রবিবার, এপ্রিল ১৮, ২০১০

সুতায় টান লাগাইবা


‘‘পারে লয়ে যাও আমায়।
আমি অপার হয়ে বসে আছি
ওহে দয়াময়’’...
বিস্তীর্ণ হাওরের বাতাসে ভেসে দূর থেকে দূরে ছড়িয়ে যাচ্ছে বয়াতির সুরের লহরী। ঢোল, তবলা, বাঁশি, হারমোনিয়াম আর করতালের তালে নেচে উঠছে মেলা প্রাঙ্গণ। আজ শেষ দিন বলে ভিড় একটু বেশি-ই। পিঁপড়ের মতো সারি বেঁধে মানুষ আসছে আর যাচ্ছে। তোতা মিয়াও এসেছে মেয়ে ময়নাকে সাথে নিয়ে।
আজ ময়নার আনন্দের শেষ নেই। সেই সাথে শেষ নেই আবদারেরও। এটা কিনো, ওটা কিনো। বৈশাখের প্রচণ্ড তাপের মধ্যেও সারা দিন ঘুরে ঘুরে পছন্দের জিনিস কিনে বোঝাই করেছে ময়না। দুটো গ্যাস বেলুন কিনতে পেরে খুশি আর ধরে না। বেলুন দুটো সারাক্ষণ আকাশের দিকে উঁকি দিয়েই আছে। ময়নার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে উড়ে যেতে চায় যেন মেঘের রাজ্যে। পুতুল, মাথার রঙিন ফিতা, লাটিম, হাত ভরে পরার জন্য রিনরিনে চুড়ি এসব কিছুই কেনার বাকি নেই ময়নার। গরম জিলেপি, উরহা, তিলুয়া, খেলনা আরো কত কী! আর নাগরদোলায় চড়তে কখনো ভুল করে না সে। অ™ভুত এক ভালো লাগার অনুভূতি রয়েছে এখানে। একবার মনে হয় আকাশে উঠে যাচ্ছে, আবার ফুড়ুৎ করে নেমে যাচ্ছে পাতালে। এভাবে আকাশ-পাতাল বিচরণ করতে বেশ ভালোই লাগে তার। সব মিলিয়ে নির্মল আনন্দের মাঝেই কাটছে ময়নার সময়।
চোখেমুখে উচ্ছ্বাস নিয়ে সে দেখে আকাশে অসংখ্য ঘুড়ির উড়াউড়ি। মেলার এক কোণে চলছে ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতা। রঙ-বেরঙের ঘুড়িগুলো গোত্তা খেয়ে খেয়ে যেন ময়নাকেই কাছে ডাকছে।
-বাপজান আমি গুড্ডির (ঘুড়ির) লগে উড়াল দিয়াম।
-তোর তো পাখির লাহান পাখনা নাইরে মায়া (মা), কেমনে উড়াল দিবি?
-পাখনা লাগবে না বাপজান। আমি গুড্ডির লাহান পাতলা।
হাসল তোতা মিয়া। সত্যিই তো, মেয়েটার মন ঘুড়ির মতোই হালকা।
- উড়তে উড়তে যদি হারায়া যাস্...?
-তুমি আমার লাটাই ধইরা রাখবা। উড়তে উড়তে যদি বাউলা বাতাসে পায়, সুতায় টান লাগাইবা।
মেয়ের এমন ওজনদারী কথায় মোটেই অবাক হলো না তোতা মিয়া। কারণ ময়নার মুখ থেকে এ ধরনের কথা শুনে সে অভ্যস্ত। মেয়েটা তার বড়ই বুদ্ধিমতি। লক্ষ্মীও বটে।
-ঠিকাছে মায়া, তোর খুশিমতো তুই আসমানে উড়বি। ঘুরবি। খেলবি। এবার চল পুতুলনাচ দেখতে যাব।
বলে পা বাড়ালো সামনের দিকে। কিন্তু পরক্ষণেই থমকে যেতে হলো তাদের। হই হই করে ওদের দিকে ভেসে আসছে জনস্রোত। মুহূর্তের মাঝে গুঁড়িয়ে যেতে দেখল পুতুল নাচের পাশের প্যান্ডেলটা। ঘের দেয়া এ প্যান্ডেলের ভেতর-ই চলে টাকার খেলা। তোতা মিয়ার বুঝতে আর বাকি রইলো না, টাকার উত্তাপে তাতিয়ে ওঠা জুয়াড়িদের হট্টগোল এটি।
ধীরে ধীরে হাঙ্গামা ছড়িয়ে যেতে লাগল মেলাজুড়ে। থেমে গেল বয়াতির গলা। সেই সাথে থেমে গেল পুরো মেলার নাচন। মানুষের উদভ্রান্ত ছুটাছুটি আর হইচই কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছে তাদের। তোতা মিয়া ভালো করেই বুঝতে পারল এখানে আর এক মুহূর্তের জন্যও থাকা নিরাপদ নয়। ময়নার হাতটা শক্তভাবে ধরে সরে যেতে লাগল ভিড় থেকে।
তারপর হাঁটতে শুরু করল ফসলের ক্ষেতের বুক চিরে ধুলোওড়া মেঠোপথ ধরে। পেছনে মেলার হট্টগোল। আর সামনে খোলা আকাশ। রোদ পড়ে গেছে। বেড়েছে মেঘের আনাগোনা। সারা দিনের উজ্জ্বলতার পর এখন যেন কান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে আকাশটা। কান্না পাচ্ছে ময়নারও। পুতুল নাচটা দেখে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল ভীষণ। কিন্তু কেন যে হঠাৎ পণ্ড হয়ে গেল সব, তার কিছুই বুঝতে পারল না ময়না। ভাবল, হট্টগোলকারীরা যখন তখন চাইলেই হয়তো সব পণ্ড করে দিতে পারে। এদের সুতায় টান লাগানোর মতো কেউ নেই।

কোন মন্তব্য নেই: