বুধবার, অক্টোবর ২৪, ২০১২

ঈদ বাহাস-২


মঙ্গলবার, অক্টোবর ২৩, ২০১২

ষাঁড়ের চোখে লাল পট্টি


শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
গরুর মতো কাণ্ড করে বসল ষাঁড়টা। শাহজাহান আলীর হাত ফসকে সোজা দৌড়ে গেল তোতা মিয়ার দোকানের দিকে। রে রে করে উঠল সবাই। বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছিল মন্তাজ উদ্দিন। তড়িঘড়ি সরতে গিয়ে গায়ে পড়ল চায়ের কাপ। পায়ে পায়ে প্যাঁচ খেয়ে হুমড়ি খেলো সবুজ। রুখে দাঁড়ানোর জন্য নেংটি আঁটল উইল্লা চোরা। আর দোকানের ভেতরে উঠে দাঁড়াল তোতা মিয়া। পাশেই আতঙ্কিত ময়না। ওর গায়ে লাল জামা। এই লাল জামা লক্ষ করেই ছুটছে পাগলা ষাঁড়। পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে শাহজাহান আলী ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। চিৎকার করে মেয়েকে পালাতে বলল তোতা মিয়া। ময়নাও হন্তদন্ত হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে হারিয়ে গেল ভেতর বাড়িতে।
তবুও ষাঁড়টাকে থামাতে পারল না উইল্লা চোরা। ময়নাকে চলে যেতে দেখে মাথার গুঁতোতে গুঁড়িয়ে দিলো দোকানের সামনের দিকটা। অন্ধ রাগে তছনছ করল সব। ছিটকে গেল চানাচুরের বয়াম। বাতাসে উড়ল চকোলেট ও চুইংগাম। চৌকিজুড়ে গড়াগড়ি খেলো কেরোসিনের টিন। এবার ঘুরে দাঁড়াল ষাঁড়টা। কেরোসিনের উৎকট গন্ধ সহ্য হয়নি তার। হাম্বা... করে লম্বা ডাক ছাড়ল। তারপর লাফ দিলো উল্টো দিকে।
কিন্তু ততক্ষণে টান পড়ে গেল গলার দড়িতে। উইল্লা চোরা, শাহজাহান আলী ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা কব্জা করে ফেলেছে ওটাকে। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করতে হলো আরো। তারপর সব শান্ত। ষাঁড়টা বাঁধা পড়ল আম গাছে। আবার সবাই জড়ো হতে লাগল দোকানের সামনে। ময়নাও লাল জামা বদলে উঁকি দিলো ভেতর বাড়ি থেকে। তারপর তাকিয়ে দেখল ওটাকে। শাহজাহান আলীর কোরবানির গরুটা যেমন নাদুসনুদুস, তেমন তেজী। আর একটু হলে তো তাকে শিঙের আগায় ঝুলিয়েই ফেলত। উইল্লা চোরা না থাকলে একে সামলানো যেত কি না সন্দেহ। চুরির অভ্যাসটা পুরোপুরি ছাড়তে না পারলেও উইল্লা চোরার এই গুণগুলো ভালো লাগে ময়নার। যে কারো বিপদে সাহসের সাথে দাঁড়িয়ে যায় সে। শুধু ময়নাই নয়, তাকে পছন্দ করে সবুজ ভাইও।
কিরে সবুজ, তোর কলেজ বন্ধ নাকি? ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে জিজ্ঞেস করল শাহজাহান আলী।
‘ঈদের সময় তো কলেজ বন্ধই থাহে।’ সোজা প্রশ্নের বাঁকা জবাব দিলো সবুজ। অবশ্য এতে কিছুই মনে করল না শাহজাহান আলী। একটা কিছু বলে কথা শুরু করা প্রয়োজন ছিল, তা হয়ে গেছে। এবার আসল আলোচনায় যাওয়া যায়Ñ গরুটা কিমুন কিনলামরে সবুজ?
দেখতাছি তো ভালাই।
‘আরে ভালা তো অইতেই অইবো। দেখতে অইবো না কেডা কিনছে!’ এতটুকু বলে ষাঁড়ের পেছন দিকে সজোরে চাপড় বসালো শাহজাহান আলী। সাথে সাথেই হাম্বা ডাক দিয়ে হিশু করতে শুরু করল ওটা। অমনি হাসি এসে গেল ময়নার। শব্দ করে হাসলও। পরক্ষণেই বাবার ধমক খেয়ে চুপ মেরে যেতে হলো। তবে মেয়েকে ধমক দিয়ে নিজের হাসির দমক আটকে রাখতে পারল না তোতা মিয়া। গোঁফের আড়ালে হালকা হাসির রেখা দেখা দিলো মন্তাজ উদ্দিনের ঠোঁটেও। কিন্তু শাহজাহান আলীকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখে প্রসঙ্গ পাল্টালো মন্তাজ উদ্দীনÑ গরুটা কয় শরিকে কিনছস?
আমতা আমতা শুরু করল শাহজাহান আলী। গলা টেনে বললÑ আ...ছে...। শরিক আছে।
ব্যাপারটা পছন্দ হলো না উইল্লা চোরারÑ কি রে, শরিকের কথা কইতে শরম লাগে নাকি?
‘না...আ..., শরম লাগতো কেরে! সাত শরিকে কিনছি।’ বলে চোখ মুখ ফ্যাকাসে করে দাঁড়িয়ে রইল শাহজাহান আলী। এর আগে তিনবার এসএসসি ফেল করেও সম্ভবত এমন চেহারা হয়নি তার।
এবার শাহজাহান আলীকে উদ্ধার করার উদ্যোগ নিলো সবুজÑ আইচ্ছা পুতু তোমারে একটা কথা জিগাই?
জিগা
তুমি কোরবানি দিতাছো কি কারণে?
মানুষ কী কারণে কোরবানি দেয়, এইডাও জানস না?
আমি তো জানি, কোরবানি অর্থ ‘ত্যাগ’। মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ত্যাগ করে। মানুষরে দেহানোর উদ্দেশ্যে নয়।
আমিও আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরবানি দিতাছি।
সুন্দর কথা। এক গরু একলা কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নাই বইলা সাত শরিকে দিতাছো। আল্লাহ তো তোমার সামর্থ্য জানেন। তাইলে শরমের কী আছে?
চুপ মেরে গেল শাহজাহান আলী। কথা বলল মন্তাজ উদ্দিনÑ আছে আছে, শরমের ব্যাপার আছে।
নিজে যা নয়, অইন্যের কাছে তা জাহির করার মইদ্যে বাহাদুরি আছে। ষাঁড়ের চোখে লাল পট্টি বাইন্ধা দিলে ষাঁড় পাগলা হয়। চোখের সামনে খালি লাল আর লাল দেখে। মিছামিছি লালের পিছে দৌড়ায়। আমাদের চোখেও লাল পট্টি বান্ধা। বাহাদুরির পট্টি। চোখের সামনে দেখি প্রভাব আর প্রতিপত্তি। আমরা ও ষাঁড়ের মতো বাহাদুরির পিছে দৌড়াই

মঙ্গলবার, আগস্ট ২৮, ২০১২

ঈদ বাহাস


শুক্রবার, মার্চ ১৬, ২০১২

ড্রাকুলা রহস্য


শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
দপ করে নিভে গেলো হারিকেনের আলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুশফিকের কাঁধ স্পর্শ করলো ঠাণ্ডা হাত। এ হাত ড্রাকুলার, মুশফিক নিশ্চিত, হাতটি ওর না হয়ে পারেই না। পোড়াবাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে ড্রাকুলাটি। মুশফিকের পেছনে এখন সাঙ্ঘাতিক বিপদ। কী করা যায়, কী করা যায়। দূর ছাই, কিছুইতো করার নেই। ভাবতে ভাবতেই কালো অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো পোড়া সলতের লাল আলোটাও। দরদর করে ঘাম ঝরছে মাথা থেকে। শিরায় শিরায় হুটোপুটি করছে গরম রক্ত। আকুলিবিকুলি করে ওঠলো মুশফিক। আর বুঝি রে নেই।
রে হবে কী করে, নিজেইতো ডেকে এনেছে নিজের বিপদ। বিদ্যুৎ চলে গেলো। ব্যস সুবোধ বালকের মতো ঘুমিয়ে যাবে। তা না, মাঝ রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে ভাবতে বসলো পোড়াবাড়ি রহস্য নিয়ে। যেন এর একটা কিনারা করেই ছাড়বে। এবার হলো তো! বড়রা সবসময়ই মানা করেন- কখনো পোড়াবাড়ির চৌহদ্দি মাড়াবে না, কাসের পড়া চুরি করে মাসুদ রানা-তিনগোয়েন্দা পড়বে না, রাত জেগে অশরীরির কথা ভাববে না। বেশি বেশি ভাবলেই নাকি ওরা এসে হাজির হয়। প্রথম প্রথম বিশ্বাস হতো না এসব কথা। কিন্তু সেদিন নিজের কানে শুনলো ওদের নিঃশ্বাসের শব্দ। নিজের চোখেই দেখলো ভয়ঙ্কর ড্রাকুলাটা। মনে হলো যেন মরা ব্রহ্মপুত্রের তলা ফোঁড়ে গরম রক্ত চোষে নিচ্ছিলো।
এই এই, কাঁপছিস কেনরে তুই? ভয় পেলি নাকি?
কে কে? কে আবার, এখানে ড্রাকুলা আর মুশফিক ছাড়া আরতো কেউ নেই। কিন্তু কথা বললো যে! ড্রাকুলারা মানুষের সাথে কথাও বলে নাকি! একদম মানুষের মতো গলা। কাঁপুনি থামলো না মুশফিকের।
আ..হা। তুই দেখি একেবারে ভীতুর ডিম। আমি মুমিতু।
মুমিতু? কোন মুমিতু? কে মুমিতু?
আমি মুমিতু রে মুমিতু। তোর খালাতো ভাই মুমিতু। এবার কাঁপাকাঁপি বন্ধ কর দেখি।
কলজেয় পানি ফিরে এলো মুশফিকের। তবে কাঁপুনি বন্ধ হতে একটু সময় নিলো। তারপর এমন ভাব করলো যেন কিছুই হয়নি। বললো ‘ওও মুমিতো...’। এতটুকু বলে থেমে যেতে পারলে কোন ঝামেলা বাঁধতো না। কিন্তু আগের কথার রেশ ধরে মুখ ফসকে বলেই ফেললো ‘... আমিতো ভেবেছিলাম ড্রাকুলা বুঝি।’
বলেছে তো সেরেছে। একেবারে জেঁকে বসলো মুমিতু- কী সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড! তুই তাহলে অশরীরিতে বিশ্বাস করিস? তুই কি মনে করিস সত্যি সত্যি রক্তচোষা ড্রাকুলা আছে? তোর ধারণা ওরা রাতের অন্ধকারে কফিনের ডালা খুলে বেরিয়ে আসে? এমন ধরনের গোটা দশেক প্রশ্ন করে ফেললো এক নি:শ্বাসে। মুমিতুর প্রশ্নের তোড়ে লজ্জায় মুখ লাল হয়ে এলো মুশফিকের। তারপরও আত্মপ সমর্থন করতে ছাড়েনি- আমি কি এমনি এমনি বিশ্বাস করি? তুই জানিস না, ওই পোড়াবাড়িতে একটি ড্রাকুলা থাকে।
কথা শুনে হেসেই কুটি কুটি মুমিতো- দেখেছিস কখনো?
দেখছি না মানে! প্রায়ই ওটা গরু-ছাগলের রক্ত চোষে খায়। রাত-বিরাতে মানুষও নিখোঁজ হয় ওখানে। প্রায় সকালেই পোড়াবাড়ির সামনে রক্তশূন্য সাদা দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। রাতভর তিয়াশ মিটিয়ে রক্ত পান করে বাড়ির সামনে ফেলে রাখে শরীর। সকালে কারো জ্ঞান ফেরে, কারো ফেরে না।
আরে ধূর। তোদের পোড়াবাড়িতে ড্রাকুলা-ট্রাকুলা আসবে কোত্থেকে? ড্রাকুলা তো ব্রাম স্টোকারের লেখা একটি গা ছমছমে কাহিনী।
তুই কী করে জানবি, এখানে ড্রাকুলা আছে বা নাই। দুই দিনের জন্য বেড়াতে এসে মুখের ওপর চট করে বলে দিলি, এখানে কোনো ড্রাকুলা-ট্রাকুলা নাই।
মাসুদ রানা আর তিন গোয়েন্দা পড়ে পড়ে তোর মাথাটাই খারাপ হয়েছে। ওসব কল্পকাহিনী কেবল বই এর পাতায় মানায়, বাস্তবে নয়।
এটা আমি ভালো করেই জানি, তোকে শিখিয়ে দিতে হবে না। তবে আমাদের পোড়াবাড়িতে যে একটি ড্রাকুলা আছে, সেটা আমি নিজের চোখে দেখেছি।
মহা বিরক্ত হলো মুমিতু- এটা তোর বিভ্রম বা মনের ভয়।
এ বিষয়ে আর কথা বলতে চাচ্ছি না। যদি চাস তোকে দেখাতে পারি।
দেখাতে পারি মানে? তুই কি বলতে চাচ্ছিস ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলার মতো এখানেও বন্দী হয়ে আছে কোন এক পাপীর অশুভ আত্মা? নিশুতিতে সে কফিন ছেড়ে বেরিয়ে আসে বাদুড়ের রূপ নিয়ে? উড়ে গিয়ে মানুষের গলার রগ ফুটিয়ে চুষে নেয় রক্ত? তারপর ভোরের আলো ফোটার আগেই আবার ঢুকে যায় কফিনে?
এতসব জানি না। এখানে ড্রাকুলা থাকে, এটাই সত্যি। চল এখন-ই তোকে দেখিয়ে আনবো। প্রস্তাবটা দিয়ে সাথে সাথেই পিছিয়ে গেলো মুশফিক। কিন্তু ভুল একবার করে ফেললে আর নিস্তার নেই, অন্তত মুমিতুর হাত থেকে।
এখন ভয় পাচ্ছিস কেন? খালাম্মা-খালু টের পাবেন না। চল। ওনারা নাক ডেকে ঘুমুচ্ছেন।
না মানে, বলছিলাম কী...। আমতা আমতা শুরু করলো মুশফিক।
ওও, তাহলে মানছিস যে, ওই পোড়াবাড়িতে কোন ড্রাকুলা নেই। থাকলে তো দেখাতে পারতি।
কথাটা তীরের মতো বিঁধলো মুশফিকের গায়ে। ঠিক করলো সাহস করে মুমিতুকে নিয়ে যাবে পোড়াবাড়ির কাছে। দূর থেকে ড্রাকুলাটিকে একবার দেখিয়েই চলে আসবে। সাবধান থাকতে হবে, ড্রাকুলার নজরে পড়ার আগেই ওদের ফিরে আসতে হবে। অবশ্য ড্রাকুলার চোখ ফাঁকি দিয়ে আসাটাও আরেক মুস্কিলের কাজ। মহা বিপদে পড়ে গেলো সে। কিন্তু মুমিতু ততণে চৌকাঠ পেরিয়ে সিঁড়িতে। কী আর করা! মুশফিককেও বেরোতে হলো।
ভাগ্যিস জোসনা রাত। কিন্তু জোসনা হলে কী হবে, কুয়াশার মায়াবি জালে লুকোচুরি খেলছে চাঁদের পসর। দূরের গাছ-গাছালি দেখা যাচ্ছে তো যাচ্ছে না। জনমানবের চিহ্ন নেই, ভর নিশিতে থাকার কথাও নয়। একদম নিজঝুম নিরালা। মরা ব্রহ্মপুত্র’র কাশবন থেকে হঠাৎ হঠাৎ-ই ভেসে আসছে শেয়ালের ডাক। এমনিতেই ঠাণ্ডা, তার ওপর শিড়দাঁড়া বেয়ে আরেকটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেলো মুশফিকের। আচমকা শোওও করে ভেসে গেলো কনকনে বাতাস। এক মুহূর্তের জন্য নড়ে ওঠলো পোড়াবাড়ির সামনের গাছগুলো। ভয়ে আর এগুতে ইচ্ছে করছে না মুশফিকের।
আমরা বরং এখানেই দাঁড়াই। ড্রাকুলাটা পোড়াবাড়ি ছেড়ে এদিকেও আসতে পারে, তখন না হয় দেখে নেব।
এতো ভয় পাচ্ছিস কেন? এখান থেকে তো ঠিকঠাকমতো পোড়াবাড়িটাই দেখা যাচ্ছে না। আর ওসব ড্রাকুলার ছায়-টায়া দেখালে হবে না। আমি চাই মূর্তমান ড্রাকুলা। চল সামনে হাঁটি।
এখানে কিছুণ দাঁড়াই না। তারপর দেখা না মিললে না হয় আরো এগোবো।
আচ্ছা ঠিকআছে, এত করে যেহেতু বলছিস কিছুণ না হয় অপো করলাম। তবে শর্ত আছে একটা।
কী শর্ত?
ব্রাম স্টোকারের লেখা ড্রাকুলার কাহিনীটা আমি বলব, আর তোকে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে হবে।
এতো একেবারে মরার ওপর খরার ঘা। বিপদের পর বিপদ এসে পড়ছে মুশফিকের ঘাড়ে। এখন কী করা উচিত তার, সামনে এগুবে, নাকি এখানে দাঁড়িয়ে ড্রাকুলার কাহিনী শুনবে? একটাও ওর পছন্দের অপশন নয়। তবুও কেবল আত্মসম্মানের খাতিরে প্রচণ্ড বিরক্তি আর অনিচ্ছা নিয়ে কাহিনী শুনবে বলেই ঠিক করলো মুশফিক।
তাহলে শোন, ব্রাম স্টোকার ছিলেন আয়ারল্যান্ডের এক লেখক। তিনিই ‘ড্রাকুলা’ নামের উপন্যাসটি লিখেন। আর এটি প্রকাশ হয় ১৮৯৭ সালে। ড্রাকুলা উপন্যাসের রহস্য চরিত্রের নাম কাউন্ট ড্রাকুলা। ইংরেজি ভাষায় স্টোকারের সেই ড্রাকুলা উপন্যাসটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়। এ কারণেই অনুবাদ হয় অনেকগুলো ভাষায়। আর তোদের মতো ভীতুর ডিমরা এগুলো পড়ে পড়ে মনের মাঝে গেঁথে নিয়েছে, সত্যি সত্যিই ড্রাকুলার অস্তিত্ব আছে।
েেপ গেলো মুশফিক। ওর ভয়টা একটু বেশি, তাই বলে কথায় কথায় কেউ ভীতুর ডিম বলে খোটা দেবে এমনটা মানতে রাজি নয়- সাবধান মুমিতু, আরেকবার যদি আমাকে ভীতুর ডিম বলেছিস তো ...
তো কী করবি, তোর ওই ড্রাকুলাকে দিয়ে আমার রক্ত খাওয়াবি? বিশ্রীভাবে হাসলো মুমিতু। জবাবে কিছু একটা করতে চাইলেও আপাতত চুপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলো মুশফিক। কয়েক সেকেন্ড নীরবতা এবং কী ভেবে যেন আবার ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা কথন শুরু করলো মুমিতু-
তারপর শোন, ড্রাকুলা ছিলো অস্ট্রিয়ার ট্রানসালভানিয়ার এক রক্তচোষা। দিনের বেলা মানুষের মতোই থাকতো, লোকজনের সাথে ভদ্র ব্যবহার করতো। আর রাত হলেই অস্থির হয়ে যেতো রক্তের নেশায়।
তার ছিলো অঢেল সম্পত্তি। আর বিশাল এক দুর্গ। দুর্গের ভেতর কফিনে বন্দি ছিলো আরো অশুভ আত্মা। ছিলো ড্রাকুলার কয়েকটি বউ। উপন্যাসের কাহিনী শুরু হয়েছে এক ইংরেজ আইনজীবীকে দিয়ে। তার নাম জোনাথন হার্কার। তিনি আইন বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করে যে কোম্পানিতে চাকরি পান সে কোম্পানির একটি কাজেই তাকে যেতে হয়েছিলো ড্রাকুলার দুর্গে। তার কাজ ছিলো কাউন্ট ড্রাকুলা নামের ওই লোককে আইনি সহায়তা দেয়া। বেচারা হার্কার কী আর তখন জানতো যে ড্রাকুলা লোকটা এত ভয়ঙ্কর!
তাহলে পরে কিভাবে জানতে পারলো? প্রশ্ন করলো মুশফিক।
কথার মাঝে কথা বলবি না। সেটাইতো বলছি- ড্রাকুলা তাকে নিষেধ করেছিলো রাতের বেলা যেন বেডরুমের বাইরে বের না হয়। কিন্তু বেচারা হার্কারের প্রথম থেকেই সন্দেহ হচ্ছিলো ড্রাকুলাকে। তার রাজকীয় চালচলন, রহস্যময় আচরণ আর নিশুতির কিছু বীভৎস দৃশ্য হার্কারের নজরে আসে। তাই এক রাতে ঠিক করলো, দুর্গটা ঘুরেফিরে দেখবে। ব্যস, যেই ভাবা সেই কাজ। আর যা হওয়ার হলোও তাই।
কী হলো? থিরথির করে কাঁপছে মুশফিক। তবে এ কাঁপুনি ভয়ে নাকি শীতের প্রকোপে তা অনুমান করা কঠিন।
কী আর হবে, পড়লো রক্তচোষা বাদুড়দের খপ্পরে।
এখানে আবার বাদুড় এলো কোত্থেকে?
আরে বোকা কোথাকার, ভ্যাম্পায়ারের নাম শুনিসনি? ওরা বাদুড়, তবে রক্ত পান করে। ড্রাকুলাওতো রক্ত পান করতো, ওড়তে পারতো। তাই তাকেও রক্তচোষা বাদুড় অর্থাৎ ভ্যাম্পায়ার বলা যায়, নাকি? হার্কার সেদিন তিনটি স্ত্রী ভ্যাম্পায়ারের খপ্পরে পড়লো। এরা ছিলো ড্রাকুলার বউ। শেষ মুহূর্তে কাউন্ট ড্রাকুলা তাকে রা করে। রা করলো বলে ভাববি না হার্কারকে সে সত্যি সত্যিই বাঁচাতে চাইতো। আসলে প্রয়োজনীয় আইনি সাহায্য নেয়ার আগে সে হার্কারকে মারতে চাইছিলো না। শুধু তাই নয়, ড্রাকুলার ইচ্ছে ছিলো লন্ডনের ল্য মানুষের মাঝে এসে উপস্থিত হওয়া। এখানে আসতে পারলে তার বীভৎস কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি আরো বাড়বে। কিন্তু ইংল্যন্ড ও লন্ডন সম্পর্কে ড্রাকুলার কোন জ্ঞান ছিলো না। এ বিষয়ে সে হার্কারের কাছ থেকে পাঠ নিতে থাকলো।
হার্কার এই পিশাচটাকে শেখাতে গেল কেন?
প্রাণের ভয় আছে না? প্রাণের ভয়ে শেখালো। কিন্তু সে ভালোভাবেই বুঝেছিলো যে, এখানে সে বন্দি হয়ে আছে। তাই কাউন্ট ড্রাকুলার দুর্গ থেকে পালিয়ে যাওয়ার ফন্দিফিকির করতে লাগলো সে। একদিন সুযোগ বুঝে পালিয়েও গেল। কিন্তু ততদিনে লন্ডন সম্পর্কে যা জানার তা জেনে গেছে ড্রাকুলা।
তারপর কী হলো, ড্রাকুলা কি লন্ডনে গিয়ে হার্কারকে ধরে ফেললো?
এত সহজেই ধরে ফেলবে! তখন থেকেই শুরু হলো আসল খেলা। এর কিছুদিন পরই একটি রাশিয়ান জাহাজে ঘটে রহস্যময় ঘটনা। জাহাজটি ইংল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলো। অজ্ঞাত কারণে এর সব নাবিক নিখোঁজ হয়ে যায়। শুধুমাত্র ক্যাপ্টেনের লাশ পাওয়া যায় হালের সাথে বাঁধা অবস্থায়। ক্যাপ্টেনের ডাইরি পড়ে জানা যায়, এখানে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। তারপর থেকেই জাহাজের মাঝিমাল্লারা একে একে নিখোঁজ হতে থাকে। জাহাজ থেকে কুকুরের মতো একটি জানোয়ারকে লাফিয়ে সাগরতীরে নেমে যেতেও দেখেছিল ক্যাপ্টেন। আর জাহাজের মালের তালিকায় ছিল ট্রানসিলভানিয়া থেকে আসা রুপালি বালি ও গুঁড়ো মাটি।
এর মানে ট্রানসিলভানিয়া থেকে কাউন্ট ড্রাকুলা কুকুর সেজে জাহাজে ওঠেছিল? প্রশ্ন করলো মুশফিক
হ্যাঁ। তুই তো দেখছি ভালো বুদ্ধিমান হয়ে ওঠছিস।
আর ওই কুকুরটাই যাত্রীদের রক্ত পান করার পর লাশ নিখোঁজ করে দিতো, তাই না?
হ্যাঁ, তাই। তারপরের ঘটনাগুলো আরো লোমহর্ষক। লন্ডনে গিয়ে ড্রাকুলা সন্ধান পায় হার্কারের স্ত্রী উইলহেমিনা মুরে ও তার বান্ধবী লুসি ওয়েস্টেনবারের। ঘটনাচক্রে সেখানে গিয়ে কাউন্ট ড্রাকুলা তার একজন বিশেষ অনুচরও যোগাড় করে ফেলে। লন্ডন হয়ে ওঠে ড্রাকুলার রক্ত পানের স্বর্গরাজ্য। সে তার রক্তপানের সুবিধার জন্য লন্ডন চিড়িয়াখানা থেকে একটি নেকড়ে ছেড়ে দেয়। নেকড়ের আক্রমণের ভয়ে মারা যায় লুসির মা এবং এর কিছুদিন পর লুসিও।
হার্কারের স্ত্রী মিনার কী অবস্থা হয়?
মিনার অবস্থার কথা বলার আগে লুসির কথা বলে নিই। লুসিকে কবর দেয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন পরই পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয় প্রায়ই নাকি একটি সুন্দরী নারী ছোট ছেলেমেয়েদের পিছু নিচ্ছে। সেই সুন্দরী নারী ছিলো মূলত লুসির আত্মা। সে মরে গিয়ে ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হয়েছিলো। একসময় হৃৎপিণ্ডে শূলবিদ্ধ করে তাকে মেরে ফেলা হয়। তখন সবাই ড্রাকুলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে যায়। কিভাবে এই পিশাচটাকে হত্যা করা যায়, সে চিন্তাই সবার মাথায়। এর কিছুদিন পর ড্রাকুলা হার্কারের স্ত্রী মিনার ওপর প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। কৌশলে ড্রাকুলা মিনাকে নিজের (ড্রাকুলা) রক্ত পান করায়। তারপর ড্রাকুলা আর মিনার মাঝে সৃস্টি হয় এক অতিলৌকিক বন্ধন। মিনার মানসিক নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ চলে যায় ড্রাকুলার হাতে। ড্রাকুলার কারসাজিতে প্রায়ই অজ্ঞান হয়ে যেত মিনা। তখন ড্রাকুলার সাথে টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ থাকতো ওর। আর এই সুযোগটি কাজে লাগানোর চেস্টা করলো হার্কারসহ ড্রাকুলাবিরোধিরা। মিনার অজ্ঞান অবস্থায় তারা ড্রাকুলার গতিবিধি বুঝার চেস্টা করতো। এমনকি মাঝে মাঝে সজ্ঞান অবস্থায়ও মিনাকে সম্মোহিত করে ড্রাকুলা কোথায় আছে তা জেনে নিতো।
কিভাবে সম্ভব?
কিভাবে সম্ভব, আমি কী করে বলবো? ব্রাম স্টোকারকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।
আচ্ছা ঠিক আছে, দেখা হলে জিজ্ঞেস করবো। আপাতত তুই বাকিটা বল
দিলিতো মাঝখান থেকে মেজাজ খারাপ করে। বাকিটা আর কী বলবো, তারপর ঘটনাচক্রে কাউন্ট ড্রাকুলা আবার ফেরত যায় তার ট্রানসিলভানিয়ার দুর্গে। ড্রাকুলার পিছু ধাওয়া করে হার্কারের দল। সবশেষে কোন এক সূর্যাস্তের আগে ছুরি দিয়ে গলা কেটে ও হৃৎপিণ্ডে শূলবিদ্ধ করে ড্রাকুলাকে ধ্বংস করে তারা।
মিনার কি অবস্থা হয়?
মিনার আর কী অবস্থা হবে! তার ওপর থেকে ড্রাকুলার প্রভাব কেটে যায়। আর হার্কার ও মিনা সুখে শান্তিতে সংসার করতে থাকে।
এত দ্রুত বলে শেষ করে দিলি?
দ্রুতই তো বলবো। লোমহর্ষক ঘটনাগুলো তাড়িয়ে তাড়িয়ে বললে, তুই এখানেই হার্টফেল করতি।
‘হার্টফেল’ শব্দটা শুনে সত্যিই হার্টফেল করার অবস্থা হলো মুশফিকের। ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলার ঘোর কাটিয়ে ততণে সে ফিরে এসেছে পোড়াবাড়ির ড্রাকুলায়। কাহিনীর জালে আটকা পড়ে কখন যে ওরা এগিয়ে এসেছে পোড়াবাড়ির কাছাকাছি টেরই পায়নি। মাথায় সঙ্কেত বেজে ওঠলো, এখন দুপুর রাত। আর ওরা দাঁড়িয়ে আছে পোড়াবাড়ির ঠিক সামনে। ব্রহ্মপুত্র’র তীরেই পুরনো রাজবাড়ি এটি। কেউ থাকে না। সামনের দিকে ছোটবড় অনেকগুলো ফটক। সবগুলো সিল করা। প্রধান ফটকের বাম দিকে আট-দশটি ঘোড়ার মূর্তি, সামনের দু’পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন এখনি চিঁহি স্বরে ছুটবে। ডান দিকে কয়েকটি জঙ্গলশিঙে হরিণের মূর্তি, তাকিয়ে আছে ঠিক ওদের দিকে। এখন আর কোন ওপায় নেই। আজ নির্ঘাত ড্রাকুলার কবলে পড়তে হবে। তারপর রক্তশূন্য অবস্থায় সাদা হয়ে পড়ে থাকতে হবে এখানে। এ ভাবনা যে কেবল মুশফিকের, এমন নয়। মুমিতুও ভীষণ ভড়কে গেছে। পোড়াবাড়িতে আসার পর মনে হচ্ছে ঠিকই এর ভেতর একটি ড্রাকুলা আছে। এই প্রথমবারের মতো মুমিতুর মনে হলো ড্রাকুলার অস্তিত্ব রয়েছে। অনেকেতো বলাবলি করে ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলার কাহিনী লেখা হয়েছে সত্যিকার এক মানুষের রহস্যময় জীবন থেকে। ‘ড্রাকুলা’ উপন্যাসটি লেখার আগে স্টোকার সাত বছর ইউরিপীয় লোককথা ও ভ্যাম্পায়ার মানবদের ওপর পড়াশোনা করেছিলেন। ইউরোপের স্লাভ জাতির লোকেরা বিশ্বাস করে, পাপী ও শয়তান লোকদের আত্মা রক্তচোষার রূপ ধরে পৃথিবীতে ফিরে আসে।
মুশফিকের চেয়ে বেশি কাঁপছে মুমিতু। দু’জন জড়াজড়ি করে হাঁটছে। কিন্তু কোনদিকে হাঁটছে?
কে জানে? এই মুহূর্তে কোন দিক জ্ঞান তাদের নেই। আর নেই ভাষাজ্ঞানও। মুমিতুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে আবোলতাবোল ধরনের কিছু শব্দ ‘ভোলাদ! ভোলাদ! আমাদের এবারের মতো ছেড়ে দাও।’
আপাত বিবেচনায় আবোলতাবোল মনে হলেও শব্দগুলো একেবারে আবোলতাবোল নয়। কারণ অনেকের ধারণা ভোলাদ নামের এক ব্যক্তির কাহিনী থেকেই স্টোকার ‘ড্রাকুলা’ উপন্যাসটি লিখেছিলেন। ভোলাদের জন্ম ১৪৩২ সালে পাহাড়ি অঞ্চল ট্রানসিলভানিয়াতেই। তার বাবা ছিল ওয়ালাচিয়ার শাসক। সেটা এখন রুমানিয়াতে। শত্র“র হাতে ভোলাদের বাবা মারা যায়। যুবক ভোলাদ সিংহাসনে বসেই প্রতিশোধ নেয়া শুরু করে। অনেক তুর্কিকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতে থাকে। মানুষ হত্যা করার নানা ধরনের বীভৎস পদ্ধতি সে আবিষ্কার করেছিল, তাই তাকে বলা হতো যমদূত। তীক্ষ্ম অস্ত্র দিয়ে সে মানুষকে এফোঁড়-ওফোঁড় ছিঁড়ে ফেলতো। ১৪৭৬ সালে ভোলাদ শত্র“র হাতে মারা যায়। কয়েকবছর পর তার কবর খুঁড়ে দেখা যায়, কবরে লাশ নেই। তাই লোকজনের ধারণা পরবর্তীতে ভোলাদের অশুভ আত্মা ভ্যাম্পায়ার হয়ে যায়। আর এ কাহিনীটিই উপন্যাস ‘ড্রাকুলা’র উৎস বলে অনেকে মনে করে।
তখনো ‘ভোলাদ’ শব্দটি মুশফিকের কাছে দুর্বোধ্য। ওর ধারণা মুমিতু হয়তো পাগল হয়ে গেছে। অবশ্য নিজেকেও কেমন পাগল পাগল লাগছে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে পাগল পাগল লাগাটাই স্বাভাবিক। কোনদিকে হাঁটছে, কোথায় ঠেকছে কিছুই বলতে পারছে না। কিন্তু দু’জন একসাথেই আছে। আর প্রতিমূহূর্তে অপো করছে এই বুঝি রক্তচোষাটা কাঁধে বসিয়ে দিলো তীক্ষ্ম দাঁত। কিন্তু না, দাঁতও বসাচ্ছে না, আবার ঘোর থেকেও দিচ্ছে না মুক্তি। আটকে গেছে মায়াজালে। পুরো পৃথিবীকে দোলে ওঠতে দেখলো ওরা। দোলে ওঠলো কাশবন, পোড়াবাড়ির প্রধান ফটক। আবার ভেসে এলো সেই কনকনে ভয়ঙ্কর বাতাস। কয়েকটি তেঁতুলগাছ একসাথে কুর্নিশ করলো পোড়াবাড়িটাকে। এখনি ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে রক্তচোষা ড্রাকুলা।

ক্যাপশন
প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ
১৯০৬ সালে তোলা স্টোকারের ছবি
মানুষ হত্যা করার বীভৎস পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলো ভোলাদ




মঙ্গলবার, মার্চ ১৩, ২০১২

শত্রুতা করার সময় কই?



শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
অবশেষে ৩০০তম সংখ্যায় পদার্পন করল থেরাপি। কিন্তু কিভাবে করল, এর পেছনে অনেক কাহিনী।
সব কথা প্রকাশ করতে চাই না। তাতে সোহেল অটলের (থেরাপির বিভাগীয় সম্পাদক) সাথে শত্রুতা বেড়ে যেতে পারে। হাজার হোক আমরা প্রতিবেশি। একে অপরের শত্রু হলেও পাশাপাশি দু’টি ডেস্কে বসি। প্রতিবেশির সাথে সদ্ভাব রাখা উচিত। না হয় যে কোন সময় নাশকতা ঘটতে পারে।
এবার নিশ্চয়ই বলবেন- সোহেল অটল এমন লোক নন।
মুখ দেখে কি লোক চেনা যায়? থেরাপির বিভাগীয় সম্পাদককে চিনতে হলে অবকাশের ২৫০তম এবং ৩০০তম সংখ্যা দুটি পড়তে হবে। আর যারা পুরনো সংখ্যা খোঁজাখুঁজির ঝক্কি নিতে রাজি নন, তাদের জন্য হালকাপাতলা বিবরণ দিচ্ছি-
আমরা দু’জন একই সাথে দু’টি ম্যগাজিনের দায়িত্ব পেলাম। কথা ছিল মিলেমিশে কাজ করব। কিন্তু কে রাখে কার কথা। শুরু হলো শত্রুতা।
কিভাবে শুরু হলো?
শুনুন তাহলে সে কথা- আমি শান্তশিস্ট ভদ্র লোক। নীরবে পড়ে থাকি অবকাশ নিয়ে। কৌতুহল হলে উঁকিঝুঁকি মারি থেরাপির ডেস্কে। মাঝে মাঝে টুকটাক নিন্দা করি। শত্রুতা করার সময় কই?
কিন্তু একদিন আমাকে নড়েচড়ে বসতেই হলো। খেয়াল করলাম, শাহাবুদ্দীন ভাই (আহমেদ শাহাবুদ্দীন, নয়া দিগন্ত’র ফিচার এডিটর) এর রহস্যজন আচরন। তিনি আমার হাতে ঘন ঘন নোটিশ ধরিয়ে দিচ্ছেন। নোটিশে লেখা থাকে ‘আগামি সপ্তাহে অনিবার্য কারনে অবকাশ বন্ধ থাকবে’ ধরনের কথা। অন্যদিকে থেরাপির সংখ্যাগুলো তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। লোক দেখানোর জন্য সোহেল অটলকেও নোটিশ দিচ্ছেন, তবে আমার তুলনায় নিতান্তই কম।
ঘটনা কী! এর পেছনে নিশ্চয়-ই কারো হাত থাকতে পারে। লম্বা হাত। সন্দেহের তীর ছুটলো অটলের দিকে। শুধু সন্দেহই নয়, গোপন সূত্রে খবর পেলাম তিনি রীতিমত উঠেপড়ে লেগেছেন আমার বিরুদ্ধে। অবকাশের সংখ্যা বন্ধ রাখার জন্য যতরকম চেস্টা-তদবির প্রয়োজন সবই করছেন অটল।
পরের ঘটনা ঘুরে দাঁড়ানোর। মাঝে মাঝেই রান আউন হতে লাগলো থেরাপি। কখনো ক্রিজের অর্ধেকটা দৌড়ে, কখনো কাছাকাছি পৌঁছে। অন্যদিকে সোহেল অটলের চোখের সামনেই থেরাপির আগে ত্রিপল সেঞ্চুরি পূর্ণ করল অবকাশ। জয় হলো আমার।
কিভাবে ছিনিয়ে আনলাম জয়!
বিস্তারিত রণকৌশল ব্যখ্যা করা যাবে না। তবে এতটুকু বলে রাখি- দাবার ঘুঁটি পাল্টে গেলো নতুন মোটর সাইকেল কেনার পর। অর্থাৎ সোহেল অটল যেদিন ওই বাহনটি কিনলেন, সেদিন থেকেই উড়ে বেড়াচ্ছেন। এগজস্ট পাইপের ধোঁয়া ছেড়ে মনের আনন্দে চলাফেরা করছেন। আর আমি শাহাবুদ্দীন ভাই এর সাথে চা খাই। মাঝে মাঝে এক কাপের যায়গায় দুই কাপও খাওয়া হয়।

রবিবার, ফেব্রুয়ারী ২৬, ২০১২

পাতালপুরে

যেইনা রানি পা ডুবালো
দুধের তলে
অমনি হঠাৎ দুধের সাগর
ওঠলো টলে।
লাটিম যেমন বেহুঁশ হয়ে
ঘোরতে থাকে,
তেমনি ঘোরে সাগর যেন
ওড়তে থাকে।
পাতারানি পাতার নায়ে
ঠাঁয় তখনো
ঘূর্ণিপাকে ঠিক থাকা কি
যায় কখনো?
যায় না বলেই নৌকা থেকে
অযূত দূরে
ছিটকে গেলো দ্বীপের রানি
পাতালপুরে ।

পাতার নাও

পাতাদ্বীপের রানী পাতা।
কোথায় তবে
রানীর নাও?
কোথায় সেটা নোঙর করে
কোথায় আবার
ভাসায় গাও?

আচ্ছা, একি বলছো যা তা!
পাতা রানীর
পাতার নাও
পাতাদ্বীপে নোঙর করে
দুধ-সাগরে
ভাসায় গাও।

গা ভাসিয়ে দিব্যি চলে
পাতালপুরীর গল্প বলে
পাতার নাও।
পাতারানী নাওয়ে ভেসে
দুধ-সাগরের অতল দেশে
ভেজায় পাও।

শুক্রবার, জানুয়ারী ২৭, ২০১২

মেঘে ঢাকা তারা


শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ

ফাহমিদা নবীর গান কখনো ঝিলিমিলি স্বপ্নাবেশ। কখনো এক বিকেল রোদ অথবা ভরা জোসনা। তার জীবনও কিন্তু সরলরেখা নয়। এঁকেবেকে চলা নদীর মতোই। এই জীবন-যৌবনের ভাঁজে ভাঁজে আছে অনেক অন্ধকারও। ঠিক মেঘে ঢাকা তারার মতো।
৪ জানুয়ারি এই শিল্পীর জন্মদিন। এ উপলে তার প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা

হাসি আর ফুল। এ দুটো অনুষঙ্গ এক করলে যে ছবিটি দাঁড়ায়, সেটা হলো ফাহমিদা নবীর। ফাহমিদা নবী মানে হাসি, ফাহমিদা নবী মানেই ‘চুলে তাহার সাদা ফুল’। অর্থাৎ তিনি সুন্দর- ভেতরে ও বাইরে। জীবনকেও সাজাতে চান সুন্দর করে, ঠিক ফুলের মতোই।
একখন্ড ছাদ। পাশে ধানমন্ডি লেক- শ্যঁওলা পড়া জল, ঢালে বিছানো ঘাসের কার্পেট, গাছের ছায়া, ফুল, পাখি, প্রজাপতির ওড়াওড়ি। মোটকথা শান্ত প্রকৃতি ঘিড়ে রেখেছে ছাদটিকে। আর এ ছাদের তলায়-ই ফাহমিদা নবীর ছিমছাম একটি ফ্যাট। ড্রয়িংরুমে সাজানো গাছের গুঁড়ি, লতা-পাতাসহ প্রকৃতির নানান অনুষঙ্গ।
কি কারণ?
‘কারণতো একটাই। আমি প্রকৃতির মেয়ে, প্রকৃতিকে ভালোবাসি। ঘর সাজানো আমার শখ। মানুষের মনের সৌন্দর্য্যটাকে ঘরের মধ্যে প্রকাশ করা উচিত। তাছাড়া ফুলের মাঝে আমি আমার অস্তিত্ব দেখি। কেন জানি না, ছোটবেলা থেকেই ফুল দেখে আনন্দে চিতকার করে ওঠতাম। ফুলের জন্যই সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের প্রতি আমার মোহ ছিলো, এখনো আছে। জাপানের সবাই ফুল ভালোবাসে। চেরি ফুল তাদের খুব প্রিয়।’
ফাহমিদা নবী ফুলের মাঝে খুঁজে পান মানবিকতা, অনুভব করেন পৃথিবীকে। তাই মাঝে মাঝে তাকে সাজতে দেখা যায় তাজা ফুলের অলঙ্কারে। তিনি ফুলের মাঝে জীবনের সৌন্দর্য্য খুঁজে পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে- ‘আমি মনে করি, প্রতিটি ভালোর মাঝেই সৌন্দর্য্য লুকিয়ে আছে। কেবল সুন্দরটাকে উপলব্ধি করতে পারলেই হয়। আমি ভীষণভাবে এ উপলব্ধিটা করি রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি গানে। এই যেমন- আমারো পরানো যাহা চায়, গানটি সবার-ই পছন্দের। এর ভেতরও ফুলের অস্তিত্ব। গানটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে প্রকৃতি, বৃস্টি ও ফুল। এ ফুলের সৌরভেই রবীন্দ্রনাথ মনন আর চেতনার দরজা খুলে দিয়েছেন।’
ফাহমিদা নবীর প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ। দার্শনিক সক্রেটিস তার চিন্তা, চেতনা ও বোধ। আর ইতিহাসের চরিত্রগুলোর মাঝে ভালো লাগে রাজা অশোক ও চেঙ্গিস খানের মতো চরিত্রগুলোকে। তাই বলে এদের নৃশংসতাকে তিনি পছন্দ করেন এমন নয়। ইতিহাসের এই চরিত্রগুলোর নৃশংসতার আগে ও পরে এবং জীবনের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে প্রেম, ভালোবাসা। রাজা অশোক রাজ্য জয় করতে করতে একসময় কান্ত হয়ে নিজের মাঝে বোধ জাগ্রত করেছিলেন। তারপর রাজ্য জয় ছেড়ে দিয়ে মনের জয়ের উদ্দেশ্যে নেমে যান পথে। খুঁজে ফেরেন আত্মার শান্তি। ফাহমিদা নবীও জীবনকে সহজ ও সুন্দর করে দেখতে চান কেবল প্রশান্তির জন্য।

কণ্ঠশীলন
শুধু নিজের প্রশান্তি নয়, অন্যের মাঝে প্রশান্তির বীজ বুনে দেয়ার কাজটিও তিনি করেন। কিভাবে করেন? জানা যাক ফ্যন্সি’র কাছ থেকে। ফ্যন্সি চাকরি করেন বেসরকারি একটি ব্যংকে। টুক-টাক গান করেন, নিজের জন্য বা কারো অনুরোধে। ফাহমিদা নবীর গান তার খুব ভালো লাগে। টেলিভিশনে ফাহমিদা নবীর একটি সাাতকার দেখে তার সাথে যোগাযোগ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। কি ছিলো সেই সাাতকারে? ‘সাাতকারে ফাহমিদা নবী বলেছিলেন, তিনি সপ্তাহে দু’দিন ভয়েস গ্র“মিং কাস করান। যারা গান করেন, তাদেরকে কণ্ঠশীলন করান। পাশাপাশি গলার সাথে গানের ম্যচিং করার বিষয়েও প্রশিণ দেন। শুধু তাই নয়, তিনি বলেছিলেন সেখানে নাকি প্রতিটি ছাত্র’র চিন্তা, মেধা, মননসহ ব্যক্তিগত বিষয়গুলো ধরে ধরে আলোচনা করা হয়।’
তারপর মোহগ্রস্তের মতো ফাহমিদা নবীর কাছে ছুটে গেলেন ফ্যন্সি। ভর্তি হলেন একটি ব্যচে। ফলাফল কী হলো? আগের ফ্যন্সি ও পরের ফ্যন্সির মাঝে পার্থক্য দি দাঁড়ালো? ‘আগের চেয়ে আমার মনোবল বেড়ে গেলো। এখন মঞ্চে যখন দাঁড়াই, ভাবি আমিই দুনিয়ার রাজা। আমার ওপর কেউ নেই। মঞ্চের বাইরের আবেগ-অনুভূতি আমাকে স্পর্শ করতে পারে না। মাইক্রোফোনের সামনে কিভাবে দাঁড়াতে হয়, গান গাইতে হলে কখন কেমন এক্সপ্রেশন প্রয়োজন সবকিছু শিখেছি কাস থেকে।’
ফাহমিদা নবীর ভয়েস গ্র“মিং কাস শুরু হয়েছে ২০০৭ সালে। প্রতি শুক্র ও শনিবার তিনি কাস নেন মুহাম্মদপুরের একটি স্কুলে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ বিভিন্ন পেশাজীবিরা তার শিার্থী। দর্শনে পড়ালেখা করেছেন বলেই কি তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের দর্শন শেখান? ‘মোটেও না। আমি মূলত দর্শনের ওপর গুরুত্ব দেই নিজেকে নিজে চেনার জন্য। নিজের কাছে নিজে পরিস্কার থাকলেই কোন কাজে ঝামেলা নেই, মানসিক বিপর্যস্ততারতো প্রশ্নই ওঠে না। আমি ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে জাগতিক বিষয় নিয়ে কথা বলি। কেউ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকলে তার বোধের জায়গাগুলো জাগ্রত করে দেয়ার চেস্টা করি। আমি একটি কাস নেই মননের ওপর। এর মূল বিষয় হচ্ছে - স্বপ্ন শুধু দেখলাম বসে বসে, মাঠে নামলাম না। অর্থাৎ স্বপ্ন যদি দেখতে চাও, তবে স্বপ্নের পথে হাটো।’
তিনি মনে করেন সার্বিক সৌন্দর্য্য নিয়েই মানুসের সৌন্দর্য্য। সততার চোখ বা নিষ্পাপ ভেতরকে কেউ বাহ্যিক সেজেগুঁজে তৈরি করতে পারে না।
১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সাত বছর দুটি স্কুলে শিকতা করেছিলেন তিনি। তাই শিকতার নেশাটা একেবারে ছাড়তে পারেননি। তার স্বপ্ন একটি পূর্ণাঙ্গ সংগীত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। যেখানে গানের লাইব্রেরি থেকে শুরু করে বাদ্যযন্ত্রসহ সব আয়োজনই থাকবে।

এক যে ছিলো রাজা
এখন যিনি গানের মাস্টার, তিনি প্রথম গান শিখেছিলেন কোথায়?
পানির মতো সহজ জবাব- তার বাবার নাম মাহমুদুন্নবী। আর মাহমুদুন্নবী মানেই হলো গান, উপমহাদেশের নামকরা শিল্পী। সুতরাং তার মেয়ের ভেতর গান বাসা বেঁধেছিলো কিভাবে, এমন প্রশ্ন অবান্তর। মাহমুদুন্নবীর দুই কণ্যাই (ফাহমিদা নবী ও তার ছোট বোন সামিনা চৌধুরি) এখন খ্যতিমান শিল্পী।
মাহমুদুন্নবী ছিলেন গানের রাজা। সেই রাজার ছিলো তিন কন্যা নুমা (ফাহমিদা নবী), নোভা (সামিনা চৌধুরি) ও অন্তরা (তানজিদা নবী)। আর ছিলো এক পুত্র পঞ্চম (রেদয়ান চৌধুরী)। তাদের প্রাসাদ ছিলো ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে, ছায়া সুনিবীর শান্তির নীড়। প্রাসাদে ছিলো দারুন এক আম গাছ। তিন কন্যাকে নিয়ে রাজার ছিলো এক দু:খ, সুযোগ পেলেই ওরা আম চুরি করে খেয়ে ফেলতো। কি আর করা, কণ্যা বলে কথা। চুরি করেও বার বার পার পেয়ে যেতো।
এ তো গেলো এক দু:েখর কথা। রাজ্য চালান রাজা, তবুও যে তার দু:েখর সীমা নেই। কারণ রাণীর ভয়ে তাকে তটস্ত থাকতে হতো। রাণী সবসময় রাজার খাবারদাবারের ওপর খবরদারি করতেন। এটা খাওয়া যাবে না, ওটা খাওয়া যাবে না। বিশেষ করে মিস্টি খাওয়ার ওপর কড়াকড়িটা ছিলো বেশি। কি তাজ্জব কথা, রাজার ওপর খবরদারি! না না এ হতেই পারে না। যে কোন ওপায়ে মিস্টি খেতেই হবে। কি করা যায়, কি করা যায়। ছলে বলে কলা কৌশলে রাণীর চোখ এড়িয়ে তিন কন্যা আর এক পুত্রকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যেতেন প্রাসাদ থেকে। ছল করতেন- যেন হাটতে বেরিয়েছেন। কিন্তু তলে তলে ছিলো অন্য ফন্দি। বাসা থেকে কয়েক কদম হাটলেই মরণ চাঁদের মিস্টির দোকান। চারজনকে নিয়ে রাজা ঢোকে যেতেন সেখানে। মিস্টির অর্ডার দিতেন। তার পর প্লেটের পর প্লেট মিস্টি আসতো আর শেষ হয়ে যেতো। রাজকন্যারা খেয়ে দেয়ে কান্ত হয়ে গেলে তাদের প্লেটের মিস্টিও সাবার করে দিতেন রাজা।
আগেকার সেই রাজা এখন আর নেই। এমনকি রাজকন্যা-রাজপুত্ররাও সেই প্রাসাদে নেই। তবে আম গাছটি দাঁড়িয়ে আছে আগের মতোই। এ প্রাসাদে একসময় যাতায়াত ছিলো পার্শ্ববর্তী রাজ্যের অনেক রাজা ও রাণীদের। প্রতিদিন সন্ধ্যায় এখানে বসতো সুরের আসর। কারণ সেই রাজা ছিলেন সুরের রাজা। তার সুরের প্রাসাদ এলিফ্যন্ট রোডে থাকলেও আসল প্রাসাদ ছিলো খুলনায়। ফুলতলা বাসস্ট্যন্ডের সাথেই ছিমছাম একটি প্রাসাদ। আর রাজার বাবার মূল প্রাসাদ ছিলো ভারতের বর্ধমানে।
সেই রাজার রাণীর আসল প্রাসাদ ছিলো দিনাজপুরের গনেশতলায়। রাজকন্যা ও রাজপুত্ররা ঢাকায় পড়াশোনা করলেও বছরের প্রায় ছয় মাস কাটাতো নানাবাড়িতে। নানা-নানী, মামা, খালা, পাড়া-প্রতিবেশি, সিনেমা হল এসব নিয়েই ছিলো তাদের উচ্ছল জীবন। সেখানে ছিলো লাল রঙের সিমেন্টে বাঁধানো কলতলা, সিমেন্টের সোফা। মামারা নাটক তৈরি করতেন। কলতলাতে পারিবারিক নাটক মঞ্চস্ত হতো। বড় মামার (বাদল মামা) একটি নাটকের দলও ছিলো- নবরূপী নাট্যদল। সব মিলিয়ে নানাবাড়িতে ছিলো অসাধারন এক সাংস্কৃতিক পরিবেশ। তাদের পরিবারের শিাটাই ছিলো মূলত গান-বাজনা নিয়ে। তিন রাজকণ্যা আর এক রাজপুত্র’র খেলার সাথির কোন অভাব ছিলো না। ছয় খালা ও মামাদের মাঝে বেশ কয়েকজন ছিলো তাদের বয়সি। নানী মেহেরুন্নেসা ছিলেন তাদের বন্ধুর মতো। নাটক-রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লতা মুঙ্গেশকর এদের নিয়েই সারান মেতে থাকতো তারা। তারা একে অপরের সাথে কোন খেলনা জিনিস নিয়ে খুনসুটি করতো না। সুরের রাজ্যের রাজকন্যা ও রাজপুত্রদের খুনসুটি হতো গান, নাটক ও সাহিত্য নিয়ে। বুঝে ওঠার আগে থেকেই তারা রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার চরিত্রগুলোর সাথে পরিচিত হয়ে উঠেছিলো। ভাই-বোনদের মাঝে কেউ কেতকি চরিত্রকে সমর্থর্ন করতো, কেউ লাবন্যকে। তবে নায়ক অমিত রায়ের ব্যপারে সবারই এক কথা ‘অমিত হলো ভেজা বেড়াল’। ছোটবেলায় সংসারের কোন ঝুট-ঝামেলা তাদের স্পর্শ করতে পারতো না।

অত:পর বড় কণ্যা
সেই সুরের রাজার বড় কণ্যা নুমা একদিন বড় হয়ে ওঠলো। রাজার মতো সাহস নিয়ে সেও রাজত্ব করতে লাগলো। কিন্তু কিভাবে সে বড় হলো?
বড় হতে হলে পড়ালেখা করতে হয়। তাই সে ছোট থাকতেই পড়ালেখায় মন বসালো। ভর্তি হলো গ্রীণরোডের সান ফাওয়ার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। ওখানে একবছর পড়ার পর মুহাম্মদপুর অগ্রণী গার্লস হাই স্কুলে চলে এলো। থাকলো একেবারে দশম শ্রেণী পর্যন্ত। মাঝখানে কি ঘটলো?
ঘটলো অনেক কিছুই, বিশ্বস্ত ও কাছের বান্ধবি অর্চনা, শম্পা ও মুনসহ কয়েকজনকে নিয়ে গঠন করলো ভয়ঙ্কর এক বিচ্ছুবাহিনী। এ বাহিনীর কাজ ছিলো স্কুলজুড়ে দস্যিপনা করে বেড়ানো। এর ওর ব্যপারে নাক গলানো, কান গলানো ছিলো নৈমেত্তিক ব্যপার। গাছের লটকন চুরি করায় বিচ্ছু বাহিনী ছিলো সিদ্ধহস্ত। আর মাঝে মাঝে রোমাঞ্চের জন্য কাসে ফাঁকি দেয়ার পদ্ধতিও আবিষ্কার করতো- বিচ্ছুবাহিনীর সদস্যরা গবেষণা করে আবিষ্কার করে ফেলেছিলো যে, ইসলামিয়াত স্যর কাসে এসে একজনকে সূরা এখলাস জিজ্ঞেস করলে, তার পরের জনকে সূরা নাস জিজ্ঞেস করবে। তাই বিচ্ছুবাহিনীর সবাই সব সূরা না পড়ে ভাগাভাগি করে সূরা মুখস্ত করে আসতো।
এ তো গেলো দশম শ্রেণীর কথা। কিন্তু রাজার বড় কণ্যা এস.এস.সি পাশ করলো কোন স্কুল থেকে? ‘মুহাম্মদপুর গার্লস হাই স্কুল থেকে। আমাদের বাসা পরিবর্তন করার কারণে সেখানে চলে যেতে হয়েছিলো। এইচ.এসসি পাশ করি হলিক্রস কলেজ থেকে। তারপর দর্শনে অনার্স-মাস্টার্স করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।’

পথের ছবি
বড় কন্যা বড় হলো। গানে গানে যশ কুড়োলো। কিন্তু কোন পথে হেঁটে?
সে পথের ছবি আঁকতে গেলে শুরু করতে হয় প্রাসাদ থেকে। অর্থাৎ এলিফ্যন্ট রোডের সেই প্রাসাদ থেকেই পথের উৎপত্তি। তারপর সেই পথ বাঁক নিলো ওস্তাদ আমানুল্লাহ খানের (মারা যান ২০০৩ সালে) ভাঙা বাড়িতে। ১৯৭৫ সালের দিকের কথা- রাজকন্যা নুমা তখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। তাকে তালিম নিতে যেতে হতো আমানুল্লাহ খানের কাছে। মুহাম্মদপুরের একটি ভাঙা বাড়িতে থাকতেন তিনি। সেকি করুণ অবস্থা- একটিমাত্র ঘরে তিনটি খাট পাতা ছিলো। খুব কস্টে-সিস্টে সংসার চালাতেন।
পথের বাকি ছবিটা আঁকা যাক সরাসরি বড়কন্যার বর্ণনায়-
‘আমি প্রথম গান গেয়েছিলাম সত্তরের দশকের শেষের দিকে, তথা ১৯৭৭ সালে। বিটিভিতে আবদুল্লাহ আবু সাঈদের উপস্থাপনায় চতুরঙ্গ অনুষ্ঠানে গেয়েছিলাম কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা ও হ্যাপি আখন্দের সুরে এই অন্ধ করায় বসে।
গান গেয়ে আমার প্রথম উপার্জন ছিলো রেডিও থেকে। ১৯৭৭ সালে রেডিওর কলকাকলি অনুষ্ঠানে গেয়ে ২৫ টাকা পেয়েছিলাম। কিভাবে খরচ করেছিলাম সেটাও মনে আছে। ২৫ টাকা দিয়ে একটি বেতের র‌্যাক এবং ছয়টি গ্লাস কিনেছিলাম। তখন আমি মাত্র ৭ম শ্রেণীতে পড়ি। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় একেবারে ছোটবেলা থেকেই ছোট ভাই-বোনদের প্রতি যতœশীল ছিলাম আমি। তাছাড়া সংসার ও সংসারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের প্রতি আমার অন্যরকম নেশা ছিলো।’
১৯৭৭ সালের শেষের দিকেই আমি টেলিভিশন থেকে উপার্জন করি ১০০ টাকা। তখন বাবার সাথে ডুয়েট গেয়েছিলাম ‘আয় খুকু আয়’ গানটি। এই একশ’ টাকা দিয়ে মা আমার নামে একটি একাউন্ট খুলে দেন পূবালী ব্যাংকে।
প্রথম সলো এলবাম তুমি তুলনাহীনা প্রকাশ হয় ১৯৭৯ সালে। আর চলচ্চিত্রে প্রথম গাই ১৯৮৩ সালে ‘দূরদেশ’ ছবিতে। গানটি ছিলো- ভাইটি আমার তুমি কেঁদোনা, বোনটি আমার তুমি কেঁদো না। এর সুরকার ঊষা খান। এটি মূলত ছিলো একটি হিন্দী গানের সুর। গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকার ও ঊষা খান। আর বাংলা ভার্সন গেয়েছিলেন আমি ও সামিনা।’
পেশাগত প্রয়োজনের বাইরেও ফাহমিদা নবী কেবল নিজের আনন্দের জন্য গুনগুন করেন। আবার কারো অনুরোধেও গেয়ে শোনান। কিন্তু কোন গান গাইবেন, কেমন গান গাইবেন তা অধিকাংশ েেত্র নির্ভর করে পরিবেশ ও পরিস্থিতির ওপর। তবে সাধারণত মেলোডি গানই তার বেশি পছন্দ। যেমন- ‘তুমি কি সেই তুমি’ , রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’। সর্বোপরী গান গাওয়ার ব্যাপারে মনকেই প্রাধান দেয়ার চেস্টা করেন তিনি ‘মেলোডি গান আমার আত্মার গান। মেলোডিগুলো আমার ভেতর থেকে আসে। এছাড়া অন্যগুলোতে আমি অনুভবে প্রবেশ করতে পারি না।’ তবে কোন কোন সময় মনের চেয়ে শ্রোতার পছন্দটাকেই প্রাধান্য দিতে হয়।

মেঘ-জোসনার লুকোচুরি
ফাহমিদা নবী মনে করেন, প্রতিটি মানুষের জীবন প্রতি দশ বছর পর পর একেক দিকে বাঁক নেয়। অর্থাৎ মানুষের জীবনকে ভাগ করলে প্রতি দশ বছর করে আলাদা করতে হবে। এক অংশের জীবন অন্য অংশের সাথে মিলবে না। প্রতিটি অংশই আলাদা আলাদা। এমনকি পূর্ববর্তী অংশগুলোর দুঃখবোধ পরবর্তী অংশের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলবে না। আবার পূর্ববর্তী অংশের সুখবোধগুলোও পরবর্তী অংশে আন্দোলিত হবে না।
‘আমার জীবনও প্রতি দশ বছরে একটি করে অংশ হয়ে গেছে। যেমন জন্ম থেকে প্রথম দশ বছর পর্যন্ত এক রকম ছিলো, আবার পরবর্তী দশ বছর ছিলো অন্যরকম। সেটা কেটেছে কৈশোরের দূরন্তপনায়। জীবনের কৈশোরত্তীর্ণ ভাগটিতে এসে প্রচণ্ডভাবে মানুষকে ভয় পেতে আরম্ভ করি আমি। পরবর্তীতে ভেবে দেখলাম, সবাই-ইতো মানুষ। সবার ভেতরে বিশুদ্ধতা-অশুদ্ধতা দুই-ই আছে। সব মানুষের মাঝে হাসি আছে, কান্না আছে। তাহলে মানুষ কতটাই বা খারাপ হতে পারে! সুতরাং সিদ্ধান্ত নিলাম মানুষকে ভয় না করে জয় করতে হবে। তারপর আমার জীবনের পরবর্তী অংশটি কাটে মানুষ জয়ের অভিযানে।’
তবে তিনি তার জীবনের টার্নিং পয়েন্টগুলোর মাঝে বাবার মৃত্যুর সময়টাকে যেভাবে দেখেছেন, এখন তার মেয়ের বাবার মৃত্যুর সময়টাকেও মেয়ের জন্য সেভাবেই দেখছেন। ফাহমিদা নবীর স্বামী ছিলেন জয়নুল আলম বাবু। তিনি মারা যান গত সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ তারিখে। তিনি একসময় এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও মূলত ছিলেন একজন সৌখিন ফটোগ্রাফার। ১৯৮৭ সালে তাদের বিয়ে হয়েছিলো। ১৮ই সেপ্টেম্বর সারাদেশে ভ’মিকম্প হয়। এতে ভয় পেয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান।
বাবার মৃত্যু ও স্বামীর মৃত্যু এ দুটোই তার জীবনের বড় টার্নিং পয়েন্ট। পার্থক্য হলো একটির প্রভাব ছিলো সরাসরি তার ওপর। আর আরেকটির প্রভাব মেয়ের ওপর হয়ে তার নিজের ওপর পড়ছে। ফাহমিদা নবীর একমাত্র মেয়ের নাম আনমোল। বর্তমানে পড়ছেন আইন বিষয়ে। তার বিয়ের আংটি পরানো হয় আগস্টের ৯ তারিখ। বর তানভীর হাসনাত রোমান ভারতের ব্যাঙ্গালোর থেকে বিবিএ শেষ করে পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করছেন।

বোধ
জাকিয়া জেনিফার। ফাহমিদা নবীর এক অন্ধ ভক্ত। প্রায়-ই তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির একটি অংশ তিনি ফাহমিদার নামে লিখে দিতে চান। কি কারণ? ‘ম্যম-এর (ফাহমিদা নবীর) গাণ আমাকে পাগল করে দেয়। লুকোচুরি গল্প শুনে আমি যোগাযোগ করতে চাই ম্যম-এর সাথে। তারপর প্রথম যেদিন তার সাথে ফোনে কথা বললাম, সেদিন থেকেই মোহগ্রস্ত হয়ে গেলাম।’
জাকিয়া জেনিফারের বাবার বাড়ি হাজারীবাগে। ২০০৮ সালে বিয়ে হয় চকবাজারের ব্যবসায়ীর সাথে। বিয়ের পর স্বামী ও স্বামীর পরিবার তার পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়। এ থেকেই সূত্রপাত হয় পারিবারিক কলহের। ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে দু’জনের। তাই জেনিফার একসময় আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন- ‘ভাবলাম আত্মহত্যা করার আগে ম্যম-এর সাথে শেষবারের মতো কথা বলে নেই। ফোন দিলাম ম্যমকে। আমি যে আত্মহত্যা করবো এ কথা বলার ইচ্ছা ছিলো না, কিন্তু কিভাবে যেন বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। সাথে সাথেই ম্যাম ফোন কেটে দিলেন। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু কিছুন পরই তিনি ফোন দিলেন আমাকে।’
তারপর দীর্ঘ আলাপ জীবন ও জীবনের বোধ নিয়ে। অবশেষে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন। জেনিফার মনে করেন ফাহমিদা নবী-ই তাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। তার কারনেই পরবর্তীতে তিনি আবার সংসারি হতে পেরেছেন। জীবন সম্পর্কে নিজের বোধকে জাগ্রত করা এবং পরিবারের অন্যদের মাঝে জাগ্রত করানোর কাজটি তিনি ফাহমিদার কাছ থেকেই শিখেছেন। বর্তমানে তার পড়ালেখা করার েেত্রও স্বামীর পরিবার থেকে কোন বাধা নেই।
জাকিয়া জেনিফার ফাহমিদা নবীর কাছ থেকে শিখেছেন জীবনের কাছে কখনো হেরে যেতে নেই, বরং জীবনকে নিজের মতো করে গড়ে নিতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন মনোবল আর আত্মবিশ্বাস।

ফাহমিদা নবী

ডাক নাম
নুমা

জন্ম
৪ জানুয়ারি

বাবা
মাহমুদুন্নবী

মা
রাশিদা চৌধুরী

স্বামী
মরহুম জয়নুল আলম বাবু

সন্তান
আনমোল

প্রথম এলবাম
তুমি তুলনাহীনা-১৯৭৯

মোট এলবাম
১১টা সলো এবং অসংখ্য মিক্সড ও ডোয়েট।

দাবার রাণী

রাণী হামিদ। দাবার রাজ্যের এক রাণীর নাম। খেলায় তিনি প্রতিপরে মন্ত্রী-সেপাই ধ্বংসের নীলনকশা করে গেলেও তার জীবনের উপলব্ধি ‘যুদ্ধ নয় শান্তি’। এবারের প্রচ্ছদ রচনা রাণী হামিদকে নিয়ে। তৈরি করেছেন শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদসোহেল অটল


রাণী হামিদের ড্রয়িং রুমে দাবার বোর্ড থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। শুধু স্বাভাবিক-ই নয়, বরং একজন আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টারের বাসায় সেটা না থাকলেই বেমানান হতো। রাজা-মন্ত্রী, হাতি-ঘোড়া, কিস্তি-সেপাইগুলো নির্দিস্ট ঘরে সাজানো। যে কেউ দেখে মুগ্ধ হবেন। আর মুগ্ধ হবেন কজুড়ে সাজানো শিরোপা আর শিরোপা দেখে।
ভেতর ঘর থেকে অনেকটা হঠাৎ-ই এসে হাজির হলেন তিনি। মুখে স্মীত হাসি ‘অনেকন বসিয়ে রাখলাম তোমাদের। আসার আগে আরেকবার ফোন করবে না? তাহলে আগেই তৈরি হয়ে থাকতাম।’
বেলা তখন পড়ে এসেছে। সন্ধ্যা হয় হয়। ঠিক হলো আগে ফটো সেশনের কাজ। চলে যাওয়া হলো আউটডোর তথা তার বাড়ির সামনে। পুরনো ডিওএইচএস-এ ছিমছাম বাড়ি। তিনতলা বাড়ির খোলামেলা বিন্যাস, বিস্তৃত আঙিনা, প্রশস্ত লন সবই আকর্ষণীয়। ছবি তোলা হলো আউটডোরে, অত:পর ইনডোরে। তারপর আবার ড্রয়িং রুম এবং জীবনের ডায়েরি খোলে বসা-

বেড়ে ওঠা
স্মৃতি হাতড়ানোর জন্য একটু সময় ভাবলেন তিনি। তারপর একলাফে চলে গেলেন শৈশবের অধ্যায়ে। যে অধ্যায়টি তিনি পাড়ি দিয়ে এসেছেন নানা দুরন্তপনায়। ‘আমি ছোটবেলা থেকেই ছিলাম দূরন্ত। খেলতাম, ঘুরতাম, ফিরতাম। বলা নেই কওয়া নেই হরহামেশাই এখানে সেখানে উধাও হয়ে যেতাম। হারিয়ে যেতাম গ্রামের মেঠো পথে। ঘুরে বেড়াতাম এ গ্রাম ও গ্রাম।’
শৈশবে যেমন করেছেন দুষ্টুমি তেমনি অনেক বোকামীর কথা মনে হলে আজো তিনি হেসে কুটি কুটি হন। তেমনি এক ঘটনার কথা শোনালেন ‘আমি আর আমার বড় বোন পারু তখন একই স্কুলে পড়তাম। পারু আমার ওপরের কাসে পড়তো। সে ছিলো আমার চেয়ে ফর্সা এবং সবসময় টিপটপ হয়ে থাকতো। আর আমি ছিলাম কালো ও রোদে পোড়া। তাই কাসের মেয়েদের কেউ বিশ্বাসই করতে চাইতো না যে আমরা দু’জন সম্পর্কে আপন বোন হই। তাই একদিন এক মেয়ে জিজ্ঞেস-ই করে বসলো- তোমরা দু’জন কি আপন বোন? আমি তো তখন আপন বলতে কি বোঝায় সেটাই বুঝিনা। বেশ ভড়কে গেলাম, কি জবাব দেব! একটু ভেবে আবিষ্কার করলাম, আপন বলতে ওরা হয়তো বোঝাচ্ছে পর। তাই আমি বললাম- পারু আমার আপন বোন নয়, নিজ বোন। তারপর সবার হাসতে হাসতে গড়াগড়ি যাওয়ার অবস্থা।’
শৈশবের কতা মনে হতেই রাণীর সামনে যে ছবিটি ভেসে ওঠেÑ তিনি হলেন তার বাবা। বাবার আগ্রহের কারণেই তিনি ছিলেন অনেক প্রাণবন্ত। করতে পেরেছেন খেলাধুলা। বাড়িতে ছিলো টেনিস খেলার চর্চা। স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বাবা তার নাম দিয়ে আসতেন।
রাণীর খেলাধুলার ব্যপারে আগ্রহ ছিলো শিকদেরও। তারা চাইতেন সে যেনো দৌড় অব্যহত রাখে। শিকরা স্বপ্ন দেখতেন একদিন জাতীয় দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে রাণী। সেই থেকে ছোট্ট রাণীর দৌড় শুরু। এখনো চলছে। তবে অ্যথলেট হিসাবে নয়। সে দৌড় দাবার দৌড়। জাতীয় পর্যায়ের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জতিক পর্যায়ে। তিনি দাবাড়– হিসাবে আজকের রাণী হামিদ হয়ে উঠেছেন মূলত বাবার আগ্রহের কারনেই ‘বাবাই আমাকে দাবার বোর্ড কিনে দিয়েছিলেন। স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সবসময় পুরস্কার পেতাম আমি। আর এতে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন বাবা। কিন্তু মেয়েদের অ্যথলেট হতে গেলে তো কিছু সমস্যা থাকেই। সে কারণে আমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে আউটডোর খেলা থেকে কোজ করে আনতে থাকলেন বাবা। তাই অবসর সময় কাটানোর জন্য দাবা খেলার প্রতি উৎসাহ দিতেন। তবে অবশ্যই পড়ালেখার যেন তি না হয় সে ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। বাবা যখন বাড়িতে থাকতেন না, তখন ছোট ভাইকে নিয়ে দাবার বোর্ডেই মজে থাকতাম।’
বাবা সৈয়দ মমতাজ আলী ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। চাকরির কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে তাকে কাটাতে হয়েছে। আর এ কারনেই তার সন্তানদের পরিবর্তন করতে হয়েছে অনেক স্কুল। রাণীর প্রাথমিক শিা শুরু হয় চট্টগ্রাম নন্দনকানন গার্লস হাইস্কুলে। তিনি ১৯৫২ সালে সরাসরি ২য় শ্রেণীতে ভর্তি হন। তখন স্কুলের ওপরের শ্রেণীর শিার্থীরা তাকে ডেকে মিছিলে নিয়ে যেতো। কিসের মিছিল, অতশত তিনি বুঝতেন না। মিছিল হবে, ব্যস। একধরনের থ্রিলতো পাওয়া যাবে। এখন তিনি সে স্মৃতি মনে করে গর্ববোধ করেন। কারণ মিছিলগুলো ছিলো রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে।
১৯৫৪ সালে বাবা বদলি হয়ে যান কুমিল্লায়। রাণীও সেখানকার মিশনারি স্কুলে ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণি পড়েন কুমিল্লার ফয়জুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলে। তারপর বাবার বদলির কারণে আবার তাকে কুমিল্লা ছেড়ে চলে যেতে হয় রাজশাহীতে। ৮ম ও ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন রাজশাহীর একটি স্কুলে। ১০ম শ্রেণীতে পড়েন সিলেট বালিকা বিদ্যালয়ে। এ স্কুল থেকে তিনি মেট্রিক পাশ করেন ১৯৬০ সালে। পরবর্তীতে আর কলেজে ভর্তি হননি। কিন্তু ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে প্রাইভেট পরীা দিয়ে ইন্টারমিডিয়েট এবং ডিগ্রী পাস করেন। একাডেমিক পড়ালেখা তার কাছে ছিলো পানির মতো সহজ। ছাত্র-ছাত্রীরা কেন পরীায় ফেল করে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এর কোন জবাব খোঁজে পান না তিনি।

সংসার
বাংলাদেশের প্রোপটে একজন নারীর জীবনে প্রথম বাবা, তারপর স্বামী এবং সবশেষে সন্তানদের গুরুত্ব বেশি থাকে। রাণী হামিদও এেেত্র ব্যতিক্রম নন। মাত্র পনের বছর বয়সে তিনি শুরু করেন বিবাহিত জীবন। ১৯৫৯ সালে তার বিয়ে হয় সেনা কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আব্দুল হামিদের সাথে। তখন তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর একজন সাঁতারু হিসেবেও রেকর্ড করেছিলেন। আব্দুল হামিদ বহুল আলোচিত কয়েকটি বইয়েরও লেখক। এর মাঝে রয়েছে 'তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা'। এছাড়া তিনি আরো চারটি বই লিখেছেন। স্বামীর সহযোগিতায়-ই রাণীর পে এতদুর আসা সম্ভব হয়েছে ‘দাবা খেলায় আমি মনযোগ দিতে পেরেছি কেবল আমার স্বামীর কারণে। খেলার জন্য আমাকে প্রায়-ই দেশ ও দেশের বাইরে যেতে হয়েছে। এসব ব্যাপারে তিনি ছিলেন উদার। তিনি সবসময়-ই আমার বায়োডাটা আপগ্রেড রাখতেন। তাছাড়া আমাকে কখন কী করতে হবে এসব তদারকি তিনিই করতেন।’
রাণী হামিদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে ছাড়া পরিবারের সবাই খেলা-ধুলার সাথে যুক্ত। বড় ছেলে কায়সার হামিদ বাংলাদেশের একজন তারকা ফুটবলার। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলেছেন অনেক দিন। আশি ও নব্বই এর দশকে খেলতেন মোহামেডান স্পোর্টিং-এর হয়ে। কায়সার হামিদ ছিলেন সে আমলের সেরা সেন্ট্রাল ডিফেন্ডারদের একজন। দীর্ঘদিন মোহামেডানের অধিনায়ক ছিলেন। মেজ ছেলে সোহেল হামিদ স্কোয়াস ফেডারেশনের সম্পাদক ও একজন ক্রিকেটার এবং ছোট ছেলে শাহজাহান হামিদ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। মেয়ে জেবিন হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করে কিছুদিন পিআইবিতে কিছু দিন চাকরি করেছেন। বর্তমানে তিনি লেখালেখি করেন।

দাবার বোর্ডে
দাবাকে পেশা হিসাবে নেয়ার জোরালো ইচ্ছা তার কখনো ছিল না। একজন গৃহিনী হিসাবে সময় কাটানো এবং আনন্দের জন্য তিনি দাবা খেলাকেই বেছে নেন ‘আনন্দের জন্যই আমি দাবা খেলি। তাছাড়া দাবা এমন একটি খেলা, যা সব বয়সেই খেলা যায়। আমার ছেলে কায়সার হামিদ ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছে। অথচ তার মা হয়েও আমি এখনো জাতীয় দলে খেলছি। এটাওতো উপভোগ্য বিষয়। আর প্রচলিত অন্যান্য খেলাধুলার জন্য শারিরীক সমতার প্রয়োজন। কিন্তু দাবায় সেটার দরকার হয়না। এখানে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাই মূখ্য।’
দাবা খেলে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করলেও এর জন্য দৈনন্দিন জীবনের অন্য অনুষঙ্গগুলো বাদ দিতে রাজি নন তিনি। ব্যস্ত জীবনের চেয়ে ঘরের জীবন-ই তার বেশি পছন্দ। তবে কোনকিছু অর্জনের জন্য যতটুকু পেশাদারি হতে হয় ততটুকুতো রয়েছেই।
আর সেই পেশাদারিত্বটুকু পাকা হয়েছে বিয়ের পর। খেলাধুলার প্রতি তাঁর স্বামী আব্দুল হামিদের আগ্রহ ও উৎছিলো ব্যাপক। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট-এর কোয়ার্টারে থাকতেন তারা। তখন তাদের প্রতিবেশি ছিলেন জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন ডঃ আকমল হোসেন। তাঁর কাছ থেকেই শেখেন খেলার আন্তর্জাতিক নিয়ম কানুন। পরবর্তীতে ড: আকমলের সহযোগিতায়-ই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিতে থাকেন। ১৯৭৬ সালে প্রথম মহসিন দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন।
জাতীয় দাবা প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম অংশ নেন ১৯৭৭সালে। সে খেলায়-ই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যান ‘তখন আমি চার বাচ্চার মা। তখনকার অনুভূতি ছিলো খুবই আনন্দের। দৈনিক বাংলার প্রথম পৃষ্ঠায় আমার ছবি এসেছিলো। জিরো থেকে হিরো হওয়ার মতো আরকি। এরপর আমাকে আর ঠেকায় কে। পরপর ৯ বার জাতীয় পর্যায়ে খেলে প্রতিবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছি।’
১৯৮১ সালে তিনি ভারতের হায়দারাবাদে এশিয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে কৃতিত্বের স্বার রাখেন। তিনি কমনওয়েলথ এর একজন শীর্ষ দাবাড়–, আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার ও জাতীয় নারী দাবা চ্যাম্পিয়ন। তিনি এ পর্যন্ত তিনবার ব্রিটিশ নারী দাবা চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। এখন আর ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে পারেন না। কেন? এ নিয়ে রয়েছে আরেক মজার কাহিনী- ব্রিটিশ মহিলা দাবাড়–রা যখন বাংলাদেশি রাণী হামিদের কাছে বার বার পরাজিত হচ্ছিলেন, তখন বিষয়টি তাদের কাছে অপমানজনক মনে হচ্ছিলো। তারা দাবি তোললেন ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপে অন্যদেশের নারীরা খেলতে পারবে না এবং কর্তৃপ তা-ই করলো।
রাণী হামিদ দাবা অলিম্পিয়াডে যোগ্যতার ভিত্তিতে জাতীয় পুরুষ দলের হয়েও অংশ নিয়েছেন। পুরুষ দলের হয়ে খেলতে যাওয়ায় রয়েছে তার মজার অভিজ্ঞতা ‘একবার গ্রীসে খেলতে যাই পুরুষ দলের হয়ে। আমার খেলা তখনো শুরু হয়নি। অন্য অনেকেই খেলছে। ভাবলাম বাইরে গিয়ে চা খেয়ে আসি। চা খেয়ে যখন ফিরছিলাম, তখনি বাঁধলো গন্ডগোল। নিরাপত্তারীরা কিছুতেই আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না। ওরা বার বার বলছে, মহিলা দলের খেলা ওদিকে হচ্ছে এখানে নয়। কিছুতেই বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না যে, আমি পুরুষ দলের হয়ে খেলছি। তার ওপর আরো সমস্যা হলো, ওরা ইংরেজি ভাষা বোঝে না। ভেতরে ঢুকতে দেবে না তো দেবেই না। তারপর অনেক ঝক্কি-ঝামেলা করে ঢুকতে পেরেছিলাম।’
বাংলাদেশের যে মানুষটির কাছে দাবা পরিচিত, তার কাছে রাণী হামিদ নামটিও পরিচিত। শুধু দেশে কেন, দেশের সীমানা ছাড়িয়েও তার রয়েছে অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী ‘একবারের ঘটনা। ২০১০ সালে গ্রীসে গিয়েছিলাম খেলতে। বাসে করে এক যায়গা থেকে অন্য যায়গায় যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি রাস্তার মাঝখানে বাস থেমে গেছে। আরে কী কান্ড! তাকিয়ে দেখি বাস চালক সিটে নেই। কোথায় যেনো উধাও হয়ে গেছেন। কিছুন পর চালককে আবিষ্কার করলাম আমার সামনে। হাতে একতোড়া ফুল। আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছেন। আমি তো হতভম্ব! এই লোক আমাকে চিনল কি করে!’

সময় কাটে
রাণী হামিদ তার জীবনকে তিনভাগে ভাগ করেন- বাল্যকাল, মাধ্যবয়স এবং সর্বশেষ বৃদ্ধ বয়স। এ তিনভাগকে তিনি তিন রকম করে উপভোগ করেছেন। তিনটি ভাগই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের দিকে তাকালে যখন সন্তানের মা হলেন সে সময়টাকে তিনি গুরুত্ব দেন। আবার দাবা খেলার দিকে তাকালে এ বয়সটাকে গুরুত্ব দেন। তিনি মনে করেন মানুষের জীবনের কোন সময়-ই গুরুত্বহীন নয়।
দাবার বোর্ডে তিনি প্রতিপরে মন্ত্রী- সেপাই ধ্বংসের নীলনকশা করে গেলেও তার জীবনের উপলব্ধি ‘যুদ্ধ নয় শান্তি। সুখে থাকো, শান্তিতে থাকো। মানুষকে কষ্ট দিয়ো না। পারলে উপকার করো। না পারলে কারো অপকার করো না।’
খাওয়া, ঘুম আর টিভি দেখেই বেশিরভাগ সময় কাটে তার। তিনি মনে করেন স্বামী জীবিত না থাকলে মহিলাদের তেমন কোন দায়িত্ব থাকে না। তিনিও এখন দায়িত্বমুক্ত। সারাদিন নাতি-নাতনীদেরকে নিয়ে হই-চই করে কাটিয়ে দেন ‘এখন নাতিরাই আমার সঙ্গি। এই যে এখানে দেখছ তিনজনকে, (ড্রয়িংরুমে উপস্থিত নাতিদের দেখিয়ে) লম্বাটা হলো সাদাত, ওটা আয়মান। আর এটা হলো মোস্তফা। আমি ডাকি সনু, মনু, মস্তু। নামগুলো লিখে দিয়ো কিন্তু। সনুকে আমি দাবাড়– বানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রথমেই একটি ভুল করে ফেলেছি। বড় একটি টুর্নামেন্টে খেলতে পাঠিয়েছিলাম। সেখান থেকে হেরে এসে দাবার প্রতি ভীতি তৈরি হয়েছে ওর। তারপর আর ইনডোর খেলার প্রতি আগ্রহ নেই। বাপের মতো (কায়সার হামিদের) ফুটবল খেলার নেশা।’

অত:পর
আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত এক মাত্র বাংলাদেশী মহিলা দাবাড়– রাণী হামিদ তার সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় সাপোর্ট পাননি সরকারের কাছ থেকে ‘বাংলাদেশে দাবা খেলার পৃষ্ঠপোষকতা নেই। একটি পর্যায়ের পর খেলোয়ারদের বড় ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। যার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সাপোর্ট আমরা পাই না। নিয়মিত টুর্নামেন্ট খেলার জন্য স্পন্সর যোগার করাও এদেশে দুস্কর। দাবাতে স্পন্সররা বেশি আগ্রহী হন না। কারণ মিডিয়া এ খেলাটি সেভাবে প্রচার করে না। দাবার চলতি খবরগলো গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় না। ফলে মানুষও জানে না বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কে হচ্ছে। অন্যান্য খেলার মতো দাবার বড় বড় টুর্নামেন্টগুলোর খবর পত্রিকায় আসা উচিত।’

অত:পর রাণী হামিদের ডায়েরির পাতা প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। ঠিক তখনি হাস্যবদনে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলেন তার বড় ছেলে কায়সার হামিদ। যথারীতি কুশলাদী বিনিময় এবং ফটো সেশন। অবশ্যই মায়ের সাথে।

ছবিগুলো তুলেছেন ইমশিয়াত শরীফ

এক টুকরো রাণী হামিদ

পুরো নাম: সৈয়দা জসিমুন্নেসা খাতুন
জন্ম: ১৯৪৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি
ববা: সৈয়দ মমতাজ আলী (পুলিশ কর্মকর্তা)
মা: মোসাম্মাত্“ন্নেসা খাতুন
ভাই-বোন: সৈয়দ আমীর আলী (অবসরপ্রাপ্ত এসপি), এয়ার কমান্ডার শমসের আলী, সৈয়দ দেলোয়ার আলী, সৈয়দ মোতাহের আলী, জমীরুন্নেসা খাতুন (পারু), সৈয়দা লুত্ন্নেসা খাতুন, মিনু মমতাজ।
বিয়ে: ১৫ বছর বয়সে ১৯৫৯ সালে
স্বামী: মোহাম্মাদ আব্দুল হামিদ (সাবেক সেনা কর্মকর্তা)
সন্তান: কায়সার হামিদ (ফুটবলার), সোহেল হামিদ (স্কোয়াস ফেডারেশনের সম্পাদক), শাহজাহান হামিদ (টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার), জেবিন হামিদ (লেখক)।
শিাগত যোগ্যতা: ডিগ্রি
প্রকাশিত বই: মজার খেলা দাবা, দাবা খেলার আইন কানুন।