সোমবার, নভেম্বর ২৯, ২০১০

পাখিরা আত্মহত্যা করে যেখানে



শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
নিকষ অন্ধকার। টিপটিপে বৃষ্টি। সেই সাথে গাঢ় কুয়াশা। আর মৃদু বাতাসের প্রবাহ শুরু হলেই ঘটতে থাকে ঘটনাটা। অর্থাৎ সন্ধ্যা ৭ টা থেকেই পাখিগুলো ব্যস্ত হয়ে যায় আগুনে ঝাপ দিতে। উদ্দেশ্য আত্মহত্যা!
হ্যা, পাখিরা আগুনে ঝাপিয়ে আত্মহত্যা করে জাটিঙ্গা গ্রামে। আর গ্রামের নামেই নাম এ পাখিদের ‘জাটিঙ্গা’। ভারতের আসাম রাজ্যের গৌহাটি থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে উত্তর কাছাড় জেলার একটি গ্রাম এটি, হাফলং থেকে ৯ কি.মি. দক্ষিনে। প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্য আর পাখি রহস্যের কারণেই আসামের এ গ্রাম সারা বিশ্বে পরিচিত। এখানে মৌসুমী মাসগুলোর শেষের দিকে শুরু হয় পাখিদের আত্মহত্যার হিড়িক। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত।
অমাবস্যার রাত, টিপটিপে বৃষ্টি, গাঢ় কুয়াশা আর বাতাসের প্রবাহ এ কয়টির সমন্বয় ঘটলেই আলোর উৎসের দিকে ছুটে যাওয়া এদের অভ্যাস। জাটিঙ্গার লোকজনের এতে বেশ সুবিধাই হয়েছে। তাদের মাংসের প্রয়োজন হলে রাতে আগুন জ্বেলে বসে। ব্যস, পাখিগুলো ডানা ঝাপটিয়ে আসতে থাকে আত্মাহুতি দিতে। আলোর উৎসের ঠিক উপরে এসে পাখা আর পা ছেড়ে দিয়ে ধপ করে মাটিতে পড়ে যায় যেন ‘কান্ত প্রাণ এক’। মায়াবি চোখের এ পাখিগুলোকে তখন দেখে মনে হতে পারে অর্ধমৃত। জীবণের প্রতি বুঝি ভীষণ বিরক্ত। আর তাই এ জীবণ এরা রাখতে চায়না। আকাশ থেকে লুটিয়ে পড়ার সময় সব পাখিই যে আগুনের উপর পড়ে এমন নয়। বরং কিছু ইতস্তত ছড়িয়ে যায় আগুনের পাশে। কিন্তু এরা বেঁচে থাকলেও মরার মতো পড়ে থাকে এবং সহজেই ধরা দেয়। পাখি শিকারের জন্য এর চেয়ে সহজ উপায় আর কি হতে পারে গ্রামবাসিদের কাছে? অনেক সময় আলোর দিকে উড়ে আসতে থাকা পাখিদের বাঁশের লাঠি কিংবা গুলতি দিয়েও সহজে শিকার করে স্থানীয় লোকজন।
এসব পাখিদের কি কোন দুঃখ তাড়া করে? নয়তো কেন তারা আত্মহত্যা করতে আসে? এর জবাব কারো কাছে নেই। বহু বছর ধরে এমনটাই চলে আসছে। হৃদয়ে দুঃখ থাক আর নাই থাক এদের চোখে সব সময় বুনো ভাব আর দুঃখের ছায়া দেখা যায়। জাটিঙ্গা পাখি কখনো পোষ মেনেছে বলে কারো জানা নেই। আর পাখিবিষারদ ও গবেষকরা হলফ করে বলেছেন, পাখিরা কখনো মানসিক রোগে ভোগে না। তাহলে কেন আগুন ও আলোর প্রতি এদের অমোঘ টান?
এ রহস্যের জট আজ পর্যন্ত কেউ খুলতে পারেনি। এটাকে কেউ বলে আত্মহত্যা, কেউ বলে ভুতুড়ে ব্যাপার। কেননা জাটিঙ্গার পাশেই হাফলং। সেখানে এই পাখি কখনো যায় না অথচ জাটিংগা আর হাফলংয়ের আকাশের দূরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটার। স্থানীয় ‘জাইনতিয়া’ জনগোষ্ঠীর ধারণা, এমন ঘটনার পেছনে অশুভ আত্মার ভ’মিকা রয়েছে।
অনেক গবেষকরাই আপ্রাণ চেস্টা করেছেন জাটিঙ্গা পাখিরহস্যের কিনারা করতে। কিন্তু পারেন নি। তবে অধিকাংশের বিশ্বাস বৈরি আবহাওয়াই এর প্রধান কারণ। চাঁদহীন কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে টিপটিপে বৃষ্টির সাথে বাতাসের প্রবাহ প্রকৃতিতে একটি গোলমেলে অবস্থা তৈরি করে। যে কারণে পাখিরা আর স্বাভাবিক থাকতে পারে না, বাধ্য হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কিন্তু কি কারণে আলোর উৎস এদেরকে আকর্ষণ করে? এর কোন সদুত্তর না থাকলেও পাখিদের নিষ্ক্রিয় হওয়ার ব্যাপারে আরেকটি ধারণা রয়েছে, আলোর আকর্ষণে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এরা ছুটতে থাকে উৎস লক্ষ্য করে। পথে গাছগাছালিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। আর আহত অবস্থায় উৎসে এসেই নিঃশ্বেস হয়ে যায় শরীরের শক্তি। তবে এ ধারণার পেছনে কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ মেলেনি। তাছাড়া মাটিতে লুটিয়ে পড়া পাখিদের গায়ে কোন আঘাতের চিহ্নও পাওয়া যায়নি।
পাখি বিশারদ ড. এস সেনগুপ্ত, এ. রউফ এবং সলিম আলির গবেষণায় ৪৪ প্রজাতির পাখির আলোক উৎসের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়। কিন্তু দেখা গেছে, জাটিঙ্গা গ্রামের দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও দুইশ’ মিটার প্রস্তের নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া অন্যান্য এলাকায় আলোর প্রতি তাদের আকর্ষণ নেই। আবার আরো একটি অ™ভ’ত ব্যাপার হলো এ আত্ম্যহত্যার প্রবণতা কেবল স্থানীয় জাটিঙ্গা পাখিদের মাঝেই দেখা যায়, কোন অতিথি পাখি এমন আচরণ করে না। কাজেই পাখি বিশারদ আর তাবড় তাবড় গবেষকদের মাথা গুলিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তারা ব্যাপারটিকে ভ’তুরে বলে মানতেও রাজি নন, আবার রহস্যের জাল ভেদ করে বেরিয়েও আসতে পারছেন না।
ড. সুধীর সেনগুপ্ত ধারণা করছেন জটিল আবহাওয়ার কারণে হয়তো সেখানকার ভ’চুম্বকত্বের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর অত্যধিক ভ’চুম্বকত্ব এবং আলো একসাথে পাখিদের ওপর মারাত্মক কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ফলে সাইকোলজিকেলভাবে পাখিরা উদভ্রান্ত হয়ে যায় এবং অস্বাভাবিকভাবে আলোর উৎসের দিকে ছুটে চলে। তারপর অবশ হয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। তবে এসব কথাও প্রমাণিত হয়নি। মূলত বৈরী আবহাওয়ায় গাঢ় কুয়াশা আর টিপটিপে বৃষ্টিতে উড়ে যাবার সময় গ্রামবাসীদের আলোর ফাঁদে আকৃষ্ট হয়ে পাখিরা এ কান্ড ঘটায়, এটিই সব গবেষণার উপসংহার। এছাড়া ঐ এলাকায় পাখির ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। এ জন্য সংখ্যাগত সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে এটি হয়তো প্রকৃতিরই কোন না জানা খেলা।