মঙ্গলবার, আগস্ট ৩১, ২০১০

ছুটির বিড়ম্বনা

হুরমুর করে আরো একগাদা লোক আছড়ে পড়ল বাসের উপর। তিল ধারণের জায়গাটুকু পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই। কিন্তু তবুও ঠেলে-ঠুলে ঠিকই ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে লোকগুলো। কেউ ঝুলে আছে দরজায়। আবার কেউবা উঠে যাচ্ছে ছাদে। ছাদ থেকে কয়েকজনের পা জানালার দিকে ঝুলে থাকতে দেখলো ময়না। ভাগ্যিস আগে আগে ওরা টিকেট কেটে সিটে বসতে পেরেছিলো। নাহয় ওদেরকেও হয়তো এভাবেই যেতে হতো। অবশ্য সিট না পেলে দাঁড়িয়ে যেতে রাজি হতেন না বাবা। শহরে যাবার পথেই যে এত ঝামেলা পোহাতে হবে তা ধারণাও করতে পারেনি সে। এমন জানলে কেনাকাটা করার জন্য বাবার সাথে আসার বায়না ধরতো না ময়না।
মুড়ির টিনের মতো বাসটি ঘট ঘট ঘট শব্দ তুলে এগুচ্ছে গরুর গাড়ির গতিতে। বেশি প্যাসেঞ্জার বোঝাই করেছে বলে নয়, এ বাসগুলোর প্রকৃতিই এমন। মাত্র ষোল কিলোমিটার দূরত্বের এ পথটুকু পাড়ি দিতে এক থেকে দেড় ঘন্টার মতো লেগে যায়। কারণ একটু পর পর থামরে, প্যাসেঞ্জার তোলরে, স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেলে ঠেলে ঠুলে স্টার্ট তুলরে ইত্যাদি আরকি। এখন মনে হচ্ছে রিকসায় গেলেই ভালো হতো। কিন্তু রিকসা যা ভাড়া চাইল তা শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো ওদের। ঈদের মৌসুমে ভাড়া তিন থেকে চারগুন হয়ে যায় কেন তা বুঝে আসছে না ময়নার।
ওহ্, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। বাসের গোমোট পরিবেশে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বাবা অবশ্য জানালার পাশের সিটেই বসিয়েছেন তাকে। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন বাবার গায়ের উপর যেভাবে হেলে পরছে, তাতে বাবাও খানিকটা চেপে বসেছেন ময়নার দিকে। লোকজনের ঘামের বোঁটকা গন্ধে পেট গুলিয়ে আসছে। ক্ষনে ক্ষনে উথলিয়ে উঠতে চাচ্ছে বমি। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে জানালার কাঁচ খুলে দিয়েছেন বাবা। এতে বাইরে থেকে বাতাস ঢোকছে বটে, সেই সাথে ঢোকছে ধুলো। মুহুর্তের মাঝেই ধুলোময় হয়ে গেল ময়না। ভেতর থেকে খ্যাট খ্যাট করে উঠলো কয়েকজন লোক
- এ্যাই ভাই জানালা খুলছুইন কেরে? বালু (ধুলি) আইতাছে।
- ছেরিডা বুমি করবঅ দেকতাছুইন না? মেয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলল তোতা মিয়া।
লোকজনের কটুক্তি আর ধুলির ঝড়ে বমি করতে ভুলে গেল ময়না। বন্ধ করে দিলো জানালার কাঁচ। চুপচাপ বসে রইলো জনারন্যের ভেতর।
- আহাইরে জানডা বাইরইয়া যাইতাছেগা। বিরক্তি প্রকাশ করল এক যাত্রী। তার কথাতে ধরলো অন্য আরেকজন
- জান বাইরইতনা, বাসের মইদ্যে মানুষ কট্টি (কতগুলো) লইছে দেখছনি। দুইন্নাইডার মাইদ্যে (দুনিয়াতে) যে কত মানুষ আছে ঈদের সময় অইলে দেহুন যায়।
- আরে অহনঅই মানুষের দেখছঅ কি, ঈদ তঅ আরো কয়দিন দেরি আছে।
- হেই কতা আর কইয়েননা ভাই। সারা দেশের মইদ্যে আউলাডাতঅ লাগবঅ ঈদের আগের দিন। অফিস আদালতে ছুটি থাহে মাত্র তিন দিনের। ঈদের আগের দিন সবাই শহর ছাইরা ছুডে গেরামের দিকে। কিন্তু কেউ ঠিক সময়ের মাইদ্যে যাইতে পারেনা। কেউ যায় ঈদের দিন। আবার রাস্তায় এক্সিডেন্ট কইরা কেউ পৌঁছতেই পারেনা।
- একবার না হুনছিলাম, সরকার নাকি এইবার থেইকা ঈদের ছুটি পাঁচদিনের করবঅ? হের পরেতো আর কোনঅ খবর-টবর হুনলামনা
- রোজার ঈদ অইল গিয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উৎসব। এই উৎসবের লাইগ্যা পাঁচদিনের ছুটি দিলে মানুষ ইকটু শান্তিতে গেরামের বাড়িতে গিয়া ঈদ করতঅ পারব।
- হুনছি অইন্য অনেক দেশে নাকি বড় উৎসবে বেশি দিনের ছুটি থাহে।
- অইন্য অনেক দেশে থাকলেই যে আমার দেশে থাকতে অইব, এমুন কোন কথা না। পাঁচদিনের ছুটি অইলে আমরার লাগি সুবিধা অয়, হেইডা অইল গিয়া বড় কতা।
যাত্রীদের একেকজনের একেক কথায় কান ঝালাপালা হয়ে উঠল ময়নার। গরম, বোটকা গন্ধ, বমির উদ্রেক সব মিলিয়ে চরম এক অস্থির সময় কাটছে ওর। আর এ অস্থিরতা নিয়েই সিটে বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছে ময়না। এগিয়ে চলছে বাস। বাড়ছে মানুষের কোলাহল
29.08.10

রবিবার, আগস্ট ১৫, ২০১০

উইল্লা চোরার উপলব্ধি

- তোতা মিয়া এক কেজি ছোলা দ্যাও।
বলে ধীরে-সুস্তে বেঞ্চিটায় বসল উইল্লা চোরা। শুনতে অশোভন এ শব্দটি ছাড়া তার সত্যি কোন নাম আছে কি না এ তথ্য ময়নার জানা নেই। এ নামেই সবাই তাকে চেনে। ‘উইল্লা চোরা’ অবশ্য তার নাম নয় বরং পরিচয়। ‘নামে নয় গুণেই পরিচয়’ আরকি। উইল্লা বিলাইয়ের (হুলো বিড়ালের) মত ছেঁচড়া চুরির অভ্যাস নাকি তার ছোটকাল থেকেই। অমুকের গাছের লাউটা, গাছ পাকা কাঁঠালটা, সব্জি ক্ষেত থেকে মুলাটা প্রায়ই উধাও হয়ে যেতো আগে। আর এসবের দায়ভার উইল্লা চোরার উপরই বর্তাতো। তার আতঙ্কে নাকি ঘর খালি রেখে গ্রামের মহিলারা পাড়া বেড়াতে পর্যন্ত পারত না। পাছে কোন জিনিসটা চুরি হয়ে যায়!
সেই হিসাবে এখন বেশ শান্তিতেই আছে গ্রামের মানুষ। কারণ আগের সেই ছ্যাঁচরা চুরির অভ্যাসটা ছেড়ে দিয়েছে উইল্লা চোরা। তাই বলে যে চুরি-চামারি থেকে অবসর নিয়েছে এমনটি নয়। এখনও দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে তার নামে দরবার আসে মাসে তিন কি চারবার।
- তুমি ছোলা দিয়া কি করবা? জিজ্ঞেস করল তোতা মিয়া
- কি করাম মানে, রোজা রমজানের দিন ছোলা ছাড়া ইফতার অয় নাকি?
- আসার্য্য কারবার! তুমি অইলা গিয়া চুর (চোর) মানুষ, তুমি হিবার রোজা রাখছ নাকি?
একটু যেন লজ্জ্বাই পেল উইল্লা চোরা। তারপর ঘাঢ় নুইয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল, আরে বেশতি কতা কইঅ না। আমি চোর অইতাম ফারি, কিন্তুক স্বভাব বালা আছে।
- তাইলে তুমি হাছাহাছি রোজা রাকছ! যেন আকাশ থেকে পড়ে প্রশ্নটি করল তোতা মিয়া।
- রোজা লইয়া কেউ মিছামিছি কতা কয় নাকি? চিন্তা করছি এইবার থেইকা রোজা থাহুনের অভ্যাস করাম।
- বেশ বালা চিন্তা। কিন্তুক রোজা থাইক্কা চুরি-চামারি করলে কি আর রোজা অইব?
- চিন্তা করছি এইসব ছাইরা দিয়াম। এই মাসটা দেহি ইকটু পাক-পবিত্র অইয়া আল্লা-বিল্লা কইরা কাডায়া দিতারি কিনা।
- তাইলে এইমাসে তোমার কুকাম বন্দ থাকব?
- হ
- খালি এই মাসে থাকবঅ নাকি সারা বছর? ঈদের পরেই হিবার পাপ কামানি শুরু করবা!
- আরে নাহ, কইলামনা বালা অইয়া গেছি।
- বালা অইয়া গেলে বালা কতা। হুনঅ একটা কতা কই, রমজান মাস অইল গিয়া সংযমের মাস। এই মাসে সংযমের অভ্যাস করনের লাই¹া আল্লায় কইছে। কারণ এই অভ্যাসের গতি যাতে সারা বছর থাহে। তুমি যুদি একমাস চুরি-চামারি ছাইরা বাঁচতে পার, তে সারা বছর পারতানা কেরে?
বাবার কথাটি বেশ ভালো লাগলো ময়নার। সাত্যিইতো একমাস ভাল হয়ে থাকতে পারলে সারাবছরইতো ভালো হয়ে থাকা যায়। দাদির কাছে সে শুনেছে রমজান মাস হলো অনুশীলনের মাস। রাতে সেহরি খাওয়া, ফজরের নামাজ পড়া, সকালে ঘুম থেকে উঠা, কাজে যাওয়া, ইফতার করা, তারাবির নামাজ পড়ার মধ্য দিয়ে মুসলমানদের সময় কাটে অনুশীলনের মধ্য দিয়ে। রমজান মাসে শয়তানকে নিয়ন্ত্রন করে রাখা হয় বলে মানুষের মাঝে খারাপ কাজ করার প্রবণতা কমে যায়। উইল্লা চোরাই এর জ্বলন্ত উদাহরণ।
ততক্ষনে এক কেজি ছোলার প্যাকেট তোতা মিয়ার কাছ থেকে বুঝে নিলো উইল্লা চোরা। তারপর হাত বাড়িয়ে দশ টাকার চারটি কড়কড়ে নোট এগিয়ে দিলো।
- আরও পাঁচ টেহা দেওঅন লাগবঅ। দাম অহন বাড়তি, তোতা মিয়ার এ কথাতে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো উইল্লা চোরা।
- আরে কি কও, ছোলার দাম অত বাইড়া গেছেগা!
- খালি ছোলার দাম কেরে, রোজা উপলক্ষে অনেক কিছুর দামঅই অহন বাড়তি।
- রোযা অইলঅ গিয়া সংযমের মাস। আর বাংলাদেশের ব্যবসায়িরা এই মাসে সংযম করবতো দুরের কতা, লুটপাটের উৎসব লাগাইয়া দেয়। রোজার মাইদ্যে আমি উইল্লা চোরা গেলাম বালা অইয়া, আর ব্যবসায়ীরা শুরু করল ডেহাইতি (ডাকাতি)। হায় আফসোস!

বুধবার, আগস্ট ১১, ২০১০

বিউটি বোর্ডিংয়ে এক দুপুর

আমি ও সোহেল অটল

মঙ্গলবার, আগস্ট ১০, ২০১০

বাতাস লাগছে বাতাস

মা সন্তানকে খুন করতে সহযোগিতা করে- কথাটা একদম বিশ্বাস করতে পারল না ময়না।
- আহা, কী ফুটফুটে চেহারা রে। বলতে বলতে পত্রিকাটা তোতা মিয়ার দিকে এগিয়ে দিল মন্তাজ উদ্দিন। ময়নারও কৌতুহল হলো তিন বছরের তানহাকে দেখতে। উঁকি দিলো পত্রিকার পাতায়। ইস, ডাগর চোখের কী মায়াবি চাহনি! ফোঁকলা দাঁত। কপালে কাজলের টিপ। মেয়েটাকে আদর করে এ টিপ কে পড়িয়ে দিয়েছিলো? ‘আয় আয় চাঁদ মামা/টিপ দিয়ে যা/চাঁদের কপালে চাঁদ/টিপ দিয়ে যা...’ ছড়া কাটতে কাটতে মায়েরাইতো এ কাজটি করে থাকে। তানহার ক্ষেত্রেও নিশ্চয়-ই এর ব্যতিক্রম হয়নি। হয়তো ছড়ার ছন্দে ছন্দে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ওকে কাজল কালো করেছিলো মা-ই। তারপর চুমুতে চুমুতে কপাল ভরিয়ে ভনিতা করে বলেছিলো, এইতো আমার চাঁদের (তানহার) কপালে চাঁদ এসে টিপ দিয়ে গেলো। হ্যা, তখন তো মায়ের কাছে চাঁদের মতোই ছিলো তানহা। অমাবশ্যার অন্ধকার দূর করে মায়ের কোল জুড়ে সে এসেছিলো পূর্ণিমার চাঁদ হয়েই। দ্যুতি ছড়িয়েছিলো মায়ের মনে। সত্যিই কি তাই? এমনটিই তো হওয়ার কথা। ময়নার দেখা সব মায়েরাইতো এমন । মায়ের উষ্ণতাই সন্তানের প্রথম আশ্রয়। মাকে ছাড়া একটি দিনও কল্পনা করতে পারে না ময়না। কিন্তু কী এমন ঘটনা ঘটল যে, তিন বছরের ছোট্ট শিশুর মৃত্যু হলো নিজের মায়ের কারণে! অপরাধটা ছিলো কার, শিশুর নাকি ওর মায়ের? অপরাধ যার-ই হোক। কী কারণে একজন মা নিজের কোল থেকে পূর্ণিমার চাঁদ দূরে ঠেলে দিতে চাইবে? কোন অমোঘ টানে? তাহলে কি এখন মায়েরাও বদলে যাচ্ছে। সন্তানরা কি এখন মায়ের কোলেও নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারবে না!
- ও পুতু (চাচা) পুতুগো, তানহা কি মা’রে (মাকে) ত্যক্ত (বিরক্ত) করতঅ?
- নাহ্। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এক কথায় জবাব দিলো মন্তাজ উদ্দিন। কিন্তু মন্তাজ চাচার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপারটা মোটেই আঁচ করতে পারলো না ময়না।
- তে (তাহলে) ছেরিডা কী দুষ করছিন (করেছিলো) যে একবারে মাইরালান লাগব (মেরে ফেলতে হবে)!
- এই ছেরি চুপ র্ক। মুরুব্বিরার কতার মইদ্যে কতা কওঅন (বলা) বালানা। ধমকে উঠল তোতা মিয়া।
বাবার ধমকে একেবারে চুপসে গেলো সে। আর কথা বলার সাহস হলোনা। তারপরও ক্ষীণ একটি আশা ধরে রেখেছিলো যে, অন্তত: ভদ্রতার জন্য হলেও মন্তাজ চাচা বুঝি তার কৌতুহল নিবৃত্ত করবে। কিন্তু ওদিক থেকেও কোন সাড়া না পেয়ে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো ময়নার। চুপচাপ বসে রইল বাবার পাশে। মনযোগ দিলো অন্য কাজে। ভাব দেখালো যেনো এদিকের কোনো কথাতেই তার কান নেই।
- কী কইবা তোতা মিয়া, খালি পরকিয়া আর খুন না, আমরার দেশটা অহন নানা অপরাধে ভইরা যাইতাছে। ‘সামাজিক মূল্যবোধ’ কইতে (বলতে) একটা কতা আছে। হেই মূল্যবোধ কইম্মা যাইতাছে। কইম্যা যাইতাছে মানুষের নীতি-নৈতিকতা।
- হ, বাইছা (ভাই সাহেব)। তুমি উচিত কতা কইছঅ। আমরার সমাজ কিমুন জানি বদলাইয়া যাইতাছে। সবচে আপন বন্ধনগুলাও অহন ভাইঙ্গা চুরমার অইয়া যাইতাছে।
- বাতাস লাগছে বাতাস। একটা কতা কই হুনঅ, তুমি যুদি কোনো জাতিরে ধ্বংস করতা চাও, পইলা (প্রথমে) হেই জাতির সংস্কৃতি আর মূল্যবোধগুলা ধ্বংস কর। হেরপরে দেখবা আপনা-আপনি হেই জাতি এক অমোঘ নেশায় বুঁদ অইয়া যাইব। মেরুদণ্ড খাড়া কইরা দুইডা কতাও কইতে পারবনা।
- আমরারেও এমুন নেশার বাতাসে পাইছে নাকি?
- লক্ষণ খারাপ। জিরজিরায়া (ঝির ঝির করে) আজইরা (অশুভ) বাতাস ঘিইরা ধরতাছে আমরারে। আমরা ঠ্যাঙ্গের উপরে ঠ্যাঙ্গ তুইল্লা ঝিমাইতাছি। আমরার সরকারের তঅ এইদিকে কোন মনযোগঅই নাই। হেরা অহন ব্যস্ত নানান আজাইরা কামে। আর হেই সুযোগে খুন, রাহাজানি, ডাকাইতি, পরকিয়ায় ভইরা যাইতাছে দেশ। আর মানুষের কাছেও এউগুলা গা সওয়া অইয়া গেছে।
- হঅ, আজাইরা কামে মানুষের টেহা (টাকা) খরচ করতাছে। আমরার চিন্তাভাবনা থেইকা নীতি-টিতি একবারে উইট্টা গেছেগা দেহি!
-নীতিটিতির কতা আর কী কও তুমি! হেদিন পত্রিকার মইদ্যে দেকলাম গত এক মাসে সারা দেশে খুনঅই অইছে ২৮০ জন! অইন্য কতা নাঅয় বাদ অই দিলাম।
- পাবলিক এক্কেবারে ত্যক্ত বিরক্ত অইয়া গেছেগা। হুনলাম আওমী লীগের (আওয়ামী লীগের) এক নেতাও নাকি ত্যক্ত-বিরক্ত অইয়া কইছে যে দেশ বিপদের দিকে আউ¹াইতাছে?
- হ, তুমি ঠিকঅই হুনছঅ। কতা তঅ হাছা। পুরা তাইজ্জব কাণ্ডকারখানা শুরু অইয়া গেছে। প্রধান বিচারপতির মুখ দিয়া পর্যন্ত বাইরঅইছে যে, দেশঅ অহন ন্যায্য কতাডা পর্যন্ত কওনের স্বাধীনতা নাই।
এতক্ষণে ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠলো ময়না। ভেবেছিলো কান খাড়া রাখলে হয়তো তানহা হত্যার রহস্য কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারবে সে। কিন্তু বাবা আর মন্তাজ চাচার কথাগুলো এমন দিকে মোড় নিয়েছে, যা ওর বোঝার কথা নয়। কিন্তু তবুও যে বোঝার চেষ্টা করে নি এমনটি নয়। আর চেষ্টা করলে কিছুনা কিছু তো সফল হওয়াই যায়।

রবিবার, আগস্ট ০১, ২০১০

জামাই আইছে আনন্দে

আজ ময়নার মেয়ের বিয়ে। আয়োজন নিয়ে মহা ব্যস্ত সে। এক মুহূর্ত অবসর নেই। মেয়েটাকে কিনে এনেছিল বৈশাখী মেলা থেকে। সেই থেকে ওর সংসারেরই সদস্য সে। নিজের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছে গয়না। তারপর চিকচিকে জরির একটি গয়না পরিয়েও দিয়েছিল গলায়। কিন্তু সেটা যে কবে উধাও হয়ে গেল, তা বলতেই পারছে না ময়না। এমনকি মেয়েটাও মুখ ফুটে বলছে না যে কেউ গলা থেকে খুলে নিয়েছে, নাকি খেয়ালের বশে নিজেই হারিয়ে ফেলেছে। না না, গয়না কথা বলতে পারে না এমনটি নয়। প্রতিদিনই ময়নার সাথে কত্ত কথা হয়। অবশ্য শব্দ করে কিছুই বলতে পারে না সে। শত হলেও পুতুল তো! তাই ওর মনের ভাষা বুঝে নিতে হয় ময়নাকেই। এর জন্য কোনো দুঃখ নেই ময়নার। কারণ সে জানে পুতুলরা কখনো কথা বলতে পারে না। তবে মায়ের কাছে তাদের থাকে হাজারো আবদার। এই যেমন খাইয়ে দাও, পরিয়ে দাও, আদর করো, ঘুম পাড়িয়ে দাও। এসবের কোনো কাজই বাকি রাখে না ময়না। একেবারে খাওয়া থেকে শুরু করে ঘুম পাড়ানো পর্যন্ত সবকিছু সে-ই দেখাশোনা করে।
এমন আদুরে মেয়েকে বিয়ে দিতে কিছু তো খারাপ লাগছেই ময়নার। খারাপ লাগলেই আর কী? মেয়ে যেহেতু আছে আজ নয় কাল বিয়ে তো দিতেই হবে। তবে এত বিচ্ছেদ-বিরহের মাঝেও বেশ আনন্দই হচ্ছে ওর। কারণ পাত্র হিসেবে পারভিনের ছেলেটা একেবারে রাজপুত্র। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো পারভিনের সাথে একটা সম্বন্ধ তৈরি হোক, এমনটাই চাইছিল সে। হঠাৎ সে দিন বলা নেই, কওয়া নেই পারভিনই প্রস্তাব করে বসল ময়নার সাথে সই পাতবে। আর যায় কোথায়, দু’জনে মিলে ঠিক করল দিনক্ষণ। আরো ঠিক করল এই দিনেই হবে ওদের পুতুল বিয়ে। এতে নিজেদের মাঝে সম্পর্কটা আরো গাঢ় হবে। ব্যস, যেই কথা সেই কাজ।
আজ সেই কাক্সিত দিন। মহা ধুমধামে চলছে আয়োজন। ময়নার সখীরা সবাই উপস্থিত। উপস্থিত এক দঙ্গল ছেলেমেয়েও। বাঁশের কঞ্চি আর পাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্যান্ডেল। একে ঘিরেই সবার ব্যস্ততা। এই বাটনা বাটরে, কুটনা কুটরে...। একটু বড়সড় টোপায় (খেলনা পাতিলে) ভাত চড়িয়েছে ময়না। টোপার ভেতরে যে ভাতের বদলে বালি ভর্তি, এ খবর কারো অজানা নয়। কিন্তু তবুও সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে কখন রান্না শেষ হবে, তারপর বর আসবে। আর ক্বল-অ, ক্বল-অ ধরনের অদ্ভুত শব্দ করে খাওয়ার ভান করবে সবাই। সেই সাথে হবে ময়না-পারভিনের সই পাতাপাতি। দু’জনের মাঝে তৈরি হবে নতুন একটি সম্পর্ক। প্রতিজ্ঞা করবে পরস্পরের সুখ-দু:খ, হাসি-কান্নার অংশীদার হওয়ার। বন্ধুত্ব গড়ার সেই আনুষ্ঠানিক মুহূর্তটিকে ত্বরান্বিত করতেই এত ব্যস্ততা। আশপাশের ঝোপে বাজার করছে কয়েকজন। এরই মাঝে কাল্পনিক নানা কেনাকাটা করে ফিরেও এসেছে দুলাল। ওর ঝুলি ভর্তি ইটের সুড়কির মাংস, পাতার মাছ আর নানা ধরনের তরকারি। মেলা থেকে কিনে আনা টিনের বঁটি দিয়ে তরকারি কাটায় ব্যস্ত হয়ে গেল একজন। তারপর চুলায় ফুঁ দাওরে, আগুন জ্বালরে...। অবশেষে রান্নাবান্না শেষ হলো ময়নাদের। এরই মাঝে খবর এলো বরযাত্রা শুরু গেছে। এক অনাবিল আনন্দে ভরে উঠল সবার চোখ। এবার ওরা ব্যস্ত হয়ে উঠল গয়নাকে নিয়ে। ইস্ লাল টুকটুকে শাড়ি পরে আছে ও। একদম চুপ মেরে বসে আছে। ময়নাও দৃষ্টি ঘুরালো ওর দিকে। ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল।
এলোমেলো বাদ্যের শব্দে কানে তালা লাগার মতো অবস্থা। বরযাত্রীদের মাঝে বেশ কয়েকটি ছেলের গলায় ঝুলানো রয়েছে ঢোল। কোরবানির গরুর পর্দা ভাঙা কলসের মুখে সেঁটে প্রতি বছরই ওরা এগুলো তৈরি করে। তারপর যখন ইচ্ছা তখন বাজায়। আজ কচুর ডাঁটা দিয়ে এমনভাবে বাজাচ্ছে যেন ঢোল এবং কানের পর্দা ফাটিয়েই ছাড়বে। কাছাকাছি চলে আসতেই পারভিনের ছেলেটাকে দেখতে পেল ময়না। ইস্ কি সাজে সেজেছে ও! রাজপুত্র যে একেবারে রাজপুত্রের মতোই। মাথায় টোপর, গলায় পুঁথির মালা। আসছে ঘোড়ায় চড়ে। আর ঘোড়াটা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে বিয়ারিংয়ের গাড়িতে। সবাই বিপুল উৎসাহে টেনে নিয়ে আসছে গাড়িটাকে। কনে পক্ষের তৈরি পাট শোলার তোরণের সামনে এসে থামতেই হলো ওদের। তারপর দরকষাকষি। অবশেষে কাঁঠালপাতার টাকা বিনিময়ের মাধ্যমে সমঝোতা।
তোরণ উন্মুক্ত করে দাঁড়ালো ময়নারা। রাজপুত্রের মতো বর প্রবেশ করল পাতার ছাউনিতে। কোরাস তুলল এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে ‘চম্পা ফুলের গন্ধে/জামাই আইছে আনন্দে/চম্পা ফুলের সুবাসে/জামাই আইছে আহাসে...’