রবিবার, অক্টোবর ১১, ২০০৯

হোজ্জ্বা কাহিনী

শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ

একবার হলো কি নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বাকে সবাই মিলে দাঁড় করিয়ে দিলো খুতবা দেয়ার জন্য। অথচ তিনি তেমন বক্তৃতা দিতে পারতেন না। মিম্বরে দাঁড়িয়ে কোনটা থেকে কোন কথা বলে ফেলেন, শেষতকে নাকি আবার লজ্জ্বায় পরতে হয়, এসব শংকাই কাজ করছিলো তার মনে। কিন্তু সবাই এমন করে ধরলো যে তাকে দাঁড়াতেই হলো। কিন্তু তিনিও কম যাননা। মনে মনে এঁটে নিলেন বিদঘুটে এক বুদ্ধি। প্রথমেই গলা খাঁকারি দিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন আমি এখন আপনাদের উদ্দেশ্যে কি বলবো তা কি আপনারা জানেন? সমস্বরে জবাব এলো, না আমরা জানিনা। তার পর তিনি কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, আমি কি বলবো তা যদি আপনারা নাই জানেন তবে সেটা বলে আর লাভ নেই। তারপর সোজা বেরিয়ে গেলেন মসজিদের বাইরে। মুসল্লিরাতো হা-হুতাশ। এত কষ্ট করে হোজ্জ্বাকে ধরে এনেও তার মুখ থেকে বক্তৃতা বের করানো গেলোনা! কিন্তু সহজেই তারা ছেড়ে দিতে রাজি নন। এঁটে নিলেন নতুন এক ফন্দি। অন্য একদিন আবার হোজ্জ্বাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বক্তৃতার জন্য দাঁড় করানো হলো মিম্বরে। তখনও তিনি সবার উদ্দেশ্যে আগের প্রশ্নটিই করলেন। উপস্থিত মুসল্লিরা এবার জবাব দিলেন, হ্যা আপনি কি বলবেন তা আমরা জানি। হোজ্জ্বা এবারও পেয়ে বসলেন সবাইকে। বললেন আপনারা যেহেতু জানেনই তবে আমার আর বলার কি প্রয়োজন। তারপর উপস্থিত সবার হা হয়ে যাওয়া মুখের সামনে দিয়েই বেরিয়ে গেলেন মসজিদ থেকে। কিন্তু তবু হাল ছাড়তে রাজি ছিলেননা তারা। ক্রমেই বুদ্ধি আঁটছিলেন কি করে কথার জালে আটকানো যায় হোজ্জ্বাকে। অবশেষে ঠিক করা হলো শেষবারের মতো আরো একবার চেস্টা করে দেখা যাক। বুদ্ধির বাকসো ওই বেটা হোজ্জ্বার দৌর কতটুকু তা তাদের দেখে নিতে হবেই। আগের মতোই আবার তাকে টেনে আনা হলো মিম্বরে। এবারও ঠিক আগের প্রশ্নটিই করলেন তিনি। মুসল্লিরা এর জবাব আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন। তাদের অর্ধেক লোক উত্তর দিলেন, হ্যা আপনি কি বলবেন তা আমরা জানি। আর বাকি অর্ধেক বললেন, না আমরা জানিনা। তারপর সবাই তাকিয়ে থাকলেন হোজ্জ্বার মুখের দিকে। ভাবলেন এবার নিশ্চয়ই কোন চালাকি করতে পারবেননা তিনি। চালাক হোজ্জ্বাকে ফাঁসানো গেলো ভেবে সবার মুখে ফুটে উঠলো তৃপ্তির হাসি। কিন্তু না হোজ্জ্বা কি এত সহজে হেরে যাবার পত্র নাকি! মুখ খুললেন তিনি। ধীরে ধীরে সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আমি আজ কি বলব এ কথাটি যারা জানেন, তারা দয়া করে বুঝিয়ে দিন যারা জানেননা তাদেরকে। বলেই আর দেরি করলেন না দ্রুত নেমে গেলেন মিম্বর ছেড়ে।
গল্পের শেষ এখানেই। কিন্তু গল্পের নায়ক নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বা যে এখানে বুদ্ধিমত্ত্বার পরিচয় দিয়েছেন তা কিন্তু একদম বুঝার বাকি নেই আমাদের। আর কেনইবা বুঝবোনা, সেই কবে থেকে হোজ্জ্বার সাথে আমাদের পরিচয়! দাদুর কাছে চুপি চুপি কত্তো শুনেছি হোজ্জ্বার গল্প, শুনেছি গুরুজনদের কাছে, কাসের পড়া ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কত্তো পড়েছি হোজ্জ্বা সংগ্রহ! আর হোজ্জ্বা মানেইতো হাসতে হাসতে একেবারে গড়াগড়ি অবস্থা। হ্যা নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বা ছিলেন সত্যিই একজন রহস্য পুরুষ। রাহস্যপুরুষ বলছি এ কারণে যে তাকে কখনো আমরা চিনেছি চালাক ও তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন হোজ্জ্বা হিসাবে আবার কখনো চিনেছি বোকা হোজ্জ্বা হিসাবে। কোন কোন কাহিনীতে তাকে আমরা দেখি যৌক্তিক ভ’মিকায়, কোনটিতে অযৌক্তিক ভ’মিকায়। কোনটিতে দেখি স্বাভাবিক আবার কোনটিতে তার ভ’মিকা থাকে একেবারেই অস্বাভাবিক। কোনটিতে বুদ্ধিসম্মন্ন একজন প্রগাঢ় হোজ্জ্বার চরিত্র ফুটে উঠে, আবার কোনটিতে তিনি থাকেন একেবারে গো-বেচারা বোকার ভ’মিকায়। উপরে চালাক নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বার পরিচয়তো পেলামই, এবার বোকা হোজ্জ্বার একটি পরিচয় পেলেই তার রহস্যময় চরিত্রটি আরো খোলাসা হয়ে ধরা দেবে।
http://www.english-for-students.com/images/HodjasDonkey.gif
কোন এক রমজান মাসের আগে সবার মাঝে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে রোযা রাখার জন্য। কিন্তু প্রতি রমজানেই রোযা রাখতে বেশ কষ্ট হয় হোজ্জ্বার। তাই এবার ঠিক করলেন যে, রোযা রাখবেন না। কিন্তু সমস্যা হলো রোযা না রাখলে লোকজনতো তাকে মন্দ বলবে। তাই কি করা যায, কি করা যায়, চিন্তাভাবনা করে বুদ্ধি ঠিক করলেন যে সবার সামনে তিনি রোযা রাখার ভান করবেন। আর চুপি চুপি ঠিকই খেয়ে নেবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও দেখা দিলো আরেক সমস্যা। কেউ যদি হঠাৎ তার কাছে জানতে চায় যে আজ কততম রোযা, তখন তিনি কি বলবেন? নিজে রোজা না রাখলেতো সঠিক হিসাবও দিতে পারবেন না। তছাড়া তখনতো আর ক্যালেন্ডারও ছিলোনা। অবশেষে হোজ্জ্বা ঠিক করলেন যে, যত রোযা যাবে তিনি ততটি পাথর একটা বাক্সে জমা করে রাখবেন। অর্থাৎ প্রতিদিন বক্সে একটা একটা করে পথর জমা হবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে পথরগুলো গুণে বলে দেয়া যাবে আজ কততম রোজা। তিনি ভাবলেন তার এই চালাকি কেউ ধরতে পারবেনা। কিন্তু সব প্ল্যান কি আর সব সময় সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়! এর মাঝেও লেগে গেলো গন্ডগোল। তার স্ত্রী খেয়াল করলেন যে হোজ্জ্বা প্রতিদিন একটি বাক্সে পাথর রাখছেন। স্বামিভক্ত স্ত্রী ভাবলেন নিশ্চয়ই হোজ্জ্বা কোন মহান কাজ করছেন। তাই তাকেও প্রতিদিন একটি করে পাথর এই বাক্সে রাখতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। অবশেষে বাক্সে পাথর রাখার দলে সামিল হলো তার ছেলে এবং মেয়েও। মোটকথা তারা সবাই বিপুল বিক্রমে পাথর জমাতে শুরু করল। এদিকে কি ঘটছে এসবের কিছুই কিন্তু হোজ্জ্বা জানেননা। বিপত্তিটা ঘটলো সেদিনই, এক ফাজিল প্রতিবেশি হোজ্জ্বাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলো যে, এখন পর্যন্ত কয়টা রোযা গেলো? অতিচালাক হোজ্জ্বা বললেন, "দাঁড়াও একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি"। তারপর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে বাক্স খুলে পাথর গোনা শুরু করলেন তিনি। কিন্তু তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো, যখন পাথরের সংখ্যা দাঁড়াল মোট ৯৬ টিতে। ভাবলেন এই কয়দিনেতো এত্তো পাথর হওয়ার কথা না। আবার নিজের হাতে যা গুণলেন তাও তো সত্যি। এসব সাত পাঁচ ভেবে তিনি ভাবলেন রোজার সংখ্যা কিছুটা কমিয়ে বলাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। অবশেষে প্রতিবেশির সামনে এসে তিনি বিপুল বিক্রমে জানিয়ে দিলেন যে ইতিমধ্যেই ৫৩ টি রোজা চলে গিয়েছে। প্রতিবেশিতো তাকে পাগল ঠাওরে নিয়ে বললেন "যান কি যা-তা বলছেন, এতো হতেই পারেনা!"। কি এতো বড়ো অপমান ভেবে গর্জে উঠলেন হোজ্জ্বা, "চোপরাও! আমি তো তাও কমই বলেছি, পাথর গুনলে তো আরো বেশিই পেতে"।
বোকা বা চালাক যাই হোকনা কেন রহস্যময় হোজ্জ্বার প্রচলিত এসব কাহিনীগুলো যেমনভাবে আমাদের হাসির খোড়াক তেমনি এসবের প্রায় সবগুলোতেই লুকিয়ে রয়েছে নীতি-নৈতিকতা কিংবা শিক্ষনীয় বিষয়। কৌতুহল জাগা স্বাভাবিক যে, কিভাবে সৃস্টি হয়েছিলো এসব কাহিনীর? এ প্রশ্নের জবাব স্পস্ট করে এখন পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। অনেকে অনুমান করছেন তার চরিত্রই ছিলো এরকম উদ্ভট, আবার অনেকের ধারণা মানুষ যেন হাসি-আনন্দের সাথে সাথে খুঁজে নিতে পারে শিক্ষার উপাদান তাই নিজের নামে তিনি তৈরি করেছেন এমন গল্পকথা। সে যাই হোক হোজ্জ্বা চরিত্র আমাদেরকে আনন্দ দিতে পেরেছে বলেইতো ছোট নেই বড় নেই সবাই আমরা তার সাথে পরিচিত। শুধু তাই নয় অবাক বিষয় হলো মধ্যপ্রাচ্য থেকে হোজ্জ্বা কাহিনীর সৃস্টি হলেও কালের বিবর্তনে হাসি-আনন্দের হিল্লোলে তা স্পর্শ করে গেছে সারা বিশ্বকে। আর এগুলোর শিক্ষনীয় ছিলো বলেই স্থায়িত্ব পেয়েছে এতকাল। শুরুতে উল্লেখিত গল্পটির শিক্ষনিয় বিষয় হলো বুদ্ধি থাকলে যে কোন পরিস্থিতিই সামাল দেয়া যায়। আর দ্বিতীয় গল্পটির দ্বারা আমরা বুঝতে পেরেছি, আসলে ফাঁকি দেয়ার চেস্টা কখনো সফল হয়না। তাই এ চেস্টা করা উচিত নয়। রোজা না রাখলে আল্লাহর কাছেতো জবাবদিহীতা রয়েছেই, সেই সাথে কোন না কোনভাবে মানুষের সামনেও তা প্রকাশ পেয়ে যাবে। হোজ্জ্বার এমন কিছু কাহিনী রয়েছে যেগুলো কেবলমাত্র কৌতুক হিসাবেই ধরা হয়। যেমন: একদিন হোজ্জ্বা নদীর তিরে বসে আছেন। তখন অপর পার থেকে এক লোক চিৎকার করে তাকে জিজ্ঞেস করলো, আমি কিভাবে নদীর ঐপার যাবো একটু বলে দিবেন কি? হোজ্জ্বা এর জবাবে বললেন, তুমি নদীর ঐপারেই আছো। শিক্ষনীয় এবং মজাদার এসব গল্পের সৃস্টি যেভাবেই হোকনা কেন বর্তমানে এগুলোর কোনটিতে হোজ্জ্বা উপস্থাপিত হয়েছেন প্রগাঢ় হিসাবে কোনটিতে বোকার ভ’মিকায়। আবার দেখা গেছে তিনি কখনো শাসকের বিরুদ্ধে কথা বলতেও ভয় পেতেননা। রাজসভা বা যে কোন অনুষ্ঠানে প্রবল বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে তিনি হার মানিয়ে দিতেন বাদশাহকেও। মোটকথা বর্তমানে হোজ্জ্বার উপস্থাপন রয়েছে নানা আঙ্গিকে। কিছু রয়েছে আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য সমন্বিত বর্ণনার মাধ্যমে। আবার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠিত গল্প, কবিতা ও বিভিন্ন ধারণার উপর।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে প্রচলিত রয়েছে নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বার বিভিন্ন কাহিনী। ইতিহাসের মজার এই চরিত্র হাসি আনন্দ মিশ্রিত ভালোলাগার এক আবেশ। নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বা নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে বুদ্ধিদীপ্ত কিন্তু কৌতুকমিশ্রিত এক চেহারা। অনেকটা কল্পিত এ চেহারার অধিকারীর মাথায় বিশাল এক পাগড়ি, তিনি চড়ে বেড়াচ্ছেন গাধার পিঠে করে। অথচ এ চরিত্রটি আসলেই কি বাস্তব, আর বাস্তব হলেও ঠিক কোন সময়টা ছিলো হোজ্জ্বার সময়কাল, কোথায় তার জন্ম এসব প্রশ্নের জবাব আমরা কয়জনইবা খুঁজতে যাই! হ্যা নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বা নামে সত্যি সত্যিই একজন ছিলেন। ঐতিহাসিক এই চরিত্রের জন্ম মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন এনাতোলিয়াতে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে এর অবস্থান। তিনি ১২০৯ সালে বর্তমান সিভরিহিসার জেলার হরতু গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সিভরিহিসার বর্তমান তুরস্কের একটি প্রদেশ। জন্মের পর থেকে কিছুদিন এ গ্রামেই ছিলো তার বসবাস। পরবর্তীতে তিনি আকসেহিরে চলে যান। তার শেষ জীবণ কাটে তুরস্কের প্রাচীন নগরী কোনিয়াতে। এ কোনিয়া নগরী থেকেই সৃস্টি হয় হোজ্জ্বার যতসব কাহিনী। অবশেষে তাঁর মৃত্যুও হয় এখানেই। ধারণা করা হয় তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন ১২৭৫ সালে।
http://englishcafecdn.englishcafe.com/files/images/ec_13203_1250540215.post.jpg
আমরা হোজ্জ্বার গল্প ও কাহিনীগুলোর সাথে পরিচিত হয়েছি আমাদের আগের প্রজন্মের কাছ থেকে শুনে, বই পড়ে এবং বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে। তবে মূলত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাঁধে ভর করেই হোজ্জ্বার পরিচয় ঘটেছে আমাদের সাথে। সময়ের যাত্রায় অনেক কিছুই পরিবর্তনশীল। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় সংস্কৃতি, সাহিত্য, জীবণপ্রণালী, লোক কথা, উপকথা প্রভৃতি। তেমনি তের শতকের চরিত্র নাসিরউদ্দিন হোজ্জ্বার সাথে এখন আমরা যেভাবে পরিচিত হচ্ছি, তিনি হয়তো ঠিক তেমন ছিলেননা। তবে প্রচলিত ধারণাগুলোর চাইতে যে একেবারে ব্যতিক্রম ছিলেন তাও নয়। একটু যে পরিবর্তিত, পরিবর্জিত বা পরিবর্ধিত হয়েছে তাও সময়ের স্বাভাবিক হিসাবেই। তার গল্প কাহিনীগুলো বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে যাওয়ায় এগুলোকে উপস্থাপন করা হয়েছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে। আর এ কারণেই বিভিন্ন সময় হোজ্জার কাহিনীর সাথে হয়েছে নানা সংযোজন বিয়োজন। বিভিন্ন ভাষায় এসব কাহিনীগুলো অনুবাদ হওয়ায় কোন কোন এলাকায় হোজ্জ্বার মতো স্বতন্ত্র চরিত্রেরও তৈরি হয়ে গেছে। অনেক এলাকায় নাসিরুদ্দীন পরিণত হয়েছে সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশে। এসব কারণেই হোজ্জ্বা একেক এলাকায় একেক নামে পরিচিত। নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বা নামে তিনি তার বসবাসের এলাকা তুরস্কে, বসনিয়ান এবং আমাদের বাংলাভাষাবাসিদের কাছে পরিচিত। কুর্দীদের কাছে তিনি মোল্লা নাসিরুদ্দীন। আরব এবং পারসিয়ানদের কাছেও তাই। আলবেনিয়ায় তাকে ডাকা হয় নাস্ট্রাদিন হোক্সা কিংবা শুধুমাত্র নাস্ট্রাদিনী নামে। আজেরীদের কাছে মোল্লা নাসিরুদ্দীন। উজবেকদের কাছে নাসিরুদ্দীন অফেন্দী অথবা শুধুমাত্র অফেন্দী নামে তাঁর পরিচয়। এসব এলাকা ছাড়াও তার কাহিনী-উপকাহিনীগুলো আরমেনিয়ান, বুলগেরিয়ান, গ্রীক, হিন্দি, ইতালিয়ান, পশতু, রুমানিয়ান, সারবিয়ান, উর্দু, বুলগেরিয়া প্রভৃতি লোক ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে। এসব এলাকায় অনেক ক্ষেত্রে তিনি তার প্রজ্ঞা এবং বিচারিক ক্ষমতার জন্য বেশ জনপ্রিয়। আবার চীনেও তিনি অফেন্দি নাসিরুদ্দিন নামে পরিচিত। বর্তমান চীনে তাকে নিয়ে বিভিন্ন রকমের মুভি, কার্টুন এবং উপন্যাসও রচিত হয়েছে। সময়ের সাথে সংস্কৃতি পরিবর্তিত হলেও কিংবদন্তী নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বার প্রবাহ স্তিমিত হওয়ার নয়। বরং তা আরো বিস্তার লাভ করছে প্রযুক্তির কল্যাণে। প্রযুক্তি ও প্রজন্মের কাঁধে ভর করে এভাবেই মানুষের কানে কানে বেঁচে থাকবে হোজ্জ্বা কাহিনী।

ইতিহাসের পদধ্বনি: দ্বিতীয় পর্ব







শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ







জুরিখ

মানুষের ভির নেই বললেই চলে, কিন্তু তবুও এটি একটি নগরী। ইতিহসের প্রাচীনতম এ নগরী হলো সুইজারল্যান্ডের জুরিখ। ইউরোপের অন্তর্ভূক্ত হলেও উরোপের অধিকাংশ নগরীর মতো দালনকোঠায় ঠাসা শহর এটি নয়। নির্জন, নি¯Íব্ধ প্রকৃতিতে সুশোভিত জুরিখের স্বীকৃতি রয়েছে জীবণের জন্য নিরাপদ শহর হিসাবে। প্রকৃতির অপর সৌন্দর্যের এ লীলাভ’মি নগরী হিসাবে গড়ে উঠেছিলো খ্রি:পূর্ব ৩০০০ সালে। তখন লিমাত নদীর চঞ্চল প্রবাহ আর তুষার ঝরা শীতল এ পাহাড়ি উপত্যকাতে উষ্ণতা বয়ে এনেছিলো মানুষ। নগরীটির গড়ে উঠার সময়কাল থেকে সঠিক ইতিহাস পাওয়া না গেলেও অন্তত এতটুকু বলা যায় যে, এটি একসময় ছিলো আত্মত্যাগী ধ্যানমগ্নদের নগরী।
জীবণ থেকে পালিয়ে বেড়ানো এ আত্মত্যাগীদের খুঁজে পাওয়া যায় যেমন ইতিহাসের নানান খাঁজে, তেমনি এদের অ¯িÍত্ব রয়েছে সভ্যতার আধুনিক স্পর্শের ভেতরও। তারা জীব ও জগতের মোহ ত্যাগ করে ছুটছে অপার রহস্যের পেছনে। পরম সত্ত¡ার সাথে আপন অ¯িÍত্বকে বিলীন করে দেয়াই তাদের ব্রত। কোলাহলহীন প্রকৃতির অঢেল সম্পদে সমৃদ্ধ বর্তমান জুরিখকে সামনে রেখেই অনুমান করা যায় পাঁচ হাজার বছর আগে এর রূপ ও নির্জনতা কেমন ছিলো। হয়তো শুরুর দিকে ধ্যান পাগল এসব আত্মত্যাগীরা দুঃখ জরাগ্র¯Í পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে সুখবোধে মিলিয়ে যেতে নির্জন এ স্থানটিকেই বেছে নিয়েছিলো তাদের জন্য। মনশ্চু থেকে রহস্যের পর্দা তুলে নিতে এ ভ’স্বর্গেই চলে তাদের সাধনা। তারপর হয়তো জীবণের প্রয়োজনেই ক্রমাগত জেগে উঠতে থাকে ধ্যান ভেঙ্গে। সেই সাথে জেগে উঠতে থাকে এ ভ’খন্ডটিও। যার পরিণতি বর্তমান ছিমছাম, আধুনিক ও অপার সৌন্দর্যের নগরী জুরিখ। এ জুরিখ নামটিই এর আদি নাম নয়। ধারণা করা হয় জুরিখ এর পূর্ব নাম ছিলো টুরিকম। ২য় শতকে সেখানকার বিভিন্ন সমাধির স্মৃতিফলকে ‘টুরিকম’ নামের অ¯িÍত্বই রয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে ‘টুরিকম’ নামটির বিবর্তন ঘটে বর্তমান জুরিখ-এ এসে পৌঁছেছে। ৬ষ্ট শতকে এটি ছিলো ‘জুরিখী’ এবং সবশেষে ১০ম শতক থেকেই ‘জুরিখ’ নামটি পরিচিতি পায়। রুমানদের সময়ে টুরিকম নামের এ শহরটি ছিলো গ্যালিয়া বেলজিকার সীমান্তে কর সংগ্রহের স্থান এবং এখান থেকে লিমাত নদীর উপর দিয়ে ভেসে যাওয়া পণ্যের নিয়ন্ত্রণও করা হত। ইতিহাসের পথ ধরে স্পস্টভাবে যতদূর জানা যায় এ অঞ্চলটি একসময় ছিলো রুমান শাসনের অধীনে। প্রতাপশালী রুমান শাসক চারলিম্যাগনির নাতি লুইস তার শাসনের সময় এ এলাকাটিতে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। বিশেষ করে তখন পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানো সন্ন্যাসীদের কল্যাণে লুইস অনেক ভ’মিকাই গ্রহণ করে। রুমান দূর্গগুলোর পাশে ক্যারোলিনজিয়া দূর্গ নির্মাণ এবং ৮৩৫ সালে জীবণবিমুখ ত্যাগীদের জন্য ফ্রাউমুনস্টার আশ্রম নির্মাণ ছিলো উলেøখযোগ্য। এ আশ্রমটি নির্মাণের পর জুরিখকে পুরোপুরিভাবে তাদের বসবাসের উপযোগী করে দেয়া হয়। তখন কেবল জুরিখ নয়, ইউরি, আলবিসের এলাকার বনভ’মিতেও তাদের পদচারণা আরো সহজ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১০৪৫ সালে জীবণবিমুখ আত্মত্যাগীদেরকে জীবণমুখী করতে সÿম হয় ৩য় হেনরি। তখন তাদের অনেককে মালিক করে দেয়া হয় বিভিন্ন বিপনীবিতানের। কাউকে নিয়োজিত করা হয় কর আদায়ের কাজে। বলা যায় তখন থেকেই কোন না কোন অর্থ উপার্জনের কাজে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকে তারা।

লিমাত এর প্রবাহ বয়ে গেছে যে ভ’খন্ডের বুক চির ধরিয়ে, এর উত্তর পশ্চিম অংশের শেষ থেকে শুরু হয়েছে জুরিখ লেক। এ লেকের দুই পাশেই পরিচ্ছন্ন অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান সৌন্দর্যের শহর জুরিখ। অসংখ্য সবুজ গাছের পাহাড় ঘেড়া এ নগরীটিই ক্যানটন জুরিখ (সুইজারল্যান্ডের প্রদেশকে বলা হয় ক্যানটন। ক্যানটন জুরিখ তেমনি একটি প্রদেশ) এর রাজধানী। নগরীটি এক দিকে যেমন সুইজারল্যান্ডের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র, তেমনি সংস্কৃতির রাজধানী । আর্ট গ্যালারির ছড়াছড়ি ইউরোপের অন্যতম প্রধান চিত্রকলা কেন্দ্র এখানে। শহরের ‘আর্ট মাইল’ হিসাবে পরিচিত একটি সড়ক রামিট্রাস। এর পাশে গায়ে গা লাগিয়ে অবস্থান একেকটি আর্ট গ্যালারির। জুরিখে জাদুঘরের সংখ্যা ৫০-এর বেশি।
জুরিখ নগরীর ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক কেন্দ্র হলো সৌন্দর্যের অপূর্ব বুননে বিন্য¯Í লিনডেনহোফ পাহাড়। পাহাড়টির ঠিক উত্তর দিকে রয়েছে সিটি পুলিশ স্টেশন, দÿিণে খুব কাছাকাছিই সেন্ট পিটার চার্চ, যাতে রয়েছে গোটা ইউরোপের সবচেয়ে বড়ো চার্চ ‘কক ফেস’। পশ্চিমে এর সীমা যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে সেখানে বানহোফস্ট্রেস বিপনী সরণি। মজার বিষয় হলো এর সড়ক ধরে হেঁটে গেলে পায়ের তলায় গড়াগড়ি খায় শত-সহস্র কোটি নগদ ডলার। শুধু তাই নয় মাটির নিচে রয়েছে কাড়ি কাড়ি মণিমাণিক, সোনাদানা সমেত বিশাল রতœভান্ডার। মূলত বিশ্ববিখ্যাত সুইস ব্যাংকগুলোর ভূগর্ভস্থ ভল্ট থাকার কারনেই সড়কেরই নিচে বিশাল এ রতœাগার। মাটির নিচেই শুধু নয়, ঐশ্বর্যের ছড়াছড়ি রাস্তার দু’পাশের বিপনীবিতানগুলোতেও। সবচেয়ে নামকরা সুইস ঘড়ি, বিশ্বখ্যাত চকোলেট, অলঙ্কার আর বিখ্যাত অনেক ব্র্যান্ড আর ডিজাইনার আইটেমের দোকান রয়েছে এখানে। কয়েকটি বড় শো রুমে দেখা যাবে চকচকে অস্ত্রধারী, ততোধিক ঝকঝকে চেহারার প্রহরী।
পাহাড়ের পূর্বদিকে স্বচ্ছ প্রবাহে বয়ে গেছে লিমাত নদী। নদী আর পাহাড়ের বন্ধন যেখানে এর ঠিক ৭০০ মিটার দÿিণ দিকেই লিমাতের সাথে সংযোগ ঘটেছে জুরিখ লেক এর। স্বচ্ছ স্ফটিকের মত পানিসমৃদ্ধ লেকের ধার থেকে আকাশের দিকে উঠে গিয়েছে যে পাহাড়, বহুদূরে তার মাথায় চিকচিক করে বরফ। আকাশের নীলও সেখানে ফুটে উঠেছে ভিন্ন এক বৈচিত্রে। সে নীলে চোখ তুলে তাকালে কোনও এক অপূর্ব প্রসন্নতায় ভরে যায় যে কারো মন। লেকের কোথাও উড়ে বেড়ায় কিংবা সাঁতার কাটে নানান প্রজাতির পাখি। কোথাও চারপাশে সবুজ পার্কেরমতো স্থান। পাহাড়ের মাঝখানে ছোট একটি উপত্যকার মতো রয়েছে যা পাবলিক স্কয়ার হিসাবে পরিচিত। লিমাত নদীর ধারে পুরনো জুরিখ সংরতি একটি এলাকা। এর আশপাশেই বিলাসি নগরী জুরিখ মেতে উঠে ভিন্ন এক বিলাসিতায়। প্রতি রাতে রেডমার্ক এ এলাকা ভেসে যায় নারী ও পুরুষের উন্মত্ততায়। লাল আলোকে কেন্দ্র করে আদিম আকর্ষণে অনেকেই ছুটে আসে নীল পরীর সন্ধানে।
পৃথিবীর অনেক নগরীগুলোতে মানুষের বসবাস গড়ে উঠার পর ধ্বংস করা হয়েছে প্রকৃতিকে এবং বিনস্ট করা হয়েছে সেকানকার সৌন্দর্য্য। কিন্তু জুরিখ এর ব্যতিক্রম। এখানে প্রকৃতি যেমনভাবে ঢেলে দিয়েছে সৌন্দর্য্য, তেমনি এখানকার বাসিন্দারা এগুলো বিনষ্ট না করে বরং গড়ে তুলেছে আরো মাধুরি মিশিয়ে। শহরের এখানে সেখানে শোভা পায় অসংখ্য ফোয়ারা। তাই জুরিখকে বলা হয় ফোয়ারার শহর। পুরো শহরে ছোটবড়ো মিলিয়ে ফোয়ারার সংখ্যা হবে হাজারের বেশি। প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়ে এগুলো জানান দেয় অন্যরকম এক ঐশ্বর্যের। ফোয়ারা নগরী জুরিখের সূর্য যখন আকাশের কোথাও তলিয়ে যাবার প্রস্তুতি নেয়, তখন হৃদয় ছুঁয়া বাতাস প্রকৃতিতে নিয়ে আসে ঠান্ডা এক আমেজ। আর সারাদিনের প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ, উষ্ণতার উঠানামা সবই ঘটে প্রায় সহনীয় পর্যায়ে। সেখানকার প্রকৃতির কোমল পরশে ভিন্ন এক আরামে পরিপূর্ণ হয়ে যেতে বাধ্য যে কারো মন। জুরিখের আবহাওয়া আদ্র। সেখানে বছরে পরিবর্তন হয় ৪টি ঋতুর। গ্রীষ্ম, শীত, বছরের তৃতীয় ঋতু(যা আমাদের দেশে শরৎ ও হেমন্তকাল) এবং বসন্ত। গ্রীষ্মে গড়ে তাপমাত্রা থাকে সর্বোচ্চ ২১-২৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ১০-১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। শীতে গড় তাপমাত্রা থাকে মাত্র ৪-৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আর তৃতীয় ঋতু ও বসন্তে সেখানকার আবহাওয়ায় বিরাজ করে মধ্যম মাত্রার ঠান্ডা। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এ শহরের সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দেয় তুষার পতন। হরহামেশাই পথে ঘাটে ছড়িয়ে থাকে ঝরা তুষারের ছিটেফোঁটা। সেখানকার আরামদায়ক এ আবহাওয়ার তুলনা কেবল হয় পৃথিবীর ভ’সর্গ ভারতের কাশ্মীর এলাকার সাথে। কাশ্মীরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ভারতের চলচ্চিত্রগুলোর শ্যুটিং করা হয় জুরিখসহ সুইজ্যারল্যান্ডের বিভিন্ন এলাকায়। কারণ স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে ভারতের দমন নীতির কারণেএ ভ’খন্ড শ্যুটিংয়ের জন্য নিরাপদ নয়।
প্রাচীনতম সভ্যতার বহি:প্রকাশ এ নগরী গড়ে উঠার পরও পৃথিবীতে সৃস্টি হয়েছে আরো অসংখ্য সভ্যতার। এগুলোর অধিকাংশর অ¯িÍত্বই বিলীন হয়ে গেছে কালের গর্ভে। কিন্তু আপন ঐশ্বর্য টিকিয়ে রেখে এখনও জীবণের জন্য নিরাপদ শহর হিসেবে টিকে আছে সৌন্দর্যের নগরী জুরিখ। ২০০৭ সালের শুমারী অনুযায়ী এ নগরীতে বসবাস ৩৫৮,৫৪০ লোকের। এদের মাঝে ৩০.৬ শতাংশ অধিবাসী সুইজারল্যান্ডের নাগরিক। তাদের অফিসিয়াল ও অধিকাংশ জনগণের ভাষা জার্মান। এদের মাঝে অনেকে জুরিখ জার্মান এবং অনেকে সুইস জার্মান ভাষায় কথা বলে। জার্মান হলো ৭৭ শতাংশ অধিবাসীর মাতৃভাষা। এছাড়া ইতালীয়ান ভাষায় কথা বলে ৪.৭ শতাংশ এবং অন্যান্য ভাষায় বলে ১ শতাংশ অধিবাসী। জুরিখের বাসিন্দাদের মাঝে বর্তমানে ক্যাথলিক খ্রিস্টানের সংখ্যা বেশি। তাছারা শহরের বাসিন্দাদের মাঝে একটি বড় অংশ নিজেদেরকে সকল ধর্ম মুক্ত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ তারা কোন ধর্মের অনুসারী নয়। তবে জুরিখের ইতিহাসে ভাবের পাগল আত্মত্যাগীদের বসতি এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন একেশ্বরবাদী ধর্মের অ¯িÍত্বের সন্ধান পাওয়া গেলেও পৌত্তলিকতার ছুঁয়া খুঁজে পাওয়া যায়না।

কোনিয়া
মসজিদ ও জাদুঘরের নগরী কোনিয়া। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানব বসতির সূচনা হওয়া এ নগরীতে রয়েছে বহু প্রাচীন মসজিদের অ¯িÍত্ব। আর বসতির ঘনত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে এর সংখ্যা। তাছারা এ নগরীতে রয়েছে বেশ কয়েকটি জাদুঘর। মূলত এ কারনেই কোনিয়াকে মসজিদ ও জাদুঘরের শহর বলা হয়। এক সময় এ নগরী ছিলো ইসলামের দূর্গ। এখানে বেড়ে উঠেছেন অনেক মুসলিম পন্ডিত। কোনিয়ার মাটিতে জন্ম হয়েছে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও ভাবান্দোলনের। এখানকার আধ্যাত্মিকতার আলো ছড়িয়ে গেছে পৃথিবীর অন্ধকারাচ্ছন্ন বিভিন্ন এলাকায়। ধারণা করা হয় বাংলাদেশের এক প্রান্তে শায়িত অলি হজরত শাহজালাল (রা.) এর জন্মও এ কোনিয়াতেই। সেখান থেকেই জ্ঞান আহরণের যাত্রা শুরু করে দীর্ঘ জীবণে আধ্যাত্মিকতা ও অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে তিনি আলোকিত করতে আসেন ভারতীয় উপমহাদেশকে। কারো কারো মতে হজরত শাহজালাল (রা.) এর জন্ম ছিলো ইয়েমনে। তবে অধিকাংশ মুসলিম পন্ডিতদের ধারণা ১২৭১ সালে তিনি তুরস্কের নগরী কোনিয়াতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন ইসলামি পন্ডিত, সুফি ও কবি জালাল উদ্দিন রুমীর সমসাময়িক একজন ইসলাম ধর্ম প্রচারকের পুত্র। বাংলাদেশে এ কথাটিই বেশি প্রচলিত রয়েছে যে তিনি ইয়েমন থেকেই সিলেটে এসেছিলেন। তবে ধারণা করা হয় ছোটবেলায় কিংবা প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে শাহ জালাল কোনিয়া থেকে ইয়েমনে চলে যান। তিনি বেড়ে উঠেন তাঁর মামা সাইয়েদ আহমেদ কবিরের কাছে। তাঁর কাছ থেকেই তিনি ইসলামের উপর অগাধ পান্ডিত্য অর্জন ও আধ্যাত্মিকতার ছুঁয়া পান। মোটামুটি ৩০ বছর তিনি মামার সান্নিধ্যে অধ্যয়ন ও আধ্যাত্মিকতায় ডুবে থাকেন। একদিন মামা সাইয়েদ কবির তাঁকে কিছু মাটি তুলে দিয়ে হিন্দু¯Íানের দিকে রওয়ানা হতে বলেন। সেইসাথে তিনি বলেন এই মাটির সাথে হিন্দুস্থানের যে অঞ্চলের মাটির মিল পাওয়া যাবে, সেখানেই যেন তিনি বসতি গড়েন। তিনি করলেনও তাই। দীর্ঘ সফরে রওয়ানা হয়ে যান হিন্দু¯Íানের উদ্দেশ্যে। সিলেট অঞ্চলের সাথে মামার দেয়া মাটির মিল পাওয়ায়, সেখানেই বসতি গড়ে তুলেন তিনি। এর উদ্দেশ্য ছিলো এ এলাকার নির্যাতিত, নিগৃহীত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তিনি জ্ঞানের আলো ছড়ালেন এখানকার বাসিন্দাদের মাঝে। যার ফলশ্রæতিতে সিলেটের মাটি পরিণত হলো পূণ্যভ’মিতে। এমনই অনেক মুসলিম সাধক তৈরি হয়েছিলেন কোনিয়ার মাটি থেকে। তারপর তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তকে আলোকিত করেছেন সত্যের আলো দিয়ে।
মুসলিম সুফিবাদ ও আধ্মাত্মবাদের দূর্গ পবিত্র ভ’মি কোনিয়া ধন্য হয়েছে হজরত শাহজালাল (রা.) এর বাবা জালালউদ্দিন রুমির স্পর্শে। পারস্যের এ কবি জীবণের শেষ পঞ্চাশটি বছর কাটিয়েছিলেন কোনিয়াতেই এবং এখানেই রয়েছে তাঁর সমাধিসৌধ। যা বর্তমানে মেভলানা জাদুঘর হিসাবে পরিচিত। রুমির অপর নাম মেভলানা। এ জাদুঘরে রুমির কবরের পাশেই রয়েছে তাঁর বাবা বাহাউদ্দিনের কবর। এ মাটি আলোকিত হয়ে উঠেছে ইবনে আরাবির মতো মুসলিম সুফিদের জ্ঞানের আলোতে। তিনি ১২০৭ সালে সেলজুক সরকারের আমন্ত্রণে সেখানে যান। এখানে বসবাস করেছেন ইতিহাসের রহস্যময় ব্যক্তি নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বা। ১৩ শতকের শেষের দিকে খুব সম্ভবত ১২৮৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এ মাটিতেই।
মুসলমান আধ্যাত্মবাদের এ ভ’মির অবস্থান প্রাচীন এনাতোলিয়া মালভ’মির কেন্দ্রে। ভ’মধ্য সাগর থেকে এর দূরত্ব ২৫০ কিলোমিটার এবং কৃষ্ণ সাগর থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ইতিহাস সন্ধানের উদ্দেশ্যে মাটি খনন করে দেখা যায় বর্তমান তুরস্কের প্রাচীন এ নগরী গড়ে উঠেছিলো তাম্র যুগের শেষের দিকে। অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালে। তবে এর ইতিহাস মোটামুটি স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বে হিটিটিস সময়কাল থেকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়কালে একে শাসন করেছেন বিভিন্ন শাসকরা। ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন নগরী জাজিয়ানটেপের মতো কোনিয়াও ছিলো মেসোপটিমিয়া সভ্যতার অংশ। জাজিয়ানটেপে বিভিন্ন শাসক গোষ্ঠির আগমন-প্রত্যাগমনের মতোইএখানেও ঘটেছে তাই। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সালের দিকে কোনিয়া নগরী চলে যায় সাগরে ভেসে আসা বণিকদের দখলে। খ্রিস্টপূর্ব ৮ শতকে কেন্দ্রীয় এনাতোলিয়ায় ফ্রেগেইনসরা তাদের রাজ্য স্থাপন করে।
৬৯০ খ্রিস্টপূর্বে এটি সিমেরিয়ানদের দখলে যায়। এর আরও পরে নগরীটি পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয় এবং পরসিয়ানদের হাতে থাকে ৩৩৩ খ্রিস্টপূর্বে আলেকজান্ডারের বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত। আলেকজান্ডার এক যুদ্ধে দারিউসকে পরাজিত করে তার সাম্রাজ্য আয়ত্বে নেন। পরবর্তীতে অর্ধেক পৃথিবীর শাসক আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য ভাগ হয়ে যায়। তখন কোনিয়া এলাকাটি অন্তর্ভূক্ত হয় আলেকজান্ডারের সামরিক অফিসার সেলুকাস এর শাসনের আওতায়। হেলেনিস্টিক সময়কালে নগরীটি শাসিত হয় পারগামন রাজাদের মাধ্যমে। সর্বশেষ পারগামন রাজা ৩য় আত্বালুস মারা যান এখানেই। ১০৭১ সালে সেলজুক তুর্করা এ এলাকা অধীনে নেয়। পরবর্তী ১০৯৭ সাল থেকে ১২৪৩ সাল পর্যন্ত কোনিয়া ছিলো রুম সালতানাতের রাজধানী। মূলত এ নগরীটি ব্যপকভাবে গড়ে উঠে ১২ শতকের শেষার্ধের দিকে। রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের কারণে ১২২০ সালে কোনিয়া পরিপূর্ণ হয়ে উঠে খারেজমিড থেকে আগত শরণার্থীদের দ্বারা। সেলজুক সময়কালের পর এ অঞ্চল শাসন করে অটোমানরা। স্বাভাবিকভাবেই নাগরিক সুবিধা ও অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দের জন্য বিভিন্ন অনুন্নত অঞ্চল থেকে মানুষ নগরমুখী হয়। এ প্রবণতার কারণেই মানবস্পন্ধনে ক্রমেই মুখরিত হয়ে উঠতে থাকে কোনিয়া। অটোমান সময়কালে ১৮৯৫ সালের এক হিসাবে এ নগরীর বাসিন্দা ছিলো পঁয়তালিøশ হাজার। এদের মাঝে ৪২,৩১৮ জন মুসলমান, ১,৫৬৬ জন আরমেনিয়ান খ্রিস্টান এবং ৮৯৯ জন গ্রীক খ্রিস্টান। তখন মসজিদের সংখ্যা ছিলো ২১ এবং চার্চ ৫টি। পরবর্তীতে ইটালিয়ান রেলওয়ে শ্রমিকদের জন্য ১৯১০ সালে একটি চার্চ নির্মাণ করা হয়। ১৯২৩ সালে গ্রীক-তুর্কি জনসংখ্যার আদান প্রদানের কারণে এটি কেবলমাত্র মুসলমানদের নগরীতে পরিণত হয়।
কোনিয়াতে তুরস্কের বৃহত্তর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি সেলকুক বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। এটি ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। নগরীটি একসময় সেলজুক সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল বলে সে সাম্রাজ্যের নামানুসারে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়। মূলত সেলজুক থেকেই সেলকুকের উৎপত্তি। কোনিয়া নগরীটি প্রাচীন হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এখানে রয়েছে অসংখ্য প্রাচীনতম নিদর্শন। আর এসব কারণেই কোনিয়া থেকে প্রতিনিয়ত ভেসে আসছে ইতিহাসের পদধ্বনি। এখানে রয়েছে প্রাচীন স্থাপনা আলাউদ্দিন মসজিদ। এটি নির্মিত হয়েছিলো ১২ এবং ১৩তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদের নামানুসারেই নামকরণ করা হয়েছিলো এর। ঐতিহাসিক এ স্থাপনার একভাগে মূল মসজিদ এবং অন্য ভাগে সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদসহ সেলজুক সালতানাতের বিভিন্ন ব্যক্তিদের কবর। কোনিয়াতে অবস্থিত প্রাচীন বিভিন্ন বিদ্যাপিঠ বর্তমানে অতীত নিদর্শনগুলোকে বুকে ধারণ করে জাদুঘর হিসাবে টিকে রয়েছে। এরকম জাদুঘর হলো ইঞ্চ মিনারাট মাদ্রাসা এবং কারাটায়া মাদ্রাসা।
মানুষের সন্তরণে সভ্যতা গড়ে উঠে মানুষের প্রয়োজনেই। এর কোনটি টিকে থাকে, কোনটি আবার হারিয়ে যায় সময়ের স্রোতে। আবার অ¯িÍত্ব টিকিয়ে রাখলেও অনেক সভ্যতা থেকে বিলীন হয়ে যায় অতীত অনেক শিল্প ও সংস্কৃতির ব্যবহারিক দিক। কিন্তু কোনিয়া এখনো জলাঞ্জলি দেয়নি তাদের অতীত সৌখিন শিল্প গালিচা বুনন। জাজিয়ানটেপের মতোই এ নগরীর গালিচাও বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তেমনি এ ভ’খন্ডটি সমাদৃত এখানকার আধ্মাত্বিক সাধক ও মুসলিম সুফিদের পান্ডিত্যের জন্য। তবে ধর্ম নিরপেÿ তুরস্কের বৈরি বাতাস বয়ে গেলেও একেবারে লন্ডভন্ড করে দিতে পারেনি একসময়কার ইসলামের দূর্গ এই নগরীকে। এখনো পরম যতেœ অতীতকে আগলে রেখেছে পবিত্র ভ’মি কোনিয়া।

গীজা
পিরামিডের নগরী গীজা। প্রাচীন এ নগরীতে অবস্থিত আশ্চর্য স্থাপনা গ্রেট পিরামিড গীজা। অনেকের ধারণা এ স্থাপত্যটি চাঁদের বুক থেকেও দেখা যাওয়া সম্ভব। এখানে রয়েছে মায়াবী এক স্থাপনা স্ফিংসসহ আরো অনেক পিরামিড। পিরামিডের কারণে বিশ্বব্যাপী এ ব-দ্বীপটি পরিচিত হলেও অনেকের ধারণা এটি পরিপূর্ণ এক মরু এলাকা। মূলত তা নয় মিশরীয় সংস্কৃতির গুরুত্বপূণৃ এ স্থানে রয়েছে ঘনবসতি। ২০০৬ সালের এক হিসাব অনুযায়ী গীজাতে রয়েছে ২,৬৮১,৮৬৩ জনের বসতি। নীল নদের পশ্চিম তেির অবস্থিত নগরী গীজার অবস্থান রাজধানী কায়রো থেকে ২০ কিলোমিটার দÿিণ পশ্চিম দিকে। বর্তমানে এটি গীজ গভর্ণরেটের রাজধানী। আরবি ‘গীজা’ শব্দের অর্থ ‘সীমান্ত’। আর এ কারণেই গ্রেট পিরামিড গীজাকে অবস্থানগতভাবে বলা হয় মাঝে এবং সীমান্তে।
মিশরের প্রাচীন এ মালভ’মিতে বসতির সূচনা শুরু হয়েছে ৫০০০ বছর আগে ফারাউ শাসকদের সময় থেকে। ধারণা করা হয় এ নগরীটি গড়ে উঠেছে খ্রিস্টপূর্ব ২৫৬৮ সালে। পিরামিড নির্মাণ ও এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পেশার উপর ভিত্তি করে এখানে বসতির শুরু হয়। আর ক্রমেই এতে আসতে থাকে নতুন নতুন পরিবর্তন। তবে নগরীটির জৌলুস ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় ১৮ শতকে এবং সা¤প্রতিক বিংশ শতাব্দীতে। এখানে রয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ২৬০১ থেকে ২৫১৫ সাল পর্যন্ত ফারাউ শাসক মেনকিউর, খাফরে এবং খুফুর স্মৃতি।
গীজাতে সারা বিশ্ব থেকে পর্যটকরা ছুটে আসে ‘গ্রেট পিরামিড গীজা’র আকর্ষণে। মিশরে পিরামিডের সংখ্যা ১০০ টিরও বেশি, এর মাঝে সর্বোচ্চ এবং শ্রেষ্ঠ পিরামিড হলো গীজা। মিশরের গীজা ব-দ্বীপে অবস্থিত পিরামিডগুলোর মাঝে এটি সর্ববৃহৎ এবং সর্বাধিক পরিচিত। তাই এ পিরামিডকেই বলা হয় গীজা। গীজাতে উলেøখযোগ্য আরো তিনটি পিরামিড রয়েছে, এগুলো হলো গ্রেট পিরামিড অব খেফরান, গ্রেট পিরামিড অব মেনকিউর এবং স্ফিংস। সিংহের দেহ ও মানুষের চেহারার আকৃতিতে নির্মিত স্ফিংস যেন এক বিশাল মায়াবী মানবপশু।
মিশরের এ ব-দ্বীপটিকে বলা যায় সমাধির দ্বীপ। কারণ পিরামিড সমাধিসৌধ হিসেবেই পরিচিত। প্রাচীন মিশরীয় প্রতাপশালী ফারাও শাসকরা মারা গেলে তাদের লাশ সংরÿণে রাখার জন্য নির্মাণ করা হতো পিরামিড। তাদের ধারণা ছিলো এর ভেতরই অতিবাহিত হবে মৃতের পরবর্তী জীবণ। আর দ্বিতীয় জীবন সুখে শান্তিতে অতিবাহিত করার জন্য এগুলো নির্মাণ করা হতো রতœাগারসমেত। এসব রতœাগারে লাশ রেখে আসার সময় তারা দিয়ে আসতো অনেক ধন-রতœও। তাছারা নিয়মিত সেখানে দেয়া হতো খাবার।
পিরামিড বলতে পৃথিবীব্যাপী যেটি পরিচিত সেটি হলো, মিশরের গীজায় অবস্থিত সবচেয়ে উঁচু পিরামিড গীজা। অন্যগুলোর মতো গীজার ভেতর কোন ফারাও রাজার মৃতদেহ নেই। আর স্বাভাবিকভাবেই এ কারণে কোন রতœাগারও নেই। কিন্তু অনেক চোরদের ধারণা ছিলো গীজার ভেতরও রয়েছে অঢেল রতœ ভান্ডার। এ কারণে বিভিন্ন সময় কাঙ্খিত সে রতœগুলোকে সরিয়ে ফেলার জন্য এতে অভিযান চালাতো তারা। কিন্তু এর ভেতরকার সুড়ঙ্গগুলোর বিন্যাস ও গতিপথ এতই জটিল ছিলো যে পথ হারিয়ে ফেলতো অনেক রতœ লুটেরা। গীজাকে সঠিক ব্যবস্থাপনায় নেয়ার আগে বহু চোর এবং কৌতুহলীদেরকে লাশ হতে হয়েছে এর ভেতর।
পৃথিবীর এই আশ্চর্য স্থাপনাগুলোকে বুকে ধারণ করে পর্যটন নগরী হিসাবে টিকে আছে গীজা। মিশরের অর্থনীতিতে বড় একটি অবদান রাখছে এই নগরীর আশ্চর্যতম আকর্ষণ।

জিয়ান

আদিম মানুষের একটি গোষ্ঠী ল্যানটিয়ান। বর্তমান পৃথিবীতে এই গোষ্ঠীকে নিয়ে সৃস্টি হয়েছে অনেক প্রশ্নের। সেই সাথে এদেরকে নিয়ে প্রচলিত রয়েছে অনেক কিংবদন্তি। কেউ কেউ এদেরকে মানুষ হিসাবে বিবেচনা করলেও নির্দ্বিধায় পুরোপুরি মানুষের আওতায় ফেলছেননা। কেওবা বলছেন এরা আদৌ মানুষ ছিলোনা। আবার কেউ তুলে ধরছেন বিবর্তনবাদের যুক্তি। ১৯৬৩ সালে চীনের ল্যানটিয়ান এলাকায় আদিম মানুষ ল্যানটিয়ানদের অ¯িÍত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমান ল্যানটিয়ানের ৫০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিম দিকেই চীনা সংস্কৃতির সমৃদ্ধ নগরী জিয়ান। অনেকেই ধারণা করছেন ইতিহাসের প্রাচীনতম এ এলাকায় বসতির সূচনা হয়েছে ল্যানটিয়ানদের মাধ্যমেই। পর্যায়ক্রমে তা এসে উপনীত হয়েছে আজকের জৌলুসপূর্ণ অবস্থায়। অনুমান করা হয় নগরী হিসাবে এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব ২২০৫ সালে। জিয়ান ঐতিহাসিকভাবে ‘চেঙ্গান’ নামে পরিচিত। এটি বর্তমান চীনের শাঞ্জি প্রদেশের রাজধানী। চাইনিজ শব্দ জিয়ানের অর্থ ‘শান্তি’।
জিয়ান সংস্কৃতি সমৃদ্ধ নগরী। খ্রিস্টপূর্ব ১১ শতকে এটি চীনের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক রাজধানী হিসাবে পরিচিতি পায়। তখনকার জউ শাসনের রাজধানী ছিলো বর্তমান জিয়ানের পশ্চিম অংশ ফেঙ্গ এবং হাউ এলাকা। পরবর্তীতে অর্থাৎ ২২১-২০৬ খ্রিস্টপূর্বের সময়কাল চীন ছিলো কীন শাসনের অধীনে। তখনও এ নগরীর রাজধানী ছিলো উত্তর পশ্চিম এলাকা জিয়ানায়াঙ্গ। এই জিয়ানায়াঙ্গই বিবর্তনে জিয়ান-এ এসে পৌঁছায়। খ্রিস্টপূর্ব ২০২ সালে হান শাসনের প্রতিষ্ঠাতা লিউ বগের সময়ও চাঙ্গান এর রাজধানী ছিলো এই নগরী। এখানেই তিনি নির্মাণ করেন চাঙ্গালী পেলেস। বর্তমান জিয়ানের উত্তর অংশে উয়িয়াঙ্গ প্যালেসটিও নির্মাণ করেন তিনিই। ২০০৫ সালের শেষের দিকের এক হিসাবে জিয়ানের লোকসংখ্যা ছিলো ৮.০৭ মিলিয়ন। যার ৫১.৬৬ শতাংশ ছিলো পুরুষ এবং ৪৮.৩৪ শতাংশ ছিলো মহিলা। জিয়ানের অধিবাসীদের অধিকাংশ হান চাইনিজ। যাদের পরিমাণ ৯৯.১ শতাংশ। শহরে মুসলিম হুই এর সংখ্যা ৫০,০০০।
প্রাচীন এ নগরীতে এখন রয়ে গেছে ইতিহাসের অনেক চাপ। নগরীর চারপাশ ঘিরে রেখেছে ঐতিহাসিক একটি দেয়াল। এখানে রয়েছে কীন শি হুয়ান্ডা এর সমাধি ফলক এবং তার সময়কার তৈরি টেরাকোটা আরমি। তাছারা এখনো কাঠামো টিকে রয়েছে জউ শাসনের অনেকের সমাধীসৌধের।


আসিয়ুট
কায়রো থেকে ৩৭৫ কিলোমিটার দÿিণে প্রাচীন নগরী আসিয়ুটের অবস্থান। ধারণা করা হয় এ এলাকা নগরী হিসাবে গড়ে উঠেছিলো ফারাও শাসকদের সময় ২১৬০ খ্রিস্টপূর্বে। বর্তমান মিশরের আধুনিক আসিয়ুট প্রদেশের রাজধানী এ শহরটি ৩১০০ খ্রিস্টপূর্বে ছিলো মিশরের একটি প্রশাসনিক বিভাগ। যাকে বলা হতো নোম। মিশরীয় খ্রীস্টানদের উলেøখযোগ্য পরিমাণের বসবাস এখানে।
নীল নদের পশ্চিম তীরের জৌলুসপূর্ণ এ নগরী মূলত একটি দ্বীপ। এর আকৃতি কলাসদৃম্য হওয়ায় ইংরেজীতে একে বেনানা দ্বীপ বলা হয়। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং মুক্ত আবহাওয়ার আকর্ষণে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন অবকাশ কাটানোর জন্য। শেফার্ড শাসনের সময়কালে এ দ্বীপটি প্রথম আবিষ্কার করেন রিকামাই।
বর্তমানে আসিয়ুট মিশরের কৃষিÿেত্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্র। এখানে রয়েছে বিখ্যাত বিদ্যাপিঠ আসিয়ুট বিশ্ববিদ্যালয়। যা মিশরের ৩য় বৃহত্তম একটি বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে ১৯০২ সালে নির্মাণ করা হয় আসিয়ুট ব্যারেজ। মিশরের প্রাচীন এ নগরীর উলেøখযোগ্য একটি প্রতিষ্ঠান হলো লিলিয়ান ট্রেশার এতিমখানা। যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী লিলিয়ান ট্রেশার। ১৯৬১ সালে তিনি আসিয়ুটেই মৃত্যুবরণ করেন। ৫ম শতকের গ্রীক কবি কলুনুস উঠে এসেছিলেন এ নগরী থেকেই। এখানকার বাসিন্দা ছিলেন মিশরের ২য় প্রেসিডেন্ট জামাল আবদাল নাছের।









লাক্সার

দÿিণ মিশরের নগরী লাক্সার। একটি উন্মুক্ত জাদুঘর হিসাবে এ নগরীর পরিচয় রয়েছে বিশ্বব্যাপী। অর্থাৎ পুরো লাক্সার শহরটিই একটি জাদুঘর। এর প্রতিটি অলি-গলিতে খুঁজে পাওয়া যায় ইতিহাস। নগরীর বাতাসে প্রতিনিয়ত ভেসে বেড়ায় ইতিহাসের পদধ্বনি। উন্মুক্ত জাদুঘরের এ শহরে রয়েছে অসংখ্য মনুমেন্ট, গীর্জা এবং সমাধিসৌধ। এখানকার আকর্ষণ নীল নদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত কিং ভ্যালী এবং কুইন ভ্যালী। খ্রিস্টপূর্ব ১৬ থেকে ১১তম শতকে সেখানকার রাজা এবং প্রতাপশালীদের সমাহিত করা হয়েছে এ কিং ভ্যালিতে আর তাদের স্ত্রীদের সমাধি রয়েছে কুইন ভ্যালিতে। আর এ কারণেই পৃথিবীর পর্যটকদের টেনে আনে ঐতিহাসিক এ স্থান।
লাক্সার নগরী বর্তমান মিশরের লাক্সার গভর্ণরেটের রাজধানী। ৪১৬ কিলোমিটার ব্যাপ্তীর এ নগরীতে ১৯৯৯ সালের হিসাব অনুযায়ী ৩৭৬, ০২২ জন লোকের বসবাস। মিশরের প্রাচীন নগরী থিবিস এর একটি অংশ লাক্সার। থিবিস হলো গ্রীক একটি নাম। মিশরের একটি নগরী হিসাবে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বে এটি শুরু হয়। ধারণা করা হয় লাক্সার নগড়ী হিসাবে গড়ে উঠেছিলো ২১৬০ খ্রিস্টপূর্বে। স্থানীয়ভাবে এটি পরিচিত ছিলো প্রধানতম নগরী হিসাবে। কোনসময় এটি পরিচয় পেয়েছে ‘রাজদন্ডের নগরী’ হিসাবে। আবার এটি বর্তমানে সমাধিসৌধের নগরী হিসাবেও পরিচিত। এ নগরীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় মূলত সা¤প্রতিক ১১তম শাসকের সময়। মূলত তখনই শহরটি সমৃদ্ধি লাভ করে। তখন থেকেই বৃদ্ধি পায় বাসিন্দাদের জীবণযাত্রার মান, সামাজিক অবস্থান এবং নগরীর জৌলুস। সেই সাথে এটি প্রজ্ঞা, শিল্প, ধর্ম এবং রাজনীতির কেন্দ্রও হয়ে উঠতে থাকে ক্রমেই।
লাক্সারের অর্থনীতি মিশরের অন্যান্য নগরীর মতোই। তবে এর বড় অংশ নির্ভর করে পর্যটন শিল্পের উপর। আর এখানকার উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম কৃষি। বাসিন্দাদের বড় একটি অংশই কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল।

লিসবন
ইতিহাসের প্রাচীনতম নগরী লিসবন। পর্তুগালের পশ্চিম অংশের এ নগরী ছুঁয়েই প্রবাহিত হচ্ছে টাগুস নদী। সভ্যতার ধুলিকণাকে সময়ের স্রোতে প্রবাহিত করে দিয়ে আপন প্রবাহে আটলান্টিক মহাসাগরে নিজেকে বিলীন করে দিচ্ছে এ নদী। বর্তমানে লিসবনের বড় পরিচয় হলো এটি পর্তুগালের রাজধানী। স্থানীয়ভাবে এর উচ্চারণ লিসবয়া। ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালে গড়ে উঠেছিলো নগরীটি। তবে সেই সময় থেকে এর ইতিহাস স্পষ্ট করে কিছুই বলা যায়না। প্র¯Íর যুগে এখানে বসতি ছিলো আইবেরিয়ানদের। এ আইবেরিয়ানদের অধিকাংশই তখন বসবাস করতো আটলান্টিক ইউরূপে। সম্ভবত তারা এ এলাকায় এসে বসতি স্থাপন করে।
মূলত লিসবন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সংস্কৃতিকভাবে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধিলাভ করে ক্রুসেডারদের অধিগ্রহণে যাবার পর থেকে। খ্রিস্টপূর্ব ১১৪৭ সালে ক্রুসেডাররা খ্রিস্টানদের বসতির জন্য দখল করে নেয় এ এলাকা । এর পর থেকে লিসবনের জৌলুস ক্রমেই বাড়তে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতকে নগরীটি অধিগ্রহণ করে মুরস। আর ৫ম শতকে অধিগ্রহণ করে জুলিয়াস কায়জার। পরবর্তীতে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ সালে লিসবন চলে যায় রোমানদের অধীনে।

বর্তমানে ৮৪.৮ বর্গকিলোমিটারজুড়ে ব্যাপ্ত লিসবন শহরের জনসংখ্যা ৫৬৪৫৬৭ জন। এর মাঝে পৌর এলাকার স্থায়ী অধিবাসী ২.৮ মিলিয়ন এবং ৩.৩৪ মিলিয়ন লোক ঘিঞ্জিভাবে বসতি স্থাপন করেছে নগরীর সীমান্তে। পর্তুগালের অর্থনীতিতে সম্পদে সমৃদ্দশালী এ নগরীর বড় অংশের অবদান থাকে। নগরীর পশ্চিম দিক মানসান্টু ফরেস্ট পার্কের সবুজ বেস্টনিতে ঘেরা। ইউরুপের বৃহত্তম এ পার্কটির ব্যপ্তি ১০ বর্গ কিলোমিটার।
ভ’মধ্যসাগরীয় আবহাওয়ার নগরী লিসবন স্থাপত্য শিল্পে সমৃদ্ধ। এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে রুমান, গোনিক, ম্যানুইলাইন, বারাকুই, পর্তুগীজ, আধুনিক, উত্তরাধুনীকসহ বিভিন্ন সময়কালের নানা আকর্ষণীয় স্থাপনত্য শৈলী। শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য প্রাচীন মনুমেন্ট আর ঐতিহাসিক স্থাপনা। যেগুলো থেকে প্রতিনিয়ত ভেসে আসছে ইতিহাসের পদধ্বনি।

সোমবার, আগস্ট ০৩, ২০০৯

সেরা কর্মীর সম্মাননা গ্রহণ করছি

কর্মক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় ২০০৮ সালের সেরা কর্মীর সম্মাননা গ্রহণ করছি।
ঘটনাটা ঘটেছিলো ২০০৯ এর ২৭ জুলাই।
বি:দ্র: ছবির সৌন্দর্যবর্ধনের প্রয়োজনে আমাদের ব্র্যান্ড ম্যানেজার সাহেবের চেহারা ক্যামেরার সামনে স্পস্ট দেখা গেলেও অতিশয় অস্পস্ট ও ক্ষীণ চেহারার লোকটা যে সত্যি সত্যিই আমি এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

রবিবার, আগস্ট ০২, ২০০৯

ইতিহাসের পদধ্বনি: প্রথম পর্ব


শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
মানব বসতির বিভিন্ন পর্যায়ে গড়ে উঠেছিলো সভ্যতম অনেক নগরী। নাগরিক সুবিধার বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল এ নগরীগুলো মানুষ গড়ে তুলেছিলো নিজেদের প্রয়োজনেই। নিজস্ব বুদ্ধিমত্তার যে আলাদা গুণ রয়েছে মানুষের মাঝে, এ কারণেই তাদের পÿে প্রকৃতির অনেক অনুষঙ্গকে নিজেদের মতো গড়ে নেয়া সম্ভব। কিন্তু এগুলো টিকিয়ে রাখাও কি মানুষের সাধ্যের ভেতর? নাহ, যদি তাই হতো তবে পৃথিবীতে গড়ে উঠা অনেক সভ্যতাই হারিয়ে যেতোনা সীমাহিন শূন্যে। প্রাচীন নগরীগুলোর মাঝে কোনটির স্থান এখন কেবল ইতিহাসের পাতায়। আবার কোনটির খবর হয়তো বর্তমান পৃথিবীর কেউ জানেইনা। অপরদিকে কালের ধূলোয় পুরনো অনেক নগরীই সৃস্টির পর থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ধরে রাখতে পেরেছে প্রাণশক্তি। এখনো প্রাণোচ্ছল সেই নগরীগুলোর শিরা উপশিরায় বিরাজ করে জীবণের উষ্ণতা। প্রকৃতি তার আপন নিয়মেই গিলে ফেলে সভ্যতম অনেক জনপদকে। আবার আপন নিয়মেই সময়ের সাথে টিকিয়ে রাখে কোন কোন নগরীর প্রাণ। প্রকৃতির এই নিয়মকে বেঁধে দিয়েছেন যে সত্ত¡া, তাঁর ইচ্ছার উপরই নির্ভর করে জীব, জগত, নগর এবং সভ্যতার উত্থান পতন। এ পরম সত্ত¡ার সাথে তুলনীয় নয় অন্য কোন কিছুই। কিন্তু তবুও কালের অভিযাত্রায় বিভিন্ন পৌত্তলিক নগরীতে পূজনীয় করে তোলা হয়েছিল অন্য কোন সত্ত¡াকে। অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, কালের স্রোতে ভেসে যাওয়া অসংখ্য নগরীর প্রায় সবই ছিলো পৌত্তলিকতায় পরিপূর্ণ। অন্যদিকে গড়ে উঠার পর হাজার হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে বেঁচে থাকা নগরীগুলোতে পাওয়া যায়না এতটুকু পৌত্তলিকতার ছুঁয়া। এমন কয়েকটি প্রাচীন শহরই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যেগুলো থেকে প্রতিনিয়ত ভেসে আসছে ইতিহাসের পদধ্বনি।

জাজিয়ানটেপ
কোথাও জলপাই বন, কোথাও ভিনেয়ার্ড কিংবা পে¯Íাবাদমের তরুবিথী আগলে রেখেছে প্রাচীন এ শহরটিকে। ভ’মধ্য সাগরের ১২০ কিলোমিটার পূর্বেই এর অবস্থান। অদূরে বয়ে গেছে ইউফ্রেটিস নদীর সরু একটি প্রবাহ সাকিরসুঁই। ইতিহাসের কোন এক ভাঁজে এ শহরটি গড়ে উঠেছিলো নাগরিক জীবণের উপযোগী হিসাবে। এখানকার প্রাচীন স্থাপনাগুলো এখনো শব্দ তুলে মাটি এবং মানুষের হৃদয় নিংড়ানো পললের। এখানে কান পেতে এখনো অনুভব করা যায় প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার স্পন্ধন।
পৃথিবীর প্রাচীনতম শহরগুলোর মাঝে জাজিয়ানটেপ হলো সবচেয়ে পুরনো। ধারণা করা হয় তুরস্কের এ শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো আজ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছরেরও (খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৫০) আগে। সময়ের স্রোতে প্রবাহিত হয়ে অনেক শহর গড়ে উঠলেও আবার এ স্রোতেই বিলীন হয়ে গেছে সেগুলো। কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন নগরী জাজিয়ানটেপ আজ পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছে প্রাণ শক্তি। একদিন যে নগরীতে স্পন্দন তুলেছিলো মানুষ, সেই নগরী এখনো আগলে আছে মানুষের কোলাহলকে। তুরস্কের দÿিণ পূর্বাঞ্চলের সবেচেয়ে বড় শহর এই জাজিয়ানটেপ। আরো মজার ব্যাপার হলো মেসোপটেমিয়া সভ্যতাকেও ধারণ করেছিলো এখানকার অধিবাসীরা। ঐতিহাসিক মেসোপটেমিয়া সভ্যতার দÿিণ পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত এনাটোলিয়া পর্যটন এলাকা। সভ্যতম এনাটোলিয়ার পশ্চিমেই জাজিয়ানটেপের অবস্থান। অতীতকে জানার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিয়ত মানুষ ছুটে আসছে এনাটোলিয়াতে। ভাবের জগতে ভর করে ভ্রমণে বেরিয়ে পরছে মেসোপটেমিয়ায়। আর তাদের ভাবনার উপকরণ হিসাবে কাজ করছে অসংখ্য প্রাচীনতম নিদর্শন। এগুলোর অনেক কিছুকেই প্রদর্শনের জন্য সংরÿনে রেখেছে জাজিয়ানটেপ জাদুঘর। শহরের বুকে মজবুত ভীত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন স্বাÿীগুলো পর্যটকদের কানে কানে বলে যাচ্ছে সময়ের কাহিনী। কেবল তাই নয় এর আয়তন, ছিমছাম আধুনিকতা, নান্দনিক বিন্যাস এবং জৌলুস যে কাউকে টেনে নিতে বাধ্য অতিত মেসোপটেমিয়ায়। আয়তনের দিক থেকে সমগ্র তুরস্কে এর অবস্থান ষষ্ঠতম। প্রাচীন এ শহরকে কেন্দ্র করে বর্তমান তুরস্কে জাজিয়ানটেপ নামে রয়েছে একটি প্রদেশ। প্রশাসনিকভাবে প্রদেশ জাজিয়ানটেপ পরিচালিত হয় দুটি কেন্দ্রীয় জেলার অধীনে। এর একটি সাহিনবে এবং অপরটি সেহিতকামিল। দÿিণ দিক থেকে জাজিয়ানটেপের সীমা সিরিয়ার সাথে। তবে সেদিকের এক অংশে রয়েছে কিলিস। উত্তরে আদিয়ামান, পূর্বে সানলিউরফা, দÿিণ পশ্চিমে হাটায়, পশ্চিমে ভ’মধ্য সাগর ও জাজিয়ানটেপের মাঝখানে ওসমানিয়া এবং উত্তর পশ্চিমে কাহরামানমারাসের অবস্থান।
ভৌগলিক ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জাজিয়ানটেপ প্রাচীন কাল থেকেই বন্ধুত্বপূর্ণ ও উদার শহর হিসাবে পরিচিত। আকর্ষণীয় নির্মাণশৈলী ও সভ্য মানুষের পদচারনায় ২১৩৮ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত এ শহরটি পরিণত হয়েছে জীবন্ত এক আধুনিক শহরে। ১৯১১ সালের এনসাইকোপিডিয়া ব্রিটেনিকার তথ্য অনুযায়ী ১৯ শতকের শেষের দিকে এর জনসংখ্যা ছিলো ৪৫,০০০ এর মতো। এর দুই তৃতীয়াংশ ছিলো মুসলমান। আর সর্বশেষ ২০০৭ সালের শুমারি অনুযায়ী মেট্রোপলিটন এরিয়ার লোকসংখ্যা ১,২৩৭,৮৭৪। এদের মাঝে সিরিয়ান ইহুদীদের সংখ্যাও উলেøখযোগ্য পরিমাণ। নানা সময় সিরিয়ান ইহুদীদের এনটেবি বংশীয়রা বি¯Íার লাভ করে। আর সেখানকার খ্্িরস্টানদের অধিকাংশই হলো আরমেনিয়ান।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসকের অধীনে থাকার কারণে জাজিয়ানটেপ গড়ে উঠেছে ভিন্ন এক মাত্রায়। এখানে রয়েছে নানান মানব গোষ্ঠী, ভাষা ও সংস্কৃতির ছুঁয়া। আর তাই সংস্কৃতি ভেদে এর নাম নিয়েও রয়েছে ভিন্নতা। জাজিয়ানটেপ নগরী প্রাচীন গ্রীক এবং রোমানদের কাছে দোলিখ নামে পরিচিত। যাকে তুর্কিরা দুলুক বলে থাকে। কুর্দিদের ভাষায় এটি দিলোক, আরাবীয়দের ভাষায় সেলজুকস এবং অটোমানদের কাছে এইনটেব নামে পরিচিত।
প্রাচীনতম এ নগরীর বয়স এবং ইতিহাস সন্ধানে মানুষের চেষ্টার শেষ নেই। কিন্তু এখন পর্যন্ত ইতিহাসের লেজ ধরে ধরে অন্ধকারে এগিয়ে চললেও নগরীর শুরুর সময়কালে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে এর কোন ইতিহাস পাওয়া না গেলেও অনুমান করা হয় তাউরুস পাহাড়ের উপর প্রতিষ্ঠিত অ্যান্টিওছিয়া আত তাউরুস নামক শহরের একটি অংশ ছিলো এটি। ইতিহাসের পথ ধরে যতদূর আগানো যায়, সে সময়টা ছিলো খ্রিস্টপূর্ব ১৮ শতকে প্রাচীন এনাটোলিয়ান সভ্যতার হিটিটিস সময়কাল। কারণ বর্তমানে এখানে সময়ের স্বাÿী হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন কেলøা ও স্থাপত্যগুলোর সাথে হিটিটিসদের বৈশিষ্ট্যের মিল পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে অসংখ্যবারই হাত বদল হয়েছে এর প্রশাসনিক ÿমতা। প্রথম নাগরিক সভ্যতার ধারক হওয়ার কারণেই নানা যুদ্ধ বিগ্রহ ও উত্থান পতনের স্বাÿী হয়ে আছে এই জাজিয়ানটেপ। সাত শতকের প্রথম দিকে আরবীয়রা এই অঞ্চলে আধিপত্য বি¯Íার করে। আরবীয় শাসনের সময় বিভিন্ন সময়ে এ অঞ্চল পূর্ব রুমানদের অধীনেও যায়। আব্বাসীয় শাসনের অবসানের পর জাজিয়ানটেপ টুলুনিভস, ইখসিডিডস এবং হামদানীডসদের শাসনের অধীনেও যায়। ৯৬২ খৃস্টাব্দে পূর্ব রুমানীয় অর্থাৎ বিজানটিন্সরা এ অঞ্চল দখল করে নেয় এবং ১০৬৭ খ্রীস্টাব্দে সেলজুকদের বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। তারা তুরস্কে সেলজুক সালতানাত প্রতিষ্ঠা করে। ১০৮৬ সালে এনাটোলিয়ান সেলজুকদের কাছ থেকে এর শাসন চলে যায় সিরিয়ান সেলজুকদের কাছে। প্রথম ক্রুসেড শুরু হলে ১০৯৮ সালে এটি ক্রুসেডারদের দখলে চলে যায়। এটি ১২৫০ সালে সেলজুক সালতানাতের পুন:প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত টিকে থাকে। সিলিসিয়ার আরমেনীয় রাজ্যের দ্বারা জাজিয়ানটেপ অধিকৃত ছিল ১১৫৫ থেক ১১৫৭ সাল পর্যন্ত এবং ১২০৪ থেকে ১২০৬ সাল পর্যন্ত। ১১৭২ সালে এ অঞ্চল অধিকার করে নূরউদ্দীন জঙ্গি। পরবর্তীতে ১১৮১ সালে তা ইতিহাসের প্রখ্যাত বীর সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর শাসনের অধীনেও ছিলো। ১২১৮ সালে রোমের সেলজুক সালতানাত পুন: অধিগ্রহণ করে জাজিয়ানটেপকে। জাজিয়ানটেপ মঙ্গোলীয়দের শাসনাধীন ছিলো ১২৬০-১২৬১, ১২৭১-১২৭২, ১২৮০-১২৮১ এবং ১২৯৯-১৩১৭ সাল পর্যন্ত। ইসলাম ধর্মে দীÿিত হওয়া ¯øাভদের অধীনে ছিলো ১২৬১-১২৭১, ১২৭২-১২৮০, ১২৮১-১২৯৯, ১৭১৭-১৩৪১, ১৩৫০-১৩৭৮, ১৩৮১-১৩৮৯ এবং ১৩৯৫-১৫১৬ সাল পর্যন্ত। ১৫১৬ সালে মার্জদাবিক এর যুদ্ধের পর অটোমানরা এ এলাকা অধিগ্রহণ করে।
সময়ের স্বাÿী জাজিয়ানটেপ মূলত দীর্ঘ বয়সের মহিমায়ই পরিচিত পুরো পৃথিবীতে। সেই সাথে আপন সৌন্দর্য এবং অর্থনৈতিক কারণেও রয়েছে এর খ্যাতি। তামার তার এবং ইয়ামেনী ¯িøপারের জন্য এ অঞ্চল প্রসিদ্ধ। তুরস্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ শিল্প এলাকাকে দÿিণপূর্ব এবং পূর্ব তুরস্কের বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে ধরা হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এ শহরটি সেজে উঠলেও আপন ঐশ্বর্যকে কখনো জলাঞ্জলি দেয়নি জাজিয়ানটেপ। ইতিহাসের অলিগলি দাবড়িয়ে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে পৃথিবী থেকে পর্যটকরা এসে ভীর করে প্রতিনিয়ত। তাই বেশ কিছু উন্নত পর্যটন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেখানে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো তুরস্কের অর্থনীতিতে রাখছে বড় একটি ভ’মিকা। জাজিয়ানটেপ থেকে উৎপাদিত পণ্যের মাঝে স্ট্রাইপড সিল্ক, কটন ফেব্রিক, চামড়া জাত পণ্য, জলপাই তেল, আঙ্গুর থেকে তৈরি মিষ্টি, তামাক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এখানকার উৎপাদিত পে¯Íাবাদাম পৃথিবীব্যাপি খ্যাত বলে জাজিয়ানটেপ তুরস্কে পে¯Íাবাদামের শহর হিসাবে পরিচিত।
জাজিয়ানটেপ থেকে উৎপাদিত গালিচার বেশ কদর রয়েছে বিশ্বে। গালিচা তৈরি এখানকার অনেকের ঐতিহ্যবাহী পেশা। প্রাচীন জাজিয়ানটেপের নারীরা পশম দিয়ে গালিচা বুনন করতো। তারা এ গালিচাকে নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়ে তুলতো। গালিচাকে তারা দেখতো কবিতার চিত্ররূপ হিসাবে। এর নকশাগুলোর মাঝে প্রস্তুতকারীরা ফুটিয়ে তুলে মানুষের রহস্যময় আচরণ। কখনো কখনো এসব গালিচায় থাকে ময়ূর, ঘাস খাচ্ছে এমন হরিণ, উঁচু সাইপ্রেস গাছ, অলঙকৃত ফুলদানি, জলাধার, সন্তরণরত হাঁস, রূপালি মাছ এবং লতাপাতা ও ফুলের ছবি। গালিচা কেবল সৌন্দর্যকেই ফুটিয়ে তুলেনা বরং এর নকশা ও প্রতিটি বুননের ভেতরে লুকিয়ে থাকে ভিন্ন এক রহস্য। যে কারণে যুদ্ধবিগ্রহের সময় একপÿ অপরপÿের অনেক কিছু তছনছ করে দিলেও গালিচাগুলোকে অÿত রাখতো। এসব গালিচার মূল্য হামলাকারীদের কাছেও ছিল অনেক। গালিচায় কখনো মৃত্যু, ধ্বংস, বিশৃঙ্খলা ফুটিয়ে তোলা হয়না। সৌন্দর্যকে বিকশিত করার এ মাধ্যমে অশুভকে দূরে রাখা হয়। নিষ্ঠুরতা, যাতনা ও বিষাদ একান্তই যদি তুলে ধরতে হতো তবে এসবের সাড়া দেয়া হতো সৌন্দর্যকে তুলে ধরার মাধ্যমে। প্রাচীন সব গালিচা প্রস্তুকারীই জানতো যে, সৌন্দর্যই হচ্ছে সব যাতনার নিরাময়। সৌন্দর্যপ্রিয় ও সৌখিন লোকেরা ছিলো এসব গালিচার ক্রেতা। ÿমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিদের প্রাসাদে শুভা পেত অসাধারণ এসব শিল্পকর্ম। সময়ের সাথে সাথে সব কিছু পাল্টালেও মানুষের সৌন্দর্যপ্রিয়তা একেবারেই পাল্টায়না। জাজিয়ানটেপের অধিবাসিদের সেই সৌন্দর্যপ্রিয়তা বংশপরম্পরায় এখনো রয়েগেছে অটুট। সে কারণেই আজো টিকে আছে সেখানকার গালিচা শিল্প। কেবল টিকে থাকা নয় বরং সমগ্র বিশ্বকে আহŸান করছে সৌন্দর্যের দিকে। গালিচা হলো সৌন্দর্য, অভিনন্দন, সানন্দে গ্রহণ ও উৎসবের প্রতীক। এখনো এ প্রতীকের সাথে থেকে জাজিয়ানটেপ মেতে উঠে আগের মতো উৎসবে।

http://blog.bibleplaces.com/uploaded_images/West_Jerusalem_aerial_from_north,_tb010703236-786405.jpg
জেরুজালেম
মানচিত্রের উত্তরে চিলতের মতো হয়ে এসে যেখানটায় শেষ হয়েছে মৃত সাগর, এর ৩৫ কিলোমিটার অদূরেই পবিত্রতম এক পাহাড়ি উপত্যকা জেরুজালেম। মুসলমান, খ্রিস্টান এবং ইহুদী ধর্মের জন্য পবিত্র এ উপত্যকাটি সভ্যতার ছুঁয়ায় গড়ে উঠেছে জুদিয়ান পাহাড়ের পাদদেশে। কেবল ধর্মীয় কারণে নয় ভৌগলিকভাবেও জেরুজালেমের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এক অবস্থান। প্রকৃতির অঢেল নিঃসর্গ যেন ঢেলে দেয়া হয়েছে এখানে। উপত্যকার পূর্ব দিকে যেমন পৃথিবীর রাহস্যঘেরা এক আশ্চর্য মৃত সাগর, তেমনি মাত্র ৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে এসে আছড়ে পরছে ভ’মধ্যসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালা। এরই মাঝে মানুষের বসতি। ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালে শহর হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো জেরুজালেম। আর একেই পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম শহর হিসাবে ধরা হয়। মানুষের বসতির প্রথম দিকে জুদিয়ান পাহাড়ের শ্যামল এ উপত্যকাটি কেমন ছিলো তা ধারণা করা না গেলেও অন্তত বাইবেলিয় সময়ের কথা বলা যায়। তখন বসতির ভেতর সবুজ নয়, বরং ছিলো সবুজের ভেতর বসতি। কোথাও দেখা যেতো কাঠবাদাম, কোথাও জলপাই আবার কোথাওবা পাইন বন। কিন্তু মানুষের শুধু শুধু প্রকৃতিকে ধ্বংস করার প্রবণতার ফলে আগের সেই সবুজ এখন আর টিকে নেই। তবে পৃথিবীর অন্যান্য অনেক নগরীর সাথে তুলনা করলে এর পরিমাণ অবশ্যই বেশি। এখনো এ শহরের পূর্ব দিক ঘিরে রেখেছে নির্মল জলপাই বন। ছোট বড় অসংখ্য উপত্যকার সমন্বয়ে ভ’খন্ডটির রয়েছে ভিন্ন এক আবহ, রয়েছে অসম্ভব নান্দনিকতা। পুরাতন শহরের দÿিণ অংশ ছাড়িয়ে রয়েছে কিডরুন উপত্যকা। তারপর আবার উঁচু হয়ে উঠেছে জলপাই পাহাড়। একই দিকে গভীর ও ঢালু উপত্যকা হিন্নুন। খ্রীস্টানদের ধারণা এ হিন্নুন থেকেই শুরু হবে পাপিদের পরলৌকিক শা¯িÍ। উত্তর পশ্চিম দিকে দামেস্ক গেটের কাছাকাছি আরেক উপত্যকা তাইরুপিয়ানের অবস্থান।
জেরুজালেম জুড়ে বছরের বারো মাসই থাকে নির্মল প্রকৃতির কোমল ছুঁয়া। এখানকার বাসিন্দারা অভ্য¯Í ভ’মধ্যসাগরীয় আবহাওয়ায়। তারা যেমনভাবে অভিবাদন জানায় গ্রীষ্মকে তেমনি শীতও এদের বরণীয়। এ উপত্যকায় গ্রীষ্ম আসে আলো ও আঁধারের উষ্ণতার ব্যবধান নিয়ে। আকাশে সূর্যের উপস্থিতিতে প্রচন্ড তাপে তাঁতিয়ে উঠে এরা। আবার সূর্য তলিয়ে গেলে ঠান্ডায় কেঁপে ওঠে এরাই। কখনো কখনো ঝর ঝর করে উপত্যকাকে ভিজিয়ে দিয়ে যায় বৃষ্টি। আবার এখানে মৃদু তুষার ঝরিয়ে আগমন ঘটে শীত মৌসুমের। পবিত্রতম এ উপত্যকায় প্রকৃতির সবই ঘটে স্বাভাবিক নিয়মে। কিন্তু যত অস্বাভাবিকতা কেবল এখানকার বাসিন্দাদের মাঝেই। কোথাও কোন অসঙ্গতি না থাকলে হয়তো ইতিহাসের প্রাচীন এ নগরী নিভৃতেই চলতো সময়ের পথ ধরে। পাহাড় গলে প্রবেশ করা সাগরের নির্মল বাতাস আবার নির্মলতা নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারতো জেরুজালেম থেকে। কিন্তু এখানকার প্রতিদিনের বাতাসে এখন নেই এতটুকু শান্তির লেশ, নেই কোন উদারতা। এখন ইজরাইলের করায়ত্তে থাকা জেরুজালেমের আকাশ বিদির্ণ করে ফাটে কামানের গোলা, বাতাসে বারুদের গন্ধ আর ভ’মিতে ভারি অস্ত্রের ঝনঝনানি। পাহাড় সাগরের মিতালিতে অবস্থান করলেও এখানকার বাসিন্দারা বিভক্ত। অনেকের চোখে ঘুম নেই, থালায় খাবার নেই, মাথা গোঁজার ঠাই নেই, জীবণের অধিকার নেই, নিজের স্বাধীনতা নেই। এ যেন পরিণত হয়েছে এক নেই উপত্যকায়।
এ উপত্যকা থেকে যারা নেই করেছে শান্তিপ্রিয় মানুষের ঘুম, তাদেরই বিষাক্ত নখর প্রতিনিয়ত দাগ কাটছে মানবতার বুকে। এখানকার দখলদারী ইহুদীদের বুনন করা জালে এখন বন্দি পুরো পৃথিবী। এ নগরীর অভ্যন্তরেই অবস্থান মুসলমানদের একসময়কার কেবলা মসজিদুল আকসার। অথচ আজ পবিত্রতম সেই স্থানে প্রার্থনার জন্য মুসলমানদের হাজারো বাঁধা। নিজের ভ’মিতে তাদের বসতি যেন কারাগারের বদ্ধ প্রকোষ্ঠে। ইজরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর তলøাশি ও নিষ্ঠুরতার আতঙ্ক তাদের তাড়া করে প্রতি মুহুর্তে। কিন্তু তবুও দখলদারিত্বের জীবণে নিজেদের পরিচিতি টিকিয়ে রাখার জন্য আল আকসা অভিমুখে ভেসে আসছে মানুষের স্রোত৷ পুরুষ, মহিলা, শিশু এরা সবাই মূলত পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনী মুসলমান৷ পশ্চিম তীরের অন্য যে কোন শহরের বা গাযার ফিলিস্তিনীদের জন্য পুরাতন জেরুজালেমের দরজা বন্ধ৷ আর পূর্ব যেরুজালেম থেকে ছুটে আসা মানুষের স্বাধীনতায় খড়গ বসাতে মসজিদের চারদিকে এবং প্রবেশ পথে থাকে ইজরাইলি সৈন্য ও পুলিশের কঠিন টহল৷ সন্দেহ হলেই দেখছে পরিচয়পত্র। অযথাই লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা, নির্যাতন, হত্যা, গুম প্রতিদিনের জন্য খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁচলে থাকা এ উপত্যকার মানবিয় বহি:প্রকাশ বড়ই কুৎসিত। অথচ এটি অন্যরকম এক বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আধুনিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্তে¡ও এখানে খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন এক আবহ। পৃথিবীর প্রাচীনতম এ নগরী তিনটি অংশে বিভক্ত। এক অংশ দ্রæত উন্নয়নশীল বাণিজ্যিক এলাকা পশ্চিম জেরুজালেম। অধিকাংশ আরবীয়দের বসবাস যেখানে সে অংশটি পূর্ব জেরুজালেম এবং যে অংশের কারণে ইতিহাসের পাতায় প্রাচীন নগরী হিসাবে স্থান পেয়েছে এ উপত্যকাটি সেটি হলো শহরের মূল ও পূরাতন অংশ। ইউনেস্কো পুরাতন জেরুজালেমকে ঘোষণা দিয়েছে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইট হিসাবে। জেরুজালেমের অর্থনীতির বড় একটি অংশ নির্ভর করে শহরের পুরাতন অংশের উপর। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা ছুটে আসে ইতিহাসের অনঢ় স্বাÿী এ অংশ এবং পশ্চিম দিকে নির্মিত দেয়ালের আকর্ষণে। এখানে এসে তারা ডুবে যেতে চায় অতীতে। কারণ এ নগরী গড়ে উঠেছে অসংখ্য শৈল্পিক সংস্কৃতির সংমিশ্রণে। কেবল তাই নয, পবিত্রতম জেরুজালেমে এখনো টিকে রয়েছে প্রাচীন অনেক প্রার্থনাগার। পুরো শহরে সিনাগগের সংখ্যা ১২০৪টি, চার্চ ১৫৮ টি এবং মসজিদ রয়েছে ৭৩টি। এগুলোই শহরের ৭৪৭,৬০০ জন বাসিন্দার প্রার্থনালয়। ২০০৭ সালের এ শুমারি অনুযায়ী এদের মাঝে ৬৪ শতাংশ ইহুদী, ৩২ শতাংশ মুসলিম এবং ২ শতাংশ ক্রিস্টান। ১২৫.১৫৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ নগরীতে ২০০৫ সালের শেষের দিকে বসতির ঘনত্ব ছিলো প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫,৭৫০.৪ জন। ইজরাইল ও ফিলি¯িÍন উভয় রাষ্ট্রই এ শহরকে রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করলেও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একে কোন দেশের রাজধানীর স্বীকৃতি দেয়না। অধিকাংশ রাষ্ট্র তেলআবিবকে ইসরাইলের এবং গাজাকে ফিলি¯িÍনের রাজধানী হিসাবে গণ্য করে।
একেশ্বরবাদী তিনটি ধর্মের জন্য জুদিয়ান পাহাড়ের উপত্যকায় গড়ে উঠা এ শহরটি পবিত্র হওয়ার কারণে একে বলা হয় পবিত্রতম শহর । আর জেরুজালেম শব্দের অর্থও হলো পবিত্র। প্রাচীন মিশরীয় রেকর্ডে জেরুজালেমের যে নাম পাওয়া যায় তা হলো ‘রুসালিমুন’ অথবা ‘উরসালিমুন’। গ্রীকরা এর পূর্বে ‘হাইক’ সংযোজন করে ‘হাইক্রোসালিমুন’ বলে ডাকে। । আরবদের কাছে এটি আল-কুদস বলে পরিচিত। এর সবগুলোর অর্থই হলো পবিত্র। হিব্রæ পান্ডুলিপি অনুযায়ী জেরুজালেম ৯৭০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত ছিলো হযরত দাউদ (আ.) এর শাসনের অধীন। তাঁর সময় এ শহরটি গড়ে উঠেছিলো বলে একে দাউদ এর শহরও বলা হয়। পরবর্তীতে এ অঞ্চলের শাসক হন তাঁর পুত্র হজরত সোলায়মান (আ.)। তিনিই এ নগরীতে আল আকসা মসজিদটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে ইতিহাসের ধারা বেয়ে গড়ে উঠেছে আজকের সভ্য নগরী জেরুজালেম।
পর্যায়ক্রমে এ উপত্যকায় ইহুদী, খৃষ্টান এবং মুসলমানরা জনবসতি গড়ে তোলে। জেরুজালেমকে রাজধানী করে গড়ে তোলা ইহুদীদের জুদাহ রাষ্ট্র একসময় বিধ্ব¯Í হয়েছিলো ব্যবলনীয় রাজা নেবুচাঁদনেজারের হাতে। পরবর্তীতে রোমানদের আক্রমনে আবারও ইহুদীরা বিতাড়িত হয় জেরুজালেম থেকে। সপ্তম শতাব্দীতে এলাকা মুসলমানদের আয়ত্তে¡ আসে এবং অটোম্যান সাম্রাজোর শেষ পর্যন্ত তা অুন্ন থাকে। তখন এখানে ইহুদীদের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। আজ যে ইহুদীরা মুসলমানদেরকে বিতাড়িত করার জন্য উত্তপ্ত করে রেখেছে জেরুজালেম ও ফিলি¯িÍনকে। সে ইহুদীরা মুসলিম শাসনের অধীনে সবসময়ই থেকেছে নিরাপদ। হজরত ওমর রা. এর খেলাফতের সময় দীর্ঘ ৫০০ বছর পর জেরুজালেমে বসতি গড়ার অনুমতি পায় তারা। কোথাও যখন ঠাঁই মিলছিলোনা তখন ইসলামের ২য় খলিফা আশ্রয় দিয়েছিলেন তাদের। এই জেরুজালেম স্বাÿী হয়ে আছে মুসলিম শাসকদের উদারতা ও স¤প্রীতির। ওমরের সময় মুসলিম সৈন্যরা অবরুদ্ধ করে রেখেছিলো জুদিয়ান পাহাড়ের এ উপত্যকা। কিন্তু খ্রীষ্টানদের দাবি ছিরো তারা খলিফা উমরের কাছে উত্মসমর্পণ করবেন। ইসলামের ২য় খলিফা হযরত ওমর (রা.)ও তাদের সাথে চুক্তি সম্পাদনের জন্য আরব থেকে রওয়ানা দেন সুদূর জেরুজালেমের উদ্দ্যেশে । তিনি সেখানে পৌঁছার পর সারা জেরুজালেম অবাক হয় দেখল বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকর্তা ওমর (রা.) গাধার দড়ি হাতে বিনয়ের সাথে হেটে শহরে প্রবেশ করছেন। আর গাধার পিঠে সওয়ার তারই ভৃত্য। কেবল তাই নয় ধর্মীয় স¤প্রীতি রÿার জন্য এ জেরুজালেমেই তিনি নজির রেখে গেছেন আরেক উদারতার। হযরত ওমর (রা.) জেরুজালেমের একটি বিখ্যাত চার্চ পরিদর্শনে ছিলেন। সেখানে নামাজের সময় হয়ে গেলে তিনি অন্য স্থানে গিয়ে নামাজ আদায় করেন। কারণ তাঁর শংকা ছিলো চার্চের ঐ স্থানে নামাজ আদায় করলে, তার স্বরণে পরবর্তীতে একে মসজিদে রূপান্তর করা হতে পারে। এ কারণেই এ চার্চের আশপাশে মুসলমানরা একত্রিত হয়ে যেন নামাজ আদায় করতে না পারে সেজন্য একটি ডিক্রিও জারি করেন।
মুসলমানরা ইহুদীদেরকে আশ্রয় দিলেও বিভিন্ন সময় তাদের মার খেতে হয়েছে অন্যদের হাতে। রোমানদের আক্রমণে বিধ্ব¯Í হবার পর ইহুদীরা ইউরোপের বিভিন্ন ভূখন্ডে ছড়িয়ে পড়ে এবং নির্বাসিত জীবন যাপন শুরু করে। তখন তারা কোন দেশেই মূলধারার জনগোষ্ঠীর সাথে একীভূত হতে পারেনি। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে ইহুদীরা সবেেত্রই ভূমিকা রাখলেও এদের জীবন পরিচালিত হতো মূলধারার বাহিরে। পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তারা বস্তিতে এবং শহরের উপকন্ঠে বাস করত। এই নির্বাসিত জীবন থেকে মুক্তির জন্য ইহুদীরা জায়নবাদী আন্দোলন গড়ে তুলে। জুদিয়ান পাহাড়ের আরেক নাম হলো জায়ন। এ পাহাড়ের উপত্যকা জেরুজালেমে তারা আবার একত্রিত হবার জন্য তাদের সংগ্রাম ছিলো বলে এ আন্দোলনের নাম দিয়েছিলো জায়নবাদী আন্দোলন। এ পাহাড়ের পাদদেশে সারা বিশ্ব থেকে ইহুদীরা এসে নিজেদের আবেগকে প্রশমিত করতো। নির্বাসিত জীবনে বিভিন্ন ভূখন্ডে তারা লালন করতে থাকে এ আন্দোলনকে। উনবিংশ শতাব্দিতে কিছুসংখ্যক ইহুদী ফিলি¯িÍনে ফিরে এসে জেরুজালেম, সাফেদ এবং ত্রিবেরীতে বসবাস শুরু করে। ধীরে ধীরে তাদের জায়নবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে এবং প্রতাপশালী বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে তাদের প্রভাব বাড়তে থাকে। এ কারণে ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে একটি সনদে বলায় হয় ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করা হবে একটি হবে আরবের আর একটি ইহুদিদের। এ সনদে বলা হয় জেরুজালেম স্বাসিত হবে সরাসরি জাতিসংঘের দ্বারা। এর ফলে শুরু হয় আরব আর ইহুদিদের মধ্যে সংঘর্ষের। তখন ইহুদি এই অবৈধ অভিবাসিরা সংঘটিত হতে থাকে পশ্চিমাদের সাহায্য সহযোগিতায়। কিন্তু ১৯৫৭ সালে ইহুদি, ফরাসী আর ব্রিটিশ সমন্বিত শক্তির কাছে পরাজিত হয় আরবরা। অবশেষে ১৯৬৭সালের ৬দিনের যুদ্ধে আরবরা পুরোপুরি পরাজিত হয় জায়নিষ্ট শক্তির কাছে। এর আগে জেরুজালেম এর পূর্বাংশ ছিলো জর্দানের অধীনে। পরবর্তীতে ইহুদিরা আরো অনেক অঞ্চল নিজেদের অধিকারে নিয়ে নেয়। আর একের পর এক গণহত্যা চালিয়ে অগ্নিগর্ভে পরিণত করে জেরুজালেমসহ পুরো ফিলি¯িÍনকে।

http://msnbcmedia4.msn.com/j/msnbc/Components/Photos/070331/070331_kirkuk_hmed_2p.hmedium.jpg
কিরকুক
আজ থেকে পাঁচ হাজার বছরেরও পূর্বে গড়ে উঠা শহর কিরকুক। এর অবস্থান বর্তমান ইরাকের উত্তরাঞ্চলে। রাজধানী বাগদাদ থেকে ব্যবধান ২৫০ কিমি। হ্যামরিন পাহাড়ের উত্তর দিকে প্রাচীন এ নগরবসতি ছুঁয়ে প্রবাহিত হয়েছে তিনটি নদী। পশ্চিমে টাইগ্রীস ও জ্যাব এবং দÿিণ পূর্ব দিক দিয়ে কলকলিয়ে বয়ে গেছে সিরওয়ান। এ প্রবাহগুলো কখনো অপেÿা করেনি কারো জন্য, যেমনভাবে অপেÿা করেনি সময়। যে পথের শেষ নেই সে পথ ধরেই সময়ের অফুরন্ত অভিযাত্রা। খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার সালে সেই যে সময়ের সাথে যোগ হয়েছিলো এই সভ্য নগরী, আজ অবধি সাথেই আছে। তবে এই ব্যবধানটুকুতে বয়ে গেছে পরিবর্তনের ঝড়, বদলে গেছে ভ’খন্ডের অনেককিছু। সভ্যতাকে ধারণ করে প্রবাহ ÿীণ হয়ে এসেছে টাইগ্রীস, জ্যাব এবং সিরওয়ানের। এখানকার নাগরিকদেরকে যেমনভাবে দোলা দিয়েছে ইতিহাসের সোনালি অধ্যায়, তেমনি কষাঘাতে পিষ্ট করেছে অন্ধকারের কালো। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির চক্রে কিরকুকের বাসিন্দারা বর্তমানে সোনালী কোন অধ্যায়ের স্বাÿী নয়, বরং পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে তারা ডুবে আছে কালো এক গহŸরে। এখানে গণতন্ত্র বিতরণ করার ছুঁতো ধরে দূর ভ’খন্ড থেকে উরে এসে স্বাধীনতা কেড়ে নেয় দখলদারিরা। কেবল তাই নয় প্রাচীন এ নগরীর সন্তানদের মাঝে জ্বেলে দেয় অভ্যন্তরিণ বিভেদের আগুন। সে আগুনে এখন প্রতিদিন জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে কিরকুক। এখানে শিশুদের ঘুম ভাঙ্গে গগণবিদারী বোমার শব্দে। বাতাসে ভাসে বারুদের গন্ধ। বিধ্বংসী তান্ডবে অতৃপ্তির বেদনা নিয়ে মাটিতে মিশে যেতে হচ্ছে হাজার হাজার বছরের পুরনো নিদর্শনগুলোকে।
পৃথিবীর প্রাচীন এ নগরবসতির প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে সভ্যতার অতিত। প্রাচীন বাসিন্দাদের আবেগ আর অনুভ’তির নিঃশ্বাসগুলো এখনো ভেসে বেড়ায় কিরকুকের বাতাসে। প্রাচীন এ নগরীর সুখ-দুখ এবং সংস্কৃতির মাঝে ডুবে থাকার ফুসরত নেই এখানকার বাসিন্দাদের। জীবণের অনিশ্চয়তায় তাঁরা ব্য¯Í জীবণের সন্ধানে। এখন তাদের কাছে মূল্যহীন মানবসভ্যতার হাজারো নিদর্শন। একসময়কার শহর রÿাকারী প্রাচীন দূর্গটি এখন আর তাদের টানতে পারেনা। অথচ একে পরিদর্শন করতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে পর্যটক। বর্তমানে বিপজ্জনক কিরকুকের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত এ দূর্গটির আকর্ষণ পর্যটকদের টানলেও অবশ্য হ্রাস পেয়েছে তাদের আগমন। এটি নির্মিত হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব ৮৮৪ এবং ৮৮৪ সালে। সেনা প্রতিরÿার জন্য রাজা ২য় আসরনাসির পাল এটি নির্মাণ করেছিলেন ১৩০ ফুট উঁচু করে। কিরকুকের অভ্যন্তরে রয়েছে এতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা কিশলা। ৬ একর ভ’মিতে নির্মিত এ স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়েছিলো শীতের সময় সৈন্যদের অবস্থানের জন্য। এ শহরের আরেক অ™ভ’ত ও আকর্ষণীয় স্থাপনা কায়সারিয়া মার্কেট। আল কায়সারিয়াহ প্রতিরÿা দুর্গের কাছেই অবস্থিত। অটোমান শাসনের সময় নির্মাণ করা হয়েছিলো আশ্চর্য এ স্থাপনা। এখানে রয়েছে ঘন্টা, দিন, মাস এবং বছরের প্রতীক। পুরো মার্কেটটিতে ৩৬৫টি তলা রয়েছে, যা বছরের সবগুলো দিনের প্রতীক বহন করে। ২য় তলায় ১২টি ছোট কÿ রয়েছে যেগুলো বছরের বারমাসের প্রতীক। মার্কেটে ২৪টি গলিপথ রয়েছে যেগুলো দিনের চব্বিশঘন্টার প্রতীক। আর সপ্তাহের ৭ দিনের প্রতীক বহন করছে এর সাতটি দরজা।
ঐতিহাসিক অসংখ্য স্থাপনা বুকে ধারণ করা এ নগরীটি মূলত প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো মেসোপটেমিযার উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারি উপজাতি হুরিয়ানদের সময়কালে। ককেশাস নৃগোষ্ঠীর হুরিয়ানদের রাজত্বকালে ভ’খন্ডটি পরিচিত ছিলো আরাপফা নামে। শব্দটির অর্থ হলো শহর। আসেরিয়দের পতনের পর কিরকুক পরিচিত ছিলো কুরকুরা নামে। গ্রীকদের অধীনে থাকার সময় এটি কারখা ডি-বেট ¯øখ নামে পরিচয় লাভ করেছিলো। ৭ম শতাব্দীতে এ এলাকা মুসলমানরা অধিকার করে। তখন আরব লেখকেরা একে কিরখেনি বলে উলেøখ করতো। কিরখেনি শব্দের অর্থ হলো নগররÿাকারী দূর্গ।
প্রাচীন আসেরিয়ান শহর অরপফা থেকে কিরকুকের সৃস্টি। কিরকুকের আদি অবস্থা অরফকা আসেরিয়ান শাসকরেদর অধীনে থাকলেও, এর রাজধানী ছিলো মিত্বানিয়ানদের অধীনে। ১৫০০ থেকে ১৩৬০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত আসেরীয় সকল শাসকরাই মিত্বানীয়দের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে। কিন্তু আবার খ্রিস্টপূর্ব ১৪ শতকে মিত্বানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে দেয় আসেরিয়রা। এতেই পতন ঘটে তাদের। কিরকুকে সভ্যতার এক বিপ্লব ঘটে যায় মূলত তখনই। খ্রিস্টপূর্ব ১০ম এবং ১১তম শতাব্দীতে আসিয়ান শাসনের অধীনে বিভিন্ন নাগরিক সুযোগ সুবিধার সমন্বয়ে সতেজ হয়ে উঠতে থাকে কিরকুক। আবার খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ট শতকে আসেরিয়া মেডেস ইউনিয়নের দখলে চলে যায়। ৭ম শতকে এ শহরটি আসে মুসলমানদের দখলে।
এ এলাকায় পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থান থেকে বসতির জন্য ছুটে আসে মানুষ। এদের মাঝে উলেøখযোগ্য অভিবাসন হয় আরব এবং তুরস্ক থেকে। মুসলমানদের শাসনের সময় আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন এখানে এসে বসবাস শুরু করে। ১৬ শতকের দিকে সাফাভিন শাসনের সময় তুর্কিদের আগমন ঘটে। শাহ প্রথম ইসমাইল শিয়া বিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সেখানে অবস্থানরত সুন্নীদের স্থানে প্রতিস্থাপন করতে থাকে শিয়াদেরকে। মূলত তখন থেকেই এ অঞ্চলে মুসলমানদের মাঝে গড়ে উঠে অভ্যন্তরিন বিভেদ। সময়ের বিবর্তনে জাতীয়তাবোধের উপর ভিত্তি করে মুসলমানরা ভাগ হয়ে যায় কুর্দী, তুর্কী, আরব প্রভৃতি দল ও উপদলে। তার পর থেকে এ বিভেদ কিরকুকসহ গোটা ইরাককে প্রতিনিয়ত পরিণত করে তুলছে অগ্নিগর্ভে। অটোমান বিশ্বকোষ প্রণেতা শামসুদ্দিন শামীর বর্ণনা অনুযায়ী ১৮৯৭ সালে কিরকুকের মোট বাসিন্দার তিন চতুর্থাংশ ছিলো কুর্দি, তুর্কী এবং আরব। ইহুদী ছিলো সাত হাজার ষাট জন এবং খ্রিস্টানের সংখ্যা ছিলো ৪৬০ জন। ১৯৫৭ সালের এক হিসাবে কিরকুকে বসবাসকারি কুর্দির সংখ্যা ছিল ১৭৮,০০০, তুর্কী ৪৮০০০, আরব ৪৩,০০ এবং খ্রিস্টানের বসবাস ১০,০০০। বর্তমানে পুরো শহরে ৮৫০৭৮৭ জনের বসতি।
কেবল ঐতিহাসিকভাবেই নয় কিরকুকের উপর নির্ভর করে ইরাকের অর্থনীতির বড় একটি অংশ। সমগ্র দেশের পেট্রোলিয়াম শিল্পের কেন্দ্র এই নগরী। এখানে রয়েছে ‘বাবা গুরগুর’ তেল ÿেত্র। দেশের সর্ববৃহৎ এ ÿেত্রটি আবিষ্কৃত হয় ১৯২৭ সালে। আর তেল উত্তোলন শুরু করে আরো সাত বছর পর ১৯৩৪ সাল থেকে। এক পেট্রোলিয়াম শিল্পের আশির্বাদেই সেখানকার বাসিন্দাদের জীবণ প্রকৃতি হওয়ার কথা মসৃণ ও স্বাচ্ছন্দময়। কিন্তু তা না হয়ে কাল হয়ে দাঁড়ালো এ শিল্পই। ইরাকের ভ’গর্ভ¯Í সম্পদ লুটেপুটে নেয়ার জন্য এখানে লুলুভ জিভ ডুবিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো। এতেই তারা শান্ত নয়, বরং নিষ্ঠুরভাবে মুছে দিতে চাচ্ছে এ নগরীর নিজস্বতাকে। নিজেদের মাঝে অসংখ্য বিভেদের দেয়ালের অ¯িÍত্ব থাকলেও সেখানকার একেশ্বরবাদি বাসিন্দারা অপেÿায় আছে পরিপূর্ণ এক স্বাধীনতার জন্য। সেইসাথে পৌত্তলিকতামুক্ত সন্তানদের অপেÿার প্রহর গুণে গুণে প্রতি রাতেই টাইগ্রীসের প্রবাহে অশ্রæ ঝরায় এ নগরী। এ কারণেই হয়তো একদিন কিরকুকে উদিত হতেও পারে স্বাভাবিক সূর্য।

শুক্রবার, জুলাই ১০, ২০০৯

মৌসুমি বায়ু : এক গভীর রহস্য


শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ

[লেখাটি মাসিক অন্য দিগন্তে তনয় হোসনেয়ারা (আমার ছদ্মনাম) নামে ছাপা হয়েছে]

নীল রঙ্গেরএক জলজ চাদর, যার অভ্যন্তরে তলিয়ে আছে তিনচতুর্থাংশ পৃথিবী। এরই ফোকল গলে এখানে সেখানে অ¯িÍত্ব প্রমাণ করছে স্থলভাগ। আবার এ স্থলভাগের অভ্যন্তরেও জাল বিছানো রয়েছে সন্তরণরত চাদরের। মোট কথা এ চাদর অর্থাৎ পানির অ¯িÍত্ব পৃথিবীর সবখানেই। জীবণের জন্য পানি। কারণ পানি যেমন ধরে রেখেছে অথই সাগরের অসংখ্য জীবণকে, তেমনি সজিব করে রেখেছে স্থলভাগকেও। কোথাও বৃস্টির পশলা ভিজিয়ে দিয়ে যায় ভ’মি, কোথাও পাহাড়ি ঢল নেমে প্লাবিত করে নদী, আবার কোন ভ’খন্ড সজিব রাখে পেঁজা তুলোর মতো ঝরা তুষার। যেখানে জীবণের অ¯িÍত্ব রয়েছে, সেখানেই রয়েছে পানিরও অ¯িÍত্ব। বাতাসের ভেতর থেকেও আমরা যেমন বাহ্যিকভাবে ততটা ধরতে পারিনা এর গুরুত্ব, তেমনি পানিময় পৃথিবীতে পানিকে অনুভব করতে পারিনা ততটা। পানির উৎসের অন্যতম একটি হলো বৃষ্টি। বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত হয় মূলত আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র মাসে (জুন, জুলাই, আগস্ট)। আর এ বৃষ্টির উৎস হলো অজস্র পানির ফোঁটা নিয়ে ভেসে আসা মৌসুমি বায়ু। জলকণাপূর্ণ মেঘের এ তরঙ্গসীমা সাধারণত বাংলাদেশকে স্পর্শ করে জুনের প্রথম দিকে এবং ছেড়ে যায় সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে।
পূর্ণ-মাপের চিত্র দেখুন
মৌসুমি বায়ু কি
মৗসুমি বায়ু হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট মৌসুমে প্রবাহিত বায়ু। অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, এখনো এর উৎপত্তি নিয়ে পরিস্কার কিছু বলতে পারেননি কোন বিজ্ঞানী ও গবেষক। সাগরের দিক থেকে এটি ভেসে আসে এতটুকুই কেবল স্পস্ট। কিন্তু সাগরের কোন স্থান থেকে এর প্রবাহ শুরু হয় তা এখনো রয়ে এক গভীর রহস্যের আড়ালে। তবে মৌসুমি বায়ুর অভিযাত্রায় কিভাবে পানি সংযোজিত হয় এর ব্যাখ্যা রয়েছে । সাধারণত যে এলাকায় যখন মৌসুমি বায়ুর প্রভাব লÿ করা যায়, তখন বাতাসের ব্যাপক গতি থাকে। মূলত বাতাসের প্রচন্ড গতিই এর সাথে পানি সংযোজিত করে। বাতাসের প্রচন্ড প্রবাহে উথাল-পাথাল ঢেউ তুলে আন্দোলিত হয় সাগরের নীল চাদর। আর এর সঞ্চালনের ফলে উপরিভাগে সৃষ্টি হয় প্রচুর ফেনার। এই ফেনা সৃস্টি করে অসংখ্য বুদবুদের। একসময় বুদবুদগুলো ফেঁটে হাজার হাজার ুদ্র জলকনা মিশে যায় বাতাসের সাথে। অবশ্য অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে অনেক সময় পানি বাষ্পে রূপান্তরিত হয়েও ভেসে যায়। এ বাতাস যতই সমুদ্র উপক’লের দিকে আসতে থাকে ততই ধুলিকণার সাথে মিশতে থাকে পানির বিন্দুগুলো। পরবর্তীতে এ মিশ্রণ উঠে যায় বায়ু মন্ডলের উপরের দিকে। এর ফলে বাষ্প আরও ঘনীভ’ত হয়ে ধূলি মিশ্রিত কনার চারদিকে জড়ো হয় এবং পরবর্তীতে ফোঁটা ফোঁটা পানির সৃষ্টি করে। পানির এই ফোঁটাগুলো প্রথমে একত্রিত হয় এবং সৃষ্টি করে মেঘমালার। আর এই মেঘকে আপন প্রবাহে ভাসিয়ে বেড়ায় মৌসুমি বায়ু।
অনেক ভ’তত্ত¡বিদদের বিশ্বাস সর্বপ্রথম সৌসুমি বায়ু শক্তিশালী হয়ে এসেছিলো ৮ মিলিয়ন বছর আগে। তারা আরব সাগরে বাতাসের প্রবাহ থেকে এবং চায়না নিম্ন মালভ’মি অঞ্চল থেকে বাতাসে বয়ে আসা বালুকণাকে পরীÿা করে এ অনুমান করেন। তাছারা তাদের পরীÿার আওতায় ছিল চীনের বৃÿ ফসিল এবং দÿিণ চীনা সাগরের তলানি। এসব পরীÿা থেকে এটা মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে যে ১৫ থেকে ২০ মিলিয়ন বছর আগেও ছিল মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ ।

প্রবাহ
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিবছর একই সময়ে মৌসুমি বায়ু ভাসিয়ে নিয়ে আসে মেঘ। সেই সাথে নিচের ¯Íরে প্রবাহিত বায়ুতে ভেসে বেড়ায় অসংখ্য জলকণা। যার অস্তিত্ব এ অঞ্চলে অনুভব করা যায় । দÿিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এর প্রভাব বেশি থাকার কারণেই হয়তো সর্বপ্রথম মৌসুমী বায়ু হিসাবে এটি পরিচিতি পায় ভারত, বাংলাদেশ, পাকি¯Íানসহ আশপাশের দেশগুলোতে। বিশ্বের অন্যান্য যেসব স্থানে এ বায়ু প্রবাহিত হয় সেগুলোর মাঝে উলেøখযোগ্য হলো উত্তর আমেরিকা, দÿিণ আমেরিকা, সাব-সাহারান আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং পূর্বে এশিয়া।
এশিয়ার দÿিণাঞ্চলে ডিসেম্বর মাস থেকে মার্চের শুরুর সময় পর্যন্ত উত্তর পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত বায়ু উত্তরের মৌসুমি বায়ু হিসাবে পরিচিত। এ মৌসুমী বায়ুর চাপ বিরাজ করে সাধারণত দÿিণ পূর্ব এশিয়া এবং অস্ট্রেলেসিয়াতে। অস্ট্রেলেসিয়া এলাকার অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি দেশ অসিয়ানিয়া, নিউজিল্যান্ড, পাপুয়া নিউ গিনি এবং এর আশপাশে প্রশান্ত মহাসাগরের অন্যান্য দ্বীপ হয়ে এ বায়ু সরাসরি প্রবাহিত হয় অস্ট্রেলিয়ার দিকে।
দÿিণ-পশ্চিম অঞ্চলে প্রবাহিত হয় গ্রীষ্মকালীন মৌসুমিবায়ু। এটি জুন থেকে শুরু হয়ে থাকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ভারতীয় মরুভ’মি ও এর সাথে সংশিøষ্ট এলাকা, ভারতের উত্তরাঞ্চল এবং কেন্দ্রীয় এলাকাব্যাপী এ বায়ু প্রবাহিত হয়। এ অঞ্চলে গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপ থেকে উৎপন্ন চাপ সৃস্টি করে বায়ূ শূন্যতার। আর ভারত মহাসাগর থেকে ভেজা বাতাস বেপরোয়াভাবে ছুটে আসে এই শূন্যতা পূরণের জন্য। পরবর্তীতে এর প্রবাহ এসে বাড়ি খায় হিমালয়ে। সুউচ্চ হিমালয় অতিক্রম করে সেন্ট্রাল এশিয়ার দিকে যেতে না পারায় জলকণাসমৃদ্দ এ বাতাস উপরের দিকে বাঁক নিয়ে আবার ফিরে আসে উল্টো পথে। গমনের ¯Íর থেকে ফিরে আসার ¯Íরে তাপমাত্রা কম হওয়ায় জলকণাগুলো রূপান্তরিত হয় মেঘে। আর এ মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টিই ভিজিয়ে দিয়ে যায় ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান।
এ প্রবাহ জুন থেকে শুরু হয় এবং শেষ হয় সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে। এ অঞ্চলে মৌসুমি বায়ুর প্রবাহকে মূলত দুইভাগে ভাগ করা যায়। এর একটি প্রবাহ ছুটে আসে আরব সাগরের দিক থেকে এবং অপরটি আসে বঙ্গোপসাগর থেকে। আরব সাগর থেকে আসা মৌসুমি বায়ু পথমে আঘাত করে কেরালা রাজ্যের পশ্চিম দিকে। আর বঙ্গোপসাগর থেকে ভেসে আসা ভেজা বাতাস আঘাত হানে পূর্ব হিমালয়ে। এর ব্যাপ্তি বাংলাদেশসহ উত্তর পূর্ব ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গ। উত্তর পূর্ব দিক থেকে ছুটে আসে ভিন্ন এক বায়ুর প্রবাহ। এটি বিরাজ করে ভারত মহাসগর ও এর আশপাশের বায়ুমন্ডলে।
উত্তর আমেরিকর দিকে মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ লÿ্য করা যায় জুনের শেষ দিক কিংবা জুলাই এর শুরুর দিকে। আর এর ইতি ঘটে সেপ্টেম্বরে। ম্যাক্সিকোতেই সাধারণত এর চাপ বিরাজ করে বেশি। তবে তা মধ্যজুলাইয়ের দিকে বি¯Íার লাভ করে যুক্তরাষ্ট্রের দÿিণ পশ্চিম এলাকায়। আফ্রিকান মৌসুমি বায়ু আটলান্টিকের বিষুবরেখা থেকে যাত্রা শুরু করে ফেব্রæয়ারি মাসে । তা পশ্চিম আফ্রিকায় পৌঁছে জুনের শেষ দিকে। আবার অক্টোবরে দÿিণে হয় এর ফিরতি প্রবাহ। ইউরুপে মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ হয় শীতের সময়। এ বিষয়টি অবাক হওয়ার মতো হলেও ইউরুপের ÿেত্রে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা।

রহস্য
মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি ও প্রবাহ পৃথিবীর জন্য এক বিস্ময়। নির্দিস্ট মৌসুমে অজস্র জলকণাসমেত এর আবির্ভাব সজীব করে তোলে প্রকৃতি। কারণ এর প্রবাহে রয়েছে বিপুল পরিমাণ পানি। আর পানিই হলো জীবণের অনুষঙ্গ। কোথাও নোনা, কোথাও মিঠাপানি আবার কোথাওবা এগুলোর অদলবদলের কারনে ভারসাম্য বজায় রয়েছে জীববৈচিত্রের। প্রাাণের অ¯িÍত্ব টিকিয়ে রাখার অন্যান্য অনুষঙ্গগুলোর মতো পানির বিন্যাসও নিখুঁতভাবে করে রেখেছেন পরমসত্ত¡া। সৃস্টির সেরা জীব মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন মিঠা পানির। অবাক হতে হয়, পরম সত্ত¡ার অদৃশ্য ইশারায় ঠিকঠিকই বছরের নির্দিস্ট সময়ে বিপুল মিঠা পানির ভান্ডার ঝরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টি। তারপর রসে পরিপূর্ণ মাটিতে গজিয়ে উঠছে তৃণ, সবুজ হয়ে উঠছে পৃথিবী। প্রকৃতির আরেক রহস্য এই বৃষ্টি! স্বাভাবিক হিসাবেই প্রশ্ন জাগে, কিভাবেইবা সাগরের লবনাক্ত পানি আকাশে ভাসতে ভাসতে পরিণত হয় মিঠা পানিতে! মৌসুমি বায়ুর প্রবাহে লবণাক্ত সমুদ্র থেকে উঠে আসে বাষ্প। তারপর প্রকৃতির নিখুঁত নিয়মে বিশুদধ খাবার পানিতে পরিণত হয়ে ঝর ঝরিয়ে ঝরতে থাকে পৃথিবীর কল্যাণে। এ এক অপার রহস্য। অবশ্য লবণাক্ত পানিকে বিশুদ্ধ খাবার পানিতে পরিণত করা মানুষের পÿে সম্ভব। কিন্তু তা অনেক ব্যয় স্বাপেÿ। আরো বিস্ময় হলো, সাগর থেকে যে বাষ্প বাতাসের সাথে মিশে যায় তা কেবল এইচটুও, অর্থাৎ ডিস্টিল ওয়াটার। কিন্তু প্রকৃত ডিস্টিল ওয়াটার মানুষের পানের উপযোগী নয়। এইচটুও এর সাথে আরো বিভিন্ন উপাদান থাকলেই কেবল তা মানুষ খেতে পারে। অথচ সমুদ্রের নোনা পানি বিষ্ময়করভাবে বিশুদ্ধ হয়ে যখন পৃথিব বুকে ঝরে ফোঁটায় ফোঁটায়, তখন তা থাকে অন্যান্য উপাদানসমেত সম্পূর্ণ পান করার উপযোগী। কেবল তা-ই নয় এ বৃষ্টির পানিই হলো খাবারের জন্য সবচেয়ে বিশুদ্ধ। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে জীব ও জগতের এসব রহস্য ক্রমেই জানতে শুরু করেছে মানুষ। হয়তো ভবিষ্যতে এমন অনেক কিছুই উন্মোচিত হবে, যা আজকের দুনিয়ার ধারণার বাইরে। তবে অধুনা জ্ঞান-বিজ্ঞানের এ বিপ্লব শুরু হয়েছে আর কয়দিনই হলো। এইতো বিশ শতকের ভেতরইতো বিজ্ঞান কেবল উদ্ভাবন করতে পারলো বাতাস থেকেই যে বৃষ্টির সৃস্টি। কিন্তু পরমসত্ত¡ার জীবণনির্দেশিকায় এসব বিষয় উলেøখ করা হয়েছে বহু আগেই। পবিত্র কোরআনে রয়েছে:
“আমি বহনকারী বায়ুরাশি প্রেরণ করি: তারপর আকাশ থেকে বারিবর্ষণ করি ও তা তোমাদেরকে পান করতে দিই, তার ভান্ডার তোমাদের কাছে নেই।” (সূরা হিজর-১৫ঃ২২)।
http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/4/46/Rain_in_Kerela_01.jpg

শনিবার, মে ০৯, ২০০৯

হৃদয় পটে









রাত শেষে কেটে যাবে আঁধার যখন
কাঁচা রঙে লাল হবে সূর্য তখন
পৃথিবীতে কেঁপে এলো থির থির থির
আলোর ফোয়ারা হয়ে শিশুর শরীর।

সেদিন সকাল ছিলো ঝলোমলো ঝল
গানে উদাসী হলো পাখিদের দল।
বাতাসের ফিস ফিস কানাকানি রটে
কান থেকে বলে দিলো হৃদয় পটে
যার লাগি এতো সব তিনি শেষ নবী
দেহ মন মগজে রেখো তাঁর ছবি।

সোমবার, এপ্রিল ২৭, ২০০৯

অবারিত আকাশ


সামনে অবারিত আকাশ

রবিবার, এপ্রিল ২৬, ২০০৯

তলিয়ে যান সুখনিদ্রায়


শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ:

ঘুম! চোখের পাতা আর মেলে রাখা যায়না। ক্রমশ মাথা থেকে দূর হয়ে যেতে থাকে পৃথিবীর ভাবনা। নিভতে নিভতে এক হয়ে যায় পাতা। তখন পৃথিবীর আলো আর ভাবনা থেকে অনেক দূরে অন্য এক জগতে। সেখানে শুধূই প্রশান্তি আর তৃপ্তি। আমরা অনেকেই বুঝতেও পারিনা এ তৃপ্তির উপরই কতটা নির্ভর করে আমাদের শরীর, স্বাস্থ ও মনন। সুখনিদ্রায় তলিয়ে যেতে না পারলে সারাটা দিন-ই কেটে যায় অস্ব¯িÍ অতৃপ্তির সাথে। অনিয়মিত ঘুমের অভ্যাসের কারণেই পুরো দিন কাটে অবসাদ এবং ঘোরের মধ্য দিয়ে। হারিয়ে যায় সময়ের ছন্দ। ঘুম প্রভাব ফেলে দৈনন্দিন রুটিনে এবং রুটিন প্রভাব ফেলে ঘুমে। যাদের রয়েছে অনিদ্রা রোগ, যাদের দু’চোখের পাতা এক করার জন্য নিয়মিত খেতে হয় ঘুমের বড়ি তাদের যন্ত্রণা কেবল তারাই অনুধাবন করতে পারেন। সে কারণেই সুস্থতার জন্য প্রয়োজন একটি রুটিন করে নেয়া। ঘুম ও কাজের জন্য বেঁধে দিন নির্দিস্ট সময় এবং এর ছন্দ রেখে চলার চেস্টা করুন ঘড়ির কাটার সাথে ।

প্রতিদিন একই সময় বিছানা ছাড়ুন
প্রতিদিন একই সময়ে বিছানা ছাড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এ অভ্যাসের কারণেই নিরবচ্ছিন্ন প্রশান্তিময় রাতের ঘুমের শেষে শুরু হতে পারে সুন্দর একটি সকাল। আপনার মনের মতো করে সাজানো শয়নকÿটিতে মনোরম পরিবেশের পাশাপাশি এমন ব্যবস্থা রাখবেন যেন আলোর আনাগোনা সহজ হয়। সকালের কোমল আলো ঘরে প্রবেশ করে যখন চোখের পাতায় আলতু স্পর্শ করে যাবে আর গাইবে ঘুমভাঙ্গানির গাণ তখনি মিটমিট করে চোখ মেলুন। সাথে সাথেই সে আলো আপনার চেতনাকে ছুঁয়ে যাবে। স্বক্রীয় করবে চিন্তা এবং অনুভ‚তিকে।
‘ইউসিএল এ ¯িøপ ডিজর্ডারস সেন্টার’ এর পরিচালক ড. ফ্রীসকা এল ইয়ান-গু বলেছেন ‘সূর্যলোক ম¯িÍষ্ককে কার্যÿম করে তোলে’। সে বিবেচনায় প্রয়োজন প্রথম সূর্যালোকের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিদিন একই সময়ে বিছানা ছাড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। তাহলেই প্রতিটি কাজ এবং রাতের ঘুম হবে স্বাস্থসম্মতভাবে।

মনের ভারসাম্য
আনন্দ, সুখ, বেদনার অনুভ‚তিগুলো মনের ভেতর প্রবাহিত হয় তরঙ্গের মতো। আর সে কারণেই কখনো উৎফুলø, কখনো মেঘাচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে মানুষের মন। নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে মনের পরস্পর বিপরীত এ দুটি অবস্থার মাঝে দূরত্ব কমিয়ে আনা যায় ভারসাম্য।
সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর বিছানায় বসে থাকবেন দশ মিনিট। এ দশ মিনিট আপনি বরাদ্দ করে রাখুন প্রতিটি দিনের জন্য। সে সময়টাতে সোজা হয়ে বসবেন বিছানার উপর। তারপর চোখ দুটি বন্ধ করুন এবং আপনার সুন্দর জীবণের জন্য আলøাহর কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করুন। সেই সাথে নিজের মাঝে একটি সুখানুভ‚তি জাগ্রত করুন। আপনার এ সময়ের কৃতজ্ঞতা এবং নির্মল সূখানুভ‚তিটুকুই প্রশান্তিময় সারাদিনের উৎস।
এরপর বিছানা ছাড়–ন এবং প্রাত কাজগুলো একে একে সারতে থাকুন। এ সময়টুকুকে আপনি মনে করবেন ‘বুটিং পিরিয়ড’। অর্থাৎ গুছিয়ে নেয়ার সময়। এ সময় গুছিয়ে নেবেন নিজেকে। স্মরণ করার চেস্টা করবেন আজকের দিনে যে কাজগুলো করতে হবে সেগুলোর কথা। বিশৃঙ্খল ম¯িÍষ্ককে থরে থরে সাজিয়ে একটি শৃঙ্খলার মাঝে নিয়ে আসুন। আপনার গুছিয়ে নেয়ার জন্য ঘড়ির কাটা যতটুকু সময় বরাদ্দ করেছিল তা শেষ হওয়া মাত্রই নেমে যান কাজে। যদি পারা যায় ঘর থেকে বেরুনোর সময় সুগন্ধি ব্যবহার করুন। এতে আপনার মাঝে চলে আসবে ফুরফুরে ভাব।
প্রশান্তির ঘুম এবং সুন্দর সকালের পর পেশাগত কাজে সূর্য যখন গড়িয়ে যাবে দুপুরে ততÿন বেশ ভাল মেজাজেই থাকবেন আপনি। এতটুকু অবসাদ ঘিরে ধরবেনা।
মনের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য চাই মনকে সবসময় প্রফুলø রাখা। সকল ÿেত্রে সেটা সম্ভব না হলেও চেস্টাতো করতে হবে। সে চেস্টাগুলোর মাঝে একটি হলো কোন দুশ্চিন্তা তৈরি করতে পারে এমন সবকিছু এড়িয়ে চলা। বিশেষ করে খুন এবং জখমের অপরাধ সংক্রান্ত খবরের প্রতি অতিরিক্ত কৌতুহল রাখবেন না। যাদের সাথে আপনার বনিবনা হয় তাদের সাথেই সময় বেশি কাটান। এমনকি খেলাধূলা করার জন্যও বন্ধুদের সঙ্গ আগে বাছাই করুন।

খাবার এবং বিশ্রাম
মানসিক প্রশা¯িÍ আর সুখনিদ্রা অনেকটাই নির্ভরশীল আপনার খাবারের তালিকা এবং সময়ের উপর। অবশ্যই আপনাকে সচেতন হতে হবে তিনবেলা খাবারের সময়ের ব্যাপারে। লÿ্য রাখতে হবে যা খাচ্ছেন তা স্বাস্থসম্মত এবং আপনার উপযোগি কিনা। আপনি কর্মজীবী হলে সকালের খাবার তালিকায় এমন কিছু উপাদান রাখবেন যেন এ থেকে সারা দিনের জন্য শক্তি সঞ্চয় করে নিতে পারেন। আপনার কাজ এবং কাজের অবস্থানের উপর নির্ভর করবে দুপুরের খাবার। কর্মÿেত্রে দুপুরের খাবার খেতে হলে খেয়াল রাখবেন তা যেন অতিভোজন হয়ে না যায়। তুলনামুলক হালকা খাওয়ার চেস্টা করবেন। যদি সুযোগ থাকে দুপুরে খাবার পর অল্প সময়ের জন্য বিশ্রামে যেতে পারেন। সকাল থেকে দূপুর পর্যন্ত যতটুকু কান্তি ভর করেছিল ত্রিশ মিনিটের সে বিশ্রামটুকু ঝেরে ফেলে দিতে পারে সব। হ্যা ঘুমের জন্য আপনার সময়ের বরাদ্দ কম হলেও এর সবটুকুই কাটাবেন কেবল ঘুমিয়ে। প্রথম দিকে এটি অসম্ভব মনে হলেও পরবর্তীতে অভ্য¯Í হয়ে যাবেন। আপনি ইশারা দেবেন আর অমনি ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি এসে আপনাকে তুলে নিয়ে যাবে। তবে দুপুরের ঘুমের পূর্বমুহুর্তে অবশ্যই চেস্টা করবেন অন্যসব চিন্তুা মাথা থেকে সরিয়ে রাখতে। পরিবেশ নিযে আসুন আপনার অনুকুলে। ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রগুলোর জ্বালাতন এড়াতে গুছিয়ে নিন এগুলোকে। মোবাইল ফোনটি বন্ধ বা নিঃশব্দ করে রাখুন। ই-মেইলের ইনস্টেন্ট নোটিফিকেশন অফ করুন, রেডিও এবং টিভি বন্ধ রাখুন। তারপর ঘরের আলো নিভিয়ে দিন। আবছা অন্ধকার আর শান্ত পরিবেশই বলে দেবে এখন আপনার ঘুমের সময়।
আপনার ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে আপনার ম¯িÍষ্কের সময় সচেতনতার ÿমতা। ম¯িÍষ্ক ঘড়িকে এমনভাবে অভ্য¯Í করে তুলুন যেন যখন আপনার জেগে উঠতে হবে তখনি যেন ঘুম ভাঙ্গানোর সঙ্কেত দিতে থাকে। দেখবেন ঘড়ির কাটায় কাটায় ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন আর এ অভ্যাসের কারণেই সময়ের কাজ সময়ে করে ফেলতে পারছেন। আর অলসতা করে হাতের কাজ ফেলে রাখা উচিত নয়। এমনটি করলে তা প্রভাব ফেলবে রাতের ঘুমের উপর। এলোমেলো কাজের জন্য ঘরে ফিরতে দেরি হবে আপনার। সেই সাথে বিছানায় যেতেও পারবেন না সঠিক সময়ে। আর কাজ বাকি রেখে বিছানায় গেলেও মানসিক অস্থিরতা ব্যাঘাত ঘটাবে ঘুমের। মনে রাখবেন সমগ্র চক্রের কোথাও ছন্দ পতন হলে তা কেবল হতেই থাকবে। কাজের মাঝেই খুঁজে নেন জীবণ।

নিজের দিকে দৃস্টি দিন
কাজ এবং উৎফুলøতা এ দুটোর সমন্বয়ের জন্য যথাযথ ঘুম জরুরি আর ঘুমের জন্য প্রয়োজন মানসিক স্বাচ্ছন্দবোধ। সুস্থতা এবং স্বাচ্ছন্দের জন্য অবশ্যই এগিয়েই থাকতে হবে আপনাকে। মনে রাখতে হবে, ঘুম হল স্বাস্থ এবং সুখের জন্য জরুরি। অবাঞ্চিত কোন শব্দ যদি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় বলে আপনার মনে হয় তবে দ্রæত এর সমাধান করে ফেলুন। আপনার সঙ্গীর আচরণ কিংবা বিরক্তিকর শব্দে ঘুমের সমস্যা হলে তাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। এতেও ফল না হলে আলাদা কÿের ব্যবস্থা করুন।
একান্ত নিজের প্রশান্তির জন্যই আপনার প্রয়োজন নিদ্রাবান্ধব একটি শয়নকÿ। আর এ কÿটিকে সাজানোর ব্যাপারে পরিচয় দিতে হবে নিজস্ব রুচির। সচেতন থাকতে হবে এর আসবাবসহ পরিবেশের উপর। আসবাবপত্র কেনার জন্য আপনি কখনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগবেননা। নিজের সিদ্ধান্তকেই গুরুত্ব দিন বেশি। যখন কÿটিকে সাজানোর মনস্থির করবেন এরপর অন্তত ত্রিশ দিন ভাবুন এর অঙ্গসজ্জার ব্যাপারে। পরামর্শ করুন সঙ্গির সাথে। তারপর যেসব আসবাবে আপনাদের স্বাচ্ছন্দ হবে বলে মনে হয় সেগুলোই কিনে আনবেন। তবেই নিজের পছন্দে রুচিসম্মতভাবে সাজিয়ে তোলা কÿটিতে প্রতিদিন নিশ্চিন্তে হারিয়ে যেতে পারবেন সুখনিদ্রার অতলে।

হাতে রাখুন একান্ত সময়
বেশিরভাগ ÿেত্রেই দেখা যায় ঘুমের আগের সময়টুকুতে একেকজন ব্য¯Í থাকেন একেক কাজে। বিশেষ করে মহিলাদের মাঝে এ প্রবণতাটা একটু বেশি। পৃথিবীব্যাপী মহিলাদের অনিদ্রা রোগের কারণ নিয়ে ২০০৭ সালে একটি সংস্থার গবেষণায় দেখা যায় ঘুমানোর পূর্বের ১ ঘন্টা তারা কাটান বিভিন্ন ব্য¯Íতার মধ্য দিয়ে। কেউ গ্রহস্থালী কাজে, কেউ বাচ্চাকাচ্চাদের সামলানোতে, কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কেউ ইন্টারনেট ব্রাউজিংএ সময় কাটিয়ে বিছানায় যান। আর এসবের প্রভাব মাথায় থেকে যায় এবং নানা চিন্তা ভীর করে দূরে সরিয়ে রাখে ঘুমকে। ঘন্টার পর ঘন্টা দু’চোখের পাতা বন্ধ রেখেও চেতনাকে বিলিন করতে পারেন না ঘুমের দেশে।
নিজের জন্য কিছু সময় বরাদ্দ রাখুন ঘুমাতে যাবার আগে। সম্ভব হলে সে সময়ের ব্যাপ্তিটা হবে এক ঘন্টা বা এর কাছাকাছি। এ সময়টকু একান্তই আপনি কাটাবেন নিজেকে দম দেয়ার জন্য। ঘড়িতে যেমন করে দম দেয়া হয় পরবর্তীতে সঠিক সময় নির্দেশ করতে, তেমনি আপনি এই সময়টুকুর মধ্যে পরিকল্পনা তৈরি করবেন আগামীকালের। ভাববেন আজকের স্বাপেÿে আগামীকাল কি কি করা উচিৎ। সমালোচনা করবেন আজকের কাজগুলোর এবং একটি পরিসংখ্যান দাঁড় করাবেন সঠিক-বেঠিকের । তারপর নিদ্রায় তলিয়ে যাবার পূর্বমুহুর্তে ম¯িÍষ্ক ঘড়িতে সঙ্কেত দিয়ে রাখবেন যথাসময়ে জেগে উঠার জন্য। চক্রাকারে এরকম অনুশীলনে অভ্য¯Í হতে পারলে ঘুম আসতে সময় নেবেনা একদম । পাশাপাশি তলিয়ে যেতে পারবেন গভীর সুখনিদ্রায়। আর এ নিদ্রাতো শুষে নিচ্ছেই সকল কান্তি এবং অবসাদ।

শনিবার, এপ্রিল ২৫, ২০০৯

ফাঁক ফেয়ে এক কাক


পিঞ্জিরাটার দরজা নাকি
একটু ছিলো ফাঁক
সেই সুযোগে উড়াল দিলো
আটকে থাকা কাক!
আড়েমাড়াটা ভেঙ্গে ডানা
মেললো নীলিমায়,
ভাবলো এমন খুশীর দিনে
কোনটা করা যায়।
জর্দা দিয়ে পান চিবুবে
করলো ভেবে ঠিক,
ফেলবে মাথায় পথচারীদের
মলের সাথে পিক।

জর্দা-খয়ের-পান-সুপারীর
সাথে খেয়ে চুন
তীব্র ঝাঁঝে পাগল হলো
চড়লো মাথায় খুন।
রাস্তা এবং পার্কে গিয়ে
ঠুকরে দিলো লোক,
শহর জুড়ে কাকের ভয়ে
কাঁপলো সবার বুক।
এক বিকেলে বুদ্ধি এঁটে
শহরবাসী সব
আনলো লাঠি-খন্তা-কুড়াল
দারুণ কলরব।

কিন্তু কাকের ঠোকর কেয়ে
ঝরলো অনেক প্রাণ
কেউবা আবার নাক হারালো
কেই হারালো কান।
খবর পেয়ে আসলো পুলিশ
আসলো বিশষ ফোর্স,
গতিক ভালো নয় দেখে কাক
ধরলো আরেক কোর্স।

কোথায় নকল চুলগুলি

চুল গজানোর রূপ নিয়ে
ভাবছে খোকন বড়শী ফেলে টুপ দিয়ে
কেমনে চুলের ফাঁক ঘুরালো
টাকু মামুর টাক ফুরালো
মাছ না পেয়ে ভাবছে শুধুই ভাবছে যে
উত্তেজনায় থরো থরো কাঁপছে সে।

হঠাৎ মামু কেমন করে কোত্থেকে
এসেই হাজির বড়শী পাতার জোত দেখে।
যেইনা মাছে ঠোঁট বাগিয়ে
টোপ টেনেছে চোট লাগিয়ে
অমনি খোকন সাঁই করে ছিপ টান দিতেই
মাছসহ তা পরলো মামুর চান্দিতেই।

টাকু মামু তার পেছনে, জানতো না
জানলে এমন মাছ দেখে ছিপ টানতো না।
বড়শী এঁটে টানলো চুলে
হ্যাঁচকা টানে আনলো তুলে।

তেল-তেলে সেই টাক দেখে এক বুলবুলি
ব্যঙ্গ করে হেসেই বলে, কোথায় নকল চুলগুলি?

বিষ্ঠা রহস্য


অর্ধ ছেলা চান্দি মেলে
মানি বাবু যাচ্ছিলেন
আপন মনে গুনগুনিয়ে
একটা কিছু গাচ্ছিলেন।

হঠাৎ কীযে পড়লো এসে
উপর থেকে চান্দিতে
চমকে গিয়ে তপ্ত আঁচে
ভুললো গানে টান দিতে।

ঘটলো কীসব আজব ব্যাপার
বুঝতে বাবু হাত দিয়ে
একটুখানি আনলো তুলে
চিন্তা ফিকির বাদ দিয়ে।

ফিকে-সাদা ক্রিমের মতো
বস্তুটা কি ভাবতে হয়!
সবার আগে নাকের কাছে
গন্ধটা তার মাপতে হয়।

কৌতুহলে জিহ্বা দিয়ে
চেখেই দেখেন ঝাঁজ আছে
তাইতো ভাবেন, এটার বুঝি
প্র্যাকটিকেলি কাজ আছে।

নিন্দুকেরা বলছে বাবু
কীসব দিয়ে হাত মাজেন
আবার নাকি কাকের ছাওয়ের
বিষ্ঠা দিয়ে দঁাত মাজেন।

শেয়ার করে সস্তাতে

দুলা: সুঁই কিনেছি ঢাকায় এসে
আগের চেয়ে সস্তাতে
নয়তো গাঁয়ের দোকান থেকে
কিনলে হতো পস্তাতে।

আলফা: ভাগ্য ভালো বুদ্ধি এঁটে
এসেই গেলাম ঢাকায় হেটে
চড়া দামে কিনলে তখন
কেমন হতো লস্‌ তাতে।

দুলা: গাঁয়ের বেটা জ্যন্ত ডাকাত
দাম হেঁকেছে আট আনা
তুই এগুলে গাল বরাবর
জোরসে দিতাম চাটকানা।
জিহ্বা টেনে সুঁই ফুটিয়ে
চড়া দামের সাধ চুটিয়ে
একটি কোপে কল্লা কেটে
ভরেই দিতাম বস্তাতে।

আলফা: এই আবারো পরলি পিছে
হাটার গতি শ্লথ নাকি?
জোর কদমে চলরে দুলা
আরো অনেক পথ বাকি।
আলসেমিটা দূরে ঠেলে
ক্লান্তি দেহের ছুঁড়ে ফেলে
এক নাগাড়ে পা চালিয়ে
পৌঁছতে হবে দশটাতে।

দুলা: সামনে যেতে পারছি না আর
বুকের ভেতর ফালপারে
আমার হাতের সুঁইটা তবে
রাখনা এখন আলফারে।
কিনছি ওটা শেয়ার করে
কিন্তু একা বেয়ার করে
ভেবেই দেখি ক্ষয় করেছি
নিজেই নিজের যশ তাতে।

আলফা: আমিই বহন করবো কেন
বিচার করে দেখনারে
তারচে ধরি দু মাথাতে
তুই-আমি চল একসারে।
উদাস করা গানের কলি
কণ্ঠ ছেড়ে আওড়ে চলি
চাঙ্গা হয়ে নতুন করে
লাগবে মনে রস তাতে।

দুলা: ভাবনাটা তোর মন্দনারে
কিন্তু ছোট সুঁইটাতে
কেমন করে ধরবো এখন
মস্ত এমন দুই হাতে!
কলাগাছে সুঁইটা গেঁথে
কাঁধে তুলে যেতে যেতে
নৃত্য করে ঘাড় উঁচিয়ে
গাছটি কলার ঘঁষ তাতে।

সোনালি চুলের এক দিগ্বিজয়ী বীর

শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ:
দশ বছরের এক কিশোর। অন্যদের মত সাধারণ নয়, ঝাঁকড়া সোনালী চুলের এ কিশোর প্রতাপশালী এক রাজ্যের রাজপুত্র। রাজ্যে একটি ঘোড়া ছিল অদ্ভূত বৈশিষ্টের। এর মাথার আকৃতি ষাঁড়ের মত দেখতে। সুগঠিত পেশীর এই ঘোড়ার গায়ে প্রচন্ড শক্তি, প্রসস্ত দেহ, চওড়া পিঠ। তেজে টগবগ করত সারাক্ষণ। কেউ বাগে আনতে পারেনি একে। তাই রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন ঘোড়াটি বিক্রি করে দেবেন। একথা কানে যেতেই কিশোর রাজপুত্রের মন বিষন্ন হয়ে গেল। কারণ এ ঘোড়টির মধ্যে সে তার নিজের ছায়া দেখতো। কেন জানি কিশোর যুবরাজের ইচ্ছা হতো এর পিঠে সওয়ার হয়ে তীর বেগে ছুটে যাওয়ার। ইচ্ছা হত দিগন্ত ভেদ করে সকালের উদিয়মান সূর্যের লাল টকটকে গোলকের ভেতর মিলিয়ে যেতে। ঘোড়াটা বিক্রির ব্যাপারে সবকিছু যখন চূড়ান্ত, কিশোর রাজপুত্র আর তর সইতে পারলোনা। একলাফে অভিজ্ঞ সওয়ারীর মত চড়ে বসল এর পিঠে। সাথে সাথেই চিহি ডাক তুলে তাকে পিঠে নিয়ে ছুটলো উল্কার মত। অ™ভ‚ত তেজী এ ঘোড়ার পিঠে সেঁটে বসা ছোট্ট এ কিশোরকে মনে হয়েছিল একটি ধনুক। ঘটনা দেখেতো সবাই তাজ্জব। বাবা বুকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেলেন। উৎফুলø হয়ে সেদিন তিনি বলেছিলেন “আমার সন্তান, তুমি এ রাজ্যের বাইরেও সীমান্তকে সম্প্রসারণ কর। কেবল ম্যাকডোন তোমার জন্য যথেস্ট নয়।”
সত্যিই হল সেকথা। এই কিশোরই পরবর্তীতে দিগি¦জয়ী হয়েছিল, শাসন করেছিলো অর্ধেক পৃথিবী। ইতিহাস খ্যাত বীর আলেকজান্ডারই হলো সেই কিশোর এবং ম্যাকডোনের শাসক ফিলিপ-২ ছিলেন তার বাবা। মায়ের নাম অলিম্পিয়া।
ভালবাসার সেই ঘোড়াটি সবসময় তার কাছে প্রিয়-ই ছিলো। এর নাম ছিলো বুচিফালুস। যার অর্থ হল ষাঁড়ের মত মাথা। সকল অভিযানে ভালবাসার বুচিফালূসের পিঠে চড়ে ছুটতেন তিনি। আলেকজান্ডার এটিকে এমন ভালবাসতেন যে, ঘোড়াটি মারা যাবার পর এর নামে একটি শহরের নামকরণ করেছিলেন। যা বুচিফালুস বা বুচিফালা নামে পরিচিত। অনেকে মনে করেন বুচিফালুসের মৃত্যু হয়েছে ভারতের যুদ্ধে। আবার অনেকের ধারণা স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধ হয়ে ঘোড়াটি মারা যায়।
বাবা ফিলিপ এবং মা অলিম্পিয়া
আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট। যার জন্ম নিয়েই রয়েছে নানা কিংবদন্তী। বাবা ফিলিপ এবং মা অলিম্পিয়া আলেকজান্ডারের জন্মের পূর্বে অদ্ভূত ধরনের স্বপ্ন দেখতেন। ফিলিপ দেখেছিলেন, তিনি অলিম্পিয়ার গর্ভে সিংহের মোহর প্রতিস্থাপন করে দিয়েছেন। এ স্বপ্নটি নিয়ে রাজ্যের গণকদের সাথে কথা বললে তারা ভবিষ্যদ্বানী করেন, শীঘ্রই অলিম্পিয়ার গর্ভে একটি ছেলে সন্তান আসছে। এ সন্তানটি হবে সিংহের মত।
কিংবদন্তীর আলেকজান্ডার ৩৫৬ খ্রিস্টপূর্বে জন্মগ্রহণ করেন ম্যাকডোনের রাজধানী পেলাতে। তিনি ছিলেন ইতিহাসের অন্যতম সফল সেনানায়ক এবং সুকৌশলী যুদ্ধা। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছিলো তাঁর সাহস আর প্রতাপের কথা। বাবা ফিলিপ-২ এর মৃত্যুর পর পারস্য, এনাটোলিয়া, সিরিয়া, ফইনিসিয়া, জুদিয়া, গাজা, মিশর, ব্যক্ট্রিয়া, মেসোপটেমিয়া এবং ভারতের পাঞ্জাব পর্যন্ত তাঁর শাসন বিস্তৃত হয়।
ছোটবেলার শিক্ষক এরিস্টটলের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বুদ্ধিবৃত্তির এতটা প্রসার ঘটেছিল যে, তিনি সব কিছু পরিকল্পনা মাফিক করতেন। আলেকজান্ডারের বয়স যখন ১৩, তখন থেকে তিনি এরিস্টটলের ছাত্র হয়ে যান। নিয়মিত এরিস্টটলের কাছে তাত্তি¡ক ও ব্যবহারিক শিক্ষা নিতেন। এরিস্টটল তাকে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র, মানুষের আচরণবিধি, পশু পাখি জীব জন্তু ও শস্যসহ অনেক বিষয়ই ছিল তার শিক্ষনিয় বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। এরিস্টটলের কাছে এসব শিক্ষা পুঁথিবদ্ধ ছিলনা। আলেকজান্ডারের শরীর গঠনের জন্য নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন করার অভ্যাসও তৈরি হয় এরিস্টটলের মাধ্যমে।
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম দিক থেকেই আলেকজান্ডারের পরিকল্পনা ছিলো আরব উপদ্বীপে তাঁর সৈন্যবাহিণী এবং অর্থনৈতিক ব্যাপকতা প্রসারিত করবেন। পূর্ব-পশ্চিম সকল দিকের শাসক হবেন তিনি। সে কারণে প্রয়োজন একটি চৌকস সেনাবাহিনীর। সে লক্ষে কাজও করেছেন তিনি, বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন ভ‚মি ও আবহাওয়ায় সৈন্যদেরকে খাপ খাওয়ানোর জন্য ব্যাপকহারে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকদের অন্তর্ভুক্ত করে তিনি তার সেনাবাহিনী গঠন করেন। এসব কৌশল এবং পন্থা অবলম্বন করা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে কেবল এরিস্টটলের ছাত্র হওয়ার সুবাদে।
আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট সম্বন্ধে রয়েছে অনেক আলোচনা, পর্যালোচনা, সুনাম, দুর্নাম। প্রচলিত রয়েছে অনেক কাহিনী। উদার, হিংস্র কিংবা কৌশলী বিভিন্ন আখ্যায় আখ্যায়িত করা হয় তাকে। তার সম্বন্ধে ভাষ্য রয়েছে বাইবেলসহ নানা ধর্মগ্রন্থে, কালজয়ী বিভিন্ন সাহিত্যে। মুসলমান পন্ডিতদের কেউ কেউ মনে করছেন পবিত্র কোরআনে বর্ণিত জুলকারণাইন-ই হলো আলেকজান্ডার। আসলেই কি তাই!
আলেকজান্ডারের রাজত্ব
ম্যাকডোনের সিংহাসনে আলেকজান্ডার
৩৩৯ খ্রিস্টপূর্বে আলেকজান্ডারের বাবা যখন ৫ম স্ত্রী কিউপেট্রা ইউরিডাইসকে বিয়ে করে আনেন তখন থেকে শুরু হয়ে যায় পারিবারিক দ্বন্দ। এর পেছনের কারণ হলো জাতিয়তাবাদী চেতনা। আলেকজান্ডারের মা অলিম্পিয়া ছিলেন এপিরাসের অধিবাসিনী। অপরদিকে ৫ম স্ত্রী কিওপেট্টা ছিলেন নিখাঁদ ম্যাকডোনের কণ্যা। এ জাতিয়তাবাদ নিয়েই শুরু হয়ে যায় রাজনৈতিক নানা চক্রান্ত। অলিম্পিয়া এবং কিউপেট্রার মাঝে চলতে থাকে ঠান্ডা লড়াই। কিউপেট্রা এবং তার পক্ষের লোকজন আলেকজান্ডারের উত্থানকে সহ্য করতে পারতনা। এপিরাসের কণ্যার গর্ভের সন্তান কখনো ম্যাকডোনের রাজার উত্তরাধিকারী হতে পারেনা। ম্যাকডোনের সিংহাসনে চাই নিখাঁদ ম্যাকডোনের সন্তান। এ যুক্তির পক্ষে সিংহাসনের উত্থরাধিকারী নিয়ে অলিম্পিয়াকে কোণঠাসা করার চেস্টা চলত। সম্ভবত এসব কারণেই পরবর্তীতে আলেকজান্ডারের ক্ষোভ জন্মেছিল এবং তার শাসনামলে তার বাহিনীতে বিভিন্ন অঞ্চলের সেনা অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল।
৪র্থ এবং ৫ম স্ত্রীর মাঝে ঠান্ডা লড়াই ফিলিপ পর্যন্ত গড়ায়, এ বিষয়টি নিয়ে আলেকজান্ডার ও ফিলিপের মাঝে বাক-বিতন্ডাও হয়। আলেকজান্ডারের একটি বেপরোয়া চিৎকারের জবাবে বাবা তাকে লক্ষ্য করে তলোয়ার ছুঁড়ে মেরেছিলেন। এর জের ধরেই মাকে নিয়ে আলেকজান্ডার ম্যাকডোন ত্যাগ করে এপিরাসে চলে যান। কিন্তু তার বোন থেকে যায় ম্যাকডোনেই। সেই বোনের নামও ছিলো কিওপেট্রা।
এর কিছুদিন পর ফিলিপ এবং আলেকজান্ডারের মাঝে আবার সমঝোতা হয় এবং সে আবার ম্যাকডোনে ফিরে আসে। কিন্তু মা থেকে যান এপিরাসে। ৩৩৮ খ্রিস্টপূর্বে বাবার অধীনে আলেকজান্ডার চীরুলিয়া যুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করেন। এতে ফিলিপ তাকে সেনাবাহিনীর একটি অংশের অধিনায়ক করে দেন এবং তার বীরত্বের জন্য উৎসবের আয়োজন করেন।
৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বে ফিলিপ তার মেয়ে ক্লিওপেট্রার বিয়ের অনুষ্ঠানে ঘাতকদের আক্রমণে মারা যান। কেউ কেউ মনে করেন বিয়ে সংক্রান্ত জটিলতা নিয়েই তাকে হত্যা করা হয়েছে। হয়তো মেয়ের সাবেক প্রেমিক কিংবা মেয়ের স্বামীর সাবেক প্রেমিকা ছিলো ঘাতক। আবার আরেকটি ধারণা রয়েছে যে, ফিলিপকে হত্যা করার পেছনে আলেকজান্ডার এবং অলিম্পিয়ার হাত রয়েছে। অবশ্য এ ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায় অনেক অনেক বছর পর ইতিহাসের গতি কারো কারো পছন্দমত বাঁক খায়নি এর কি নিশ্চয়তা? বরং ইতিহাসের অনেক ঘটনা বর্তমান বর্ণনায় উল্টো হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।
ফিলিপ-২ এর মৃত্যুর পর সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সুকৌশলী সেনানায়ক আলেকজান্ডার মাত্র ২০ বছর বয়সে আরোহণ করেন ম্যাকডোনের সিংহাসনে। সেনাবাহিনী মেনে নেয় তার আনুগত্য।

আলেকজান্ডার এবং রুক্সানা
আলেকজান্ডার এবং তার সেনাপতি হেফিশন এক জাকজমক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দারিউসের দুই কন্যাকে বিয়ে করেন
File:Hephaistion portrait Prado bronze sketch.jpegসেনাপতি হেফিশন

ব্যক্তিগত জীবন
আলেকজান্ডারের জীবনের দীর্ঘ সময়ের সাথী ছিলেন তার সেনাপতি হেফিশন। তাছারা হেফিশন ছিল তার একজন বড় বন্ধু। তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত হেফিশন-ই ছিল বাহিনীর ২য় ব্যক্তি।
আলেকজান্ডার বিয়ে করেন ২টি। প্রথম স্ত্রী ব্যক্ট্রিয়ার আদর্শ কণ্যা রুক্সানা। অপরজন পারস্যের রাজা দারিউস-৩ এবং তার স্ত্রী স্ট্যটেইরা-১ এর কণ্যা স্ট্যটেইরা-২। রুক্সানার জন্ম ৩৪১ খ্রিস্টপূর্বে। ব্যক্ট্রিয়ায় রুক্সানার জন্ম স্থান সম্বন্ধে অনেকের ধারণা তা বর্তমান আফগানিস্তান। আলেকজান্ডারের সাথে রুক্সানার বিয়ে হয় ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বে। অপর স্ত্রী স্ট্যটেইরার সাথে বিয়ে হয় ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বে। পারস্যের রাজা দারিউস-৩ আলেকজান্ডারের সাথে যুদ্ধে হেরে গিয়ে স্ত্রী, দুই কন্যা এবং মাকে রেখে পালিয়ে যান। এর কিছুদিন পর আলেকজান্ডার এবং তার সেনাপতি হেফিশন এক জাকজমক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দারিউসের দুই কন্যাকে বিয়ে করেন। আলেকজান্ডারের সাথে বিয়ে হয় স্ট্যটেইরা-২ এর এবং তার বোন ড্রিপটেইসকে বিয়ে করে হেফিশন।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর পরিবারে রাজ্যের হাল ধরার মত কেউ ছিলেননা। তার ভাই ফিলিপ এরিডাস তখন ছিল মানসিকভাবে অসুস্থ। অপরদিকে ছেলে আলেকজান্ডার-৪ এর জন্মই হয় তার মৃত্যুর পর। তাই বিশাল এ সাম্রাজ্যকে এক করে রাখা সম্ভব হয়নি। সেনাপতিদের মাঝে ভাগ হয়ে চারটি সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

মৃত্যু ও কফিন
আলেকজান্ডারের মৃত্যু নিয়ে কয়েকটি ধারণা রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, তাকে বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলা হয়েছে। কারো মতে পূর্বের ম্যালেরিয়া রোগ আবার তাকে আক্রমণ করেছিল। আবার কেউ মনে করছেন কেবল মাত্র অতিরিক্ত মদ্যপান-ই তার মৃত্যুর কারন। ৩২৩ খ্রীস্টপূর্বের ২৯মে আলেকজান্ডার তার বন্ধুদের সাথে একটি অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত মদ্যপান করেন। তখন থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে যান। বিছানায় পতিত তরুণ শাসক তখন কথাও বলতে পারেননি। নির্দেশনা দিতে পারেননি জেনারেল ও সৈন্যদেরকে। এমনকি হাত উঁচু করাও তার পক্ষে সম্ভব ছিলনা। এভাবে কয়েকদিন মাত্র। ৩২৩ খ্রীস্টপূর্বের ১০ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন ব্যবিলনের নেবুচাড্্েরজার-২ এর প্রাসাদে। তার জীবনকাল ছিল ৩৩ বছরের চেয়ে ১ মাস কম।
বর্তমানে আলেকজান্ডারের কফিন সংরক্ষিত রয়েছে তুরস্কের ইস্তাম্বুল জাদুঘরে। এটি ১৮৮৭ সালে লেবাননের সিডন এর কাছাকাছি কোন একটি স্থান থেকে পাওয়া যায়। আলেকজান্ডারের দেহের ধারক মানুষের আকৃতির এ কফিনটি স্বর্ণের তৈরি। এটি বর্তমানে একটি প্রতীকি ঢিলা কাপড় দিয়ে ঢাকা রয়েছে। কফিনের পাশেই রয়েছে তার ব্যবহৃত অস্ত্রসস্ত্র।
আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি সম্পদ ও ক্ষমতার লোভে অভিযান চালাতেন। ÿমতার দম্ভ ও সম্পদের জন্য তিনি ছিলেন বেপরোয়া। কিন্তু এ কথাও প্রচলিত রয়েছে যে, সহযোগিদের প্রতি আলেকজান্ডারের শেষ অনুরোধ ছিল মৃত্যুর পর তার হাত দুটো যেন কফিনের বাইরে প্রসারিত করে রাখার হয়। যেন সবাই দেখতে পায় বিশ্ববিজয়ী বীর আলেকজান্ডার পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে শূন্য হাতে। বিশাল সাম্রাজ্যের কিছুই তিনি সাথে করে নিয়ে যেতে পারেননি।

বাইবেল এবং আলেকজান্ডার

বাইবেলে আলেকজান্ডারের প্রতীকি বর্ননা রয়েছে। এখানে আলেককজান্ডারের প্রতীক হিসেবে দুইটি শিং এর উলেøখ রয়েছে।
দানিয়েল ৮ঃ৫-৮ পদে রয়েছে “ ... পশ্চিমদিক হইতে এক ছাগ সম¯Í পৃথিবী পার হইয়া আসিল, ভ‚মি স্পর্শ করিল না, আর সেই ছাগের দুই চুর মধ্যস্থানে বিলÿণ একটা শৃঙ্গ ছিল। পরে দুই শৃঙ্গবিশিষ্ট যে মেষকে আমি দেখিয়াছিলাম, নদীর সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে, তাহার কাছে আসিয়া সে আপন বলের ব্যগ্রতায় তাহার দিকে দৌড়িয়া গলে। আর আমি দেখিলাম, সে মেষের কাছে আসিল, এবং তাহার উপরে ক্রোধ উত্তেজিত হইল, মেষকে আঘাত করিল, ও তাহার দুই শৃঙ্গ ভাঙ্গিয়া ফেলিল, তাহার সম্মুখে দাঁড়াইবার শক্তি ঐ মেষের আর রহিল না, আর সে তাহাকে ভ‚মিতে ফেলিয়া পদতলে দলিতে লাগিল, তাহার হ¯Í হইতে ঐ মেষটীকে উদ্ধার করে, এমন কেহ ছিল না। পরে ঐ ছাগ অতিশয় আত্মগরিমা করিল, কিন্তু বলবান হইলে পর সেই বৃহৎ শৃঙ্গ ভগ্ন হইল, এবং তাহার স্থানে আকাশের চারি বায়ুর দিকে চারিটী বিলÿণ শৃঙ্গ উৎপন্ন হইল। ..”
পরবর্তীতে ২১-২২ পদে বিষয়টি স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে “ ... তুমি দুই শৃঙ্গবিশিষ্ট যে মেষ দেখিলে, সে মাদীয় ও পারসীক রাজা। আর সেই লোমশ ছাগ যবন দেশের রাজা, এবং তাহার দুই চুর মধ্যস্থানে যে বৃহৎ শৃঙ্গ সে প্রথম রাজা। আর তাহার ভগ্ন হওয়া, ও তৎপরিবর্ত্তে আর চারি শৃঙ্গ উৎপন্ন হওয়া, ইহার মর্ম্ম এই, সেই জাতি হইতে চারি রাজ্য উৎপন্ন হইবে, কিন্তু উহার ন্যায় পরাক্রম-বিশিষ্ট হইবে না। ...”
পশ্চিম দিক থেকে আগত এই ছাগ বা ছাগলটি ছিল গ্রীক সাম্রাজ্যের প্রতীক এবং বড় বড় শিংগুলো ছিল আলেকজান্ডারের প্রতীক, যিনি তার ÿমতার সর্বোচ্চ শিখরে থাকার সময় অকালে মারা যান। পরবর্তীকালে এ সাম্রাজ্য তার চারজন সেনাপতির মাঝে ভাগ হয়ে যায়।

কাসপিয়ান গেট
পবিত্র কোরআন এবং আলেকজান্ডার
পবিত্র কোরআনে ‘আলেকজান্ডার’ নামে সরাসরি কোন ভাষ্য নেই। তবে কোন কোন মুসলিম পন্ডিতগণ মনে করেন সূরা কাহাফ্-এ বর্ণিত জুলকারণাইনই হলেন আলেকজান্ডার। আরব উপদ্বীপে জুলকারণাইন নামটি পরিচিত ছিল অল্প বয়সে অধিক ক্ষমতাধর শাসক হিসেবে। জুলকারণাইন শব্দটির অর্থ হল দুই শিং বিশিস্ট। এ নামকরনের কারণ সম্পর্কে বহু কথা রয়েছে। কেউ বলেন: তাঁর মাথার চুলে দু’টি গুচ্ছ ছিল, যেগুলো দেখতে শিংএর মত। বেউ বলেন: পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যদেশগুলো জয় করার কারণে জুলকারণাইন খেতাবে ভ‚ষিত হয়েছিলেন তিনি। কেউ এমনও বলেছেন যে, তাঁর মাথায় শিং এর মত দু’টি চিনহ ছিল। অনেকের ধারণা এগুলো ছিল ক্ষত চিনহ। কিন্তু কয়েকজন মুফাচ্ছির বলেছেন এটা নিশ্চিত যে, কোরআন স্বয়ং তাঁর নাম জুলকারণাইন রাখেনি; বরং ইহুদীরা এ নাম দিয়েছিল। ইসলামী পন্ডিতদের অনেকেই কোরআনে বর্ণিত জুলকারণাইনের বৈশিষ্টগুলোর সাথে আলেকজান্ডারের বৈশিষ্টের মিল খুঁজে পান। এর মাঝে উলেøখযোগ্য হলো আলেকজান্ডারও ‘দুই শিং বিশিস্ট’ হিসেবে খ্যাত এবং তিনি পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের দেশগুলো জয় করেছিলেন। তাছারা বাইবেলেও আলেকজান্ডারকে দুই শিংবিশিস্ট বলেই অভিহিত করা হয়েছে।
আলøাহতাআয়ালা বিভিন্ন সময় পৃথিবীর মানুষকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। এদের মাঝে মাত্র কয়েকজনের নাম কোরআনে উলেøখ রয়েছে। নবী হিসেবে জুলকারণাইন এর নাম উলেøখ নেই, আবার তিনি নবী ছিলেননা এমনটিও বলা হয়নি। তাই পন্ডিতদের কেউ কেউ বলছেন হয়তো জুলকারণাইন আলøাহ প্রেরিত নবীদের মাঝে একজন ছিলেন। হয়তো সে কারনেই নিপীড়িত মানুষ সাহায্য, সহযোগিতার জন্য তাঁর কাছে ছুটে আসত। অনুসরণ করতো তাঁর দিক নির্দেশনা। তিনি নবী ছিলেন কি ছিলেননা, সে বিতর্কে না গিয়ে জুলকারণাইন-ই হলেন আলেকজান্ডার পন্ডিতদের একাংশের এ ধারণা কিভাবে হলো, তা স্পস্ট হবে কোরআনের এ বর্ণনা থেকে
“ ওরা তোমাকে জুলকারনাইন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। বলো, ‘আমি তোমাদের কাছে তার কথা বয়ান করব।’ আমি তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম ও প্রত্যেক বিষয়ের উপায় ও পথনির্দেশ করেছিলাম। সে এক পথ অবলম্বন করল। চলতে চলতে সে যখন সূর্যের অ¯Íাচলে পৌঁছাল তখন সে সূর্যকে এক পঙ্কিল জলে অ¯Í যেতে দেখল এবং সে সেখানে এক স¤প্রদায়কে দেখতে পেল। আমি বললাম, ‘হে জুলকারণাইন! তুমি এদেরকে শাস্তি দিতে পার বা এদের সদয়ভাবে গ্রহণ করতে পার।’
সে বলল, ‘যে-কেউ সীমালঙ্ঘন করবে আমি তাকে শা¯িÍ দেব, তারপর তাকে প্রতিপালকের কাছে ফিরিয়ে আনা হবে ও তিনি তাকে কঠিন শা¯িÍ দেবেন। তবে যে বিশ্বাস করে সৎকর্ম করে তার জন্য প্রতিদান হিসেবে আছে কল্যাণ ও তার সাথে ব্যবহার করার সময় আমি সহজভাবে কথা বলব।’
আবার সে এক পথ ধরল। চলতে চলতে যখন অরুণাচলে পৌঁছল তখন সে দেখল তা (সূর্য) এমন এক স¤প্রদায়ের ওপর উঠছে যাদের জন্য সূর্যের তাপ থেকে আত্মরÿার জন্য আমি কোনো আড়াল সৃষ্টি করি নি। প্রকৃত ঘটনা এই, তার বিবরণ আমি ভালো ক’রে জানি।
আবার সে এক পথ ধরল। চলতে চলতে সে যখন পাহাড়ের প্রাচীরের মাঝখানে পৌঁছল তখন সেখানে সে এক স¤প্রদায়কে পেল যারা তার কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। ওরা বলল, ‘হে জুলকারণাইন! ইয়াজুজ ও মাজুজ পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করছে; আমরা কি তোমাকে কর এই শর্তে দেব যে তুমি আমাদের ও ওদের মধ্যে এক প্রাচীর গ’ড়ে দেবে?
সে বলল, ‘আমার প্রতিপালক আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তা-ই ভালো। সুতরাং তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য করো, আমি তোমাদের ও ওদের মাঝখানে এক মজবুত প্রাচীর গড়ে দেব। তোমরা আমার কাছে লোহার তাল নিয়ে আসো।’ তারপর মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা পূর্ণ হয়ে যখন লোহার ঢিপি দুটো পাহাড়ের সমান হল তখন বলল, ‘তোমরা হাপরে দম দিতে থাকো।’ যখন তা আগুনের মতো গরম হল তখন সে বলল, ‘তোমরা গলানো তামা নিয়ে আসো, আমি তা ওর ওপর ঢেলে দেব।’
এরপর ইয়াজুজ ও মাজুজ তা পার হতে পারল না বা ভেদ করতেও পারল না। সে (জুলকারণাইন বলল, ‘এ আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ। যখন আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রæতি পূর্ণ হবে তখন তিনি ওকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবেন, আর আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি সত্য।’
সেদিন আমি ওদেরকে দলেদলে তরঙ্গের আকারে ছেড়ে দেব, আর শিঙায় ফুঁ দেওয়া হবে। তারপর আমি ওদের সকলকেই একত্র করব। আর সেদিন আমি জাহান্নামকে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত করব অবিশ্বাসীদের কাছে, যাদের চু আমার নিদর্শনের প্রতি ছিল অন্ধ, আর যাদের শোনারও ক্ষমতা ছিল না।” (সূরা কাহাফ্ ৮৩-১০১)
জুলকারণাইন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়াতেন নির্যাতীত, বঞ্চিত, শাসকের হাতে শোসিত লোকদের মুক্তি দিতেন। আলেকজান্ডারের বেলায়ও ঘুরে বেড়ানোর এবং রাজ্য জয় করার ইতিহাস রয়েছে। কুরআনের বর্ননা অনুযায়ী অরুণাচলে, যেখান থেকে সূর্য উদিত হয় সেখানে ইয়াজুজ, মাজুজের হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য দেয়াল তুলে দিয়েছিলেন জুলকারণাইন। আর সে স্থানটি পাহাড়ের প্রাচীরের মাঝখানে। এই বর্ণনার সাথে মিলে যায় এমন একটি দেয়াল রয়েছে কাসপিয়ান সাগর উপক‚লে। ইতিহাসবিদদের দ্বারা স্বীকৃত যে এ দেয়াল তৈরি করেছিলেন আলেকজান্ডার। যা তৈরি করতে লোহা ও তামা ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে একটি তোরণ রয়েছে যেটি ‘কাসপিয়ান গেট’ বা আলেকজান্ডারের গেট নামে পরিচিত। দারিয়াল এবং ডারবেন্ট নামে দুটি শহরে এর ব্যপ্তি। দারিয়াল রাশিয়া এবং জর্জিয়ার সীমান্তে অবস্থিত। এটিকে বলা হয় কাজবেক পাহাড়ের পূর্ব প্রাম্ভ। ডারবেন্ট রাশিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত একটি শহর। কাসপিয়ান সাগরের দক্ষিণপূর্ব উপকূলে নির্মীত এ দেয়ালটি তোলা হয়েছে দুটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা যায়গ্রায়। এ পাহাড় দুটিকে বলা হয় পৃথিবীর ¯Íন। আলেকজান্ডার নির্মীত এ দেয়ালের উচ্চতা ২০ মিটার এবং এটি ৩ মিটার (১০ ফুট) পুরো। এ দেয়াল ভেদ করে শত্রæদের এগিয়ে আসা অসম্ভব। তাছারা কাসপিয়ান গেটে আলেকজান্ডার রেখেছিলেন নিñিদ্র পাহাড়া। যেন গ্রীকের শত্রæরা দেয়ালের এ পাশে কোনভাবেই আসতে না পারে। কুরআনে রয়েছে যে, ইয়াজুজ মাজুজের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য এ দেয়াল নির্মাণ করা হয়। ইয়াজুজ মাজুজ সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন এ নামে অত্যাচারী শাসক ছিলো। আবার কারো মতে প্রতিকী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে এ দুটি শব্দ। এ প্রতীক হতে পারে অত্যাচারী শাসক বা শাসকদের, যারা কাসপিয়ান সাগরের এ উপক‚র দিয়ে আক্রমণ ও লুণ্ঠন চালাত।
মুসলমান পন্ডিতদের পাশাপাশি পশ্চিমা অনেক পন্ডিতগণও আলেকজান্ডারকে জুলকারণাইন বলেই অভিহীত করেন। কারণ কুরআন এবং বাইবেলে বর্ণিত অনেককিছুর সাথেই সাদৃশ্য রয়েছে বর্তমানে প্রচলিত আলেকজান্ডারের ইতিহাসের। প্রশ্ন উঠতে পারে কুরআনে বর্ণিত জুলকারণাইন ছিলেন সু শাসক। কিন্তু সেই জুলকারণাইনকে কিভাবে আলেকজান্ডার ধরা হবে? কারণ আলেকজান্ডারের ব্যাপারে সুনামের চেয়ে দুর্নামের কথা-ই বেশি প্রচলিত রয়েছে। তাছারা আলেকজান্ডারের আস্তিকতার ব্যাপারে স্বীকৃতি থাকলেও অনেকে মনে করছেন তিনি ছিলেন অগ্নিপূজক। এর সঠিক জবাব হলো পবিত্র কোরআন ব্যতিত আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মগ্রন্থগুলো যদি সময়ের সাথে সাথে মানুষের খেয়াল খুশিমত পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে, তো একজন ব্যক্তি বা শাসকের চরিত্রও বিকৃত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক নয় তাদের দর্শন বিবর্তনের।
হাজার হাজার বছর পর বিতর্ক করে হয়তো দেখা যাবে আলেকজান্ডার আদৌ জুলকারণাইন ছিলেননা। আবার হয়তো আরো গভীর পর্যালোচনা করলে একথাটি দাঁড়িয়ে যাবে আলেকজান্ডার দ্যা গ্র্যাট ছিলেন জুলকারণাইন।