সোমবার, মে ১৭, ২০১০

আগুন বেয়ে পড়ছে

‘.... ডুক্কু ডুক্কু লাই/পাতা কাটা যাই/পাতার ঝুম ঝুম/বেহালা বাজাই/বেহালার তরে/মৌমাছি ঘুরে/মৌমাছি ঘুরে...হ’
এই দম ছাইড়া দিছে, দম ছাইড়া দিছে, ময়না বুবু দম ছাইড়া দিছে। বলতে বলতে ময়নার গা ছুঁয়ে দিলো একজন। অর্থাৎ ময়না তখন মরা (খেলায় নিষ্ক্রিয়)।
ভ্যাপসা গরমে আমগাছের ছায়ায় বৌচি খেলছে এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে। মাথার ওপর ছায়া আছে বটে, বাতাসের নামগন্ধ নেই। ভাটার মতো জ্বলছে সূর্য। চোখ তুলে তাকানো যায় না। এদকি-ওদিকের স্পষ্ট রশ্মিগুলোতে উড়ন্ত ধুলোর চিক চিক। খড়ের নতুন পুঞ্জি আর রোদে শুকাতে দেয়া ন্যাড়ার ভাপ আরো চিটচিটে করে তুলছে শরীর। সেই চিটচিটে শরীর নিয়েই লুটোপুটি খাচ্ছে ওরা। দৌড়ে বেড়াচ্ছে পুরো মাঠ।
খেলায় মরে যাওয়ার পর অনেকটা হতাশ হয়েই আমগাছের শেকড়ে এসে বসেছে ময়না। পর্যবেক্ষণ করছে অন্যদের খেলা। সেই সাথে কামনা করছে নিজের দলের বিজয়। ভ্যাপসা গরমে ঘাম তো নয়, যেন আগুন বেয়ে পড়ছে শরীর থেকে।
গাছের শেকড়গুলো প ুরুষ্ট, আর বসার জন্যও বেশ। মনো হলো যেন রাজার সিংহাসনে বসে আছে সে। এখন একটু ফুরফুরে বাতাস এলেই ষোলকলা পূর্ণ হয়। ওপরের দিকে তাকায় ময়না। নাহ, গাছের একটি পাতারও নড়াচড়া নেই। ডাঁসা ডাঁসা আমগুরো জুলে আছে নির্জীব। কয়েকটি পেকে হলদেটে রযও ধরেছ্ েইস, একট া আম যদি খাওয়া যেত। একবার ইচ্ছে হলো ঢিল ছুঁড়ে...। পরক্ষণেই মনে হলো মন্তাজ চাচার কথা। বাতাসে ঝরা আম কুড়িয়ে নিতে কখনো বাধা নেই চাচার। কিন্তু গাছে ঢিল পড়েছে তো সেরেছে।
- ময়না বুবু, লও গাঙের পানিতে যাই।
হঠাৎ লক্ষ করল ছেলেমেয়ের দঙ্গল তাকে ঘিরে দঁইড়য়ে আছে। আমের তেষ্টায় বিভোর হয়ে ওঠায় কখন যে খেলার গোল্লা উঠে গেল, খেয়ালই করল না সে।
- গাঙে জুয়াইরা (নতুন) পানি আইছে, অহন ডুবাইলে (দাপাদাপি করলে) জ্বর আইব।
ময়নার কথাতে মোটেই নিরুৎসাহিত হলো না ছেলেমেয়েরা।
- শইল জুড়াইয়া পানিতে নামলে কিচ্ছু অইত না।
- আইচ্ছা অহন বইয়া থাক, আগে জিরাইয়া লই, পরে গাঙে যায়াম (যাবো)।
ময়নার এক কথাতেই শেকড় ঘিরে বসে পড়ল প ুরো দঙ্গল। শরীরের ঘাম ঝেড়ে ফেলতে ফে লতে ভাঙা কণ্ঠে গান ধরল একজন- ‘আল্লা মেঘ দে/পানি দে/ছায়া দে রে তুই/আল্লা মেঘ দে।’ এতট ুকু বলতেই ধমকে উঠল ময়না।
- অইছে হুনছি। গাছের ছেমাত (ছায়ায়) বইয়া থাইক্কা আল্লার কাছে ছেমা চাস। আর গাঙের প ানি আইয়া ক্ষেতের (জমির) ফসল সব তলাইয়া দিলো, তার পরেও পানি চাস।
লজ্জায় গানের গলা ক্ষীণ হয়ে এলো ছেলেটার। তারপ র একেবারে থেমে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপই কাটল ওদের। এক সময় ময়না আবিষ্কার করল সবার দৃষ্টিই গাছে ঝুলে থাকা আমের প্রতি।
- আম খাইবি? খাইতে চাইলে আল্লার কাছে রোদন কর তুফানের (ঝড়ের) লাইগ্যা। বৈশাখ মাস চইল্যা গেল, অহন-অ বৈশাইজ্ঞা তুফান (বৈশাখী ঝড়) আইল না।
তারপর ময়না নিজেই সুর তুলল- ‘আল্লা তুফান দে/তুফান দে...রে.../আল্লা তুফান দে.... স থে সাথে একই কথার কোরাস ধরল সবাই।
হইচই শুনে মন্তাজ চাচা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ধীরে ধীরে এসে বসল ্ ামগাছের শেকড়টায়। ঠিক ময়নার পাশেই।
- দোয়া কর, বালা কইরা দোয়া কর। তরার (তোদের) দোয়া কবুল অইব।
তার কথা শুনে আরো উৎসাহিত হলো ছেলেমেয়ারা। গাইতে গাইতে মন্তাজ চাচাকেও ইঙ্গিত করল ধুয়া তুলতে।
- বুইড়া মাইনষের দোয়া কি আল্লায় হুনব? আমার পাপের কারণে বৈশাখ মাসের তুফান আর বৈশাখে অয় না, ধান দাওয়ার (কাটার) আগে ধানি জমি পানিতে তলায়। আমরা পৃথিবীর হিসাব-কিতাব বদলাইয়া দিছি। আমরা বাড়াইয়া দিছি পৃথিবীর তাপ। মাথার ওপর অহন গনগনে তাপে সূর্য জ্বলে। পর্বতের বরফ গইলা ডুইবা যাইতাছে পৃথিবী।
শিহরিত হয়ে উঠল ময়না। থেমে গেল কোরাস। পৃথিবী আবার ডুবে যায় কিভাবে!
- তুমি এই সব কী কইতাছ পুতু? মানুষরা কি পৃথিবীর তাপ বাড়াইতে পারে?
- পারে, পারে। প্রকৃতির নিজের একটা নিয়ম আছে। আমরা প্রকৃতিরে দূষিত কইরা তুলতাছি। এর াকরণে নিয়মের লগে তাল রাখতে পারতাছে না প্রকৃতি। দেখস না বৈশাখে অহন ঝড় অয় না, কিন্তু যহন অয় তহন সিডর অইয়া লন্ডভন্ড করে মানুষের প্রাণ। কামের সময় গাঙে পানি থাহে না, কিন্তু যহন থাহে বন্যায় ভাসাইয়া নেয় ভিটা। এইগুলো অইল প্রকৃতির প্রতিশোধ। অহন তুফানের লাইগ্যা আরো বেশি কইরা রোদন কর আল্লার কাছে। তুফান আইলে তরাও আম খাইতে পারব্ িআর পৃথিবী কিছুটা অইলেও আপন গতি ফিইরা পাইব।
এতটুকু বলে থেমে গেল মন্তাজ চাচা। হঠাৎই ছন্দপতন হওয়ায় একট ু নড়েচড়ে বসল সবাই। তারপর আবার সুর তুলল ময়না- ‘আল্লা তুফান দে/তুফান দে...রে.../আল্লা তুফান দে....’ সাথে ধুয়া তুলল মন্তাজ চাচাসহ এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে।

কোন মন্তব্য নেই: