রবিবার, জুলাই ২৫, ২০১০

আলী আক্কাসের অবস্থা ভালো নয়

আলী আক্কাস একজন রিকশা চালক। গ্রামগঞ্জে নয়, একেবারে রাজধানীর অলি-গলি চষে বেড়ায় তার বাহন। দুইদিন হলো বাড়িতে এসেছে সে। এখন আড্ডা মারছে তোতা মিয়ার দোকানের সামনে। হাতে প্রায় শেষ হয়ে আসা একটি বিড়ি। মুখ থেকে গল গল করে বাতাসে উড়িয়ে দিচ্ছে ধোঁয়ার গুলতি। যথেস্ট মনযোগ দিয়ে টানছে। কারণ শেষের দিকে যে কোন সময় আগুন খসে পড়তে পারে। আর শেষ টান মানে সুখ টান। সতর্ক আলী আক্কাস সুখ টান থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাত্র নয়। অবশ্য আরও অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হতে চায়না সে, তবুও হতে হয়। এই যেমন তিনবেলা খেয়ে-পরে থাকতে পারা আর রোগ বালাইয়ে ঠিক-ঠাকমতো চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রাখে সে। কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে এসব মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হতে হয় তাকে, আর বাকিগুলো নাহয় বাদ-ই থাকলো। কেবল বিড়ির উপরই তার যত অধিকার খাটে, অন্য কোথাও নয়। অবশ্য ধোঁয়ার একেকটি গুলতির সাথে যে একটু একটু করে জীবনীশক্তিও বাতাসে ভেসে যাচ্ছে-এ তথ্যও তার অজানা নয়। সেই ছোটবেলায় শুনেছিলো ‘আই এম এ ডিস্কু ড্যান্সার/বিড়ি খাইলে হয় ক্যান্সার’। বিড়ি খেলে ক্যান্সার হয় এটা শুনতে শুনতেই বিড়ির প্রতি আগ্রহ জন্মে। আর তখন থেকেই শুরু, এখন পর্যন্ত ছাড়তে পারেনি। কোনো দিন পারবে কি না জানা নেই।
- কীগো আলী আক্কাস, এমুন চুপচাপ বইয়া রইছ কেরে? ডাহার (ঢাকার) কিছু খবর-টবর হুনাও আমরারে। দেশের অবস্তা (পরিস্থিতি) কবে বালা অইব?
তোতা মিয়ার কথার জবাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে। কিন্তু কাশির দমকে ভেতরেই আটকে থাকলো কথা। খুক্ খুক্ করে নয়, কাশির শব্দটা হলো খন্ খন্ ধরনের, একেবারে খনখনে বুড়োদের মতো। অথচ তার বয়স খুব হলে চল্লিশ কী বিয়াল্লিশ হবে।
- আরে, আরে থাউক। দেশের অবস্তা কউন লাগদনা। তোমার নিজের অবস্তাই দেহি বালা না। বিড়ি খাইতে খাইতে শইলডারে আঙরা বানায়া দিছ।
প্রচন্ড শ্বাসকষ্টের মাঝেও না হেসে পারলনা আলী আক্কাস। খা.....ক্ করে একদলা কফ নিক্ষেপ করল দূরে। কথা বলার আগে ছুঁড়ে ফেললো বিড়ির শেষ অংশটুকু।
- দেশের অবস্তাও আমার মতোই। আমি যেমুন কবে বিড়ি খাওয়া ছারতারাম (ছাড়তে পারব) জানিনা। আমরার দেশের অবস্তাও কবে বালা অইব জানি না।
- এইডা হিবার কিমুন ঢঙের কতা হুনাইলা?
- ঢঙের কতা না গো ঢঙের কতা না। ডাহা শহর অইল বাংলাদেশের রাজধানী। অইহানে বইয়া থাইক্কা পুরা দেশের ছবি দেহুন যায়। দেশের অবস্তা অহন বালা না। মানুষে মানুষে ভাগ অইয়া যাইতাছে। মানুষের পইসা খরচ অইতাছে নানান আজাইরা কামে। আর এইসব কামের ভোগান্তিও যাইতাছে মানুষের ওপরে দিয়াই।
- হঅ, সব কিছু কিমুন জানি আউলা-ঝাউলা (এলোমেলো) অইয়া যাইতাছে। সায় দিলো তোতা মিয়া।
- আউলা-ঝাউলার কতা আরঅ কও তুমি! নিজের মতঅ চলন-ফিরনেরও অহন স্বাধীনতা নাই। তোমার মুহঅ দাড়ি থাকলে পুলিশে তোমার দিকে বেকা অইয়া চাইবঅ। মাথার মইদ্যে টুপি থাকলে মাথা নুয়াইয়া চলুন লাগবঅ!
- হঅ, এইডা কইছঅ ঠিক কতা। পুরা আসায্য (আশ্চর্য) কারবার শুরু অইয়া গেছে। খালি তোমরার ডাহা শহরঅই না, আমরার গাঁও গেরামের মাইদ্যেও এইরহম অইতাছে। শান্তি কি পুরাপুরি আরায়া (হারিয়ে) যাইবগা নাকি?
- শান্তির আশা আর কইর না। শান্তির মা মইরা গেছে। দেশঅ অহন মানুষ গুম অইয়া যাইতাছে, খুন অইতাছে, আর জিনিসপত্রের দামতঅ বারছেই।
- দিন যাইতাছে আর আমরা দেহি অনিরাপদ আর কঠিন জীবনের দিকে আউ¹াইতাছি (এগিয়ে যাচ্ছি)! দীর্ঘশ্বাস ফেলল তোতা মিয়া।
- আমি কি আর সাধে কইলাম যে, দেশের অবস্তা আমার মতই!
নিজেকে নিয়ে আলী আক্কাসের হেয়ালি শুনে গলা ছেড়ে হেসে উঠল তোতা মিয়া। হাসল এতক্ষন চুপচাপ বসে থাকা ময়নাও। দেশের অবস্থা কেমন তা ওর বোঝার কথা নয়। তবে আলী আক্কাসের অবস্থা যে খুব একটা ভালো নয়, এটা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে ময়না।
২৫ জুলাই ২০১০

শনিবার, জুলাই ২৪, ২০১০

বর্ষাযাপন!



বলুন তো আজ শ্রাবণের কততম দিন? পারছেন না তাইতো? আজকের নয়া দিগন্ত দেখুন, উত্তর পেয়ে যাবেনবর্ষা তো শেষ হতে চলল, বর্ষাযাপন করেছেন? করেননি! ক্যামনে করবেন? ‘ব্যস্ততা মোরে দেয় না অবসর’।
প্রিয় পাঠক, আপনার বর্ষাযাপন’র দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে দৈনিক নয়া দিগন্তের সাপ্তাহিক প্রকাশনা অবকাশ ও থেরাপি। এই দুটি ম্যাগাজিনের সকল লেখক ও আগ্রহী পাঠকদের নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে বর্ষাযাপনের। বলুনতো কোথায়? কোথায় আবার! কিশোরগঞ্জের দিগন্ত বিস্তৃত হাওরে!
চারিদিকে অথৈ পানি। মাঝখানে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। ওখানেই বড়শি ফেলে বোয়াল মাছ ধরার চেষ্টা করছেন আপনি। ভাবুন তো দৃশ্যটি! হ্যা, সত্যিই এ সুযোগ হবে বর্ষাযাপন এ। আরো থাকবে দিনভর হৈ-চৈ, জলকেলি, বিনোদন কত কিছু!
তাহলে যাচ্ছেন তো বর্ষাযাপন করতে? যেতে চাইলে নাম রেজিষ্ট্রশন করুন ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে। যাচ্ছি কবে? ৫ আগষ্ট রাতে। ঢাকায় ফিরব ৭ আগষ্ট সকালে।
যোগাযোগ- ০১৭১১১১৫১৬৫

রবিবার, জুলাই ১৮, ২০১০

মন্তাজ চাচার কথাই ঠিক

দক্ষিণ দিক থেকে সরু ঢেউ অলস খেলতে খেলতে ভীরছে ঘায়েলে (ভাঙন থেকে বসতভিটা রক্ষার জন্য কচুরিপানা আর খড়ের স্তর)। মৃদু বাতাসের ঠেলায় ঘায়েল ঘেষে কোণঠাসা হয়ে আছে কচুরিপানা, শ্যাওলা-ঝাউলা। এমনভাবে স্থির হয়ে আছে যেন পানির উপর তৈরি করেছে সবুজাভ সর। এ সবুজ সরকেই কেটে কোটে ঠেলা জাল ঠেলছে সবুজ। আর ডাঙায় ডোলা হাতে দাঁড়িয়ে ময়না। সবুজের একেকটি খেউয়ে জাল ভর্তি হয়ে উঠছে শ্যাওলা আর শ্যাওলা। তারপর এগুলো ঝেড়ে ফেলে চিংড়ির খনি আবিষ্কার করার দায়িত্ব ময়নার উপরই। শ্যাওলার ভাঁজ খুলে খুলে একটা-দুটো চিংড়ি ডোলায় ভরতে ভরতেই জালের টোনায় ঝিলিক দিয়ে উঠে ছিট পারতে থাকা এদলা চিংড়ি। এতক্ষনে ডোলা প্রায় অর্ধেক হয়ে এসেছে। আর কয়েকটি খেউ দিয়েই আজকের মতো ক্ষান্ত হবে, ভাবছিলো সবুজ। কিন্তু উঠাৎ উদয় হওয়া কোষা নৌকাটিই ঘটালো যতো বিপত্তি। বলা নেই কওয়া নেই, নি:শব্দে ভেসে এসেছে ঠিক সবুজের পাশেই। পানিতে বৈঠা ফেলার শব্দটি পর্যন্ত তার কানে আসেনি। চরম বিরক্ত হয়েই তাকালো কোষার মাঝির দিকে। তারপর ভ্যাবাচেকা খেলো। মাথা নুইয়ে নিলো সসম্মানে, বৈঠা হাতে বসে আছে স্বয়ং মন্তাজ উদ্দিন!
- কি সবুজ মিয়া, পড়ালেহা থুইয়া দেহি জাল ঠেলায় মনযোগ দিছস! কিশোরগঞ্জেত্তে কবে আইলি?
- পরশুদিন আইছি পুতু (চাচা)
- কলেজ বন্ধ নাকি?
- না বন্ধ না। এইচএসসি পরীক্ষার রিজাল্ট দিছে ত-অ, এর লাইগ্যা কয়দিন ডিলাডালা কাস অইতাছে।
- তরার কলেজের রিজাল্ট কিমুন অইছে?
- বালাই। জিপিএ পাঁচ পাইছে আঠারজন। দুইডা ছেরা খালি ফেইল করছে।
জাল ঠেলা বন্ধ হয়ে গেলো বলে উদ্দম্যে ভাটা পরেছে ময়নার। খানিকটা বিরক্ত হয়ে তাকালো মন্তাজ চাচার দিকে। কিন্তু তার বিরক্তিতে কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই দেখে আশাহত হলো সে। এমনিতেই বার বার ডাঙায় উঠে যেতে চাচ্ছিলো সবুজ ভাই, এখনতো আর কথাই নেই। যা ধারণা করেছিলো ঠিক তাই। পরিষ্কার পানিতে এপাশ-ওপাশ করে জাল ধুয়ে নিতে দেখলো সে। অর্থাৎ আজকের মতো মাছ ধরা এখানেই সমাপ্ত। বাধ্য হয়ে কাঠখোট্টা আলাপচারিতায় মনযোগ দিলো ময়না।
- আমার ত-অ খালি ডর করতাছে পুতু। আমরার মত গরিবের বালা রিজাল্ট কইরা কোন দাম নাই।
- আরে ডরের কি আছে বেক্কল। মনযোগ দিয়া পর, বালা রিজাল্ট কর।
- কি অইব বালা রিজাল্ট কইরা। এইবার দেহ সারা দেশ-অ আটাইশ হাজার ছয়শ’ একাত্তর জন জিপিএ পাঁচ পাইছে। এরার মইদ্যে কয়জন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি অইতে পারব? টেহাওয়ালারার লাইগ্যাতো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছেই। কিন্তু আমরা যায়াম কই?
- কতা তুই মন্দ কইছসনা। আমরার দেশে আছে খালি যত আউলা নিয়ম। এইযে পুলাপাইনগুলা পাস কইরা বাইর অইতাছে, এরা কই ভর্তি অইব, কি পড়ব, এরার ভবিষ্যৎ কি এইসব লইয়া সরকারের বিন্দু মাত্র চিন্তা নাই।
- এর লাইগ্যাইতো মাজে মইদ্যে পড়ালেহা ছাইরা দিতে ইচ্ছা অয় পুতু।
- আরে ধুরু, তুই খালি অলক্ষির মত কতা কছ। সমস্যা অনেক থাকব, হের লাইগ্যা কি ঘরে বইয়া থাহুন লাগব! মনে রাহিস উপরে আল্লাহ আছে। বালা কইরা পড়ালেহা কর, এইসএসসিতেও জিপিএ পাঁচ পাইয়া গেরামের মুখ উজ্জ্বল কর।
কি-সব জিপিএ পাঁচ-টাচ নিয়ে যে ওরা কথা বলে, একদম ভালো লাগেনা ময়নার। জিপিএ পাঁচ, এ প্লাস এসব শব্দ প্রায়ই কানে আসে ওর, কিন্তু কোন কিছুর অর্থ উদ্ধার করতে পারেনি। তার কাছে সোজা হিসাব, পাস-ফেল। অবশ্য গত এসএসসি পরীক্ষায় রেজাল্টের ব্যাপারটা ছিলো ভিন্ন। তখন সবুজ ভাই জিপিএ পাঁচ পেয়েছিলো, আর সারা গ্রামের মানুষের সেকি আনন্দ! আনন্দ হয়েছিলো তারও। সেই থেকে সে বুঝে গেছে জিপিএ পাঁচ হলো ভালো ফলাফল। কিন্তু সবুজ ভাইয়ের ভাল ফলাফল সত্ত্বেও তখন ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলো শাহজাহান আলী, সারা দেশে নাকি এত ছাত্র জিপিএ পাঁচ পেয়েছিলো যে তাদের ভিড়ে খেটে খাওয়া সবুজ ভাইয়ের কোন স্থানই হবেনা। শাহজাহান আলী বলেছিলো লেখাপড়া নাকি পয়সা ছাড়া হয়-ইনা। কই লেখাপড়াতো বন্ধ হয়ে যায়নি তার! কিশোরগঞ্জ শহরে লজিং থেকে, টিউশনি করে ঠিকঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে সবুজ ভাই। আসলে মন্তাজ চাচার কথাই ঠিক, উপরে আল্লাহ আছে।
- কিরে ময়না, মাছ কিমুন পাইলি?
জবাবের অপেক্ষা না করেই মারছার (পাটাতনের) নিচে বৈঠাটা চালান করে দিলো মন্তাজ উদ্দিন। তারপর এক লাফে নেমে এলো ডাঙায়। আমগাছের শেকড়ের সাথে কোষাটা বেঁধে ঢোঁ মারলো ডোলার ভেতর। তারপর সবুজের সাথে কথা বলতে বলতে হাটা ধরলো গোপাট (মেঠো পথ) ধরে। ঠেলা জালটা কাঁধে তুলে পেছন পেছন এগুলো সবুজ, গা থেকে নিংড়ে ঝরছে পানি। চিংড়ির ডোলা হাতে পা বাড়ালো ময়নাও, হাওরের জলে কোণঠাসা সবুজ রঙের শ্যাওলা-ঝাউলা পেছনে রেখে এগিয়ে চললো সবুজ এবং মন্তাজ উদ্দিনকে অনুসরণ করে।
১৮ জুলাই ২০১০

শনিবার, জুলাই ১৭, ২০১০

বেশি খেলে বাড়ে মেদ

ছেলেটা একেবারে হাড়জিরজিরে। বয়স কত আর হবে পাঁচ থেকে ছয় এর মধ্যেই। গায়ে এতটুকু কাপড় নেই। পাঁজরের সবগুলো হাড় একে একে গোনে ফেলা যাবে। মাথা থেকে খাপরি আলাদা হয়ে আছে। গর্তে লুকানো চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে টর্চ লাইটের মতো। নি®প্রাণ কিন্তু খানিকটা ভয় মেশানো দৃষ্টি মন্তাজ উদ্দিনের দিকেই।
ভীষণ অবাক ছেলেটা, তাকে এভাবে ডাকছে কেনো মন্তাজ উদ্দিন! লোকটার সাথে কখনও কোন বেয়াদবি করেছে বলেতো মনে পরছেনা। পাটকাঠির মতো দেহ দোলাতে দোলাতে নি®প্রাণ এগিয়ে আসছে ছেলেটা। চেহারায় শঙ্কা। আর বিব্রততো বটেই। চড়া গলায কাছে ডেকে ছেলেটাকে ভয় পাইয়ে দেয়ায় বিব্রত মন্তাজউদ্দিনও। তাই হয়তো অভয় দেয়ার জন্য বেঞ্চি থেকে পা নামিয়ে কিছুটা নরম স্বরে বললো
- ডরের কিছু নাই। কাছে আয়
তারপর দুই কাপ চা আর একটি বিস্কিট দিতে বললো তোতা মিয়াকে। কিন্তু আশ্বস্ত হতে পারলনা আপদমস্তক উলঙ্গ ছেলেটা। কোন ধমক-টমক শুনবে এমন শঙ্কায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষন পরই ঘটলো অস্বাভাবিক ঘটনাটাা। তোতামিয়ার বানানো দুই কাপ চায়ের একটি তার দিকে আসতে দেখে ছিটকে পরলো খানিকটা দূরে। যেন শাস্তি দেয়ার জন্যই গরম পানির লিকার ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে তাকে।
- আরে বেক্কল, চা ধর। তর লাইগ্যাই বানাইছি। বলল তোতা মিয়া।
খানিকটা ইতস্তত করে দুই হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে টেনে নিলো চা। দ্বিধাহীনভাবে বসে পরলো মাটিতে, ঠিক মন্তাজ উদ্দিনের পায়ের কাছে। তারপর ধুয়া উঠা চা ঠান্ডা করে খাওয়ার জন্য একের পর এক ফুঁ দিতে লাগলো কাপে।
- আহারে, না খাইতে না খাইতে পোলাডার কি অবস্থা! খুব কষ্ট লাগে মন্তাজ বাইছা (ভাই সাহেব)। সমবেদনা জানালো তোতা মিয়া।
- কষ্ট লাগলেই আর কি করতারবা তুমি, বড়জোর মাঝে মইদ্যে ডাইকা আইন্না দুইডা চা বিস্কুট খাওয়াইতে পারবা। এতে কি আর ুধার জ্বালা শেষ অইব?
- টেকা-পইসাওয়ালা মাইনষের পোলাপাইনগুলারে মা বাপে সারাদিন খাওয়ার উপরেই রাহে। খাইতে চায়না, এর পরেও মুহের মইদ্দে ঠেইল্যা দেয়।
- বালা কতা মনে করছ। সারা বিশ্বে অহন মানুষ গবেষণা করতাছে পোলাপাইনের মোডা (মোটা) অওয়ন কেমনে ফিরান যায়। কয়েকদিন আগে পত্রিকাত (পত্রিকায়) দেখলাম আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বউ (মিশেল ওবামা) পুলাপাইনের মোডা অওনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করছে।
- এমুন বেইক্কইল্লামি (বোকামি) কতা ত-অ আর হুনছিনা। হেরা যেইডা বেশতি খায়, এইডা আমরার মতো গরীব দেশের পুলাপাইনরারে দিয়া দিলেই ত-অ সমস্যার সমাধান অইয়া যায়।
- যত সহজে চিন্তা করতাছ, বিষয়ডা তত সহজ না। বলতে বলতে অর্ধেক শেষ করা কাপটা এগিয়ে দিলো তোতা মিয়ার দিকে।
- আরেক চামুচ (চামিচ) চিনি দেও তোতা মিয়া। চায়ে চিনি কম দিয়া আমারে কতায় বুলাইয়া রাকতাছ। এত কিপ্টামি কর কেরে? তোমার ঝি ময়নাই বালা, চিনি কম দেয়না।
ময়নাকে আরেক চামচ চিনি দেয়ার আদেশ দিলো তোতা মিয়া। তারপর বলল
- কিপ্টামি কি আর সাধে করি বাইছা। চিনির দাম গেছে গা বাইরা। কিন্তু তোমরার কতা চিন্তা কইরা চায়ের দাম বাড়াইতে পারতাছিনা।
- না তোমারে দুষ দেইনা। দুষ আমরার কপালের। ভোট দিয়া নেতা বানাই, আর হেরা ক্ষমতায় গিয়া আমরার পেটের কতা বুইল্লা যায়। নাইলে (না হয়) আলু, পটল, চাউল, ডাউল, নুন, তেলের দাম বাড়ার পরেও ডাহায় (ঢাকায়) বইয়া মন্ত্রিরা এইসব লইয়া রস করত-অ পারে? এক মন্ত্রী আমরারে চিনি কম খাওনের উপদেশ দিছে। চিনি কম খাইলে নাকি শরীর বালা থাহে। বহুত আগে হীরক রাজার সভা কবির গলয় হুনছিলাম এমুন কতা।
আশ্চর্য হলো ময়না। হীরক রাজা আবার কে? তার দেশ-ইবা কোথায়! কৌতুহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞেস করল
- পুতু হীরক রাজা কেডা?
- সত্যজিৎ রায় নামের একজন পরিচালক ছিনেমা বানাইছিলো ‘হীরক রাজার দেশে’ নামে। এই ছিনেমার মইদ্যে হীরক রাজ্যের মানুষ না খাইয়া থাকতো। আর রাজা তার সভা কবিরে দিয়া না খাইয়া থাহুনের উপকারিতা বুঝাইতো ‘ অনাহারে নাই খেদ/বেশি খেলে বাড়ে মেদ’
১১ জুলাই ২০১০

নেমে এলো ঝুম বৃষ্টি

ধুকপুক ধুকপুক করে পাশ কাটিয়ে গেলো একটি ট্রলার। বেপরোয়া পানি ধেয়ে এসে ধাক্কা খেলো কলার ভেলাটিয়। প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো ময়নারা। কিছুক্ষন তিড়িংবিড়িং এপাশ-ওপাশ দুলে তারপর শান্ত হলো ওরা। শান্ত বলতে একেবারে স্থির হয়ে গেছে এমনটি নয়। মৃদু বাতাসের দোলায় দুলছে পুরো হাওর। সেই সাথে দুলছে ময়নাদের ভেলা। এ দুলুনিতে ভেলার স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত হলেও এর মাঝে রয়েছে ছন্দ। পানিতে এলোমেলো আলোড়ন তুলে ছুটে চলা ট্রলারের ঢেউয়ের মতো বেপরোয়া নয়। তবে তুমুল বর্ষায় হাওরের বিচিত্র খেয়ালের হদিস পাওয়া ভার। এই হয়তো দেখা গেল স্থির জলধি। যেন জলজ চাদর বিছিনো রয়েছে আকাশ অবধি। আকাশ আর হাওরের নীলে মিলে-মিশে একাকার। আবার হয়তো মুহুর্তের মাঝেই ঘটে যেতে পারে পরিবর্তন। ক্ষ্যাপা বাতাসের উন্মত্ত শক্তিতে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলতে পারে শান্ত জলধিকে। ধেয়ে আসা একেকটা ঢেউ যেন দুই মানুষ সমান। হাওরের এ অগ্নিমূর্তি প্রতি বর্ষায়ই দেখে ময়না। আর এ কারনেই ছোট্ট কলার ভেলায় ভেসে খুব একটা দুরে যায়নি ওরা।
- লগ্যিডাত (লগিতে) একটু ভর দে দুলাল। আমি একটু জিরাইয়া লই।
এক টুকরো গামছার নেংটি ছারা আর কিছুই নেই ছিপছিপে শীরের এ ছেলেটার গায়ে। ময়নার একনিষ্ঠ চ্যালা হিসাবেই ওর পরিচয়। ভেজা শরীর নিয়ে এতক্ষন বসে কাঁপছিলো সে। তাই ময়নার আদেশ পেয়ে আর দেরি করলোনা দুলাল। প্রথমে ভেলার সামনের দিকটায় এগিয়ে গেল। তারপর পানিতে লগি ফেলে তলা নাগাল পেয়ে সজোরে ভর দিলো। ভরের বিপরীতে ভেলাটি এগিয়ে চললো সামনের দিকে। আর সম গতিতেই পেছাতে থাকলো সে। একেবারে শেষ মাথায় চলে এসেই ছপ করে তুলে নিলো লগি। তারপর আবার এগুলো সামনে। এভাবে একের পর এক লগির ভরে ঢেউ কেটে কেটে কেটে ভেলা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুলাল। আর দু’পা ছড়িয়ে আয়েস করে বসে আছে ময়না।
- এই দুলাইল্লা, একটা গান ধরছনা
উৎফুল্ল হযে উঠল দুলাল। লগির ভর কোমল করে দিয়ে বড় করে একটি শ্বাস নিয়ে নিলো। তারপর কচি গলা ভাসিয়ে দিলো হাওরের মৃদু বাতাসে ‘মন মাজি তঅর বৈডা নেরে/আমি আর বাইতে ফারলাম না.....’
তাচ্ছিল্ল করল ময়না
- আরে ধুরু তুই এইহান-অ বইডা (বৈঠা) পাইলি কই? বোরা (ভেলা) বাইতাছস লগ্যি দিয়া ভরাইয়া (ভর দিয়ে) আর গাণের মইদ্যে কছ বইডার কতা!
- লগ্যির কোন গাণ জানিনা আমি।
- কী ছাতা জানস তুই?
লজ্জায় মাথা নুইয়ে রাখলো কিছুক্ষন। তারপর হঠাৎই যেন উদ্যম ফিরে পেল দুলাল। দ্বিগুণ শক্তিতে লগিতে ভর দিয়ে তীর বেগে ভাসিয়ে চললো ভেলা। আর আবৃত্তি করতে লাগলো ‘স্বর-অ, স্বর-আ/লগ্যি দিয়া ভরাইয়া/মাস্টর গেছে আরাইয়া/হ্রস্য-ই, দীরগু-ঈ/মাস্টর পাইছি....”
হেসে কুটি কুটি ময়না। সংক্রমিত হয়েছে দুলালও। হাসির দমকে ভেলা থেকে পড়ে যাওয়ার অবস্থা আরকি। হাসছে, হাসছে আর হাসছে। চোখ থেকে গড়িয়ে পরছে জল। তারপর আকাশ থেকে নেমে এলো ঝুম বৃষ্টি। তুমুল বর্ষার এ বর্ষণ ওদের হাসি নি:সৃত জলকে একাকার করে দিলো আকাশ আর হাওরের নীলের সাথে।
৪ জুলাই ২০১০

পানি আবার কিনে খায় কিভাবে!

মোটরসাইকেলটা শাহজাহান আলীর কাছে এক স্বপ্নের যান। সারাদিনই যন্ত্রটার পিঠে চড়ে ভট ভট শব্দ তুলে ঘুরে বেড়ায় এখানে-সেখানে। কোনো কাজটাজের উদ্দেশ্যে যে তা নয়, ড্রাইভিংটা ভালো করে রপ্ত করা আর এই ফাঁকে মোটর সাইকেলের আভিজাত্য দেখিয়ে বেড়ানো আর কি! আগামী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়ার দাবি জানিয়ে নাকি গাঙ্গাটিয়া গ্রামের জনগণ তাকে সেকেন্ড হ্যান্ড এ বাহনটি উপহার দিয়েছে। কিন্তু ময়নার কাছে ভিন্ন খবর- কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করার শর্তে দশ বছরের ব্যবহৃত এ মোটরসাইকেলটি কিনে এনেছে শাহজাহান আলী। পুরনো হলে কি হবে, এর পিঠে চড়ার স্বাদ অমৃতসম। এমন কথা শাহজাহান আলীর মুখে শুনলেও ততটা বিশ্বাস করতে পারছে না ময়না। কারণ স্থান-কাল পাত্র বিবেচনা না করেই ভুঁ-ভুঁও-ভুঁওওওওক্ করে যন্ত্রটার স্টার্ট বন্ধ হয়ে যেতে দেখে সে। এতে অবশ্য এর মালিকের উৎসাহে কোনো ভাটা পরতে দেখা যায় না । এই ধরা যাক এখনকার কথাই, কাঁদা-পানিতে জ্যাম হয়ে যাওয়া মোটরসাইকেলটিকে ঠেলে নিয়ে যেভাবে এগিয়ে আসছে ওদের দোকানের দিকে, তাতে মনে হচ্ছে মহাপরাক্রমশালী কোনো দৈত্যের সাথে সম্মুখ সমরে সে এক বিজয়ী বীর।
- ময়নারে, তোতা মিয়া কই?
হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল শাহজাহান আলী
- বাপজান বাড়ির বিতরে আছে।
- ডাক দিয়া ক-অ আমি আইছি। আর আমার লাগি এক কাপ চা বানা
- বাপজন, শারজাহান পুতু ((শাহজাহান চাচা) তোমারে ডাকতাছে।
ময়নার ডাক শেষ হওয়ার আগেই ওদের দোকান আর ভেতর বাড়ির সংযোগের দরজাটি খোলে গেল। কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে অলস ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলো তোতা মিয়া
- আরে শারজাহান বাইছা (ভাই সাহেব) কইত্তে?
- বাজারেত্তে আইলাম আরহি, যানডা একবারে বাইরইয়া যাইতাছে। চিন্তা করলাম তর দোহানের এক কাপ চা খাইয়া যাই। একটু জিরানিও অইল আর তর লগে দুইডা আলাপ-অ অইল।
বলতে বলতে মোটরসাইকেলটাকে সমতল জায়গায় দাঁড় করিয়ে ধপ করে বেঞ্চিতে বসে পরল শাহজাহান আলী। তারপর মুখের হাসি অটুট রেখেই পরম মমতায় তাকিয়ে থাকল ওটার দিকে। মমতা ঝারলো তোতা মিয়াও
- প্যাক-কাঁদায় দেহি আপনের গাড়িডা মারা লাইগ্যা (একাকার হয়ে) গেছে।
- মারা লাগদনা! রাস্তাডার অবস্তা কী, দেখছস নি?
- বালা কতা মন-অ করছ-অ বাইছা, রাস্তাডা ঠিক করনের লাইগ্যা কোন সেঙশন (অনুদান) পাইছনি?
- আর কইছনা। এই রাস্তার লাইগ্যাইতো হেদিন ডাহা (ঢাকা) গেছিলাম এমপি সাবের লগে দেহা করতে।
- পরে এমপি সাব কী কইল?
- দেহা আর করতে পারলাম কই, ডাহা শহর-অ গাড়ি-গোড়ার জামের (জ্যাম) লাইগ্যা চলুন যায় নাকি? দেহা করার কতা আছিন এগারডার সময়, এমপি সাবের বাসাত গিয়া উঠলাম বারডা বত্রিশ মিনিডে। গিয়া দেহি ওনি বাসাত্তে বাইরইয়া গেছে গা।
- তুমি ইকটু আগে রওনা দিলেই পারতা।
- আগেই রওনা দিছিলাম। তারপরেও দেরি। ডাহা শহরের জামের কি কোন ঠিক-ঠিকানা আছে? একবার আটকাইয়া থাকলে আর ছারুনের নাম নাই। ঘন্টার পরে ঘন্টা ঠাডাপুড়া রইদের (প্রখর রোদের) মইদ্যে গাড়িগুলাইন খারইয়া থাহে, আর ডাইবার, প্যসেঞ্জার সবাইর মথার চান্দি গরম অইয়া যায়। আর এই গরম চান্দি লইয়া, কেউ কেউরে সইহ্য করত পারেনা। একটু হেত-ভেত (এদিক-সেদিক) অইলেই লাইগ্যা দেয় কাইজ্জা।
- আমি বুইজ্জা পাইনা, এই শহরের মানুষ বাঁচে কেমনে! নাই গাছ, নাই গাঙ, নাই পানি। শ্বাস ফালাইবার জায়গাডা পর্যন্ত নাই। খালি দালান আর দালান, গাড়ি আর গাড়ি। আমরার গেরাম অই বালা।
- খালি এইগুলা অইলে ত-অ বালাই আছিন। পানি পর্যন্ত কিইন্যা খাওন লাগে। হেদিন পত্রিকার মাইদ্যে লেকছে পানির অভাবে নাকি ডাহা শহর মাডির নিচে ডাইব্বা যাইবগা।
শিউরে উঠল ময়না। এ আবার কেমন শহর, পানি আবার কিনে খায় কিভাবে! ভারি অবাক মেয়েটি। পিপাসায় গলা শুকিয়ে আসে তার। ঢক ঢক করে এক জগ পানি গলায় ঢেলে স্থির হতে চেস্টা করলো। কিন্তু পারলনা। এমন কথা শুনলে স্থির হতে পারার কথাওনা। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। এই শহরেই থাকে মন্ত্রী-এমপিসহ বড় বড় লোকেরা। এদেরকেসহ যদি ঢাকা মাটির নিচে দেবেই যায়, তবে দেশ চালাবে কে? আর এই শহরের সাধারণ মানুষগুলারই বা কী অবস্থা হবে? জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হলো ময়নার। কিন্তু ততক্ষণে শাহজাহান আলী বেঞ্চি থেকে উঠে গিয়ে শখের বাহন পরিস্কারে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। লম্বা একটি কাঠি দিয়ে দুই চাকার ভেতর আটকে থাকা দলা দলা কাঁদা বের করে নিয়ে আসছে। এতে অবশ্য সামান্য ধকল যাচ্ছে তার উপর। কিন্তু বসবাসের অনুপযোগী ঢাকার পথের চেয়ে গ্রামের এই কাঁদায় ভরা মেঠো পথে শখের বাহন তাড়িয়ে বেড়ানোতেই হয়তো অনেক প্রশান্তি, ভাবল ময়না।
২৭ জুন ২০১০

ছায়ার মতো আগলে রাখে

- কী রে ময়না, বাপের লাইগ্রা অত উতলা অইছস কেরে?
পিঁড়িতে বসে মেয়ের মাথায় বিলি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করল মা।
- রেডুত (রেডিওতে) কইছে আউজ্জা (আজ) সারাডা দিন বাপজানের লগে থাহনের লাইগ্যা।
- কেরে আউজ্জা কী অইছে?
- আউজ্জা বুলে বাবা দিবস। পৃথিবীর সব মানুষই আউজ্জা বাবার লগে কাডাইব। কিন্তু আমারে ঘুমে থুইয়াই বাপজান যে বাইর-অইল, অহন-অতো আইল না।
- এই দেহ ছেরির মুহঅ (মুখে) যত আকাইম্মা কথা। তর বাপের কি আর কামকাইজ নাই যে সারা দিন তর লগে বইয়া থাকব!
ময়নার মাথায় ভর্ৎসনাসুলভ মৃদু একটি ঝাঁকি দিয়ে কথাগুলো বলল মা। তারপর আবার মনোযোগ দিলো বিলি কাটায়। দুই হাঁটু ভাঁজ করে লক্ষ্মী মেয়ের মতো সামনের পিঁড়িটায় বসে আছে মা। ঠিক বসে থাকা নয়, বেশির ভাগ সময় পায়ের পাতার সামনের দিকটার ওপর ভর করেই উঁকি দিয়ে থাকতে হচ্ছে তাকে। কান্তি পেয়ে বসলে ভরসা হিসেবে পিঁড়িটা নিচে রয়েছে এই যা। চুলের ভাঁজে ভাঁজে মায়ের কোমল হাতের সঞ্চালন বেশ ভালোই লাগছে ময়নার। আরামে চোখ লেগে আসছে। বেশ কয়েকবারই ডলে পড়ে যাচ্ছিল। রাজ্যের ঘুম এসে চোখে ভিড় করলে কী-ই বা করার আছে ওর। কিন্তু মায়ের ঝাঁকুনি খেয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শক্ত হয়ে বসতে হয়েছে তাকে। একটু-আধটু ঝাঁকুনি আর বকুনি দিলেও মা-টা তার ভীষণ ভালো। আদর আর ভালোবাসা দিয়ে একেবারে আঁচলে আগলে রাখতে চায় ময়নাকে। আর এ কারণেই মাকে ছাড়া কোথাও গেলে এক দিনের জন্যও ভালো রাগে না ময়নার। ইস্! বাবাটাও যদি এমন হতো, তাহলে আর কোনো দুঃখই ছিল না ময়নার। একদমই বাড়িতে থাকে না বাবা। আর থাকলেও দোকানের কেনা-বেচা নিয়েই সময় পার করে। মাঝে মধ্যে ময়নাকেদোকানে বসিয়ে উধাও হয়ে যায়। সারা দিন ব্যস্ত থাকে হাটবাজারে। পৃথিবী ফর্সা হওয়ার আগেই হাওরে চলে যায় ক্ষেতের কাজে। এসব একদমই ভালো লঅগে না ওর কাছে।
- আইচ্ছা মায়া (মা), বাপজান তোমার লাহান (মতো) অইল না কেরে?
ময়নার আচমকা প্রশ্নে হাতের সঞ্চালন থামিয়ে ঝুলে থাকা কাপড়ের আঁচলটা নিজের কাঁধে ছুড়ে দিলো মা। তারপর আরাম করে পিঁড়িটায় বসে বলল,
- দেহ আমার ছেরির ঢঙের কথা! তর বাপ হিবার আমার লাহান অইত কেরে?
- তুমি যেমুন সারাক্ষণ আমার পাশে থাহ, বাপজান তো থাহে না। সারা দিন খালি এইহানে ওইহানে যায়।
- বেক্কলের (বোকার) কথা হুনছনি! সারাদিন বাইত বইয়া থাকলে, কামাই না করলে আমরার সংসার চলব কেমনে?
কথাটা ঠিকই বলেছে মা, ভাবল ময়না। বাবার এত ব্যস্ততা, এত ম্রম সব তো তার জন্যই। এটা এনে দাও, ওটা কিনে দাও এসব আবদার তো বাবার কাছেই করে সে। ওর ভালো লাগায় বাবাকে উৎফুল্ল হতে যেমন দেখেছে, তেমনি ওর মন ভার থাকলে বাবাকেও মন বার করে বসে থাকতে দেখেছে। কিন্তু যেমনভাবে মায়ের ভালোবাসার স্পর্শ অনুভব করে ময়না, বাবার বেলায় তেমনটি নয়। তবে বাবার বলিষ্ঠ হাত আর দূর থেকে ভালোবাসা যে সারাক্ষণ ছায়ার মতো আগলে রাখে তাকে, তা বেশ ভালোভাবেই অনুধাবন করে ময়না।
- বাপজান কোন সুময় আইব মায়া? বাবা দিবস-ত শেস অইয়া যাইতাছে।
- অইছে হুনছি, বেঢঙের কথা, এক দিনের লাইগ্যা অত দরদ ইতলাইয়া পড়ন বালা না (ভালো না)।
বলতে বলতে পায়ের পাতার ওপর ভর করে উঁচু হলো মা। পাশে রাখা টিনের বাটি থেকে তেল নিয়ে মাখতে লাগল ময়নার মাথায়। আর সেও বুঝে গেল এখন আর কথা বাড়ানো ছলবে না। অর্থাৎ চুপ করে মাকে মায়ের কাজ করতে দিতে হবে।
২০ জুন, ২০১০

আজ মন্তাজউদ্দিন বড়ই উৎফুল্ল

আজ মন্তাজউদ্দিন বড়ই উৎফুল্ল। কিন্তু কী কারণে এ সম্পর্কে কোন ধারণা করতে পারছে না ময়না। গোঁফের আড়ালে মুচকি হাসি নিয়েই দোকানে প্রবেশ করল মন্তাজ পুতু (চাচা)। তারপর বেঞ্চিটায় বসে এক কাপ চা দিতে বললো ময়নাকে। একজন লোক আপন মনে হেসে যাচ্ছে- ব্যাপারটা কিছুটা ব্যাখাপ্পা মনে হল তার কাছে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো, থাকনা ঠোঁটে হাসি। তাতে তো ময়নার কোন সমস্যা হচ্ছে না। কাউকে হাসতে দেখলে ভালোই লাগে তার। মন্তাজ পুতুর উৎফুল্ল মনের হাসিটা মুচকি হলেও এতে কোনো কুটিলতা কিংবা কৌতুক নেই। এটা-সেটা নিয়ে কৌতুক করতে অভ্যস্ত এ লোকটার হাসির সাথে ময়নার পরিচয় নেই, এমনটি নয়। তবুও আজ বেশ অপরিচিতই মনে হচ্ছে তাকে। কারণ এমন নির্মল ও তৃপ্তির হাসি এর আগে কে-ও হাসতে পেরেছে বলে মনে হয়না। নি:শব্দ উৎফুল্লতার হিল্লোল স্পর্শ করল ময়নাকেও, নিজের অজান্তেই অ™ভ’ত এক ভালোলাগার ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাকে। অর্থাৎ উৎফুল্ল হয়ে উঠল ময়নাও।
- একলা একলা পিটপিটায়া হাসতাছ কেরে পুতু?
- তুই হাসতাছস কেরে?
- তুমার হাসি দেইখ্যা।
- আমি হাসতাছি বাংলাদেশের মাইনষের তৃপ্তির হাসি দেইখ্যা।
কথাটা ঠিক বুঝতে পারলনা ময়না। বাংলাদেশের মানুষ আবার কখন হাসল! মন্তাজ পুতুই তো সেদিন বলেছিল এই দেশের মানুষকে ঘিরে রেখেছে কেবল সমস্যা আর সমস্যা। এত সমস্যার মাঝে থেকে কি কেউ হাসতে পারে! ব্যাপারটা জানার আগ্রহ হলো তার
- কী এমুন ঘটল চাচা?
- হুনছ নাই, আমরার দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে দায়িত্ব নিয়া স্বজনহারা তিন কন্যার বিয়া দিয়া দিছে।
-না হুনার কী আছে? এইডাতো সবাই হুনছে।
- এই কারণে সবার ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি।
এমনভাবে তো ভেবে দেখেনি সে। সত্যিইতো কয়েকদিন যাবত দোকানে চা খেতে আসা লোকজনের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রসঙ্গটি। আহা! বিয়ে বাড়িতে আগুন লেগে কত্ত মানুষই-না মারা গেল। প্রাণ হারালো পাত্রীদের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনসহ আরও কত্ত লোক। খবরটি শুনে খুব মায়া হয়েছিলো ময়নার। ভেবেছিলো আপনজন হারানোর সাথে সাথে বুঝি ভবিষ্যতটাও হারালো ওরা। কিন্তু যখন শুনল স্বজনহারা এ মেয়েদের মায়ের ভ’মিকায় এসে দাঁড়িয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, তখন অন্যদের মতো ভালো লাগার অনুভূতি হয়েছিলো তারও।
- বুঝলি মায়া (মা), প্রধানমন্ত্রী এই মহৎ কামডা কইরা একটা নজির দেহাইল। অহন তারে অনুসরণ কইরা আমরা যুদি একজনের দু:খরে দশজনের মইদ্যে ভাগ কইরা লই, তাইলে কি এই দেশের কোনো মানুষ নিজেরে অসহায় মনে করব?
বলতে বলতে তৃপ্তির হাসি নিয়েই চায়ে শেষ চুমুক বসাল মন্তাজ উদ্দিন। তারপর খালি কাপটি বেঞ্চিতে রেখে উঠে দাঁড়ালো এবং জবাবের অপেক্ষা না করেই হাটা ধরল বাড়ির পথে। তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলো ময়না। আর অপেক্ষায় রইলো অন্য আরো দিনের, যখন মন্তাজ পুতুর হাসিটা হবে ঠিক আজকের মতো নির্মল ও তৃপ্তির।

শুক্রবার, জুলাই ০২, ২০১০

কবি জাকির আবু জাফর এর ৩৯তম জন্মদিনে



গতকাল কবি জাকির আবু জাফর এর ৩৯তম জন্মদিনে