শনিবার, জুলাই ১৭, ২০১০

ছায়ার মতো আগলে রাখে

- কী রে ময়না, বাপের লাইগ্রা অত উতলা অইছস কেরে?
পিঁড়িতে বসে মেয়ের মাথায় বিলি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করল মা।
- রেডুত (রেডিওতে) কইছে আউজ্জা (আজ) সারাডা দিন বাপজানের লগে থাহনের লাইগ্যা।
- কেরে আউজ্জা কী অইছে?
- আউজ্জা বুলে বাবা দিবস। পৃথিবীর সব মানুষই আউজ্জা বাবার লগে কাডাইব। কিন্তু আমারে ঘুমে থুইয়াই বাপজান যে বাইর-অইল, অহন-অতো আইল না।
- এই দেহ ছেরির মুহঅ (মুখে) যত আকাইম্মা কথা। তর বাপের কি আর কামকাইজ নাই যে সারা দিন তর লগে বইয়া থাকব!
ময়নার মাথায় ভর্ৎসনাসুলভ মৃদু একটি ঝাঁকি দিয়ে কথাগুলো বলল মা। তারপর আবার মনোযোগ দিলো বিলি কাটায়। দুই হাঁটু ভাঁজ করে লক্ষ্মী মেয়ের মতো সামনের পিঁড়িটায় বসে আছে মা। ঠিক বসে থাকা নয়, বেশির ভাগ সময় পায়ের পাতার সামনের দিকটার ওপর ভর করেই উঁকি দিয়ে থাকতে হচ্ছে তাকে। কান্তি পেয়ে বসলে ভরসা হিসেবে পিঁড়িটা নিচে রয়েছে এই যা। চুলের ভাঁজে ভাঁজে মায়ের কোমল হাতের সঞ্চালন বেশ ভালোই লাগছে ময়নার। আরামে চোখ লেগে আসছে। বেশ কয়েকবারই ডলে পড়ে যাচ্ছিল। রাজ্যের ঘুম এসে চোখে ভিড় করলে কী-ই বা করার আছে ওর। কিন্তু মায়ের ঝাঁকুনি খেয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শক্ত হয়ে বসতে হয়েছে তাকে। একটু-আধটু ঝাঁকুনি আর বকুনি দিলেও মা-টা তার ভীষণ ভালো। আদর আর ভালোবাসা দিয়ে একেবারে আঁচলে আগলে রাখতে চায় ময়নাকে। আর এ কারণেই মাকে ছাড়া কোথাও গেলে এক দিনের জন্যও ভালো রাগে না ময়নার। ইস্! বাবাটাও যদি এমন হতো, তাহলে আর কোনো দুঃখই ছিল না ময়নার। একদমই বাড়িতে থাকে না বাবা। আর থাকলেও দোকানের কেনা-বেচা নিয়েই সময় পার করে। মাঝে মধ্যে ময়নাকেদোকানে বসিয়ে উধাও হয়ে যায়। সারা দিন ব্যস্ত থাকে হাটবাজারে। পৃথিবী ফর্সা হওয়ার আগেই হাওরে চলে যায় ক্ষেতের কাজে। এসব একদমই ভালো লঅগে না ওর কাছে।
- আইচ্ছা মায়া (মা), বাপজান তোমার লাহান (মতো) অইল না কেরে?
ময়নার আচমকা প্রশ্নে হাতের সঞ্চালন থামিয়ে ঝুলে থাকা কাপড়ের আঁচলটা নিজের কাঁধে ছুড়ে দিলো মা। তারপর আরাম করে পিঁড়িটায় বসে বলল,
- দেহ আমার ছেরির ঢঙের কথা! তর বাপ হিবার আমার লাহান অইত কেরে?
- তুমি যেমুন সারাক্ষণ আমার পাশে থাহ, বাপজান তো থাহে না। সারা দিন খালি এইহানে ওইহানে যায়।
- বেক্কলের (বোকার) কথা হুনছনি! সারাদিন বাইত বইয়া থাকলে, কামাই না করলে আমরার সংসার চলব কেমনে?
কথাটা ঠিকই বলেছে মা, ভাবল ময়না। বাবার এত ব্যস্ততা, এত ম্রম সব তো তার জন্যই। এটা এনে দাও, ওটা কিনে দাও এসব আবদার তো বাবার কাছেই করে সে। ওর ভালো লাগায় বাবাকে উৎফুল্ল হতে যেমন দেখেছে, তেমনি ওর মন ভার থাকলে বাবাকেও মন বার করে বসে থাকতে দেখেছে। কিন্তু যেমনভাবে মায়ের ভালোবাসার স্পর্শ অনুভব করে ময়না, বাবার বেলায় তেমনটি নয়। তবে বাবার বলিষ্ঠ হাত আর দূর থেকে ভালোবাসা যে সারাক্ষণ ছায়ার মতো আগলে রাখে তাকে, তা বেশ ভালোভাবেই অনুধাবন করে ময়না।
- বাপজান কোন সুময় আইব মায়া? বাবা দিবস-ত শেস অইয়া যাইতাছে।
- অইছে হুনছি, বেঢঙের কথা, এক দিনের লাইগ্যা অত দরদ ইতলাইয়া পড়ন বালা না (ভালো না)।
বলতে বলতে পায়ের পাতার ওপর ভর করে উঁচু হলো মা। পাশে রাখা টিনের বাটি থেকে তেল নিয়ে মাখতে লাগল ময়নার মাথায়। আর সেও বুঝে গেল এখন আর কথা বাড়ানো ছলবে না। অর্থাৎ চুপ করে মাকে মায়ের কাজ করতে দিতে হবে।
২০ জুন, ২০১০

কোন মন্তব্য নেই: