রবিবার, অক্টোবর ০৩, ২০১০

চুলাচুলি সমাচার

কোমরে কাপড় বেঁধে অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে আঙ্গুরির মা। পিছিয়ে নেই আছিয়ার মাও। এতক্ষন কেবল অন্দর থেকে অন্দরেই ছুটাছুটি করছিলো গ্রাম্য গালাগালের তীর। এখন পরিস্থিতি এগুচ্ছে সম্মুখ সমরের দিকে। প্রথমে দেউড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো দুজনের মাথা। তারপর পুরো অবয়ব। ঝাড়– উঁচিয়ে নানা অঙ্গভঙ্গি করতে করতে এগিয়ে আসছে আঙ্গুরির মা। সসস্ত্র প্রতিপক্ষের বিপরীতে একমুহুর্ত থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হলো আছিয়ার মা, তবে হতাশ হতে হলোনা। তাৎক্ষনিক প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলো তার ছোট মেয়ে নুরেছা। চোখের পলকেই মায়ের হাতে চালান করে দিলো শক্ত-সামর্থ একটি ঝাড়–। এবার সমানে সমান। ক্রমশ কমে আসছে দুজনের মাঝের দুরত্ব। উত্তপ্ত হচ্ছে রণাঙ্গন। বাড়ছে দর্শকদের উত্তেজনা।
চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে ময়না। কী নিয়ে এ লড়াইয়ের সূত্রপাত এর কিছুই তার জানা নেই। এমনকি কথার তীরের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ শুনেও কোন সূত্র উদ্ধার করতে পারলো না সে। তবে পাশাপাশি বাড়ির এ দুই মহিলার মাঝে এমন বাক বিতন্ডা আজই নতুন নয়। কম করে হলেও সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন গালাগালি, চুলাচুলি না করলে সম্ভবত তাদের পেটের ভাতই হজম হয়না। আর এ কারনেই দর্শকরা নিরব দাঁড়িয়ে। কেউ এগিয়ে যাচ্ছেনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে।
- কিরে ময়না, খারইয়া খারইয়া বেইট্টাইন্তের (মহিলাদের) কাইজ্জা দেহস? খারঅ তর বাপের কাছে কইয়া লই।
সবুজের কথাতে লজ্জা পেল ময়না, ভয়ও হলো কিছুটা। এত দর্শকদের ভীরে সবুজ ভাই যে তাকে দেখে ফেলবে, ভাবতে পারেনি সে। কথার কোন জবাব না দিয়ে দ্রুত বাড়ির দিকে চলে যেতে উদ্যত হচ্ছিলো। কিন্তু তখনি ঘটে গেলো ঘটনাটা!
আছিয়ার মাকে চুলের মুঠি ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে এলো আঙ্গুরির মা। হাতের ঝাড়– ফেলে দিয়ে নিচ থেকে প্রতিপক্ষের চুলের মুঠিটিও ধরার চেস্টা করলো আছিয়ার মা। খুব একটা সুবিধা করতে না পারলেও চুলের নাগাল পেল ঠিকই। কিছুক্ষনের মাঝেই দুজন সমানে সমান। একজন আরেকজনের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে লাগলো। এবার কথার তীরের পরিবর্তে শুরু হলো যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদের প্রতিযোগিতা। তারপর হাউমাউ কান্না। কিন্তু কেউ কাউকে ছাড়তে রাজি নয়, যেন বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদেনি। চুলাচুলির তুমুল পর্যায়ে দু’জনেই লুটিয়ে পরলো মাটিতে। তারপর গড়িয়ে পড়তে লাগলো বাড়ির ঢাল বেয়ে।
ঘটনার শেষটা দেখে যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো ময়নার। কিন্তু আড়চোখে সবুজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আর দাঁড়াতে সাহস হলোনা। হাঁটা শুরু করলো বাড়ির দিকে। পেছন পেছন আসতে দেখলো সবুজ ভাইকেও।
- বেইট্টাইন্তের কাইজ্জা দেহুন বালা না বুজছস? এইগুলা অইল অশিক্ষিত মানুষের কাম। তুই তো ইস্কুলে পরস। তোর এইসবের দিকে মনযোগ দেওন উচিত না।
- আইচ্ছা ভুল অইয়া গেছে। আর এমুন অইত না।
- দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা শেষ করছস ভালোয়, ভালোয়। অহন সমাপনী পরীক্ষা ভালো কইরা দেওয়ার প্রস্তুতি নে। শিক্ষিত অইয়া মানুষের মতো মানুষ অওয়ার চেস্টা কর। শিক্ষার আলো মানুষের সব মূর্খতা দূর কইরা দেয়। মানুষরে বিচার-বিবেচনা শিখায়। আঙ্গুরির মা আর আছিয়ার মা পড়ালেহা করে নাই বইলা এরার কোনো বিচার-বিবেচনা নাই। আর এর লাইগ্যাই অতো লোকজনের সামনে চুলাচুলি করতেও এরার শরম লাগে না।
- আইচ্ছা সবুজ ভাই, শিক্ষাই কি মানুষরে মানুষের মতো মানুষ বানায়?
- হ-অ
- অহন আমার একটা কতার জবাব দেও দেহি। হেদিন পত্রিকার মইদ্যে ছবি দেখলাম, ঢাহা শহরে কলেজের ছাত্রীরা রাস্তার মাইদ্যে চুলাচুলি করতাছে! হেরা কি শিক্ষিত না?
‘শিক্ষিত’ শব্দটি উচ্চারণ করতে গিয়েও করতে পারলো না সবুজ। এই ছোট্ট মেয়েটির প্রশ্নে এমন বেকায়দায় পড়ে যাবে, ভাবতে পারেনি সে। প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন পালন করার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজের ছাত্রলীগ নেতৃদের চুলাচুলির ছবি সেও দেখেছে পত্রিকায়। মিছিলের সামনে থাকাকে কেন্দ্র করে তাদের এই চুলাচুলির সূত্রপাত। তখন প্রধানমন্ত্রীর ছবি পর্যন্ত দলিত হয় তাদের পায়ের নিচে।
একেবারেই চুপসে গেল সবুজ। বুদ্ধিমতি মেয়ে ময়নাও আর ঘাটাতে চাইলো না তাকে। তবে এ-ই প্রথমবারের মতো সবুজ ভাইকে ধরাশায়ি করতে পেরে তার চোখেমুখে আনন্দ ফুটে উঠল।

কোন মন্তব্য নেই: