রবিবার, মে ৩০, ২০১০

মুসা ইব্রাহিম নামের লোকটি

এই তো সবুজ আইয়া পড়ছে।
বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো একজন। যেন তোতা মিয়ার দোকানের এই জটলাটা তার অপেক্ষাতেই ছিল। অনেকগুলো চোখের কৌতূহলি দৃষ্টিতে বিব্রত হলো সবুজ। এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে পাস করার পর লোকজনের কাছে কদর একটু বেশি-ই পাচ্ছে সে। মাঝে মাঝেই এ নিয়ে লজ্জায় পড়তে হয়। কী করবে বুঝতে পারল না সে, এমন সময় ভিড়ের মধ্য থেকে অন্য একজন হাঁক ছাড়ল...
-আরে, আগে বইতে দে সবুজরে।
চট করে একজন উঠে গিয়ে খালি করে দিলো বেঞ্চির একটা অংশ। সামান্য ইতস্তত করে মধ্যমণি হয়ে বসল সে। দোকানের সামনের পুরো জটলাটা ঘিরে ধরল তাকে। সবাই উৎসাহী। কারণ ওরা ভীষণ উদগ্রীব হয়ে আছে মুসা ইব্রাহিমকে নিয়ে।
ব্যস্ত হয়ে চা তৈরি করতে করতে তোতা মিয়া জিজ্ঞেস করল...
-মুসা ইব্রাহিম দেশে আইব কবে, এমুন কিছু লিখছে-টিকছে নাকি পত্রিকাত?
জবাবটা ভালো করে শুনবে বলে চোখ দুটো কচলে নিলো ময়না।
-কয়েক দিনের মইধ্যেই আইয়া পড়ব।
সবুজ ভাইয়ের জবাব শেষ হতে না হতেই প্রশ্ন করল অন্যজন
-হিমালয় উঁচা (উঁচু) কতখানি?
-এই ধরুইন, আপনের আমার মতো পাঁচ হাজার মানুষও যদি একজনের মাথার উপরে আরেকজন উইট্টা খাড়ই তবুও হিমালয়ের আগা (চূড়া) লাগুইল পাওন যাইত না (স্পর্শ করা যাবে না)।
-আরেব্বাইসরে, ছেড়ার বুকের পাটা দেখছনি, কত উপরে গিয়া উটছে!
বলল মুরব্বি গোছের একজন, তারপর ফুড়ুৎ করে কাপে চুমুক বসিয়ে ধীরে ধীরে মাথা তুলল অন্যজন।
-আমরার দেশের মাইনষের বুকের পাটা, চেষ্টা, বুদ্ধি-সুদ্ধি সব আছে। কিন্তু পথ দেহানোর মত মানুষ নাই। এই মুসা কত কষ্ট-মষ্ট কইরাই না টেহা জোগার করল হিমালয়ের আগায় উঠনের লাইগ্যা। সরকার কি কিছু সহযোগিতা করতে পারত না তারে? আছে ত খালি দুর্নীতি কইরা প্যাট মোটা করনের ধান্দায়।
অন্য একজন খেদ ঝাড়ল।
-আর সহযোগিতা! এসব কথা কইয়া কোনো লাভ নাই। জগতের নিয়মডাই এমুন। আমরার সবুজের কথাই ধর, সারা দিন ক্ষেতে কাম কইরা, খাইয়া না খাইয়া থাইক্কা এমুনভাবে মেট্রিক পাস করল যে অহন দশ গেরামে আমরা মাথা উঁচা কইরা কথা কইতে পারি। কিন্তু পরীক্ষার আগে ক্ষেতে কাম করার সময় কয়জন খোঁজ লইছিলা যে সবুজ কয় বেলা খাইছে কী খাইছে না?
-হ, একবারে খাঁটি কথা কইছ। অহন সবুজরে লইয়া আমরাই তো নাচানাচি করি।
তারপর একসাথে কথা বলতে শুরু করল সবাই। সৃষ্টি হলো শোরগোল। তবে এ জটলার সব কথা ঘুরপাক খেতে থাকল মুসা ইব্রাহিম আর সবুজকে ঘিরে।
পরিচিত মানুষদের উল্লাস, কাপে ফুড়–ৎ-ফাড়–ৎ চুমুকের শব্দ আর জটলা থেকে কুণ্ডলি পাকিয়ে উপরে উঠতে থাকা বিড়ির ধোঁয়া পর্যবেক্ষণ করতে করতে অ™ভূত এক ভালোলাগায় ডুবে গেল ময়না। পাহাড়ের উপরে উঠে দেশের জন্য কী সুনাম অর্জন করা যায়, তা স্পষ্ট না হলেও মুসা ইব্রাহিম নামের লোকটি যে কিছু একটা অর্জন করেছে এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত।

মঙ্গলবার, মে ২৫, ২০১০

লেহাপড়া করতে পইসা লাগে

শাহজাহান আলী লোকটা ভালো কি মন্দ এ সম্পর্কে ময়নার তেমন ধারণা নেই। তবে লোকমুখে শুনেছে তার বাবা রাশিদ মেম্বার নাকি নিজ হাতে তিন তিনটা ডাকাত জবাই করেছিল। সঙ্গত কারণেই শাহজাহান আলীকে সমীহ করে চলা প্রয়োজন। অনেকে করেনও। তবে ময়নার কাছে সমীহ পাওয়ার যোগ্য সে নয়। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কি কারণে? কোন সদুত্তর দিতে পারবেনা সে। লোকটাকে ভালো লাগেনা, ব্যস। কিভাবে আর ভালো লাগবে! দোকানের বেঞ্চিটায় বসে আছে ঘন্টাখানেক হলো। এর মধ্যে এক কাপ চা-ই কেবল খেয়েছে। আর সদ্য মেট্টিক পাশ করা সবুজ ভাইকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে ঝাঁজরা করে দিচ্ছে।
বাবা দোকানে নেই। বেচাকেনা সামাল দিতে হচ্ছে ময়নাকে একাই। এটা দাও ওটা দাও। এমনিতেই মেজাজ টঙ হয়ে আছে। তার উপর এতক্ষন ধরে একটা লোক বেঞ্চি দখল করে থাকলে কার সহ্য হয়। শুধু বসে থাকলেও হতো, একেবারে পা তুলে দিয়ে আরাম করে পরীক্ষা নিচ্ছে সবুজ ভাইয়ের। শহরে ভর্তি হতে গেলে নাকি অনেক কিছু জানা থাকতে হয়।
- আচ্ছা বলতো আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলো কে?
হঠাৎ-ই বইয়ের ভাষা (শুদ্ধ ভাষা) শুনে কৌতুহল হল ময়নার। অবশ্য শাহজাহান আলীর মুখে এমন ভাষা আজই প্রথম শোনা গেছে তা নয়। পর পর ছয় বার মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে না পারলেও শিক্ষিত ও নেতৃত্বের গুণাবলীসম্মন্ন লোক হিসাবে এলাকায় যথেস্ট যশ রয়েছে তার। সে হিসাবে মাঝে মাঝে বইয়ের ভাষায় কথা বলা দায়িত্বের আওতায় পরে।
প্রশ্ন করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জবাব দিয়ে দিলো সবুজ ভাই। কি বলেছে সঠিক বুঝতে না পারলেও ‘কলাম বাঁশ’ ধরনের একটা শব্দ ময়নার কানে এলো। এমন বাঁশের নাম সে জীবনে শোনেনি।
আগ্রহ হারিয়ে গেলো ময়নার। মনযোগ দিলো কেটলির দিকে। জ্বালানি পেয়ে উসকে উঠল চুলার আগুন। সেই সাথে উথলে উঠল সবুজ ভাইয়ের প্রতি তার দরদ। আহা, বেচারা কত কষ্ট করেইনা লেখাপড়া করেছে। রোদে-বানে সারাদিন ক্ষেতে কামলা খেটেছে। তারপর শ্রান্ত শরীর নিয়ে রাতে কোথায় ঘুমাতে যাবে তা নয়, বই নিয়ে বসেছে নুমানদের বাংলা ঘরে। নিজের বাড়িতে কুপি জ্বালানোর সাধ্য না থাকলেও হারিকেনের আলোতে নুমানকে পড়াতে পড়াতে নিজের পড়াটাও চালিয়ে গেছে। নুমানের বাবা-ইতো বইপত্র কিনে দিলো তাকে।
- এই ছেরা, চাকরি করবিনাতো কি করবি? তোর বাপের কি পইসা আছে? কলেজে লেহাপড়া করতে পইসা লাগে, পইসা।
শাহজাহান আলীর উচ্চবাচ্চে ধ্যান ভাঙল ময়নার। লক্ষ্য করল একেবারেই চুপসে গেছে সবুজ ভাই। মাথা নুইয়ে এমনভাবে বসে আছে যেন একশ’একটা খুনের আসামি।
- জ্ঞানবুদ্ধি-ত দেখলাম বালাই আছে। তো সহজ কথা সহজে বুঝসনা কেরে (কেন)! জিপিএ পাঁচ কি তুই একলাই পাইছস ? সারা দেশে এমুন রেজাল্ট করছে বহুত পোলাপান। এরার (এদের) ভীরের মইদ্যে তর মত সবুজের কোন পাত্তা থাাকবোরে?
সবুজ ভাইয়ের শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝড়ছে, লক্ষ্য করল ময়না।
- তর বাপেরে ক’ কিছু টেহা যোগার করতে, দেহি পুলিশের চাকরিতে ঢোকায়া দেয়ন যায় কিনা।
বলতে বলতে পাঞ্জাবির হাতা দুটো ভাঁজ করে নিল শাহজাহান আলী। উঠে দাঁড়ালো এবং জবাবের আশায় শেষবারের মত তাকালো সবুজের দিকে। তারপর আশাহত হয়ে পা বাড়ালো বাড়ির পথে।

সোমবার, মে ১৭, ২০১০

আগুন বেয়ে পড়ছে

‘.... ডুক্কু ডুক্কু লাই/পাতা কাটা যাই/পাতার ঝুম ঝুম/বেহালা বাজাই/বেহালার তরে/মৌমাছি ঘুরে/মৌমাছি ঘুরে...হ’
এই দম ছাইড়া দিছে, দম ছাইড়া দিছে, ময়না বুবু দম ছাইড়া দিছে। বলতে বলতে ময়নার গা ছুঁয়ে দিলো একজন। অর্থাৎ ময়না তখন মরা (খেলায় নিষ্ক্রিয়)।
ভ্যাপসা গরমে আমগাছের ছায়ায় বৌচি খেলছে এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে। মাথার ওপর ছায়া আছে বটে, বাতাসের নামগন্ধ নেই। ভাটার মতো জ্বলছে সূর্য। চোখ তুলে তাকানো যায় না। এদকি-ওদিকের স্পষ্ট রশ্মিগুলোতে উড়ন্ত ধুলোর চিক চিক। খড়ের নতুন পুঞ্জি আর রোদে শুকাতে দেয়া ন্যাড়ার ভাপ আরো চিটচিটে করে তুলছে শরীর। সেই চিটচিটে শরীর নিয়েই লুটোপুটি খাচ্ছে ওরা। দৌড়ে বেড়াচ্ছে পুরো মাঠ।
খেলায় মরে যাওয়ার পর অনেকটা হতাশ হয়েই আমগাছের শেকড়ে এসে বসেছে ময়না। পর্যবেক্ষণ করছে অন্যদের খেলা। সেই সাথে কামনা করছে নিজের দলের বিজয়। ভ্যাপসা গরমে ঘাম তো নয়, যেন আগুন বেয়ে পড়ছে শরীর থেকে।
গাছের শেকড়গুলো প ুরুষ্ট, আর বসার জন্যও বেশ। মনো হলো যেন রাজার সিংহাসনে বসে আছে সে। এখন একটু ফুরফুরে বাতাস এলেই ষোলকলা পূর্ণ হয়। ওপরের দিকে তাকায় ময়না। নাহ, গাছের একটি পাতারও নড়াচড়া নেই। ডাঁসা ডাঁসা আমগুরো জুলে আছে নির্জীব। কয়েকটি পেকে হলদেটে রযও ধরেছ্ েইস, একট া আম যদি খাওয়া যেত। একবার ইচ্ছে হলো ঢিল ছুঁড়ে...। পরক্ষণেই মনে হলো মন্তাজ চাচার কথা। বাতাসে ঝরা আম কুড়িয়ে নিতে কখনো বাধা নেই চাচার। কিন্তু গাছে ঢিল পড়েছে তো সেরেছে।
- ময়না বুবু, লও গাঙের পানিতে যাই।
হঠাৎ লক্ষ করল ছেলেমেয়ের দঙ্গল তাকে ঘিরে দঁইড়য়ে আছে। আমের তেষ্টায় বিভোর হয়ে ওঠায় কখন যে খেলার গোল্লা উঠে গেল, খেয়ালই করল না সে।
- গাঙে জুয়াইরা (নতুন) পানি আইছে, অহন ডুবাইলে (দাপাদাপি করলে) জ্বর আইব।
ময়নার কথাতে মোটেই নিরুৎসাহিত হলো না ছেলেমেয়েরা।
- শইল জুড়াইয়া পানিতে নামলে কিচ্ছু অইত না।
- আইচ্ছা অহন বইয়া থাক, আগে জিরাইয়া লই, পরে গাঙে যায়াম (যাবো)।
ময়নার এক কথাতেই শেকড় ঘিরে বসে পড়ল প ুরো দঙ্গল। শরীরের ঘাম ঝেড়ে ফেলতে ফে লতে ভাঙা কণ্ঠে গান ধরল একজন- ‘আল্লা মেঘ দে/পানি দে/ছায়া দে রে তুই/আল্লা মেঘ দে।’ এতট ুকু বলতেই ধমকে উঠল ময়না।
- অইছে হুনছি। গাছের ছেমাত (ছায়ায়) বইয়া থাইক্কা আল্লার কাছে ছেমা চাস। আর গাঙের প ানি আইয়া ক্ষেতের (জমির) ফসল সব তলাইয়া দিলো, তার পরেও পানি চাস।
লজ্জায় গানের গলা ক্ষীণ হয়ে এলো ছেলেটার। তারপ র একেবারে থেমে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপই কাটল ওদের। এক সময় ময়না আবিষ্কার করল সবার দৃষ্টিই গাছে ঝুলে থাকা আমের প্রতি।
- আম খাইবি? খাইতে চাইলে আল্লার কাছে রোদন কর তুফানের (ঝড়ের) লাইগ্যা। বৈশাখ মাস চইল্যা গেল, অহন-অ বৈশাইজ্ঞা তুফান (বৈশাখী ঝড়) আইল না।
তারপর ময়না নিজেই সুর তুলল- ‘আল্লা তুফান দে/তুফান দে...রে.../আল্লা তুফান দে.... স থে সাথে একই কথার কোরাস ধরল সবাই।
হইচই শুনে মন্তাজ চাচা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ধীরে ধীরে এসে বসল ্ ামগাছের শেকড়টায়। ঠিক ময়নার পাশেই।
- দোয়া কর, বালা কইরা দোয়া কর। তরার (তোদের) দোয়া কবুল অইব।
তার কথা শুনে আরো উৎসাহিত হলো ছেলেমেয়ারা। গাইতে গাইতে মন্তাজ চাচাকেও ইঙ্গিত করল ধুয়া তুলতে।
- বুইড়া মাইনষের দোয়া কি আল্লায় হুনব? আমার পাপের কারণে বৈশাখ মাসের তুফান আর বৈশাখে অয় না, ধান দাওয়ার (কাটার) আগে ধানি জমি পানিতে তলায়। আমরা পৃথিবীর হিসাব-কিতাব বদলাইয়া দিছি। আমরা বাড়াইয়া দিছি পৃথিবীর তাপ। মাথার ওপর অহন গনগনে তাপে সূর্য জ্বলে। পর্বতের বরফ গইলা ডুইবা যাইতাছে পৃথিবী।
শিহরিত হয়ে উঠল ময়না। থেমে গেল কোরাস। পৃথিবী আবার ডুবে যায় কিভাবে!
- তুমি এই সব কী কইতাছ পুতু? মানুষরা কি পৃথিবীর তাপ বাড়াইতে পারে?
- পারে, পারে। প্রকৃতির নিজের একটা নিয়ম আছে। আমরা প্রকৃতিরে দূষিত কইরা তুলতাছি। এর াকরণে নিয়মের লগে তাল রাখতে পারতাছে না প্রকৃতি। দেখস না বৈশাখে অহন ঝড় অয় না, কিন্তু যহন অয় তহন সিডর অইয়া লন্ডভন্ড করে মানুষের প্রাণ। কামের সময় গাঙে পানি থাহে না, কিন্তু যহন থাহে বন্যায় ভাসাইয়া নেয় ভিটা। এইগুলো অইল প্রকৃতির প্রতিশোধ। অহন তুফানের লাইগ্যা আরো বেশি কইরা রোদন কর আল্লার কাছে। তুফান আইলে তরাও আম খাইতে পারব্ িআর পৃথিবী কিছুটা অইলেও আপন গতি ফিইরা পাইব।
এতটুকু বলে থেমে গেল মন্তাজ চাচা। হঠাৎই ছন্দপতন হওয়ায় একট ু নড়েচড়ে বসল সবাই। তারপর আবার সুর তুলল ময়না- ‘আল্লা তুফান দে/তুফান দে...রে.../আল্লা তুফান দে....’ সাথে ধুয়া তুলল মন্তাজ চাচাসহ এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে।

সোমবার, মে ১০, ২০১০

হুঁশিয়ার সাবধান খবরদার


গাঙ পারের হিজল গাছটায় বসে সেই কখন থেকে ডাকছে পেঁচাটা। একবার ‘মীমম’ ধরনের ভয়ঙ্কর শব্দ তুলে, তারপর কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার। ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ ঝিমমম লহরিতে ছেদ ঘটাচ্ছে শেয়ালের হাঁক। সব মিলিয়ে যেন প্রকৃতির এক ভুতুড়ে ঐকতান। সে ঐকতানের ছন্দ ভেঙে তীক্ষ্ম আওয়াজ তুলছে চৌকিদারের বাঁশি। থেকে থেকে ভেসে আসছে চিৎকার, হুঁশিয়ার-সাবধান-খবরদার। রাত যত গভীর হচ্ছে রহস্যধ্বনিও তত স্পষ্ট হয়ে আঘাত করছে ময়নার কানে। সেই সাথে আতঙ্ক ছড়িয়ে অবস করে দিচ্ছে তাকে। শিরশির করে উঠছে শরীর। শঙ্কিত হয়ে ভাবছে সে চৌকিদারের সাহসের কথা। একেকবার বাঁশির আওয়াজ কানে আসছে আর চৌকিদারের স্থলে নিজেকে ভেবে মেরুদণ্ড ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে তার।
গভীর রাতে জিন-ভুতের বিচরণ থাকে অবাধ। ঘরের বাইরে তো বটেই এমনকি ভেতরে এসেও মানুষের উৎপাত করতে ছাড়ে না এরা। কিন্তু কি তাজ্জব ব্যাপার, এই চৌকিদার হুঁশিয়ার সাবধান বলে বলে মধ্যরাতে পাহারা দিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো গ্রাম! ভাবতেই অবাক লাগছে ময়নার। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেও চোখের পাতা এক করতে পারছে না মোটেই। ময়নার ছটফটানিতে ঘুম ভেঙে গেল পাশে শুয়ে থাকা দাদীরও
- ও ময়না, ময়নারে। নড়াচড়া করতাছস কেরে?
- আমার ডর করতাছে খুব।
আতঙ্কিত হয়ে উঠে দাদী। ঘুমের জড়তা কাটিয়ে ধরমড়িয়ে ওঠে বসে চৌকির ওপর। তারপর নাতনীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে অস্বাভাবিক কিছু না দেখে অভয় দিয়ে বলে
- আরে ডর কিয়ের, আমি তো আছি লগে।
- অই চৌকিদারের লাগি ডর লাগতাছে আমার। মাইজ রাইতে (মধ্যরাতে) একলা একলা গেরাম পর (পাহারা) দিয়া বেড়ায়। যদি জিন-ভুতে পায়?
কোনো জবাব বেরোলনা দাদীর মুখ থেকে। এক পশলা ভয় মেশানো বাতাসের ধাক্কায় ধপ করে শব্দ তুলল টিনের জানালার পাল্লায়। সেই সাথে ধপ করে কেঁপে উঠে দাদীর ভেতরটাও। পরক্ষণেই দূর থেকে অস্পষ্ট ভেসে আসে চৌকিদারের হাঁক, হুঁশিয়ার-সাবধান-খবরদার। সাথে সাথেই যেন হুঁশিয়ার হয়ে যায় দাদী। তারপর ময়নাকে আশ্বস্ত করার জন্য বলে
- জিন-ভুতের চৌদ্দ গোষ্ঠীর সাধ্যি নাই যে চৌকিদারের কোনো ক্ষতি করে।
- ভুতেরা কি চৌকিদারগরে ডরায়?
- না ডরাইলে কি এত রাইত যাইগা এরা গেরাম পর দেয়? খালি এই চৌকিদারগরেই না, সরকারি পোশাক পরইন্যা (পরিহিত) হগল সান্ত্রী, সেপাই, পুলিশগরে তারা (জিন-ভুতেরা) ডরায়।
- ও আইচ্ছা, ভুতেরাও বুঝি সরকার আর সরকারি পোশাকরে মাইন্য কইরা চলে?
জবাবে ছোট্ট করে ‘হু’ বলে আবার শুয়ে পরে দাদী। ময়নাকেও বালিশের ওপর টেনে দিয়ে হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়। মিনিটখানেক পর চোখ জড়িয়ে আসায় থেমে যায় দাদীর সঞ্চালনরত হাত। কিন্তু তখনো কৌতূহল থামেনা ময়নার। জানার আরো বিষয় ছিল তার। মন্তাজ পুতু (চাচা) যে সেদিন বলল ঢাকায় নাকি দু’জন পুলিশ খুন হয়েছে। দাদী জেগে থাকলে জিজ্ঞেস করত এদের খুনি কারা? ভেবে অবাক হচ্ছে ময়না। মানুষ ভয় পায় জিন-ভুতদের। আর তারা ভয় পায় পুলিশদের। যাকে ভুতেরা পর্যন্ত ভয় পায় তাকে খুন করা কিভাবে সম্ভব? তাহলে কি সরকারের চেয়েও এই খুনিদের ক্ষমতা অনেক বেশি?