রবিবার, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১০

খেলার নাম ভাটিয়া

যে কেউ ভেবে বসতে পারে মধ্যবয়স্ক এ লোকগুলো বুঝি দাঁড়িয়াবান্ধা খেলছে। নুমানের ছোট চাচার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি শহরে থাকেন। স্বপরিবারে গ্রামে এসেছিলেন দু’দিনের জন্য। এখন আবার চলে যাচ্ছেন। ফিরতি পথে নৌকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন বাজারের কান্দায় (উন্মুক্ত উঁচু জায়গা)। এই আশিন মাসেও যে হাওর পানিতে টইটম্বুর থাকবে, তা তিনি ভাবতেও পারেননি। অবশ্য এতে ভালোই হয়েছে, দু’দিন বেশ উপভোগ করার সুযোগ হয়েছে তার। বাড়ির সবাইকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন নৌকা বাইসালিতে। দিগন্ত বিস্তৃত হাওরের জলে ঝরা ঝর ঝর বৃষ্টিতে মোহগ্রস্ত হয়েছিলেন তিনি; বাঁধভাঙা আনন্দে বৃষ্টিকে বরণ করেছিলেন। তারপর যখন উঁকি দিয়েছিলো বৃষ্টিধোয়া রোদ, তখন আকাশ নীলা অতিক্রম করেছিলো নীলের গণ্ডি। গোটা পৃথিবী যেন মেখেছিলো রঙধনুর সাত রঙ। আকাশের রঙের বাহার প্রতিফলিত হচ্ছিলো হাওরের শান্ত জলে। ছপাত ছপাত ডিঙি নৌকার বাইসালিতে তখন হাওরটাকে মনে হয়েছিলো রঙের ক্যানভাস। কিন্তু এখন এই যাবার সময় নৌকা না পেয়ে অনিন্দ্য সুন্দর হাওরের উপরই মহা বিরক্ত হয়ে উঠেছেন তিনি। কোনো রকমে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই হলো- ব্যস, আর যাত্রীবাহী নৌকার টিকিটিও পাওয়া যায়না।
কী আর করা! বাধ্য হয়েই তাকে মনযোগ দিতে হয়েছিলো মধ্যবয়স্ক লোকগুলোর ধুপধাপ দৌড়াদৌড়িতে। প্রথমে তো একে দাঁড়িয়াবন্ধা খেলা ভেবেই বসেছিলেন তিনি। কিন্তু এ খেলায় তো এতবড় কোট (খেলার বৃত্তবিশেষ) হওয়ার কথা নয়! ব্যাপারটি পরিষ্কার করে দিলো ময়না। তারপর থেকেই গভীর আগ্রহে তিনি ডুবে গেলেন খেলার ভেতর। খেলার নাম ভাটিয়া। বিশাল বড় করে চারকোনা একটি কোট আঁকা রয়েছে। আর চারটি কোনায় পাহারায় রয়েছে চারজন। কোটের বাইরে থেকে আরো চারজন ছলাকলা করছে ভেতরে ঢোকার জন্য। চার পাহারাদারের স্পর্শমুক্ত থেকে একবার ভেতরে ঢোকে, তারপর আবার বেরিয়ে আসতে পারাই নাকি তাদের লক্ষ্য। এভাবে একে একে চারজন যদি বেরিয়ে আসতে পারে, তবেই গোল্লা। এ ধরনের নিয়মই তাকে বুঝালো ময়না। কিন্তু এতকিছু ওনার মাথায় ঢোকছে না। তিনি মুগ্ধ হয়ে দেখছেন লুঙ্গি-ন্যাংটি কেঁচে কত অবলীলায়-ই না লোকগুলো খেলে যাচ্ছে! ওরা প্রত্যেকেই তাঁর সমবয়সী হবে। অথচ এখন তাকে খেলতে বললে কি তিনি রাজি হবেন? না, হওয়ার কথা নয়। আর ওদের মতো এতো পরিশ্রমও তিনি করতে পারবেন না। বাচ্চা ছেলেদের মতো বাতাস কেটে-কুটে এঁকেবেঁকে দৌড়াদৌড়ি করছে ওরা। সারা গায়ে ধুলি। দর দর করে ঝরতে থাকা ঘামে ধুলিগুলো ভিজে কাঁদা হওয়ার আগেই আবার মাটিতে গড়াগড়ি খেতে হচ্ছে ওদের। তারপর আবার তাজা ধুলি-মাটি মেখে শুরু করছে হুটিপুটি। হুস্-হাস্ শব্দ তুলে একেকজনের শ্বাস প্রশ্বাস বেরোচ্ছে যেন যন্ত্রের গতিতে। তবুও চেহারা থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে নির্মল আনন্দ। সে আনন্দ ভর করছে দর্শকদের মাঝেও। ভাটিয়ার কোটকে ঘিরে অগুণতি দর্শক। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে। আবার কেউ বা দূর্বাঘাসে কাত হয়ে শুয়েও আছে। খেলোয়াড়দের সাথে সাথে উত্তেজনায় টানটান ওরাও। দেউড়ির আড়াল সরিয়ে বাড়ির অন্দরমহল থেকেও উপভোগ করছে মহিলারা। সবার মাঝে বিপুল এক আনন্দ। এ আনন্দের ভাগ অন্যরা যতটুকু পাচ্ছে নুমানের ছোট চাচা হয়তো ততটা পাচ্ছেন না। কারণ ভাটিয়া খেলার নিয়ম-কানুন তার জানা নেই। তারপরও প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের এ খেলাটি উপভোগ করতে পেরে অন্যরকম এক উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত তিনি। সময়ের সাথে সাথে মানুষগুলোও সব যান্ত্রিক হয়ে উঠছে। তিনিও এর বাইরে নন। একসময় বৌচি, চি কুৎ কুৎ, গোল্লাছুটসহ কত খেলাই না দেখা যেত বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে। এখন দেখা যায় বটে, তবে তা খুবই কম। লাঠিখেলা দেখতে গিয়ে কত্তবার মায়ের বকুনি খেতে হয়েছিলো তাকে! ঢোল-কাঁসরের শব্দ আর লাঠির সাজ সাজ আয়োজন একত্রিত করতো গ্রামবাসীকে। রঙবেরঙের যোদ্ধার পোশাক পড়ে হাতে মেকি তরবারি, ছোড়া ও বড় থালা সাইজের ঢাল নিয়ে লাঠিয়ালরা বাজিয়ে দিতো যুদ্ধের দামামা। মাথায় থাকতো লাল কাপড়ের পট্টি। তাদের ঘুঙুরের উচ্চ শব্দেও মোহগ্রস্ত হতেন তিনি। উপভোগ করতেন লাঠির ভেলকি।
‘জল্লা-জল্লা....’ শব্দে চিৎকার করে উঠলো খেলোয়াড়দের একপক্ষসহ উপস্থিত দর্শকরা। সম্বিত ফিরে পেলেন নুমানের ছোট চাচা। বুঝতে পারলেন কোনো খেলোয়াড় খেলার নিয়ম ভঙ্গ করেছে। একটু আড়মোড়া ভেঙে আবার খেলায় মনযোগ দিতে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু পারলেন না ময়নার ডাক শুনে ‘চাচা আমহেরে (আপনাকে) চাচী ডাকতাছে।’
ঘাঢ় ঘুরিয়ে নৌকার জন্য অপেক্ষমান স্ত্রী-সন্তানের দিকে তাকালেন তিনি। তারপর তাকালেন হাওরের জলে ডুব দিতে উন্মোখ সূর্যের দিকে এবং বললেন, ‘ময়না, তোর চাচিরে কঅ বাড়িত যাইতগা। সইন্ধা অইয়া গেছেগা। আউজ্জা আর যাইতামনা।’
26.09.10

কোন মন্তব্য নেই: