শনিবার, জুলাই ১৭, ২০১০

পানি আবার কিনে খায় কিভাবে!

মোটরসাইকেলটা শাহজাহান আলীর কাছে এক স্বপ্নের যান। সারাদিনই যন্ত্রটার পিঠে চড়ে ভট ভট শব্দ তুলে ঘুরে বেড়ায় এখানে-সেখানে। কোনো কাজটাজের উদ্দেশ্যে যে তা নয়, ড্রাইভিংটা ভালো করে রপ্ত করা আর এই ফাঁকে মোটর সাইকেলের আভিজাত্য দেখিয়ে বেড়ানো আর কি! আগামী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়ার দাবি জানিয়ে নাকি গাঙ্গাটিয়া গ্রামের জনগণ তাকে সেকেন্ড হ্যান্ড এ বাহনটি উপহার দিয়েছে। কিন্তু ময়নার কাছে ভিন্ন খবর- কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করার শর্তে দশ বছরের ব্যবহৃত এ মোটরসাইকেলটি কিনে এনেছে শাহজাহান আলী। পুরনো হলে কি হবে, এর পিঠে চড়ার স্বাদ অমৃতসম। এমন কথা শাহজাহান আলীর মুখে শুনলেও ততটা বিশ্বাস করতে পারছে না ময়না। কারণ স্থান-কাল পাত্র বিবেচনা না করেই ভুঁ-ভুঁও-ভুঁওওওওক্ করে যন্ত্রটার স্টার্ট বন্ধ হয়ে যেতে দেখে সে। এতে অবশ্য এর মালিকের উৎসাহে কোনো ভাটা পরতে দেখা যায় না । এই ধরা যাক এখনকার কথাই, কাঁদা-পানিতে জ্যাম হয়ে যাওয়া মোটরসাইকেলটিকে ঠেলে নিয়ে যেভাবে এগিয়ে আসছে ওদের দোকানের দিকে, তাতে মনে হচ্ছে মহাপরাক্রমশালী কোনো দৈত্যের সাথে সম্মুখ সমরে সে এক বিজয়ী বীর।
- ময়নারে, তোতা মিয়া কই?
হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল শাহজাহান আলী
- বাপজান বাড়ির বিতরে আছে।
- ডাক দিয়া ক-অ আমি আইছি। আর আমার লাগি এক কাপ চা বানা
- বাপজন, শারজাহান পুতু ((শাহজাহান চাচা) তোমারে ডাকতাছে।
ময়নার ডাক শেষ হওয়ার আগেই ওদের দোকান আর ভেতর বাড়ির সংযোগের দরজাটি খোলে গেল। কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে অলস ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলো তোতা মিয়া
- আরে শারজাহান বাইছা (ভাই সাহেব) কইত্তে?
- বাজারেত্তে আইলাম আরহি, যানডা একবারে বাইরইয়া যাইতাছে। চিন্তা করলাম তর দোহানের এক কাপ চা খাইয়া যাই। একটু জিরানিও অইল আর তর লগে দুইডা আলাপ-অ অইল।
বলতে বলতে মোটরসাইকেলটাকে সমতল জায়গায় দাঁড় করিয়ে ধপ করে বেঞ্চিতে বসে পরল শাহজাহান আলী। তারপর মুখের হাসি অটুট রেখেই পরম মমতায় তাকিয়ে থাকল ওটার দিকে। মমতা ঝারলো তোতা মিয়াও
- প্যাক-কাঁদায় দেহি আপনের গাড়িডা মারা লাইগ্যা (একাকার হয়ে) গেছে।
- মারা লাগদনা! রাস্তাডার অবস্তা কী, দেখছস নি?
- বালা কতা মন-অ করছ-অ বাইছা, রাস্তাডা ঠিক করনের লাইগ্যা কোন সেঙশন (অনুদান) পাইছনি?
- আর কইছনা। এই রাস্তার লাইগ্যাইতো হেদিন ডাহা (ঢাকা) গেছিলাম এমপি সাবের লগে দেহা করতে।
- পরে এমপি সাব কী কইল?
- দেহা আর করতে পারলাম কই, ডাহা শহর-অ গাড়ি-গোড়ার জামের (জ্যাম) লাইগ্যা চলুন যায় নাকি? দেহা করার কতা আছিন এগারডার সময়, এমপি সাবের বাসাত গিয়া উঠলাম বারডা বত্রিশ মিনিডে। গিয়া দেহি ওনি বাসাত্তে বাইরইয়া গেছে গা।
- তুমি ইকটু আগে রওনা দিলেই পারতা।
- আগেই রওনা দিছিলাম। তারপরেও দেরি। ডাহা শহরের জামের কি কোন ঠিক-ঠিকানা আছে? একবার আটকাইয়া থাকলে আর ছারুনের নাম নাই। ঘন্টার পরে ঘন্টা ঠাডাপুড়া রইদের (প্রখর রোদের) মইদ্যে গাড়িগুলাইন খারইয়া থাহে, আর ডাইবার, প্যসেঞ্জার সবাইর মথার চান্দি গরম অইয়া যায়। আর এই গরম চান্দি লইয়া, কেউ কেউরে সইহ্য করত পারেনা। একটু হেত-ভেত (এদিক-সেদিক) অইলেই লাইগ্যা দেয় কাইজ্জা।
- আমি বুইজ্জা পাইনা, এই শহরের মানুষ বাঁচে কেমনে! নাই গাছ, নাই গাঙ, নাই পানি। শ্বাস ফালাইবার জায়গাডা পর্যন্ত নাই। খালি দালান আর দালান, গাড়ি আর গাড়ি। আমরার গেরাম অই বালা।
- খালি এইগুলা অইলে ত-অ বালাই আছিন। পানি পর্যন্ত কিইন্যা খাওন লাগে। হেদিন পত্রিকার মাইদ্যে লেকছে পানির অভাবে নাকি ডাহা শহর মাডির নিচে ডাইব্বা যাইবগা।
শিউরে উঠল ময়না। এ আবার কেমন শহর, পানি আবার কিনে খায় কিভাবে! ভারি অবাক মেয়েটি। পিপাসায় গলা শুকিয়ে আসে তার। ঢক ঢক করে এক জগ পানি গলায় ঢেলে স্থির হতে চেস্টা করলো। কিন্তু পারলনা। এমন কথা শুনলে স্থির হতে পারার কথাওনা। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। এই শহরেই থাকে মন্ত্রী-এমপিসহ বড় বড় লোকেরা। এদেরকেসহ যদি ঢাকা মাটির নিচে দেবেই যায়, তবে দেশ চালাবে কে? আর এই শহরের সাধারণ মানুষগুলারই বা কী অবস্থা হবে? জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হলো ময়নার। কিন্তু ততক্ষণে শাহজাহান আলী বেঞ্চি থেকে উঠে গিয়ে শখের বাহন পরিস্কারে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। লম্বা একটি কাঠি দিয়ে দুই চাকার ভেতর আটকে থাকা দলা দলা কাঁদা বের করে নিয়ে আসছে। এতে অবশ্য সামান্য ধকল যাচ্ছে তার উপর। কিন্তু বসবাসের অনুপযোগী ঢাকার পথের চেয়ে গ্রামের এই কাঁদায় ভরা মেঠো পথে শখের বাহন তাড়িয়ে বেড়ানোতেই হয়তো অনেক প্রশান্তি, ভাবল ময়না।
২৭ জুন ২০১০

কোন মন্তব্য নেই: