শুক্রবার, জানুয়ারী ২৭, ২০১২

দাবার রাণী

রাণী হামিদ। দাবার রাজ্যের এক রাণীর নাম। খেলায় তিনি প্রতিপরে মন্ত্রী-সেপাই ধ্বংসের নীলনকশা করে গেলেও তার জীবনের উপলব্ধি ‘যুদ্ধ নয় শান্তি’। এবারের প্রচ্ছদ রচনা রাণী হামিদকে নিয়ে। তৈরি করেছেন শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদসোহেল অটল


রাণী হামিদের ড্রয়িং রুমে দাবার বোর্ড থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। শুধু স্বাভাবিক-ই নয়, বরং একজন আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টারের বাসায় সেটা না থাকলেই বেমানান হতো। রাজা-মন্ত্রী, হাতি-ঘোড়া, কিস্তি-সেপাইগুলো নির্দিস্ট ঘরে সাজানো। যে কেউ দেখে মুগ্ধ হবেন। আর মুগ্ধ হবেন কজুড়ে সাজানো শিরোপা আর শিরোপা দেখে।
ভেতর ঘর থেকে অনেকটা হঠাৎ-ই এসে হাজির হলেন তিনি। মুখে স্মীত হাসি ‘অনেকন বসিয়ে রাখলাম তোমাদের। আসার আগে আরেকবার ফোন করবে না? তাহলে আগেই তৈরি হয়ে থাকতাম।’
বেলা তখন পড়ে এসেছে। সন্ধ্যা হয় হয়। ঠিক হলো আগে ফটো সেশনের কাজ। চলে যাওয়া হলো আউটডোর তথা তার বাড়ির সামনে। পুরনো ডিওএইচএস-এ ছিমছাম বাড়ি। তিনতলা বাড়ির খোলামেলা বিন্যাস, বিস্তৃত আঙিনা, প্রশস্ত লন সবই আকর্ষণীয়। ছবি তোলা হলো আউটডোরে, অত:পর ইনডোরে। তারপর আবার ড্রয়িং রুম এবং জীবনের ডায়েরি খোলে বসা-

বেড়ে ওঠা
স্মৃতি হাতড়ানোর জন্য একটু সময় ভাবলেন তিনি। তারপর একলাফে চলে গেলেন শৈশবের অধ্যায়ে। যে অধ্যায়টি তিনি পাড়ি দিয়ে এসেছেন নানা দুরন্তপনায়। ‘আমি ছোটবেলা থেকেই ছিলাম দূরন্ত। খেলতাম, ঘুরতাম, ফিরতাম। বলা নেই কওয়া নেই হরহামেশাই এখানে সেখানে উধাও হয়ে যেতাম। হারিয়ে যেতাম গ্রামের মেঠো পথে। ঘুরে বেড়াতাম এ গ্রাম ও গ্রাম।’
শৈশবে যেমন করেছেন দুষ্টুমি তেমনি অনেক বোকামীর কথা মনে হলে আজো তিনি হেসে কুটি কুটি হন। তেমনি এক ঘটনার কথা শোনালেন ‘আমি আর আমার বড় বোন পারু তখন একই স্কুলে পড়তাম। পারু আমার ওপরের কাসে পড়তো। সে ছিলো আমার চেয়ে ফর্সা এবং সবসময় টিপটপ হয়ে থাকতো। আর আমি ছিলাম কালো ও রোদে পোড়া। তাই কাসের মেয়েদের কেউ বিশ্বাসই করতে চাইতো না যে আমরা দু’জন সম্পর্কে আপন বোন হই। তাই একদিন এক মেয়ে জিজ্ঞেস-ই করে বসলো- তোমরা দু’জন কি আপন বোন? আমি তো তখন আপন বলতে কি বোঝায় সেটাই বুঝিনা। বেশ ভড়কে গেলাম, কি জবাব দেব! একটু ভেবে আবিষ্কার করলাম, আপন বলতে ওরা হয়তো বোঝাচ্ছে পর। তাই আমি বললাম- পারু আমার আপন বোন নয়, নিজ বোন। তারপর সবার হাসতে হাসতে গড়াগড়ি যাওয়ার অবস্থা।’
শৈশবের কতা মনে হতেই রাণীর সামনে যে ছবিটি ভেসে ওঠেÑ তিনি হলেন তার বাবা। বাবার আগ্রহের কারণেই তিনি ছিলেন অনেক প্রাণবন্ত। করতে পেরেছেন খেলাধুলা। বাড়িতে ছিলো টেনিস খেলার চর্চা। স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বাবা তার নাম দিয়ে আসতেন।
রাণীর খেলাধুলার ব্যপারে আগ্রহ ছিলো শিকদেরও। তারা চাইতেন সে যেনো দৌড় অব্যহত রাখে। শিকরা স্বপ্ন দেখতেন একদিন জাতীয় দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে রাণী। সেই থেকে ছোট্ট রাণীর দৌড় শুরু। এখনো চলছে। তবে অ্যথলেট হিসাবে নয়। সে দৌড় দাবার দৌড়। জাতীয় পর্যায়ের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জতিক পর্যায়ে। তিনি দাবাড়– হিসাবে আজকের রাণী হামিদ হয়ে উঠেছেন মূলত বাবার আগ্রহের কারনেই ‘বাবাই আমাকে দাবার বোর্ড কিনে দিয়েছিলেন। স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সবসময় পুরস্কার পেতাম আমি। আর এতে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন বাবা। কিন্তু মেয়েদের অ্যথলেট হতে গেলে তো কিছু সমস্যা থাকেই। সে কারণে আমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে আউটডোর খেলা থেকে কোজ করে আনতে থাকলেন বাবা। তাই অবসর সময় কাটানোর জন্য দাবা খেলার প্রতি উৎসাহ দিতেন। তবে অবশ্যই পড়ালেখার যেন তি না হয় সে ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। বাবা যখন বাড়িতে থাকতেন না, তখন ছোট ভাইকে নিয়ে দাবার বোর্ডেই মজে থাকতাম।’
বাবা সৈয়দ মমতাজ আলী ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। চাকরির কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে তাকে কাটাতে হয়েছে। আর এ কারনেই তার সন্তানদের পরিবর্তন করতে হয়েছে অনেক স্কুল। রাণীর প্রাথমিক শিা শুরু হয় চট্টগ্রাম নন্দনকানন গার্লস হাইস্কুলে। তিনি ১৯৫২ সালে সরাসরি ২য় শ্রেণীতে ভর্তি হন। তখন স্কুলের ওপরের শ্রেণীর শিার্থীরা তাকে ডেকে মিছিলে নিয়ে যেতো। কিসের মিছিল, অতশত তিনি বুঝতেন না। মিছিল হবে, ব্যস। একধরনের থ্রিলতো পাওয়া যাবে। এখন তিনি সে স্মৃতি মনে করে গর্ববোধ করেন। কারণ মিছিলগুলো ছিলো রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে।
১৯৫৪ সালে বাবা বদলি হয়ে যান কুমিল্লায়। রাণীও সেখানকার মিশনারি স্কুলে ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণি পড়েন কুমিল্লার ফয়জুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলে। তারপর বাবার বদলির কারণে আবার তাকে কুমিল্লা ছেড়ে চলে যেতে হয় রাজশাহীতে। ৮ম ও ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন রাজশাহীর একটি স্কুলে। ১০ম শ্রেণীতে পড়েন সিলেট বালিকা বিদ্যালয়ে। এ স্কুল থেকে তিনি মেট্রিক পাশ করেন ১৯৬০ সালে। পরবর্তীতে আর কলেজে ভর্তি হননি। কিন্তু ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে প্রাইভেট পরীা দিয়ে ইন্টারমিডিয়েট এবং ডিগ্রী পাস করেন। একাডেমিক পড়ালেখা তার কাছে ছিলো পানির মতো সহজ। ছাত্র-ছাত্রীরা কেন পরীায় ফেল করে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এর কোন জবাব খোঁজে পান না তিনি।

সংসার
বাংলাদেশের প্রোপটে একজন নারীর জীবনে প্রথম বাবা, তারপর স্বামী এবং সবশেষে সন্তানদের গুরুত্ব বেশি থাকে। রাণী হামিদও এেেত্র ব্যতিক্রম নন। মাত্র পনের বছর বয়সে তিনি শুরু করেন বিবাহিত জীবন। ১৯৫৯ সালে তার বিয়ে হয় সেনা কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আব্দুল হামিদের সাথে। তখন তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর একজন সাঁতারু হিসেবেও রেকর্ড করেছিলেন। আব্দুল হামিদ বহুল আলোচিত কয়েকটি বইয়েরও লেখক। এর মাঝে রয়েছে 'তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা'। এছাড়া তিনি আরো চারটি বই লিখেছেন। স্বামীর সহযোগিতায়-ই রাণীর পে এতদুর আসা সম্ভব হয়েছে ‘দাবা খেলায় আমি মনযোগ দিতে পেরেছি কেবল আমার স্বামীর কারণে। খেলার জন্য আমাকে প্রায়-ই দেশ ও দেশের বাইরে যেতে হয়েছে। এসব ব্যাপারে তিনি ছিলেন উদার। তিনি সবসময়-ই আমার বায়োডাটা আপগ্রেড রাখতেন। তাছাড়া আমাকে কখন কী করতে হবে এসব তদারকি তিনিই করতেন।’
রাণী হামিদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে ছাড়া পরিবারের সবাই খেলা-ধুলার সাথে যুক্ত। বড় ছেলে কায়সার হামিদ বাংলাদেশের একজন তারকা ফুটবলার। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলেছেন অনেক দিন। আশি ও নব্বই এর দশকে খেলতেন মোহামেডান স্পোর্টিং-এর হয়ে। কায়সার হামিদ ছিলেন সে আমলের সেরা সেন্ট্রাল ডিফেন্ডারদের একজন। দীর্ঘদিন মোহামেডানের অধিনায়ক ছিলেন। মেজ ছেলে সোহেল হামিদ স্কোয়াস ফেডারেশনের সম্পাদক ও একজন ক্রিকেটার এবং ছোট ছেলে শাহজাহান হামিদ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। মেয়ে জেবিন হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করে কিছুদিন পিআইবিতে কিছু দিন চাকরি করেছেন। বর্তমানে তিনি লেখালেখি করেন।

দাবার বোর্ডে
দাবাকে পেশা হিসাবে নেয়ার জোরালো ইচ্ছা তার কখনো ছিল না। একজন গৃহিনী হিসাবে সময় কাটানো এবং আনন্দের জন্য তিনি দাবা খেলাকেই বেছে নেন ‘আনন্দের জন্যই আমি দাবা খেলি। তাছাড়া দাবা এমন একটি খেলা, যা সব বয়সেই খেলা যায়। আমার ছেলে কায়সার হামিদ ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছে। অথচ তার মা হয়েও আমি এখনো জাতীয় দলে খেলছি। এটাওতো উপভোগ্য বিষয়। আর প্রচলিত অন্যান্য খেলাধুলার জন্য শারিরীক সমতার প্রয়োজন। কিন্তু দাবায় সেটার দরকার হয়না। এখানে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাই মূখ্য।’
দাবা খেলে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করলেও এর জন্য দৈনন্দিন জীবনের অন্য অনুষঙ্গগুলো বাদ দিতে রাজি নন তিনি। ব্যস্ত জীবনের চেয়ে ঘরের জীবন-ই তার বেশি পছন্দ। তবে কোনকিছু অর্জনের জন্য যতটুকু পেশাদারি হতে হয় ততটুকুতো রয়েছেই।
আর সেই পেশাদারিত্বটুকু পাকা হয়েছে বিয়ের পর। খেলাধুলার প্রতি তাঁর স্বামী আব্দুল হামিদের আগ্রহ ও উৎছিলো ব্যাপক। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট-এর কোয়ার্টারে থাকতেন তারা। তখন তাদের প্রতিবেশি ছিলেন জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন ডঃ আকমল হোসেন। তাঁর কাছ থেকেই শেখেন খেলার আন্তর্জাতিক নিয়ম কানুন। পরবর্তীতে ড: আকমলের সহযোগিতায়-ই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিতে থাকেন। ১৯৭৬ সালে প্রথম মহসিন দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন।
জাতীয় দাবা প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম অংশ নেন ১৯৭৭সালে। সে খেলায়-ই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যান ‘তখন আমি চার বাচ্চার মা। তখনকার অনুভূতি ছিলো খুবই আনন্দের। দৈনিক বাংলার প্রথম পৃষ্ঠায় আমার ছবি এসেছিলো। জিরো থেকে হিরো হওয়ার মতো আরকি। এরপর আমাকে আর ঠেকায় কে। পরপর ৯ বার জাতীয় পর্যায়ে খেলে প্রতিবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছি।’
১৯৮১ সালে তিনি ভারতের হায়দারাবাদে এশিয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে কৃতিত্বের স্বার রাখেন। তিনি কমনওয়েলথ এর একজন শীর্ষ দাবাড়–, আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার ও জাতীয় নারী দাবা চ্যাম্পিয়ন। তিনি এ পর্যন্ত তিনবার ব্রিটিশ নারী দাবা চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। এখন আর ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে পারেন না। কেন? এ নিয়ে রয়েছে আরেক মজার কাহিনী- ব্রিটিশ মহিলা দাবাড়–রা যখন বাংলাদেশি রাণী হামিদের কাছে বার বার পরাজিত হচ্ছিলেন, তখন বিষয়টি তাদের কাছে অপমানজনক মনে হচ্ছিলো। তারা দাবি তোললেন ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপে অন্যদেশের নারীরা খেলতে পারবে না এবং কর্তৃপ তা-ই করলো।
রাণী হামিদ দাবা অলিম্পিয়াডে যোগ্যতার ভিত্তিতে জাতীয় পুরুষ দলের হয়েও অংশ নিয়েছেন। পুরুষ দলের হয়ে খেলতে যাওয়ায় রয়েছে তার মজার অভিজ্ঞতা ‘একবার গ্রীসে খেলতে যাই পুরুষ দলের হয়ে। আমার খেলা তখনো শুরু হয়নি। অন্য অনেকেই খেলছে। ভাবলাম বাইরে গিয়ে চা খেয়ে আসি। চা খেয়ে যখন ফিরছিলাম, তখনি বাঁধলো গন্ডগোল। নিরাপত্তারীরা কিছুতেই আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না। ওরা বার বার বলছে, মহিলা দলের খেলা ওদিকে হচ্ছে এখানে নয়। কিছুতেই বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না যে, আমি পুরুষ দলের হয়ে খেলছি। তার ওপর আরো সমস্যা হলো, ওরা ইংরেজি ভাষা বোঝে না। ভেতরে ঢুকতে দেবে না তো দেবেই না। তারপর অনেক ঝক্কি-ঝামেলা করে ঢুকতে পেরেছিলাম।’
বাংলাদেশের যে মানুষটির কাছে দাবা পরিচিত, তার কাছে রাণী হামিদ নামটিও পরিচিত। শুধু দেশে কেন, দেশের সীমানা ছাড়িয়েও তার রয়েছে অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী ‘একবারের ঘটনা। ২০১০ সালে গ্রীসে গিয়েছিলাম খেলতে। বাসে করে এক যায়গা থেকে অন্য যায়গায় যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি রাস্তার মাঝখানে বাস থেমে গেছে। আরে কী কান্ড! তাকিয়ে দেখি বাস চালক সিটে নেই। কোথায় যেনো উধাও হয়ে গেছেন। কিছুন পর চালককে আবিষ্কার করলাম আমার সামনে। হাতে একতোড়া ফুল। আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছেন। আমি তো হতভম্ব! এই লোক আমাকে চিনল কি করে!’

সময় কাটে
রাণী হামিদ তার জীবনকে তিনভাগে ভাগ করেন- বাল্যকাল, মাধ্যবয়স এবং সর্বশেষ বৃদ্ধ বয়স। এ তিনভাগকে তিনি তিন রকম করে উপভোগ করেছেন। তিনটি ভাগই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের দিকে তাকালে যখন সন্তানের মা হলেন সে সময়টাকে তিনি গুরুত্ব দেন। আবার দাবা খেলার দিকে তাকালে এ বয়সটাকে গুরুত্ব দেন। তিনি মনে করেন মানুষের জীবনের কোন সময়-ই গুরুত্বহীন নয়।
দাবার বোর্ডে তিনি প্রতিপরে মন্ত্রী- সেপাই ধ্বংসের নীলনকশা করে গেলেও তার জীবনের উপলব্ধি ‘যুদ্ধ নয় শান্তি। সুখে থাকো, শান্তিতে থাকো। মানুষকে কষ্ট দিয়ো না। পারলে উপকার করো। না পারলে কারো অপকার করো না।’
খাওয়া, ঘুম আর টিভি দেখেই বেশিরভাগ সময় কাটে তার। তিনি মনে করেন স্বামী জীবিত না থাকলে মহিলাদের তেমন কোন দায়িত্ব থাকে না। তিনিও এখন দায়িত্বমুক্ত। সারাদিন নাতি-নাতনীদেরকে নিয়ে হই-চই করে কাটিয়ে দেন ‘এখন নাতিরাই আমার সঙ্গি। এই যে এখানে দেখছ তিনজনকে, (ড্রয়িংরুমে উপস্থিত নাতিদের দেখিয়ে) লম্বাটা হলো সাদাত, ওটা আয়মান। আর এটা হলো মোস্তফা। আমি ডাকি সনু, মনু, মস্তু। নামগুলো লিখে দিয়ো কিন্তু। সনুকে আমি দাবাড়– বানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রথমেই একটি ভুল করে ফেলেছি। বড় একটি টুর্নামেন্টে খেলতে পাঠিয়েছিলাম। সেখান থেকে হেরে এসে দাবার প্রতি ভীতি তৈরি হয়েছে ওর। তারপর আর ইনডোর খেলার প্রতি আগ্রহ নেই। বাপের মতো (কায়সার হামিদের) ফুটবল খেলার নেশা।’

অত:পর
আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত এক মাত্র বাংলাদেশী মহিলা দাবাড়– রাণী হামিদ তার সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় সাপোর্ট পাননি সরকারের কাছ থেকে ‘বাংলাদেশে দাবা খেলার পৃষ্ঠপোষকতা নেই। একটি পর্যায়ের পর খেলোয়ারদের বড় ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। যার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সাপোর্ট আমরা পাই না। নিয়মিত টুর্নামেন্ট খেলার জন্য স্পন্সর যোগার করাও এদেশে দুস্কর। দাবাতে স্পন্সররা বেশি আগ্রহী হন না। কারণ মিডিয়া এ খেলাটি সেভাবে প্রচার করে না। দাবার চলতি খবরগলো গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় না। ফলে মানুষও জানে না বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কে হচ্ছে। অন্যান্য খেলার মতো দাবার বড় বড় টুর্নামেন্টগুলোর খবর পত্রিকায় আসা উচিত।’

অত:পর রাণী হামিদের ডায়েরির পাতা প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। ঠিক তখনি হাস্যবদনে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলেন তার বড় ছেলে কায়সার হামিদ। যথারীতি কুশলাদী বিনিময় এবং ফটো সেশন। অবশ্যই মায়ের সাথে।

ছবিগুলো তুলেছেন ইমশিয়াত শরীফ

এক টুকরো রাণী হামিদ

পুরো নাম: সৈয়দা জসিমুন্নেসা খাতুন
জন্ম: ১৯৪৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি
ববা: সৈয়দ মমতাজ আলী (পুলিশ কর্মকর্তা)
মা: মোসাম্মাত্“ন্নেসা খাতুন
ভাই-বোন: সৈয়দ আমীর আলী (অবসরপ্রাপ্ত এসপি), এয়ার কমান্ডার শমসের আলী, সৈয়দ দেলোয়ার আলী, সৈয়দ মোতাহের আলী, জমীরুন্নেসা খাতুন (পারু), সৈয়দা লুত্ন্নেসা খাতুন, মিনু মমতাজ।
বিয়ে: ১৫ বছর বয়সে ১৯৫৯ সালে
স্বামী: মোহাম্মাদ আব্দুল হামিদ (সাবেক সেনা কর্মকর্তা)
সন্তান: কায়সার হামিদ (ফুটবলার), সোহেল হামিদ (স্কোয়াস ফেডারেশনের সম্পাদক), শাহজাহান হামিদ (টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার), জেবিন হামিদ (লেখক)।
শিাগত যোগ্যতা: ডিগ্রি
প্রকাশিত বই: মজার খেলা দাবা, দাবা খেলার আইন কানুন।

কোন মন্তব্য নেই: