রবিবার, জুলাই ১৮, ২০১০

মন্তাজ চাচার কথাই ঠিক

দক্ষিণ দিক থেকে সরু ঢেউ অলস খেলতে খেলতে ভীরছে ঘায়েলে (ভাঙন থেকে বসতভিটা রক্ষার জন্য কচুরিপানা আর খড়ের স্তর)। মৃদু বাতাসের ঠেলায় ঘায়েল ঘেষে কোণঠাসা হয়ে আছে কচুরিপানা, শ্যাওলা-ঝাউলা। এমনভাবে স্থির হয়ে আছে যেন পানির উপর তৈরি করেছে সবুজাভ সর। এ সবুজ সরকেই কেটে কোটে ঠেলা জাল ঠেলছে সবুজ। আর ডাঙায় ডোলা হাতে দাঁড়িয়ে ময়না। সবুজের একেকটি খেউয়ে জাল ভর্তি হয়ে উঠছে শ্যাওলা আর শ্যাওলা। তারপর এগুলো ঝেড়ে ফেলে চিংড়ির খনি আবিষ্কার করার দায়িত্ব ময়নার উপরই। শ্যাওলার ভাঁজ খুলে খুলে একটা-দুটো চিংড়ি ডোলায় ভরতে ভরতেই জালের টোনায় ঝিলিক দিয়ে উঠে ছিট পারতে থাকা এদলা চিংড়ি। এতক্ষনে ডোলা প্রায় অর্ধেক হয়ে এসেছে। আর কয়েকটি খেউ দিয়েই আজকের মতো ক্ষান্ত হবে, ভাবছিলো সবুজ। কিন্তু উঠাৎ উদয় হওয়া কোষা নৌকাটিই ঘটালো যতো বিপত্তি। বলা নেই কওয়া নেই, নি:শব্দে ভেসে এসেছে ঠিক সবুজের পাশেই। পানিতে বৈঠা ফেলার শব্দটি পর্যন্ত তার কানে আসেনি। চরম বিরক্ত হয়েই তাকালো কোষার মাঝির দিকে। তারপর ভ্যাবাচেকা খেলো। মাথা নুইয়ে নিলো সসম্মানে, বৈঠা হাতে বসে আছে স্বয়ং মন্তাজ উদ্দিন!
- কি সবুজ মিয়া, পড়ালেহা থুইয়া দেহি জাল ঠেলায় মনযোগ দিছস! কিশোরগঞ্জেত্তে কবে আইলি?
- পরশুদিন আইছি পুতু (চাচা)
- কলেজ বন্ধ নাকি?
- না বন্ধ না। এইচএসসি পরীক্ষার রিজাল্ট দিছে ত-অ, এর লাইগ্যা কয়দিন ডিলাডালা কাস অইতাছে।
- তরার কলেজের রিজাল্ট কিমুন অইছে?
- বালাই। জিপিএ পাঁচ পাইছে আঠারজন। দুইডা ছেরা খালি ফেইল করছে।
জাল ঠেলা বন্ধ হয়ে গেলো বলে উদ্দম্যে ভাটা পরেছে ময়নার। খানিকটা বিরক্ত হয়ে তাকালো মন্তাজ চাচার দিকে। কিন্তু তার বিরক্তিতে কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই দেখে আশাহত হলো সে। এমনিতেই বার বার ডাঙায় উঠে যেতে চাচ্ছিলো সবুজ ভাই, এখনতো আর কথাই নেই। যা ধারণা করেছিলো ঠিক তাই। পরিষ্কার পানিতে এপাশ-ওপাশ করে জাল ধুয়ে নিতে দেখলো সে। অর্থাৎ আজকের মতো মাছ ধরা এখানেই সমাপ্ত। বাধ্য হয়ে কাঠখোট্টা আলাপচারিতায় মনযোগ দিলো ময়না।
- আমার ত-অ খালি ডর করতাছে পুতু। আমরার মত গরিবের বালা রিজাল্ট কইরা কোন দাম নাই।
- আরে ডরের কি আছে বেক্কল। মনযোগ দিয়া পর, বালা রিজাল্ট কর।
- কি অইব বালা রিজাল্ট কইরা। এইবার দেহ সারা দেশ-অ আটাইশ হাজার ছয়শ’ একাত্তর জন জিপিএ পাঁচ পাইছে। এরার মইদ্যে কয়জন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি অইতে পারব? টেহাওয়ালারার লাইগ্যাতো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছেই। কিন্তু আমরা যায়াম কই?
- কতা তুই মন্দ কইছসনা। আমরার দেশে আছে খালি যত আউলা নিয়ম। এইযে পুলাপাইনগুলা পাস কইরা বাইর অইতাছে, এরা কই ভর্তি অইব, কি পড়ব, এরার ভবিষ্যৎ কি এইসব লইয়া সরকারের বিন্দু মাত্র চিন্তা নাই।
- এর লাইগ্যাইতো মাজে মইদ্যে পড়ালেহা ছাইরা দিতে ইচ্ছা অয় পুতু।
- আরে ধুরু, তুই খালি অলক্ষির মত কতা কছ। সমস্যা অনেক থাকব, হের লাইগ্যা কি ঘরে বইয়া থাহুন লাগব! মনে রাহিস উপরে আল্লাহ আছে। বালা কইরা পড়ালেহা কর, এইসএসসিতেও জিপিএ পাঁচ পাইয়া গেরামের মুখ উজ্জ্বল কর।
কি-সব জিপিএ পাঁচ-টাচ নিয়ে যে ওরা কথা বলে, একদম ভালো লাগেনা ময়নার। জিপিএ পাঁচ, এ প্লাস এসব শব্দ প্রায়ই কানে আসে ওর, কিন্তু কোন কিছুর অর্থ উদ্ধার করতে পারেনি। তার কাছে সোজা হিসাব, পাস-ফেল। অবশ্য গত এসএসসি পরীক্ষায় রেজাল্টের ব্যাপারটা ছিলো ভিন্ন। তখন সবুজ ভাই জিপিএ পাঁচ পেয়েছিলো, আর সারা গ্রামের মানুষের সেকি আনন্দ! আনন্দ হয়েছিলো তারও। সেই থেকে সে বুঝে গেছে জিপিএ পাঁচ হলো ভালো ফলাফল। কিন্তু সবুজ ভাইয়ের ভাল ফলাফল সত্ত্বেও তখন ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলো শাহজাহান আলী, সারা দেশে নাকি এত ছাত্র জিপিএ পাঁচ পেয়েছিলো যে তাদের ভিড়ে খেটে খাওয়া সবুজ ভাইয়ের কোন স্থানই হবেনা। শাহজাহান আলী বলেছিলো লেখাপড়া নাকি পয়সা ছাড়া হয়-ইনা। কই লেখাপড়াতো বন্ধ হয়ে যায়নি তার! কিশোরগঞ্জ শহরে লজিং থেকে, টিউশনি করে ঠিকঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে সবুজ ভাই। আসলে মন্তাজ চাচার কথাই ঠিক, উপরে আল্লাহ আছে।
- কিরে ময়না, মাছ কিমুন পাইলি?
জবাবের অপেক্ষা না করেই মারছার (পাটাতনের) নিচে বৈঠাটা চালান করে দিলো মন্তাজ উদ্দিন। তারপর এক লাফে নেমে এলো ডাঙায়। আমগাছের শেকড়ের সাথে কোষাটা বেঁধে ঢোঁ মারলো ডোলার ভেতর। তারপর সবুজের সাথে কথা বলতে বলতে হাটা ধরলো গোপাট (মেঠো পথ) ধরে। ঠেলা জালটা কাঁধে তুলে পেছন পেছন এগুলো সবুজ, গা থেকে নিংড়ে ঝরছে পানি। চিংড়ির ডোলা হাতে পা বাড়ালো ময়নাও, হাওরের জলে কোণঠাসা সবুজ রঙের শ্যাওলা-ঝাউলা পেছনে রেখে এগিয়ে চললো সবুজ এবং মন্তাজ উদ্দিনকে অনুসরণ করে।
১৮ জুলাই ২০১০

কোন মন্তব্য নেই: