মঙ্গলবার, অক্টোবর ২৩, ২০১২

ষাঁড়ের চোখে লাল পট্টি


শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
গরুর মতো কাণ্ড করে বসল ষাঁড়টা। শাহজাহান আলীর হাত ফসকে সোজা দৌড়ে গেল তোতা মিয়ার দোকানের দিকে। রে রে করে উঠল সবাই। বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছিল মন্তাজ উদ্দিন। তড়িঘড়ি সরতে গিয়ে গায়ে পড়ল চায়ের কাপ। পায়ে পায়ে প্যাঁচ খেয়ে হুমড়ি খেলো সবুজ। রুখে দাঁড়ানোর জন্য নেংটি আঁটল উইল্লা চোরা। আর দোকানের ভেতরে উঠে দাঁড়াল তোতা মিয়া। পাশেই আতঙ্কিত ময়না। ওর গায়ে লাল জামা। এই লাল জামা লক্ষ করেই ছুটছে পাগলা ষাঁড়। পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে শাহজাহান আলী ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। চিৎকার করে মেয়েকে পালাতে বলল তোতা মিয়া। ময়নাও হন্তদন্ত হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে হারিয়ে গেল ভেতর বাড়িতে।
তবুও ষাঁড়টাকে থামাতে পারল না উইল্লা চোরা। ময়নাকে চলে যেতে দেখে মাথার গুঁতোতে গুঁড়িয়ে দিলো দোকানের সামনের দিকটা। অন্ধ রাগে তছনছ করল সব। ছিটকে গেল চানাচুরের বয়াম। বাতাসে উড়ল চকোলেট ও চুইংগাম। চৌকিজুড়ে গড়াগড়ি খেলো কেরোসিনের টিন। এবার ঘুরে দাঁড়াল ষাঁড়টা। কেরোসিনের উৎকট গন্ধ সহ্য হয়নি তার। হাম্বা... করে লম্বা ডাক ছাড়ল। তারপর লাফ দিলো উল্টো দিকে।
কিন্তু ততক্ষণে টান পড়ে গেল গলার দড়িতে। উইল্লা চোরা, শাহজাহান আলী ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা কব্জা করে ফেলেছে ওটাকে। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করতে হলো আরো। তারপর সব শান্ত। ষাঁড়টা বাঁধা পড়ল আম গাছে। আবার সবাই জড়ো হতে লাগল দোকানের সামনে। ময়নাও লাল জামা বদলে উঁকি দিলো ভেতর বাড়ি থেকে। তারপর তাকিয়ে দেখল ওটাকে। শাহজাহান আলীর কোরবানির গরুটা যেমন নাদুসনুদুস, তেমন তেজী। আর একটু হলে তো তাকে শিঙের আগায় ঝুলিয়েই ফেলত। উইল্লা চোরা না থাকলে একে সামলানো যেত কি না সন্দেহ। চুরির অভ্যাসটা পুরোপুরি ছাড়তে না পারলেও উইল্লা চোরার এই গুণগুলো ভালো লাগে ময়নার। যে কারো বিপদে সাহসের সাথে দাঁড়িয়ে যায় সে। শুধু ময়নাই নয়, তাকে পছন্দ করে সবুজ ভাইও।
কিরে সবুজ, তোর কলেজ বন্ধ নাকি? ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে জিজ্ঞেস করল শাহজাহান আলী।
‘ঈদের সময় তো কলেজ বন্ধই থাহে।’ সোজা প্রশ্নের বাঁকা জবাব দিলো সবুজ। অবশ্য এতে কিছুই মনে করল না শাহজাহান আলী। একটা কিছু বলে কথা শুরু করা প্রয়োজন ছিল, তা হয়ে গেছে। এবার আসল আলোচনায় যাওয়া যায়Ñ গরুটা কিমুন কিনলামরে সবুজ?
দেখতাছি তো ভালাই।
‘আরে ভালা তো অইতেই অইবো। দেখতে অইবো না কেডা কিনছে!’ এতটুকু বলে ষাঁড়ের পেছন দিকে সজোরে চাপড় বসালো শাহজাহান আলী। সাথে সাথেই হাম্বা ডাক দিয়ে হিশু করতে শুরু করল ওটা। অমনি হাসি এসে গেল ময়নার। শব্দ করে হাসলও। পরক্ষণেই বাবার ধমক খেয়ে চুপ মেরে যেতে হলো। তবে মেয়েকে ধমক দিয়ে নিজের হাসির দমক আটকে রাখতে পারল না তোতা মিয়া। গোঁফের আড়ালে হালকা হাসির রেখা দেখা দিলো মন্তাজ উদ্দিনের ঠোঁটেও। কিন্তু শাহজাহান আলীকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখে প্রসঙ্গ পাল্টালো মন্তাজ উদ্দীনÑ গরুটা কয় শরিকে কিনছস?
আমতা আমতা শুরু করল শাহজাহান আলী। গলা টেনে বললÑ আ...ছে...। শরিক আছে।
ব্যাপারটা পছন্দ হলো না উইল্লা চোরারÑ কি রে, শরিকের কথা কইতে শরম লাগে নাকি?
‘না...আ..., শরম লাগতো কেরে! সাত শরিকে কিনছি।’ বলে চোখ মুখ ফ্যাকাসে করে দাঁড়িয়ে রইল শাহজাহান আলী। এর আগে তিনবার এসএসসি ফেল করেও সম্ভবত এমন চেহারা হয়নি তার।
এবার শাহজাহান আলীকে উদ্ধার করার উদ্যোগ নিলো সবুজÑ আইচ্ছা পুতু তোমারে একটা কথা জিগাই?
জিগা
তুমি কোরবানি দিতাছো কি কারণে?
মানুষ কী কারণে কোরবানি দেয়, এইডাও জানস না?
আমি তো জানি, কোরবানি অর্থ ‘ত্যাগ’। মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ত্যাগ করে। মানুষরে দেহানোর উদ্দেশ্যে নয়।
আমিও আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরবানি দিতাছি।
সুন্দর কথা। এক গরু একলা কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নাই বইলা সাত শরিকে দিতাছো। আল্লাহ তো তোমার সামর্থ্য জানেন। তাইলে শরমের কী আছে?
চুপ মেরে গেল শাহজাহান আলী। কথা বলল মন্তাজ উদ্দিনÑ আছে আছে, শরমের ব্যাপার আছে।
নিজে যা নয়, অইন্যের কাছে তা জাহির করার মইদ্যে বাহাদুরি আছে। ষাঁড়ের চোখে লাল পট্টি বাইন্ধা দিলে ষাঁড় পাগলা হয়। চোখের সামনে খালি লাল আর লাল দেখে। মিছামিছি লালের পিছে দৌড়ায়। আমাদের চোখেও লাল পট্টি বান্ধা। বাহাদুরির পট্টি। চোখের সামনে দেখি প্রভাব আর প্রতিপত্তি। আমরা ও ষাঁড়ের মতো বাহাদুরির পিছে দৌড়াই

কোন মন্তব্য নেই: