মঙ্গলবার, আগস্ট ৩১, ২০১০

ছুটির বিড়ম্বনা

হুরমুর করে আরো একগাদা লোক আছড়ে পড়ল বাসের উপর। তিল ধারণের জায়গাটুকু পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই। কিন্তু তবুও ঠেলে-ঠুলে ঠিকই ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে লোকগুলো। কেউ ঝুলে আছে দরজায়। আবার কেউবা উঠে যাচ্ছে ছাদে। ছাদ থেকে কয়েকজনের পা জানালার দিকে ঝুলে থাকতে দেখলো ময়না। ভাগ্যিস আগে আগে ওরা টিকেট কেটে সিটে বসতে পেরেছিলো। নাহয় ওদেরকেও হয়তো এভাবেই যেতে হতো। অবশ্য সিট না পেলে দাঁড়িয়ে যেতে রাজি হতেন না বাবা। শহরে যাবার পথেই যে এত ঝামেলা পোহাতে হবে তা ধারণাও করতে পারেনি সে। এমন জানলে কেনাকাটা করার জন্য বাবার সাথে আসার বায়না ধরতো না ময়না।
মুড়ির টিনের মতো বাসটি ঘট ঘট ঘট শব্দ তুলে এগুচ্ছে গরুর গাড়ির গতিতে। বেশি প্যাসেঞ্জার বোঝাই করেছে বলে নয়, এ বাসগুলোর প্রকৃতিই এমন। মাত্র ষোল কিলোমিটার দূরত্বের এ পথটুকু পাড়ি দিতে এক থেকে দেড় ঘন্টার মতো লেগে যায়। কারণ একটু পর পর থামরে, প্যাসেঞ্জার তোলরে, স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেলে ঠেলে ঠুলে স্টার্ট তুলরে ইত্যাদি আরকি। এখন মনে হচ্ছে রিকসায় গেলেই ভালো হতো। কিন্তু রিকসা যা ভাড়া চাইল তা শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো ওদের। ঈদের মৌসুমে ভাড়া তিন থেকে চারগুন হয়ে যায় কেন তা বুঝে আসছে না ময়নার।
ওহ্, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। বাসের গোমোট পরিবেশে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বাবা অবশ্য জানালার পাশের সিটেই বসিয়েছেন তাকে। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন বাবার গায়ের উপর যেভাবে হেলে পরছে, তাতে বাবাও খানিকটা চেপে বসেছেন ময়নার দিকে। লোকজনের ঘামের বোঁটকা গন্ধে পেট গুলিয়ে আসছে। ক্ষনে ক্ষনে উথলিয়ে উঠতে চাচ্ছে বমি। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে জানালার কাঁচ খুলে দিয়েছেন বাবা। এতে বাইরে থেকে বাতাস ঢোকছে বটে, সেই সাথে ঢোকছে ধুলো। মুহুর্তের মাঝেই ধুলোময় হয়ে গেল ময়না। ভেতর থেকে খ্যাট খ্যাট করে উঠলো কয়েকজন লোক
- এ্যাই ভাই জানালা খুলছুইন কেরে? বালু (ধুলি) আইতাছে।
- ছেরিডা বুমি করবঅ দেকতাছুইন না? মেয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলল তোতা মিয়া।
লোকজনের কটুক্তি আর ধুলির ঝড়ে বমি করতে ভুলে গেল ময়না। বন্ধ করে দিলো জানালার কাঁচ। চুপচাপ বসে রইলো জনারন্যের ভেতর।
- আহাইরে জানডা বাইরইয়া যাইতাছেগা। বিরক্তি প্রকাশ করল এক যাত্রী। তার কথাতে ধরলো অন্য আরেকজন
- জান বাইরইতনা, বাসের মইদ্যে মানুষ কট্টি (কতগুলো) লইছে দেখছনি। দুইন্নাইডার মাইদ্যে (দুনিয়াতে) যে কত মানুষ আছে ঈদের সময় অইলে দেহুন যায়।
- আরে অহনঅই মানুষের দেখছঅ কি, ঈদ তঅ আরো কয়দিন দেরি আছে।
- হেই কতা আর কইয়েননা ভাই। সারা দেশের মইদ্যে আউলাডাতঅ লাগবঅ ঈদের আগের দিন। অফিস আদালতে ছুটি থাহে মাত্র তিন দিনের। ঈদের আগের দিন সবাই শহর ছাইরা ছুডে গেরামের দিকে। কিন্তু কেউ ঠিক সময়ের মাইদ্যে যাইতে পারেনা। কেউ যায় ঈদের দিন। আবার রাস্তায় এক্সিডেন্ট কইরা কেউ পৌঁছতেই পারেনা।
- একবার না হুনছিলাম, সরকার নাকি এইবার থেইকা ঈদের ছুটি পাঁচদিনের করবঅ? হের পরেতো আর কোনঅ খবর-টবর হুনলামনা
- রোজার ঈদ অইল গিয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উৎসব। এই উৎসবের লাইগ্যা পাঁচদিনের ছুটি দিলে মানুষ ইকটু শান্তিতে গেরামের বাড়িতে গিয়া ঈদ করতঅ পারব।
- হুনছি অইন্য অনেক দেশে নাকি বড় উৎসবে বেশি দিনের ছুটি থাহে।
- অইন্য অনেক দেশে থাকলেই যে আমার দেশে থাকতে অইব, এমুন কোন কথা না। পাঁচদিনের ছুটি অইলে আমরার লাগি সুবিধা অয়, হেইডা অইল গিয়া বড় কতা।
যাত্রীদের একেকজনের একেক কথায় কান ঝালাপালা হয়ে উঠল ময়নার। গরম, বোটকা গন্ধ, বমির উদ্রেক সব মিলিয়ে চরম এক অস্থির সময় কাটছে ওর। আর এ অস্থিরতা নিয়েই সিটে বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছে ময়না। এগিয়ে চলছে বাস। বাড়ছে মানুষের কোলাহল
29.08.10

কোন মন্তব্য নেই: