ট করে ‘হু’ বলে আবার শুয়ে পরে দাদী। ময়নাকেও বালিশের ওপর টেনে দিয়ে হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়। মিনিটখানেক পর চোখ জড়িয়ে আসায় থেমে যায় দাদীর সঞ্চালনরত হাত। কিন্তু তখনো কৌতূহল থামেনা ময়নার। জানার আরো বিষয় ছিল তার। মন্তাজ পুতু (চাচা) যে সেদিন বলল ঢাকায় নাকি দু’জন পুলিশ খুন হয়েছে। দাদী জেগে থাকলে জিজ্ঞেস করত এদের খুনি কারা? ভেবে অবাক হচ্ছে ময়না। মানুষ ভয় পায় জিন-ভুতদের। আর তারা ভয় পায় পুলিশদের। যাকে ভুতেরা পর্যন্ত ভয় পায় তাকে খুন করা কিভাবে সম্ভব? তাহলে কি সরকারের চেয়েও এই খুনিদের ক্ষমতা অনেক বেশি?

বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৯, ২০১০

কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসালো সখিনা বুবু

শুকনো খড়িকাঠের জ্বালানি পেয়ে উসকে উঠল চুলার আগুন। সেই সাথে উসকে উঠল চাচীর ক্রোধ। চুলার পাড়ে বসে থাকা জহুর চাচার দিকে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখল ময়না। নাহ, কোনোই বিকার নেই তার। মুখ নিচু করে সরিষাবাটা দিয়ে একের পর এক চিতই পিঠা খেয়েই চলছে। স্ত্রীর মনের ঝাঁজে বিচলিত হওয়া তো দুরের কথা, সরিষার ঝাঁজও কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না তার ওপর। অন্তত চেহারা দেখে তা-ই মনে হচ্ছে ময়নার কাছে। গনগনে আগুনের তাপে লাল হয়ে ওঠা মুখটি আরো লাল হতে লাগল চাচীর।
হাতে থালা নিয়ে চিতই পিঠা খেতে খেতে জহুর চাচাকে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে ময়না। চাচার এমন চুপচাপ বসে থাকাটা মোটেই ভালো লাগছে না তার। আজ হঠাৎ কী হলো যে বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে! বাড়ির সবাই তো ঠিকঠাকই আছ্ েকেউ মারা যায়নি। তা হলে কেনই বা সকালে কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসালো সখিনা বুবু! বুবুর কান্না দেখে বড়ই কষ্ট পেয়েছিল স্ েতা হলে কি মেয়ে কেঁদেছির বলেই জহুর চাচা কষ্ট পেয়েছে? ভেবে কোনো কিনারা করতে পারল না ময়না।
- আরেকটা পিডা(পিঠা) দেও সখিনার মা
- অর্ধসেদ্ধ একটা চিতই পিঠা বিপুল বিক্রমে তুলে দিতে দিতে ঝামটা দিয়ে উঠল চাচী
- খাও। খাওয়া ছাড়া আর কিছুতো পারবা না। কত কইরে কইলাম মাইয়াডারে গার্মেন্ট সে পড়ানোর কাম নাই। ঢাকা শহরে অহন বখাটে পোলারা বেসুমার ঘটনা ঘটাইতাছে।
কোনো কথা বলল না জহুর চাচা। অর্ধসেদ্ধ চিতই পিঠাটি আবার খোলায় রেখে অপেক্ষায় থাকল পূর্ণসেদ্ধ হওয়ার। উত্তর না পেয়ে এবার যেন ক্রোধে ফেটে পড়তে চাইল চাচী। হাতের ছেনিটা খসে পড়ে টুং করে শব্দ তুলল খোলার ওপর। এ শব্দ-ই ধ্যান ভাঙাল চাচার। তারপর যেন স্থির শিলাখন্ড ফেটে বজ্রের আওয়াজ বেরিয়ে এলো....
- আল্লাগো তুমি এই আমার উপরে জুলুম নাজিল করলা কেরে? আমি কী পাপ করছিলাম, আমার মাইয়া কী অন্যায় করেছিল? শিক্ষিত অইয়াও এই কাম কেমনে করল পোলাডা! আগে হুনতাম, ইস্কুল-কলেজে পড়লেই নাকি মানুষ অওয়ন (হওয়া) যায়। ময়নাও শুনেছে শিক্ষাই নাকি মানুষকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলে। কিন্তু সখিনা বুবুর কান্নার সাথে তো এ কথার কোনো মিলই খুঁজে পাচ্ছে না ময়না। দেশেতো এখন অনেক লোকই পড়াশোনা করছে। তা হলে মানুষের এত অভাব কেন? ব্যাপারটা স্পষ্ট হওয়ার জন্য জহুর চাচার কথায় আরো মনযোগী হতে চেষ্টা করল ময়না। কিন্তু ততক্ষণে আবার উদাস হয়ে গেল চাচা। আর শুন্যে ঘুরপাক খেতে থাকা চাচীর চোখ থেকে এক ফে৭াটা পানি গড়িয়ে পড়ল চুলায় বসানো গরম খোলার ওপর। তারপর ময়নার চোখের সামনেই বাষ্প হয়ে উড়ে যেতে লাগল চিতই পিঠা পোড়ার ধোঁয়ার সাথে।

রবিবার, এপ্রিল ১৮, ২০১০

সুতায় টান লাগাইবা


‘‘পারে লয়ে যাও আমায়।
আমি অপার হয়ে বসে আছি
ওহে দয়াময়’’...
বিস্তীর্ণ হাওরের বাতাসে ভেসে দূর থেকে দূরে ছড়িয়ে যাচ্ছে বয়াতির সুরের লহরী। ঢোল, তবলা, বাঁশি, হারমোনিয়াম আর করতালের তালে নেচে উঠছে মেলা প্রাঙ্গণ। আজ শেষ দিন বলে ভিড় একটু বেশি-ই। পিঁপড়ের মতো সারি বেঁধে মানুষ আসছে আর যাচ্ছে। তোতা মিয়াও এসেছে মেয়ে ময়নাকে সাথে নিয়ে।
আজ ময়নার আনন্দের শেষ নেই। সেই সাথে শেষ নেই আবদারেরও। এটা কিনো, ওটা কিনো। বৈশাখের প্রচণ্ড তাপের মধ্যেও সারা দিন ঘুরে ঘুরে পছন্দের জিনিস কিনে বোঝাই করেছে ময়না। দুটো গ্যাস বেলুন কিনতে পেরে খুশি আর ধরে না। বেলুন দুটো সারাক্ষণ আকাশের দিকে উঁকি দিয়েই আছে। ময়নার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে উড়ে যেতে চায় যেন মেঘের রাজ্যে। পুতুল, মাথার রঙিন ফিতা, লাটিম, হাত ভরে পরার জন্য রিনরিনে চুড়ি এসব কিছুই কেনার বাকি নেই ময়নার। গরম জিলেপি, উরহা, তিলুয়া, খেলনা আরো কত কী! আর নাগরদোলায় চড়তে কখনো ভুল করে না সে। অ™ভুত এক ভালো লাগার অনুভূতি রয়েছে এখানে। একবার মনে হয় আকাশে উঠে যাচ্ছে, আবার ফুড়ুৎ করে নেমে যাচ্ছে পাতালে। এভাবে আকাশ-পাতাল বিচরণ করতে বেশ ভালোই লাগে তার। সব মিলিয়ে নির্মল আনন্দের মাঝেই কাটছে ময়নার সময়।
চোখেমুখে উচ্ছ্বাস নিয়ে সে দেখে আকাশে অসংখ্য ঘুড়ির উড়াউড়ি। মেলার এক কোণে চলছে ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতা। রঙ-বেরঙের ঘুড়িগুলো গোত্তা খেয়ে খেয়ে যেন ময়নাকেই কাছে ডাকছে।
-বাপজান আমি গুড্ডির (ঘুড়ির) লগে উড়াল দিয়াম।
-তোর তো পাখির লাহান পাখনা নাইরে মায়া (মা), কেমনে উড়াল দিবি?
-পাখনা লাগবে না বাপজান। আমি গুড্ডির লাহান পাতলা।
হাসল তোতা মিয়া। সত্যিই তো, মেয়েটার মন ঘুড়ির মতোই হালকা।
- উড়তে উড়তে যদি হারায়া যাস্...?
-তুমি আমার লাটাই ধইরা রাখবা। উড়তে উড়তে যদি বাউলা বাতাসে পায়, সুতায় টান লাগাইবা।
মেয়ের এমন ওজনদারী কথায় মোটেই অবাক হলো না তোতা মিয়া। কারণ ময়নার মুখ থেকে এ ধরনের কথা শুনে সে অভ্যস্ত। মেয়েটা তার বড়ই বুদ্ধিমতি। লক্ষ্মীও বটে।
-ঠিকাছে মায়া, তোর খুশিমতো তুই আসমানে উড়বি। ঘুরবি। খেলবি। এবার চল পুতুলনাচ দেখতে যাব।
বলে পা বাড়ালো সামনের দিকে। কিন্তু পরক্ষণেই থমকে যেতে হলো তাদের। হই হই করে ওদের দিকে ভেসে আসছে জনস্রোত। মুহূর্তের মাঝে গুঁড়িয়ে যেতে দেখল পুতুল নাচের পাশের প্যান্ডেলটা। ঘের দেয়া এ প্যান্ডেলের ভেতর-ই চলে টাকার খেলা। তোতা মিয়ার বুঝতে আর বাকি রইলো না, টাকার উত্তাপে তাতিয়ে ওঠা জুয়াড়িদের হট্টগোল এটি।
ধীরে ধীরে হাঙ্গামা ছড়িয়ে যেতে লাগল মেলাজুড়ে। থেমে গেল বয়াতির গলা। সেই সাথে থেমে গেল পুরো মেলার নাচন। মানুষের উদভ্রান্ত ছুটাছুটি আর হইচই কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছে তাদের। তোতা মিয়া ভালো করেই বুঝতে পারল এখানে আর এক মুহূর্তের জন্যও থাকা নিরাপদ নয়। ময়নার হাতটা শক্তভাবে ধরে সরে যেতে লাগল ভিড় থেকে।
তারপর হাঁটতে শুরু করল ফসলের ক্ষেতের বুক চিরে ধুলোওড়া মেঠোপথ ধরে। পেছনে মেলার হট্টগোল। আর সামনে খোলা আকাশ। রোদ পড়ে গেছে। বেড়েছে মেঘের আনাগোনা। সারা দিনের উজ্জ্বলতার পর এখন যেন কান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে আকাশটা। কান্না পাচ্ছে ময়নারও। পুতুল নাচটা দেখে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল ভীষণ। কিন্তু কেন যে হঠাৎ পণ্ড হয়ে গেল সব, তার কিছুই বুঝতে পারল না ময়না। ভাবল, হট্টগোলকারীরা যখন তখন চাইলেই হয়তো সব পণ্ড করে দিতে পারে। এদের সুতায় টান লাগানোর মতো কেউ নেই।

রবিবার, এপ্রিল ০৪, ২০১০

আজ মন্তাজ উদ্দিন বড়ই বিমর্ষ

প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে তিন কি চারদিন যেন তার আসতেই হবে। কোনদিন এক কাপ চা, আবার কোনদিন সাথে একটা টোস্ট বিস্কিটও ভিজিয়ে খায়। আর খেতে খেতে কাউকে সাথে পেলে কিছুক্ষণতো বক বক করবেই। সেই কবেকার বর্ষায় তার ভিটে ভাঙ্গলো, কিভাবে অর্ধাহারে অনাহারে কাটালো, এসব গল্প। শুধু তা-ই নয়, দেশ বিদেশের নানা খবর বয়ে বেড়ায় এই মন্তাজ উদ্দিন। শুনতে বেশ ভালোই লাগে ময়নার।
আজ মন্তাজ উদ্দিন যেনো একটু বিমর্ষ। মুখ নিচু করে নীরবেই কাপে চুমুক দিয়ে যাচ্ছিলো। আহা, কত কষ্টইনা রয়েছে মানুষটার। তার মেয়ে ফজিলা খুন হয় দশ বছর বয়সে। কিন্তু কেউ জানে না কিভাবে খুন হলো । ওর লাশ ভেসে উঠেছিলো ভরা বর্ষার পানিতে। এরপর থেকেই নাকি সে ভবঘুরের মতো হয়ে গেছে । এসব কথা অনেকের মুখেই শুনেছে ময়না। কিন্তু ফুর্তিবাজ এই মানুষটির ভেতরে যে কষ্ট লুকিয়ে থাকতে পারে তা এর আগে বিশ্বাস করতে পারেনি। প্রতিটি চুমুক পর্যবেক্ষণ করতে করতে সে লক্ষ্য করলো চা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে মন্তাজ উদ্দিনের।
- আরেক কাপ চা দেই পুতু (চাচা)? উপযাজক হয়েই প্রস্তাব করল ময়না। এরপর সম্মতির অপেক্ষা না করে আরো এক কাপ চা বানানোর উদ্দেশ্যে গরম পানি ঢালতে শুরু করল সে।
মাঝ বয়সী মানুষটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ তুলল এবার। কিন্তু কোন জবাব না দিয়ে উদভ্রান্তের মত এদিক ওদিক দৃস্টি ঘুরিয়ে বিড় বিড় করে একটি শব্দ উচ্চারণ করল ‘খুন!’। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল ময়নার।
- পত্রিকার পাতায় লাল কালিতে বেসুমার খুনের খবর। বড়ির ভিতরে খুন, রাস্তায় খুন, ই্িসটশনে খুন। সারা দেশের বাতাসে অহন খুনের খবর। এত খুন রুখব কেডা?
এতটুকু বলে দ্বিতীয় কাপটি টেনে নিয়ে আবার চায়ের দিকে মনযোগ দিলো মন্তাজ উদ্দিন।

সোমবার, মার্চ ২৯, ২০১০

ঘড়ির কাঁটায় সময় আঁটা


-কিরে তোর বাবার আর কত সময়? লোকটার প্রশ্নের জবাবে কিছু বললনা ময়না কারণ তারও একই প্রশ্ন, কখন ফিরে আসবে বাবা আর কখনইবা কেরোসিন দিয়ে বিদায় করতে পারবে এই শহুরে দম্পতিকে
খানিকটা অধৈর্য্য হয়ে উঠে দাঁড়ালো মহিলা-বাড়ি চল এবার দোকানি কখন ফিরে আসে কি না আসে তার কোন ঠিক নেই আর কী আশ্চর্য্য গ্রাম-ই বা তোমাদের নেই বিদ্যুৎ, নেই দোকান পাট একটা ঝুপড়ি যা-ও পাওয়া গেল, তাতেও আবার কেরোসিনের টিন খালি!
- অপেক্ষা কর মেয়েটাতো বললোই ওর বাবা কেরোসিন নিয়ে আসছে
- হ্যা, অপেক্ষাতো করছিই তবে এ অপেক্ষার শেষ কি আদৌ হবে?
- কিভাবে আর হবে, ঘড়ির কাঁটা পুনরায় এগিয়ে নেয়ার সিদ্ধন্ত তো সরকার বাতিল করে দিয়েছে যদি আগামী ৩১ তারিখ মধ্য রাত থেকে ডে-লাইট সেভিং সিস্টেম আবার চালু হতো তবে কিছুদিন পর হয়ত আমাদের এই গ্রামের মত বঞ্চিত এলাকাগুলোতেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যেতো তখন আর দু’দিনের জন্য গ্রামে এসে কেরোসিন কিনতে অপেক্ষা করতে হতো না তোমাকে
- তাই নাকি! আগে এক ঘন্টা বিদ্যুৎ না থাকলে আরেক ঘন্টা থাকার নিশ্চয়তা ছিল এখন তাও নেই
দম্পতির দূর্বোধ্য কথাগুলো পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও শংকিত হয়ে উঠল ময়না ভাগ্যিস ওর বাবা ঘড়ি কেনার মতো বোকামি করতে যায়নি
কিছুক্ষন নিরব থেকে আবার কথা শুরু করল মহিলা -সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করায় সরকারকে অভিনন্দন কিন্তু এ সিদ্ধান্তটা ছিল নিজের সাথে প্রতারণা করার মত
- ঘড়ি কি কখনো বন্ধ থাকে? মিনিট, সেকেন্ড আর ঘন্টার কাঁটা নির্দিষ্ট কক্ষপথে ২৪ ঘন্টায় একবার পরিভ্রমণ করে ২০০৯ সালের ১৯ জুন থেকে সরকার যখন কাঁটা একঘন্টা এগিয়ে দিলো, তখন যেমন দিনে একবার পরিভ্রমণ করেছে, ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে আগের অবস্থায় পিছিয়ে দেয়ার পরও একবারই করেছে
- বিভিন্ন উন্নত দেশে ডে-লাইট সেভিং সিস্টেম রয়েছে
- উন্নত বিশ্বের অনুকরণ আমাদের একটা বাজে স্বভাব অনুকরণ কেন করবো কিংবা করলে লাভ না কি তি সে হিসাব না করে সঙ সেজেই বেশি আনন্দ পাই আমরা, অন্তত লোক হাসানো তো যায়
- তাদের কোন ভালো উদাহরণকেও কি গ্রহণ করা যাবেনা?
- এটা আমাদের জন্য মোটেই ভালো উদাহরণ নয় বিষুব রেখার কাছাকাছি দেশ এটি এখানে দিন এবং রাতের দৈর্ঘ্য শীত এবং গ্রীষ্মকালে খুব বেশি বড় এবং ছোট হয়না এছাড়া তাদের জীবণযাত্রা আমাদের মতো নয় পশ্চিমা দেশগলোতে সময় দেখে খায় সময় দেখে ঘুমায় আর আমরা ছয়টার গাড়ি নয়টায় ছাড়ি!
-আমাদের দেশের জনগণকে নতুন নিয়মে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে ঘুম থেকে ওঠে সূর্যের আলো না দেখা পর্যন্ত বিছানা ছাড়া যাবে না এমন অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে
- আর কি কি ত্যাগ করতে হবে শুনি?
-আপাতত বিদ্যুৎ সাশ্রয় করার জন্য যা যা প্রয়োজন
একমুহুর্ত কিছু একটা ভাবলো মহিলা তারপর হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো স্বামীকে -বাড়ি চল, কেরোসিন লাগবেনা এখন থেকে অন্ধকারে থাকার অনুশীলন শুরু করব আমরা প্র্যাকটিস ম্যাকস এ ম্যান পারফেক্ট কারণ, বিদ্যুৎ সাশ্রয় করার জন্য বিদ্যুৎ ব্যবহার করার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে তো!
লোকটা জবাবে যা বলল তা স্পস্ট শুনতে পেলনা ময়না কারণ ততক্ষনে ঝুপড়ি থেকে দূরত্ব অনেকটা বেড়ে গেছে দম্পতির ক্রমেই দৃস্টি থেকে তারা মিলিয়ে যাবার পর সম্বিত ফিরে পেলো সে ভাবল এসব জেনেইবা কী কাজ? ঘড়ির কাঁটা তার জীবনে প্রভাব ফেলেনা সে সুর্য্য দেখে ঘুম থেকে জাগে এবং সুর্য্যাস্ত দেখেই সন্ধ্যাবাতি জ্বালে

সোমবার, মার্চ ০১, ২০১০

স্বাধীনতা দেশে দেশে


স্বাধীনতা। এ শব্দটির মাঝেই নিহিত রয়েছে বাধাহীনতা আর স্বচ্ছন্দতা। প্রতিটি ব্যক্তি যেমন থাকতে চায় মুক্ত তেমনি বৃহৎ ক্ষেত্রে প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। বর্তমানে পৃথিবীতে রয়েছে বহু স্বাধীন দেশ। এগুলোর স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে রয়েছে ইতিহাস। প্রতিটি দেশ স্বাধীন হয়েছে বহু ত্যাগ-তীতিক্ষার পর। আবার বাংলাদেশের মতো অসংখ্য ভ’খন্ড উর্বর হয়েছে স্বাধীনতাকামীদের রক্তেও। কিন্তু তবুও মানুষ শৃঙ্খলিত থাকতে নারাজ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশগুলোর শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার তথ্য নিয়ে লিখেছেন শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ

বাংলাদেশ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। এটি জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিশ্বের তৃতীয় মুসলিম দেশ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সমাপ্তির পর ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশের সৃস্টি হয়। পাকিস্তানের জন্ম হয় দুটি আলাদা আলাদা ভ’খন্ড নিয়ে। একটি পশ্চিম পাকিস্তান এবং অপরটি পূর্ব পাকিস্তান নামে অভিহীত হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের শোষণ, নিপীড়নের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মাঝে ক্ষোভ পুঞ্জিভ’ত হতে থাকে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে দূরত্ব আরো বেড়ে যায়। স্বাধীকারের বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসে সত্তরের নির্বাচন। এতে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও সামরিক জান্তা মতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। এ বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ গভীর রাতে বাংলাদেশের অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেপ্তার করেন এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের অংশ হিসাবে বাঙালিদের উপর নির্বিচারে আক্রমণ শুরু করে। ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়া হয় স্বাধীনতার। সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত হয অস্থায়ী সরকার। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি উসমানীর নেতৃত্বে দেশকে স্বাধীন করতে অস্ত্র হাতে নেমে যায় মুক্তিযোদ্ধারা। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘ ৯ মাস অবিরাম যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান বাহিনীকে পরাভূত করে। মিত্রবাহিনী প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর প্রধান জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী আত্মসমর্পন করেন। এর মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। প্রতি বছর এ দেশে ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস হিসাবে উদযাপন করা হয়।

পাকিস্তান: পাকিস্তান ভারতীয় উপমহাদেশের একটি অংশ। জনসংখ্যার ভিত্তিতে পাকিস্তান বিশ্বের দ্বিতীয় মুসলিম দেশ। বর্তমান পাকিস্তান এলাকাটি ১৫২৬ থেকে ১৮শ শতক পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। ষোড়শ শতক থেকে বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তি ভারত উপমহাদেশে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করতে শুরু করে। পরবর্তীকালে আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোলযোগের সুযোগ নিয়ে তারা এ অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করতেও সম হয়। ১৮৫৬ সালের মধ্যেই এ ভ’খন্ডসহ উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তগত হয়। এরপর এটি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে এলাকাটি পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের পশ্চিম অংশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। দেশের অন্য অংশ পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র বাংলাদেশ গঠন করে।

ভারত: ষোড়শ শতক থেকে পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স ও ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের মতো ইউরোপীয় শক্তিগুলি ভারতে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করতে শুরু করে। পরবর্তীকালে দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোলযোগের সুযোগ নিয়ে তারা ভারতে উপনিবেশ স্থাপন করতেও সম হয়। ১৮৫৬ সালের মধ্যেই ভারতের অধিকাংশ অঞ্চল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তগত হয়। এর এক বছর পরেই ঘটে ভারতীয় সিপাহি ও দেশীয় রাজ্যগুলির সম্মিলিত এক জাতীয় গণ-অভ্যুত্থান। ভারতের ইতিহাসে এই ঘটনা প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বা সিপাহি বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও তা দেশে কোম্পানির শাসনের দুর্বলতার দিকগুলি উন্মোচিত করে দেয়। তাই ভারতকে আনা হয় ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রত্য শাসনাধীনে।
বিংশ শতকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনগুলি দেশজুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। ভারতীয় নেতা মহাত্মা গান্ধী অহিংস গণ-আইন অমান্য জাতীয় আন্দোলন শুরু করেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ সময়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রাম ভারতের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত ব্রিটিশ শাসনজাল থেকে মুক্ত হয়।

শ্রীলংকা: দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ শ্রীলংকা ১৯৭২ সালের আগে সিলন নামে পরিচিত ছিলো। প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীলঙ্কা একটি গুরুত্বপুর্ন সামুদ্রিক সৈকত ও বানিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে বনিকদের কাছে পরিচিত। ১৭৯৬ সালে দ্বীপটি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে যায়। ১৯৩০ সালের দিকে স্থানীয়দের প্রতি ব্রিটিশদের নির্যাতন-অত্যাচারের জন্য স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী সিলন নামে দেশটি স্বাধীনতা পায় যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে।

নেপাল: ধারণা করা হয় হিমালয়ান অঞ্চলে প্রায় ৯০০০ বছর ধরে মানুষের বসতি। ১০০০ খৃস্টপূর্বের দিকে এই অঞ্চলটিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য স্বতন্ত্র রাজ্য ও কনফেডারেশন গড়ে উঠে। এরকমই একটি কনফেডারেশন সাকিয়া। এর রাজা ছিলেন গৌতম বুদ্ধ। পরবর্তী সময়গুলোতে এ অঞ্চল মৌর্য, গুপ্ত, লিকচাভি, নেওয়ারি এবং চালুকাইয়া সাম্রাজ্যের অধীনে ছিলো। নেপাল একীভ’ত হয় ১৭৬৮ সালের ২১ ডিসেম্বর।

মালয়েশিয়া: মালয়েশিয়া ব্রিটিশ শাসনের অধীন ছিলো। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ সরকার মালয়েশিয়াকে স্বায়ত্বশাসন দেবার ঘোষনা করলেও দ্বৈতচাপে বিলম্বিত হয় স্বাধীনতা অর্জন। একদিকে কমিউনিস্টদের সশস্ত্র সংগ্রাম অন্যদিকে স্বাধীনতার জন্য ইউএমএনও’র নেতৃত্বে দৃঢ় অবস্থান গ্রহন। তখন টানা ১২ বছরের কমিউনিষ্টদের সন্ত্রাসী আগ্রাসন ও সারাদেশে জরুরী অবস্থা জনজীবনে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করছিল। অবশেষে ১৯৫৬ সালের ৮ অক্টোবর লন্ডনে টুংকু আবদুর রহমান ও ব্রিটিশ কলুনিয়াল সেক্রেটারী এলান লেনক্সের মাঝে স্বাধীনতার ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে উল্লেখ করা হয় ১৯৫৭ সালের ৩১ আগষ্ট মালয় ফেডারেশন তথা পশ্চিম মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সাবাহ্, সারওয়াক ও ব্রুনাইয়ের একাংশ পূর্ন স্বায়ত্বশাসন লাভ করবে। সে চুক্তি অনুযায়ীই ১৯৫৭ সালের ৩১শে আগষ্ট মালয়েশিয়া ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে পূর্ন স্বাধীনতা লাভ করে। পরবর্তীতে অবশ্য নেতৃত্বের কোন্দলের কারনে লী কিউ উইনের নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর পৃথক হয়ে ভিন্ন রাষ্ট্রে পরিনত হয়।

জাপান: বিশ্বের বুকে একটি প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি জাপান। ৬৬০ খ্রিস্টপূর্বের ১১ ফেব্রুয়ারি জাপান জাতির প্রতিষ্ঠা হয়। তাই এ দিনটিকে তারা জাতীয় প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে পালন করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সম্রাটরা রাষ্ট্রটিকে শাসন করে আসছে। জাপানীদের ধারণা তাদের সম্রাটগণ সূর্যদেবী আমাতেরাসুর বংশধর। দ্বিতীয় বিম্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর ১৯৪৫ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সামরিকভাবে জাপান দখল করে এবং সংশোধিত সংবিধান অনুসারে সম্রাটকে আলংকারিক রাষ্ট্রপ্রধান বানানো হয়। পরবর্তীতে রাহুমুক্ত হয়ে বিশ্বের বুকে একটি প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে জাপানের পুনরুত্থান ঘটে।

চীন: বলা যেতে পারে গণ প্রজাতন্ত্রী চীন হচ্ছে বর্তমান সময়ের একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশ। খ্রীস্টপূর্ব একবিংশ শতাব্দি থেকে খ্রীস্টপূর্ব ষোড়ষ শতাব্দি পর্যন্ত প্রায় ৫০০ বছর চীনে সিয়া রাজবংশ স্থায়ী ছিলো। সিয়া-ই হলো চীনের ইতিহাসের প্রথম রাজবংশ। এরপর বিভিন্ন রাজবংশ চীনকে শাসন করে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর। সে কারণে এ দিনটিকে দেশটির জাতীয় দিবস হিসাবে পালন করা হয়।  ১৯৪৯ সালে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠার পর ১৯৫৪ সালে , ১৯৭৫ সালে , ১৯৭৮ সালে আর ১৯৮২ সালে মোট চারবার এর সংবিধান সংশোধন ও প্রকাশ করা হয়।

ইন্দোনেশিয়া: প্রায় ৫,০০০ দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। ২০শ শতকের প্রথম দশকে ইন্দোনেশীয়া স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে তা ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিন বছর জাপানিরা ইন্দোনেশিয়া দখল করে। দেশটি তখন নেদারল্যান্ডের অধীনে ছিলো। ১৯৪৫ সালের ১৭ই আগস্ট মিত্রশক্তির হাতে জাপানের আত্মসমর্পনের তিন দিন পর সুকর্ণ এবং মোহাম্মাদ আতার নেতৃত্বে একটি ুদ্র দল ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

আফগানিস্তান: ১৭৪৭ সালে আহমদ শাহ দুররানি কান্দাহার শহরকে রাজধানী করে এখানে দুররানি সাম্রাজ্যের শুরু করেন। তখন থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান একটি রাজতন্ত্র ছিল। এরই মাঝে দেশের রাজধানী কান্দাহার থেকে কাবুলে স্থানান্তরিত হয় এবং দেশটি প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর কাছে অনেক অঞ্চল হারায়। ১৯ শতকে আফগানিস্তান ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য ও রুশ সাম্রাজ্যের মধ্যে এক বিরাট খেলার মধ্যবর্তী ক্রীড়নক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯৭৩ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে সামরিক অফিসারেরা রাজার পতন ঘটান এবং একটি প্রজাতন্ত্র গঠন করেন। ১৯১৯ সালের ১৯ আগস্ট তৃতীয় ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধশেষে আফগানিস্তান যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে।

উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া: অবিভক্ত কোরিয়া মূলত জাপানিদের দখলে ছিল। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাবার সময় জাপানিরা সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ফলে আদর্শগত কারণে অবিভক্ত কোরিয়া ২ ভাগে ভাগ হয়ে যায়। উত্তর কোরিয়া সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের মতাদর্শে সমাজতান্ত্রিক ব্লকে চলে যায়, অন্যদিকে দণি কোরিয়া পুঁজিবাদি আমেরিকার মতাদর্শে পুঁজিবাদি ব্লকে যোগ দেয়। ১৯৪৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়ার এবং ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাধীনতা দিবস।

যুক্তরাষ্ট্র: আমেরিকার আদিম অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ানরা সম্ভবত এশীয় বংশোদ্ভুত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে এরা কয়েক হাজার বছর ধরে বসবাস করছে। প্রাথমিক পর্যায়ে আটলান্টিক মহাসাগর তীরস্থ উত্তর আমেরিকার তেরোটি ব্রিটিশ উপনিবেশ নিয়ে গঠিত হযয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই এই উপনিবেশগুলি একটি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করে। এর মাধ্যমে উপনিবেশগুলি তাঁদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ঘোষণা করে এবং একটি সমবায় সংঘের প্রতিষ্ঠা করে। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে এই বিদ্রোহী রাজ্যগুলি গ্রেট ব্রিটেনকে পরাস্ত করে। এই যুদ্ধ ছিল ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসে প্রথম সফল স্বাধীনতা যুদ্ধ। ১৭৮৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ক্যালিফোর্নিয়া কনভেনশন বর্তমান মার্কিন সংবিধানটি গ্রহণ করে। পরের বছর এই সংবিধান স্বারিত হলে যুক্তরাষ্ট্র একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারসহ একক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।

কানাডা: ১৮৬৭ সালের ১ জুলাই কানাডা স্বাধীনতা লাভ করে চারটি রাজ্য নিয়ে। এ রাজ্য চারটি হলো অনতারিও, কুইবেক, নোভা স্কটিয়া এবং নিউ ব্রান্সউইক।
১৫তম শতকের শুরুতে ইংরেজ এবং ফরাসি অভিযাত্রীরা আটলান্টিক উপকূল আবিষ্কার করে এবং পরে বসতি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ফ্রান্স দীর্ঘ সাত বছরের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলস্বরূপ ১৭৬৩ সালে উত্তর আমেরিকায় তাদের সব উপনিবেস ইংরেজদের কাছে ছেডে দেয়। ১৮৬৭ সালের ১ জুলাই মৈত্রিতার মধ্য দিয়ে চারটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ নিয়ে দেশ হিসেবে কানাডা গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে জারীকৃত কানাডা অ্যাক্ট অনুসারে দেশটি সংসদীয় গণতন্ত্র এবং আইনগত রাজ্যতন্ত্র উভয়ই মেনে চলে।

যুক্তরাজ্য: যুক্তরাজ্য আজন্ম একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বের এক চতুর্থাংশ এলাকা ও জনগণ ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো। বর্তমানে এদের বেশিরভাগই স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও অনেকগুলিই ব্রিটিশ আইন, প্রতিষ্ঠান এবং রীতিনীতি ধরে রেখেছে। এমনকি বিশ্বের যেসব এলাকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল না, সেখানেও অনেক দেশে ব্রিটিশ সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছিলো বিশ্বের ইতিহাসের বৃহত্তম সাম্রাজ্য। বর্তমান ভৌগোলিক কাঠামো নিয়ে মূল যুক্তরাজ্যের গঠন ১৭০৭ সালের ১ মে। আর ১৮০১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আয়ারল্যান্ড দেশটির অন্তর্ভূক্ত হয়। যুক্তরাজ্য অনেকগুলো দ্বীপ নিয়ে গঠিত। দ্বীপগুলোকে একত্রে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ নামে অভিহিত করা হয়। এছাড়াও বৃটিশ সাম্রাজ্যকালীন সময়ে দখলকৃত ১৪টি বাইরের এলাকা এখনও যুক্তরাজ্যের অধীনে রয়েছে।

রাশিয়া: ১৪শ ও ১৫শ শতকে একটি শক্তিশালী রুশ রাষ্ট্র গঠিত হতে থাকে মস্কোকে ঘিরে। রাশিয়া বিশ্বের বুকে একটি বিরাট শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয় সম্রাট পিটারের সময়। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবে বলশেভিকরা রুশ রাজবংশের পতন ঘটায়। ১৯২২ সালে বলশেভিকেরা বিশ্বের প্রথম সাম্যবাদী রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করে। ১৯২২ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত রাশিয়া ছিল সোভিয়েত রাষ্ট্রকুঞ্জের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র। অনেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে রাশিয়া নামে চিনলেও মূলত রাশিয়া ছিল এর ১৫টি অংশের একটি। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে রাশিয়া মুক্ত বাজার ও গণতন্ত্রকে স্বাগত জানায়। ১৯৯০ সালের ১২ জুন রাশিয়ার নতুন ফরমেশন হওয়ায় এ দিনটিকে রাশিয়া দিবস হিসাবে উদযাপন করা হয়।

ফ্র্যান্স: বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে একটি হলো ফ্র্যান্স। প্রাচীনকালে ফ্র্যান্স অঞ্চল কেল্টীয় গল নামে পরিচিত ছিল। প্রাচীন রোমানরা খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকে অঞ্চলটির দখল নেয় এবং খ্রিস্টীয় ৫ম শতকে রোমান সাম্রাজ্যের পতন হওয়ার আগ পর্যন্ত শাসন করে। পরবর্তীতে অনেকগুলি রাজবংশ ধারাবাহিকভাবে ফ্রান্স শাসন করে। ৮৪৩ সালে ভ্যরদাঁর চুক্তির মাধ্যমে ডিউক ও রাজপুত্রদের রাজ্যগুলি একত্রিত হয়ে একটিমাত্র শাসকের অধীনে এসে ফরাসি রাষ্ট্র গঠন করে। মধ্যযুগে রাজতন্ত্রের প্রভাব কমে এলেও ১৪শ থেকে ১৮শ শতক ধরে আবার এর উত্থান হয়। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং এর পর বহু দশক ধরে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত হয়। বর্তমানে ফ্র্যান্স এর পঞ্চম প্রজাতন্ত্র পর্যায়ে রয়েছে। ১৯৫৮ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর এ প্রজাতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়।

জার্মানি: জার্মানি ১৬টি রাজ্য নিয়ে গঠিত একটি ফেডারেল ইউনিয়ন। ১৮৭১ সালের আগে এটি কোন একক রাষ্ট্র ছিল না। ১৮১৫ থেকে ১৮৬৭ পর্যন্ত জার্মানি একটি কনফেডারেসি এবং ১৮০৬ সালের আগে এটি অনেকগুলি স্বতন্ত্র রাজ্যের সমষ্টি ছিল। ১৯ শতকের শুরুতে ফ্র্যান্সের দখলদারিত্বের কারণে ১৮১৫ সালে প্রাশিয়ার নেতৃত্বে জার্মান রাষ্ট্রগুলি একটি কনফেডারেশন গঠন করে, যা ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। পরবর্তীতে ১৮৭১ সালের ১৮ জানুয়ারি রাষ্ট্রগুলো একত্রিত হয়ে জার্মান সাম্রাজ্য গঠন করে। ১৯৪০ এর দশকের শেষ দিকে জার্মানির সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলটি পূর্ব জার্মানিতে পরিণত হয়। পশ্চিম নিয়ন্ত্রিত বাকি তিন অঞ্চল একত্রিত হয়ে পশ্চিম জার্মানি গঠন করে। জার্মানির ঐতিহাসিক রাজধানী বার্লিন পূর্ব জার্মানির অনেক ভেতরে থাকলেও এটিকে দুই দেশ ভাগ করে নেয়। ১৯৬১ সালে পূর্ব জার্মানি সরকার বার্লিনে একটি প্রাচীর তুলে দেয়। পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনের বাসিন্দারা বার্লিন প্রাচীর ভেঙে ফেলে। এই ঘটনাটিকে পূর্ব ইউরোপে সাম্যবাদের পতন ও জার্মানির পুনঃএকত্রীকরণের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর দুই জার্মানি একত্রিত হয়ে জার্মান ফেডারেল প্রজাতন্ত্র গঠন করে।

সৌদি আরব: মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম রাষ্ট্র সৌদি আরব। এখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ (সা.)। সৌদি আরবের বুকেই অবস্থিত পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু পবিত্র ক্বাবা শরীফ। এ ভ’খন্ডটির সংস্কৃতি ও ইতিহাস দীর্ঘ। তবে বর্তমান রাষ্ট্র সৌদি আরব যে আয়তন নিয়ে গঠিত তা আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষিত হয় ১৯২৬ সালের ৮ জানুয়ারি। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এর একত্রিকরণ হয়। এদেশের শাসনকারী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজ আল সাউদের নামানুসারে সৌদি আরব নামকরণ করা হয়েছে।

মিশর: নীল নদের দেশ মিশর প্রায় ৩২০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকেই একটি সংহত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিদ্যমান। ৬৪১ সাল থেকে দেশটি মুসলিম ও আরব বিশ্বের একটি অংশ। ১৮৮২ সালে ব্রিটিশ সেনারা মিশর দখল করার পর প্রায় ৪০ বছর এ ভ’খন্ড তাদের উপনিবেশ ছিল। ১৯২২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দেশটি একটি রাজতন্ত্র হিসেবে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু তবুও ব্রিটিশ সৈন্যরা থেকে যায় মিশরে। ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই জামাল আবদেল নাসের-এর নেতৃত্বে একদল সামরিক অফিসার রাজতন্ত্র উৎখাত করে প্রজাতন্ত্র হিসেবে মিশর প্রতিষ্ঠা করে। সে কারণেই ২৩ জুলাইকে মিশরের জাতীয় দিবস হিসাবে উদযাপন করা হয়। মিশরকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয় ১৯৫৩ সালের ১৮ জুন। নাসের ১৯৫৬ সালের মধ্যে দেশ থেকে সমস্ত ব্রিটিশ সেনাকে সরিয়ে দেন।

ব্রাজিল: ভ’-প্রাকৃতিক বৈচিত্রে পূর্ণ ব্রাজিল ১৫০০ থেকে ১৮২২ সাল পর্যন্তএকটি পর্তুগিজ উপনিবেশ ছিল। ১৮২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করে। দণি আমেরিকার অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় অনেক শান্তিপূর্ণভাবে উপনিবেশ থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ব্রাজিলের উত্তরণ ঘটে। এসময় দেশে কোন রক্তপাত বা অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটেনি।



আলবেনিয়া: ১৯১২ সালের ২৮ নভেম্বর স্বাধীনতা অর্জন করে। আলবেনিয়ার স্বাধীনতা ছিলো দীর্ঘ ৫ শতকের অটোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তির একটি সতর্ক সংকেত।
আলজেরিয়া: ১৯৬২ সালের ৫ জুলাই স্বাধীনতা লাভ করে ফ্রান্সের কাছ থেকে।
অ্যান্ডোরা: ১৯৯৩ সালের ১৪ মার্চ স্বাধীনতা লাভ করে ফ্রান্স এবং স্পেনের কাছ থেকে।
অ্যাঙ্গোলা: ১৯৭৫ সালের ১১ নভেম্বর পর্তুগাল তার সাবেক উপনিবেশ ত্যাগ করে স্বাধীন করে দেয় অ্যাঙ্গোলাকে।
অ্যান্টিগুয়া ও বারবুদা: ১৯৮১ সালের ১ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
আর্জেন্টিনা: ১৮১৬ সালের ৯ জুলাই স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
আর্মেনিয়া: ১৯৯১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
অস্ট্রিয়া: ১৯৫৫ সালের ১৫ মে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
আজারবাইজান: ১৯৯১ সালের ১৮ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
বাহামা: ১৯৭৩ সালের ১০ জুলাই যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
বাহরাইন: ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
বারবাদোস: ১৯৬৬ সালের ৩০ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
বেলারুস: ১৯৯১ সালের ২৭ জুলাই বেলারুশের আইনসভা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে দেশটির সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে এবং ২৫ আগস্ট স্বাধীন হিসাবে স্বীকৃতি পায়।
বেলজিয়াম: ১৮৩০ সালের ৪ অক্টোবর স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। আর স্বীকৃতি পায় ১৮৩৯ সালের ১৯ এপ্রিল।
বেলিজ: ১৯৮১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
বেনিন: ১৯৬০ সালের ১ আগস্ট ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
বলিভিয়া: ১৮২৫ সালের ৬ আগস্ট স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
বসনিয়া ও হার্জেগোভেনিয়া: ১৯৯২ সালে ইউগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
বোতসোয়ানা: ১৯৬৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
ব্রাজিল: ১৮২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পর্তুগাল থেকে ব্রাজিলকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করেন পর্তুগালের রাজপুত্র ডম পেডরো। কিন্তু ১৮২৫ সালের ২৯ আগস্ট পর্যন্ত ব্রাজিলের কোন স্বতন্ত্র আইন ছিলোনা।
ব্রুনাই: ১৯৮৪ সালের ১ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
বুলগেরিয়া: ১৯০৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর অটোমান সম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
বারকিনা ফ্যাঁসো: ১৯৬০ সালের ৫ আগস্ট ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
বুরুন্ডি: ১৯৬২ সালের ১ জুলাই বেলজিয়ামের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
ক্যাপভার্দে দ্বীপপুঞ্জ: ১৯৭৫ সালের ৫ জুলাই পর্তুগাল থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
চাদ: ১৯৬০ সালের ১১ আগস্ট ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
চিলি: ১৮১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি স্পেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
কলম্বিয়া: ১৮১০ সালের ২০ জুলাই এবং ৭ আগস্ট স্পেন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে।
গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো: ১৯৬০ সালের ৩০ জুন ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
কোষ্টারিকা: ১৮২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর স্পেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
ক্রোয়েশিয়া: ১৯৯১ সালের ৮ অক্টোবর ইউগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
সাইপ্রাস: ১৯৬০ সালের ১৬ আগস্ট যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু ১ অক্টোবরকে স্বাধীনতা দিবস হিসাবে উদযাপন করা হয়।
চেক প্রজাতন্ত্র: ১৯১৮ সালের ২৮ অক্টোবর অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি থেকে স্বাধীনতা লাভ করে চেকোস্লোভাকিয়া। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লোভাকিয়া বিভক্ত হয়ে যায়।
ডোমেনিকান প্রজাতন্ত্র: ১৮৪৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি হাইতি থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
পশ্চিম তিমুর: ২০০২ সালের ২০ মে ইন্দোনেশিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
ইকুয়েডর: ১৮২২ সালের ২৪ মে স্পেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
আল সালভাদোর: ১৮২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর স্পেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
ইরিত্রিয়া: ১৯৯৩ সালের ২৪ মে ইথিউপিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
এস্তোনেশিয়া: ১৯১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বলসেভিস্ট রাশিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
ফিনল্যান্ড: ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর রাশিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
গাম্বিয়া: ১৯১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
জর্জিয়া: ১৯১৮ সালের ২৬ মে রাশিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
ঘানা: ১৯৫৭ সালের ৬ মার্চ যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
গ্রিস: ১৮২১ সালের ২৫ মার্চ অটোমান সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়।
গুয়াতেমালা: ১৮২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর স্পেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
গায়ানা: ১৯৬৬ সালের ২৬ মার্চ যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
হাইতি: ১৮০৪ সালের ১ জানুয়ারি ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
হুন্ডুরাস: ১৮২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর স্পেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
আইসল্যান্ড: ১৯৪৪ সালের ১৭ জুন ডেনমার্ক থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
ইন্দোনেশিয়া: ১৯৪৫ সালের ১৭ আগস্ট নেদারল্যান্ড থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু তা স্বীকৃতি পায় ১৯৪৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর।
ইসরাইল: মধ্যপ্রাচ্যের এ সংস্থাটি ১৯৪৮ সালের ১৪ মে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। যাকে বিশ্বের অনেক দেশ রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং অনেক দেশ দেয়নি।
জ্যামাইকা: ১৯৬২ সালের ৬ আগস্ট যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
জর্ডান: ১৯৪৬ সালের ২৫ মে যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
কাজাকিস্তান: ১৯৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
কেনিয়া: ১৯৬৩ সালের ১২ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীন হয়।
উত্তর কোরিয়া: ১৯৪৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়ার স্বাধীনতা দিবস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে অবিভক্ত কোরিয়া ছিলো জাপানিদের দখলে।
দণি কোরিয়া: ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জাপান থেকে স্বাধীন হয়।
কুয়েত: ১৯৬১ সালের ২৬ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
কিরগিজিস্তান: ১৯৯১ সালের ৩১ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হয়।
লাতভিয়া: ১৯১৮ সালের ১৮ নভেম্বর রাশিয়া থেকে স্বাধীন হয়।
লেবানন: ১৯৪৩ সালের ২২ নভেম্বর ফ্রান্স থেকে স্বাধীন হয়।
লিসোথো: ১৯৬৬ সালের ৪ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
লাইবেরিয়া: ১৮৪৭ সালের ২৬ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বাধীন হয়।
লিথুয়ানিয়া: রাশিয়া এবং জার্মানি থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ১৯১৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৯০ সালের ১১ মার্চ।
মাদাগাস্কার: ১৯৯০ সালের ২৬ জুন ফ্র্যান্স থেকে স্বাধীন হয়।
মালাউই: ১৯৬৪ সালের ৬ জুলাই যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
মালদ্বীপ: ১৯৬৫ সালের ২৬ জুলাই যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
মালি: ১৯৬০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ফ্র্যান্সের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
মাল্টা: ১৯৬৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
মরিশাস: ১৯৬৮ সালের ১২ মার্চ যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
ম্যাক্সিকো: স্পেন থেকে স্বাধীন হয় ১৮১০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। কিন্তু স্বাধীন দেশ হিসাবে পরিচিতি পায় ১৮২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর।
মালডোভা: ১৯৯১ সালের ২৭ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হয়।
মঙ্গোলিয়া: চীন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ১৯২১ সালের ১১ জুলাই।
মন্টিনিগ্রো: ২০০৬ সালের ২১ মে সার্বিয়া থেকে স্বাধীন হয়।
মরক্কো: ১৯৫৬ সালের ২ মার্চ স্পেন এবং ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
মোজাম্বিক: ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন পর্তুগাল থেকে স্বাধীন হয়।
মায়ানমার: ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
নামিবিয়া: ১৯৯০ সালের ২১ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে স্বাধীন হয়।
নিকারগুয়া: ১৮২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর স্পেন থেকে স্বাধীন হয়।
নাইজার: ১৯৬০ সালের ৩ আগস্ট ফ্র্যান্স থেকে স্বাধীন হয়।
নাইজেরিয়া: ১৯৬০ সালের ১ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
নরওয়ে: ১৯০৫ সালের ১৭ মে সুইডেন থেকে স্বাধীন হয়।
পানামা: ১৮২১ সালের ২৮ নভেম্বর স্পেন থেকে স্বাধীন হয়।
পাপুয়া নিউ গিনি: ১৯৭৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়া থেকে স্বাধীন হয়।
প্যারাগুয়ে: ১৮১১ সালের ১৫ মে স্পেন থেকে স্বাধীন হয়।
পেরু: ১৮২১ সালের ২৮ জুলাই স্পেন থেকে স্বাধীন হয়।
ফিলিপাইন: ১৮৯৮ সালের ১২ জুন স্পেন থেকে স্বাধীন হয়। ১৯৪৬ সালের ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বাধীনতার অনুমোদন দেয়া হয়। এ দিনটি ফিলিপাইনি আমেরিকান বন্ধুত্বের দিন হিসাবে পরিচিত।
পোল্যান্ড: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে পোল্যান্ড।
পর্তুগাল: ১৬৪০ সালের ১ ডিসেম্বর স্পেন থেকে স্বাধীন হয়।
কাতার: ১৯৭১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
আয়ারল্যান্ড: ১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীন হয়।
মেসিডোনিয়া: ১৯৯১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ইউগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীন হয়।
রোমানিয়া: ১৮৭৭ সালের ৯ মে অটোমান সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
রুয়ান্ডা: ১৯৬২ সালের ১ জুলাই বেলজিয়াম থেকে স্বাধীন হয়।
সাঁউ টম অ্যান্ড প্রিন্সিপি: ১৯৭৫ সালের ১২ জুলাই পর্তুগাল থেকে স্বাধীন হয়।
সারবিয়া: ১৮০৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অটোমান সাম্রাজ্যের বিপরীতে সারবিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়।
সিসিলিস: ১৯৭৬ সালের ২৯ জুন যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
সিয়েরা লিওন: ১৯৬১ সালের ২৭ এপ্রিল যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
সিঙ্গাপুর: ১৯৬৫ সালের ৯ আগস্ট মালয়েশিয়া থেকে পৃথক হয়।
স্লোভাকিয়া: ১৯১৮ সালের ২৮ অক্টোবর অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি থেকে স্বাধীনতা লাভ করে চেকোস্লোভাকিয়া । ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি চেকোস্লোভাকিয়া চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়ায় বিভক্ত হয়ে যায়।
স্লোভানিয়া: ১৯৯০ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইউগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীন হয়।
দণি আফ্রিকা: ১৯৩১ সালের ১১ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
সুরিনাম: ১৯৭৫ সালের ২৫ নভেম্বর নেদারল্যান্ড থেকে স্বাধীন হয়।
সোয়াজিল্যান্ড: ১৯৬৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
সুইজারল্যান্ড: ১২৯১ সালের ১ আগস্ট রোমান সাম্রাজ্যের বিপরীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর ফেডারেল স্টেট হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায় ১৮৪৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর।
তাজিকিস্তান: ১৯৯১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
তানজানিয়া: ১৯৬১ সালের ৯ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
ত্রিনিদাদ ও টোবাগো: ১৯৬২ সালের ৩১ আগস্ট যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
টোঙ্গা: ১৯৭০ সালের ৪ জুন যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
তিউনেশিয়া: ১৯৫৬ সালের ২০ মার্চ ২০ ফ্র্যান্স থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা লাভ করে।
ইউক্রেইন: ১৯৯১ সালের ২৪ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
সংযুক্ত আবর আমিরাত: ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
যুক্তরাষ্ট্র: ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই কিংডম অব গ্রেট ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
উরুগুয়ে: ১৮২৫ সালের ২৫ আগস্ট ব্রাজিল থেকে স্বাধীন হয়।
উজবেকিস্তান: ১৯৯১ সালের ১ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হয়।
ভ্যাটিকান সিটি: ১৯২৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইতালির সাথে লাতেরান চুক্তির অধীনে ভ্যাটিকান সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বের সবচেয়ে ুদ্রতম এই রাষ্ট্রটি রোম শহরের ভেতরে অবস্থিত স্বাধীন রাষ্ট্র।
ভেনিজয়েলা: ১৯৪৫ সালের ৫ জুলাই স্পেন থেকে স্বাধীন হয়।
ভিয়েতনাম: ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর ফ্র্যান্স থেকে স্বাধীন হয়।
ইয়েমেন: ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
জাম্বিয়া: ১৯৬৪ সালের ২৪ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
জিম্বাবুয়ে: ১৯৮০ সালের ১৮ এপ্রিল যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।