শনিবার, জুলাই ১৭, ২০১০

নেমে এলো ঝুম বৃষ্টি

ধুকপুক ধুকপুক করে পাশ কাটিয়ে গেলো একটি ট্রলার। বেপরোয়া পানি ধেয়ে এসে ধাক্কা খেলো কলার ভেলাটিয়। প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো ময়নারা। কিছুক্ষন তিড়িংবিড়িং এপাশ-ওপাশ দুলে তারপর শান্ত হলো ওরা। শান্ত বলতে একেবারে স্থির হয়ে গেছে এমনটি নয়। মৃদু বাতাসের দোলায় দুলছে পুরো হাওর। সেই সাথে দুলছে ময়নাদের ভেলা। এ দুলুনিতে ভেলার স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত হলেও এর মাঝে রয়েছে ছন্দ। পানিতে এলোমেলো আলোড়ন তুলে ছুটে চলা ট্রলারের ঢেউয়ের মতো বেপরোয়া নয়। তবে তুমুল বর্ষায় হাওরের বিচিত্র খেয়ালের হদিস পাওয়া ভার। এই হয়তো দেখা গেল স্থির জলধি। যেন জলজ চাদর বিছিনো রয়েছে আকাশ অবধি। আকাশ আর হাওরের নীলে মিলে-মিশে একাকার। আবার হয়তো মুহুর্তের মাঝেই ঘটে যেতে পারে পরিবর্তন। ক্ষ্যাপা বাতাসের উন্মত্ত শক্তিতে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলতে পারে শান্ত জলধিকে। ধেয়ে আসা একেকটা ঢেউ যেন দুই মানুষ সমান। হাওরের এ অগ্নিমূর্তি প্রতি বর্ষায়ই দেখে ময়না। আর এ কারনেই ছোট্ট কলার ভেলায় ভেসে খুব একটা দুরে যায়নি ওরা।
- লগ্যিডাত (লগিতে) একটু ভর দে দুলাল। আমি একটু জিরাইয়া লই।
এক টুকরো গামছার নেংটি ছারা আর কিছুই নেই ছিপছিপে শীরের এ ছেলেটার গায়ে। ময়নার একনিষ্ঠ চ্যালা হিসাবেই ওর পরিচয়। ভেজা শরীর নিয়ে এতক্ষন বসে কাঁপছিলো সে। তাই ময়নার আদেশ পেয়ে আর দেরি করলোনা দুলাল। প্রথমে ভেলার সামনের দিকটায় এগিয়ে গেল। তারপর পানিতে লগি ফেলে তলা নাগাল পেয়ে সজোরে ভর দিলো। ভরের বিপরীতে ভেলাটি এগিয়ে চললো সামনের দিকে। আর সম গতিতেই পেছাতে থাকলো সে। একেবারে শেষ মাথায় চলে এসেই ছপ করে তুলে নিলো লগি। তারপর আবার এগুলো সামনে। এভাবে একের পর এক লগির ভরে ঢেউ কেটে কেটে কেটে ভেলা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুলাল। আর দু’পা ছড়িয়ে আয়েস করে বসে আছে ময়না।
- এই দুলাইল্লা, একটা গান ধরছনা
উৎফুল্ল হযে উঠল দুলাল। লগির ভর কোমল করে দিয়ে বড় করে একটি শ্বাস নিয়ে নিলো। তারপর কচি গলা ভাসিয়ে দিলো হাওরের মৃদু বাতাসে ‘মন মাজি তঅর বৈডা নেরে/আমি আর বাইতে ফারলাম না.....’
তাচ্ছিল্ল করল ময়না
- আরে ধুরু তুই এইহান-অ বইডা (বৈঠা) পাইলি কই? বোরা (ভেলা) বাইতাছস লগ্যি দিয়া ভরাইয়া (ভর দিয়ে) আর গাণের মইদ্যে কছ বইডার কতা!
- লগ্যির কোন গাণ জানিনা আমি।
- কী ছাতা জানস তুই?
লজ্জায় মাথা নুইয়ে রাখলো কিছুক্ষন। তারপর হঠাৎই যেন উদ্যম ফিরে পেল দুলাল। দ্বিগুণ শক্তিতে লগিতে ভর দিয়ে তীর বেগে ভাসিয়ে চললো ভেলা। আর আবৃত্তি করতে লাগলো ‘স্বর-অ, স্বর-আ/লগ্যি দিয়া ভরাইয়া/মাস্টর গেছে আরাইয়া/হ্রস্য-ই, দীরগু-ঈ/মাস্টর পাইছি....”
হেসে কুটি কুটি ময়না। সংক্রমিত হয়েছে দুলালও। হাসির দমকে ভেলা থেকে পড়ে যাওয়ার অবস্থা আরকি। হাসছে, হাসছে আর হাসছে। চোখ থেকে গড়িয়ে পরছে জল। তারপর আকাশ থেকে নেমে এলো ঝুম বৃষ্টি। তুমুল বর্ষার এ বর্ষণ ওদের হাসি নি:সৃত জলকে একাকার করে দিলো আকাশ আর হাওরের নীলের সাথে।
৪ জুলাই ২০১০

কোন মন্তব্য নেই: