শুক্রবার, মার্চ ০৪, ২০১১

গোঁফ বিভ্রাট


শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
গোফরান সাহেব। কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। আপাদমস্তক ভদ্রলোক। অবশ্য তিনি ভদ্র কী অভদ্র সে বিষয়ে আপাতত না গেলেও চলে। কারণ অফিসের সবাই এখন গোফরান সাহেবের গোঁফ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। গোঁফ, সে তো যেকোনো পুরুষেরই থাকে। এ নিয়ে আবার ব্যস্ত হওয়ার কী আছে? হ্যাঁ, ব্যাপার একটা আছে বটেÑ
তবে ব্যাপারটাতে ঢোকার আগে গোঁফ বিষয়ে সবার একটা সাধারণ ধারণা থাকা প্রয়োজন। উইকিপিডিয়া বাংলায় গোঁফের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে ‘গোঁফ বা মোচ হলো ওষ্ঠের ওপরে গজানো চুল। সাধারণত কারো গোঁফ আছে বলা হলে মনে করা হয় তার ওষ্ঠের ওপরের অংশটুকুতেই তা সীমাবদ্ধ আছে, কারণ গাল ও থুতনির অন্যান্য অংশে গজানো চুলকে দাড়ি বলা হয়। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের গোঁফ ওঠা শুরু হয়। নিওলিথিক যুগ থেকেই পাথরের ুর দিয়ে ৗেরি করার চল শুরু হয়, আর এই সুদীর্ঘকালের ব্যবধানে গোঁফের নানারকম ফ্যাশন চালু হয়েছে। যারা গোঁফ রাখে তারা নিয়মিত ছেঁটে ও আঁচডে রীতিমতো এর যতœ করে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ ও সযতেœ রতি গোঁফের প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। বিশ্ব দাড়ি ও গোঁফ চ্যাম্পিয়নশিপে ছয়টি উপবিভাগে গোঁফের বিভাজন করা হয়। গোঁফের এমন কদর দেখেই হয়তো বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ননসেন্স ছড়াকার সুকুমার রায় বলেছিলেন : ‘গোঁফকে বলে তোমার আমারÑ গোঁফ কি কারো কেনা?/গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।’
উইকিপিডিয়ার বর্ণনা এতটুকুই। সেখানে গোফরান সাহেবের গোঁফের কথা উল্লেখ না থাকলেও সুকুমার রায়ের কবিতার একটি উদ্ধৃতি রয়েছে। হেড অফিসের এক বড়বাবু এ কবিতাটির নায়কের ভূমিকায়। আর আমাদের নায়ক গোফরান সাহেব। সুকুমার রায়ের নায়ক আর আমাদের নায়কের মাঝে পার্থক্য এতটুকু যে, বড়বাবুর সামান্য একটু মাথার ব্যামো থাকলেও এমনিতে বেশ শান্ত স্বভাবেরই। আর গোফরান সাহেবের মাথায় কোনো রকমের ব্যামোট্যামো নেই। কিন্তু তাকে কিঞ্চিত অস্থির স্বভাবের বলা চলে। আরো একটি সাঙ্ঘাতিক ধরনের পার্থক্য রয়েছেÑ একদিন কাউকে না বলে, না কয়েই বড়বাবু আন্দাজ করে বসলেন, তার গোঁফজোড়া বুঝি হারানো গেল, ‘ব্যস্ত সবাই এদিক-ওদিক করছে ঘোরাঘুরি.../বাবু হাঁকেন, ওরে আমার গোঁফ গিয়েছে চুরি!/ গোঁফ হারানো! আজব কথা! তাও কি হয় সত্যি?/ গোঁফ জোড়া তো তেমনি আছে, কমেনি এক রত্তি/সবাই তারে বুঝিয়ে বলে, সামনে ধরে আয়না।/ মোটেও গোঁফ হয়নি চুরি, কখনো তা হয় না।’ কিন্তু গোফরান সাহেবের গোঁফ কখনো চুরি গিয়েছিল বলে আজ পর্যন্ত কোনো প্রমাণ মেলেনি। চুরি করা তো দূরের কথা তার ভোলা-ভালা পাতলা গোঁফগুলোতে হাত দেয়ার সাহস পর্যন্ত কেউ রাখে না। পাতলা বলতে একেবারে পাতলা নয়। সামান্য চারা-চারা আর ছাড়া ছাড়া আরকি। উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞা অনুযায়ী এগুলোকে নিঃসন্দেহে গোঁফ বলে স্বীকৃতি দেয়া যায়।
এ তো গেলো গোঁফের কথা। কিন্তু তার দাড়ির রকমটা কী? সে বিষয়েও ধারণা নিয়ে নেয়া জরুরি। হ্যাঁ, পাতলা-টাতলা গোঁফের পাশাপাশি হালকা-সালকা কিছু দাড়িও রয়েছে তার। একবার সময় করে বসলে গুণে ফেলা যাবে সবগুলো। গোফরান সাহেব নিজে বেশ কয়েকবার দাড়ি শুমারিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। চুলের জুলফি থেকে গালের নরম অংশটুকু পর্যন্ত সফলভাবেই গুণে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু থুতনির দিকে এসেই সব গোলমেলে হয়ে গেলো। ‘একবার না পারিলে দেখো শতবার’ এ মন্ত্রের শিক্ষা ছোটবেলায়ই পেয়েছিলেন তিনি। তাই জানার অদম্য বাসনায় শতবার পেরিয়ে হাজারবার পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যেতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। কিন্তু দাড়ি শুমারির কাজটা শেষ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বার বারই থুতনিতে এসে হিসাব লণ্ডভণ্ড। একজন মানুষের ধৈর্য্য বলতেও তো একটা কথা আছে। একদিন ঠুস করেই তার ধৈর্য্যরে বাঁধটা ভেঙে গেল। সব কিছু ভাঙলে যেমন কম্পন তৈরি হয়, তারপর সেই কম্পন শব্দ হয়ে আঘাত করে মানুষের কানে, গোফরান সাহেবের বেলায়ও তেমনটি ঘটল। অর্থাৎ তার অন্তরের অন্তঃস্থলে একটি মারাত্মক ধরনের কম্পন তৈরি হলো। আর সে কম্পনের বহিঃপ্রকাশ ঘটল মুখে-চোখে। এমনকি ঠোঁটেও। তবে এই কম্পন সেই কম্পন নয়। কম্পনের চোটে তার লজ্জারাঙা মুখে মিষ্টি ধরনের ভাব ফুটে উঠল। সেই সাথে ঠোঁটের ফোকর ভেদ করে ‘হিস হিস’ ধরনের হাসির শব্দও বেরিয়ে এলো।
দেখ দেখি কী কাণ্ড! দাড়ি শুমারিতে ব্যর্থ হয়ে তিনি আবার হাসতে যাবেন কেন? এই কেনর জবাবটা যে কি তার সবটুকু বলা যাবে না। সে এক লম্বা ইতিহাস। তবে এ হাসির গোপন রহস্য সম্পর্কে অল্প-স্বল্প ধারণা দেয়া যেতে পারে মাত্র। সেদিনের সেই ঘটনার কথাটাই ধরা যাকÑ
অফিসের ক্যান্টিনে রোজকার মতো খেতে বসেছিলেন গোফরান সাহেব। হঠাৎই আবিষ্কার করলেন তিনি কোনোভাবেই ডালে চুমুক দিতে পারছেন না। যতবারই চেষ্টা করছেন ততবারই গোঁফজোড়া ভিজে যাচ্ছে। এমন ফ্যাঁসাদে জীবনে পড়েননি। রবীন্দ্রনাথ তাহলে ডাল খেতেন কিভাবে? নাকি ডাল খাওয়ার জন্য গোঁফওয়ালাদের বিশেষ কোনো পদ্ধতি রয়েছে? একজন নতুন গোঁফওয়ালা হিসেবে এসব প্রশ্নের জবাব গোফরান সাহেবের না জানারই কথা। কিন্তু এর আগেও তো তিনি ডালে চুমুক দিয়েছেন, এমন তো কখনো হয়নি! তাহলে কি ধরে নেয়া যায় আগের চেয়ে গোঁফজোড়া আরো বড় হয়ে গেছে? হলেও হতে পারে, কমপক্ষে পনের দিন তো হবেই তিনি ডাল স্পর্শ করেননি। এবার খুশি হয়ে উঠলেন গোফরান সাহেব। যাক বাবা, ছাড়াছাড়া গোঁফগুলো এবার তাহলে বাড়তে শুরু করেছে। ইচ্ছা থাকলেই যে উপায় হয় এটা তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
বিপুল বিক্রমে ডালে চুমুক দিতে লাগলেন তিনি। ফুড়–ৎ-ফাড়–ৎ শব্দে ক্যান্টিন মুখরিত। অনেকটা নিজের ইচ্ছেতেই ঘনঘন গোঁফজোড়া চুবাচ্ছেন। যার গোঁফ আছে সেই তো গোঁফ নিয়ে যেমন খুশি তেমন খেলতে পারে। যার নেই তার পক্ষে তো আর সম্ভব নয়। কাজেই নগদ যা পাও তা উপভোগ করে নাও। ডালে গোঁফ চুবানোতে যে এত আনন্দ এর আগে চিন্তাও করতে পারেননি তিনি। বড্ড মায়া হলো গোঁফহীনদের জন্য। একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন ক্যান্টিনজুড়ে। তিনি ছাড়া আর কারো নাকের নিচে কিচ্ছুটি নেই। গোঁফ না রাখলে সে আবার কিসের পুরুষ মানুষ! তা ছাড়া গোঁফ চুবানো ডালের স্বাদ যে বুঝেনি তার জীবনের চৌদ্দ আনাই মিছা। তাও আবার যেনতেন গোঁফ নয়, সার-গোবর দিয়ে বড় করে তোলা গোফরান সাহেবের নিজের গোঁফ!
আহ। কী তৃপ্তিরে বাবা। হাত ধুয়ে পরপর দুইবার ঢেঁকুর তুললেন গোফরান সাহেব। তারপর ক্যাশ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলেন বিল পরিশোধ করতে। বিল হলো সর্বমোট তেত্রিশ টাকা। তিনি পকেট থেকে একটি কড়কড়ে পঞ্চাশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিলেন ম্যানেজারের দিকে। যথারীতি বিল রেখে একটি দশ টাকা আর একটি পাঁচ টাকার নোট ফেরত দিলো ম্যানেজার। ‘আর দুই টাকা কোথায়?’ এমন ধরনের একটি জিজ্ঞাসা গোফরান সাহেবের চোখেমুখে ফুটে উঠার আগেই ‘ভাঙতি দুই টাকা নেই’ বলে একটি চুইংগাম বাড়িয়ে দিলো ম্যানেজার। হালের দোকানদারদের যা অবস্থা আরকি। অন্য সময় হলে দুই টাকার পরিবর্তে এই জিনিসটা নিতে রাজি হতেন না তিনি। কিন্তু আজ যে বিশেষ দিন। শখের গোঁফজোড়া যে আরো বড় হয়ে উঠছেÑ আজই তো তার প্রমাণ মিলল। তাই একদমই মেজাজ খারাপ করলেন না গোফরান সাহেব। চুপচাপ খোসা ছাড়িয়ে মুখে পুরে দিলেন চুইংগামটি। শিশুদের এ খাবারটিতে যে এত্তো স্বাদ লুকিয়ে রয়েছে, এ বিষয়ে একদম ধারণা ছিল না তার। এত দিন চুইংগাম খায়নি বলে বড় আফসোস হতে লাগল। ছন্দে ছন্দে চুইংগাম চিবাতে লাগলেন তিনি। সেই সাথে লক্ষ করলেন তার গোঁফজোড়াও সমান তালে নেচে যাচ্ছে। একেবারে সোনায় সোহাগা। গোঁফের নাচনে দোলে দোলে নিজের চেয়ারটাতে এসে বসলেন। এবার একটা সুখের ঘুম প্রয়োজন। মাথা কাত করে চেয়ারেই গা এলিয়ে দিলেন গোফরান সাহেব। দুনিয়ার সব আরাম এসে যেন ঘিরে ধরলো তাকে। লেগে গেলো চোখের পাতা। পুরো পৃথিবীটাই যেন শান্ত হয়ে এলো। চুইংগাম চিবাতে চিবাতেই তিনি চলে গেলেন অতীতের অম্লমধুর দিনগুলোতেÑ
আজকের এই গোঁফ একদিনের ফসল নয়। প্রতিটি সফলতার জন্যই প্রয়োজন নিবিড় অধ্যবসায়। গোফরান সাহেবের অধ্যবসায়ের সেই দিনগুলোই বয়ে এনেছে আজকের সাফল্য। তখন কেবল গোফরান সাহেব কৈশোরে পা দিয়েছেন। সমবয়সি অনেকের কাজলকালো গোঁফ ভেসে উঠলেও তার নাকের নিচে গোঁফের কোনো রেখাই দেখা দেয়নি। সেই সুযোগে অনেক বন্ধুরাই নিজেদের বড় ভাই হিসেবে দাবি করে বসলো। সমবয়সি কাউকে ভাই বলে ডাকবে এমন অপমান সহ্য করার মতো লোক গোফরান নয়। কোনো কালেই তার এ অভ্যাস ছিল না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে করেই হোক নিজেকে বড় বলে প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু এর জন্য কি করা যায়? দ্বারস্ত হলেন শুভাকাক্সিক্ষদের। কেউ কেউ একেবারেই নিরাশ করল তাকে। সাফ সাফ জানিয়ে দিলো কোনো দিনই নাকি তার গোঁফ গজাবে না। আবার একান্ত কাছের অনেকেই পরামর্শ দিলো ‘নাকের নিচে রেজার চালিয়ে দেখতে পারিস’। আইডিয়াটা পছন্দ হয়ে গেলো গোফরানের। কিন্তু বাসায় তো কোনো রেজার নেই। দোকান থেকে কিনতে যাওয়াটাও সমীচীন হবে না। বেরসিক দোকানি যদি জিজ্ঞেস করেই বসে ‘রেজার দিয়ে তোমার কি কাজ খোকাবাবু?’ কী আর করা, বাধ্য হয়েই বিকল্প পথ বেছে নিতে হলো। খাপখোলা চকচকে ব্লেড হাতে নিয়ে চুপি চুপি বাথরুমে ঢুকতে হয়েছিল তাকে। তারপর পানিতে মুখ ভিজিয়ে একচোট সাবান মেখে নিয়েছিলেন। ভাবখানা এমন যেনÑ সাবানের ফেনার নিচে অসংখ্য খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ লুকিয়ে আছে। একেবারে বড়দের মতো আরকি। তারপর কম্পমান হস্তে ব্লেডটা প্রথম চালিয়েছিলেন ঠিক ওষ্ঠ আর নাসিকার মাঝখানেই (ওষ্ঠ ও নাশিকা-উইকিপিডিয়ায় ব্যবহৃত এ দু’টি শব্দের অর্থ দাঁড়ায় যথাক্রমে ঠোঁট ও নাক)। যা হঙয়ার হলোও তাই। ঠোঁট কেটে একাকার। ভাগ্য সহায় ছিল বলে উন্নত নাসিকার কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আধুনিক যুগের ব্লেড ব্যবহার করেও পার পেলেন না গোফরান।
সদ্য কৈশোরপ্রাপ্ত গোফরান যে এমন কাজ করতে পারেন তা কেউ-ই ভাবতে পারেনি। ঘটনাটা প্রথম ফাঁস হয় তার নিজের বাড়িতেই। তারপর বাড়ি থেকে বন্ধু, বন্ধু থেকে স্কুল। এভাবে গড়াতে গড়াতে একেবারে মেয়ে বন্ধুদের কান পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। জলের মতো সহজ বিষয়টা ধীরে ধীরে বরফের মতো সাঙ্ঘাতিক হয়ে উঠতে থাকে। অন্যদের হাসি-তামাশা যেমন তেমন, মেয়েদের টিটকিরি একেবারেই সহ্য হওয়ার মতো নয়। কাসে, প্রাইভেটে, রাস্তায় যেখানে খুশি পেলেই হলো, মেয়েরা সমস্বরে উত্যক্ত করা শুরু করলো গোফরানকে। আধুনিক ভাষায় একে সম্ভবত ‘এডাম টিজিং’ হিসেবেই অভিহীত করা যায়। কেবল এডাম টিজিংয়ের শিকার হওয়াই শেষ ছিল না, মুরব্বিদের কেউ কেউ ইচড়ে পাকা বলেও খোঁচাটোচা দিতো তাকে। সেই থেকেই জেদ ধরে বসল। যে করেই হোক নাকের নিচে গোঁফ চাই-ই চাই। প্রয়োজনে রোপণ করে হলেও। এর জন্য উর্বর মাটি দরকার হলে আফ্রিকার জঙ্গলে পর্যন্ত যেতে রাজি আছে। আর একবার যদি গোঁফের বাগান জেগে ওঠে, তবে তো ছেঁটে-আঁচড়ে নিয়মিত যতœ নেবেই। শুধু গোঁফের জন্য একটি আলাদা চিরুনির বাজেটও করে ফেললেন গোফরান। এভাবে যতœ-আত্তি আর পুষ্টি পেয়ে গোঁফজোড়া যখন বড় হয়ে উঠবে, তখন তাবড় তাবড় গোঁফের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবেন। এক সময় বিশ্ব গোঁফ চ্যাম্পিয়নশিপের গৌরব আসবে তার ঘরেই। তখন গিনেস বুকে যদি তার নাম উঠে যায়, এতেও কোনো আপত্তি থাকবে না।
কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়াল একটিমাত্র অপূর্ণতা। আর সেটা হলো চেষ্টা-তদবির করেও গোঁফের দেখা পাচ্ছেন না। কথায় আছে ‘একবার না পারিলে দেখো শতবার’। তাই একবার-দু’বার, তিনবার, চারবার করে করে শতবার পর্যন্ত দেখলেন তিনি। কিন্তু কোনো ফল হলো না। তার পরও ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলেন না গোফরান। শতবার পেরিয়ে হাজারবার। এভাবে হাজার হাজারবার রেজর চালাতে হলো তাকে। রেজরের আঁচড়ে আঁচড়ে গালের চামড়া ভারি করে তুললেন। অবশেষে দু-একটি গোঁফ অঙ্কুরিত হতে দেখা গেল। অর্থাৎ সফলতা তিনি পেয়েছেন। এই প্রথমবারের মতো তিনি প্রমাণ করলেন যেÑ ইচ্ছা থাকিলেই উপায় হয়।
গোফরানের নাকের নিচে গোঁফ দেখে তো মুখপোড়া বন্ধুদের মুখে স্কচটেপ লেগে যাওয়ার অবস্থা। যারা বলেছিল, ‘গোফরানের কখনো গোঁফ গজাবে না’ তাদের দেখিয়ে দেখিয়ে বেড়াতে লাগলেন তিনি। এরপর থেকেই সবকিছুর কেমন জানি আমূল পরিবর্তন হতে থাকল। যেই বাবার কাছে দশ টাকা চাইলে হাজারটি প্রশ্ন করে জর্জরিত করেন, সেই বাবাই তাকে রেজর কেনার জন্য পুরো ষাট টাকা দিয়ে দিলেন!
সেই থেকে তার গোঁফের যতœ-আত্তিতে মনোযোগ আরো বেড়ে গেল। আরো বেড়ে গেল আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর শঙ্কার দোলা। শঙ্কাটা তখন হয়েছিল দাড়ি নিয়ে। গোঁফের দেখা মিললেও দাড়ির কোনো চিহ্নও ছিল না গোফরানের গালে। আবার সেই দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা। অর্থাৎ সার-গোবর, পানি-জল দিয়ে নিড়ানি পদ্ধতি অবলম্বন এবং অবশেষে সফল। এভাবেই চলছিল গোফরানের সংগ্রাম।
একদিন গোফরান বড় হলেন। একটি ভালো চাকরি পেলেন। সেই সাথে পেলেন মুষ্টিমেয় কিছু দাড়ি। এই গোফরান আর সেই গোফরান রইলেন না। তার ওষ্ঠ এবং নাসিকার মধ্যবর্তী স্থানে এখন ছাড়া ছাড়া গোঁফ। আর নিজে বেশ কয়েকবার শুমারি করে ব্যর্থ হয়ে নিশ্চিত হলেন যতেœ লালিত থুতনির দাড়িগুলো এখন শুমারিসীমা অতিক্রম করেছে। বিশেষ করে আজকের ডাল অনুভূতির কথা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না। আহ্ বড়ই তৃপ্তির অনুভূতি। অম্লমধুর স্মৃতি রোমন্থন করতে করতেই আরো একটি মিষ্টি হাসি দিলেন তিনি।
কি অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড! গোফরান সাহেব সামান্য একটি হাসি দিয়েছেন মাত্র, তাও নিঃশব্দে। কিন্তু তার কানে এসে প্রবেশ করল অসংখ্য হাসির কলরোল। পুকুরের মাঝখানে ঢিল ছুড়লে একটি ঢেউ থেকে যেমন পুকুরজুড়ে অসংখ্য ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়, ঘটনাটা ঠিক তেমনি ঘটল। ভূতটুত ভর করেনি তো তার ওপর? আধোঘুমে ডুবে থেকেই নিজের গায়ে চিমটি কাটলেন। পরক্ষণেই ককিয়ে উঠলেন ব্যথায় । সবকিছুই দেখি ঠিকঠাক আছে। অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি। হয়তো সেটা মনের ভুল হতে পারে। আসলে হাসিটাসির কোনো শব্দই হয়নি। এবার নিশ্চিন্ত হতে যাচ্ছিলেন তিনি। পরপরই ভাবলেন পরীক্ষামূলকভাবে আরো একটি হাসি দিয়ে দেখা দরকার। যেই ভাবা সেই কাজ, ঠোঁট দুটোকে দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে দাঁতগুলো বিকশিত করলেন। ওম্মা! এবার দেখি হাসির চোটে কানে তালা লেগে যাওয়ার অবস্থা হলো। তালা প্রায় লেগেই গিয়েছিলো, যদি তৎক্ষনাৎ চোখ না খুলতেন তিনি-
ততক্ষণে গোফরান সাহেবকে ঘিরে অসংখ্য মানুষের জটলা তৈরি হয়েছে। কেউ হু-হু-হু করে হাসছে, কেউ হাহ্ হাহ্ করে। আবার কারো পেটে খিল ধরে মরণাপন্ন অবস্থা। গোফরান সাহেব ঘটনার আদ্যোপান্ত ঠাহর করতে পারছেন না। এ দিকে বেরসিকের দল তাকে ঘিরে হেসেই চলেছে। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে তিনি মোটামুটি ধরনের নিশ্চিত হয়েই গেছেন সুকুমার রায়ের বড়বাবুর মতো তার গোঁফজোড়াও বুঝি চুরি গেল। আচমকা চেঁচিয়ে উঠলেনÑ ওরে আমার গোঁফ গিয়েছে চুরি।
চুরি হবে কেনো, ডাকাতি। তারই এক সহকর্মী পরিস্থিতি সম্পর্কে সামান্য ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করলেন।
একি অনাসৃষ্টি! দিনদুপুরে ডাকাতি!
গোফরান সাহেবের গোঁফজোড়া বুঝি এবার খোয়াতে হবে। টিটকিরি করলেন ভিড়ের মধ্য থেকেই আরেকজন।
এতবড় স্পর্ধা! ডাকাতির হুমকি! উত্তেজিত বাতচিত শুরু করলেন গোফরান সাহেব। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এক হাত দেখে নেয়ার উদ্দেশ্যে।
অভ্যাগতদের মাঝে এতক্ষণ যারা মূল ঘটনাটি দেখতে পাচ্ছিলেন না, এবার তারাও স্পষ্ট করে দেখার সুযোগ পেলেন। রাগে গজগজ করতে থাকা গোফরান সাহেবের ডালমাখা গোঁফজোড়ায় লেপ্টে আছে চুইংগাম। বড়ই আঠাল পদার্থ এটি। একবার গোঁফে লেপ্টে গেলে শেভ না করে উপায় থাকে না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অফিসজুড়ে লেগে গেল মহা হট্টগোল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে গোফরান সাহেবের মুখের চুইংগাম গোঁফে লাগল কিভাবে?
কে জানে কিভাবে।