শুক্রবার, জানুয়ারী ২৭, ২০১২

মেঘে ঢাকা তারা


শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ

ফাহমিদা নবীর গান কখনো ঝিলিমিলি স্বপ্নাবেশ। কখনো এক বিকেল রোদ অথবা ভরা জোসনা। তার জীবনও কিন্তু সরলরেখা নয়। এঁকেবেকে চলা নদীর মতোই। এই জীবন-যৌবনের ভাঁজে ভাঁজে আছে অনেক অন্ধকারও। ঠিক মেঘে ঢাকা তারার মতো।
৪ জানুয়ারি এই শিল্পীর জন্মদিন। এ উপলে তার প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা

হাসি আর ফুল। এ দুটো অনুষঙ্গ এক করলে যে ছবিটি দাঁড়ায়, সেটা হলো ফাহমিদা নবীর। ফাহমিদা নবী মানে হাসি, ফাহমিদা নবী মানেই ‘চুলে তাহার সাদা ফুল’। অর্থাৎ তিনি সুন্দর- ভেতরে ও বাইরে। জীবনকেও সাজাতে চান সুন্দর করে, ঠিক ফুলের মতোই।
একখন্ড ছাদ। পাশে ধানমন্ডি লেক- শ্যঁওলা পড়া জল, ঢালে বিছানো ঘাসের কার্পেট, গাছের ছায়া, ফুল, পাখি, প্রজাপতির ওড়াওড়ি। মোটকথা শান্ত প্রকৃতি ঘিড়ে রেখেছে ছাদটিকে। আর এ ছাদের তলায়-ই ফাহমিদা নবীর ছিমছাম একটি ফ্যাট। ড্রয়িংরুমে সাজানো গাছের গুঁড়ি, লতা-পাতাসহ প্রকৃতির নানান অনুষঙ্গ।
কি কারণ?
‘কারণতো একটাই। আমি প্রকৃতির মেয়ে, প্রকৃতিকে ভালোবাসি। ঘর সাজানো আমার শখ। মানুষের মনের সৌন্দর্য্যটাকে ঘরের মধ্যে প্রকাশ করা উচিত। তাছাড়া ফুলের মাঝে আমি আমার অস্তিত্ব দেখি। কেন জানি না, ছোটবেলা থেকেই ফুল দেখে আনন্দে চিতকার করে ওঠতাম। ফুলের জন্যই সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের প্রতি আমার মোহ ছিলো, এখনো আছে। জাপানের সবাই ফুল ভালোবাসে। চেরি ফুল তাদের খুব প্রিয়।’
ফাহমিদা নবী ফুলের মাঝে খুঁজে পান মানবিকতা, অনুভব করেন পৃথিবীকে। তাই মাঝে মাঝে তাকে সাজতে দেখা যায় তাজা ফুলের অলঙ্কারে। তিনি ফুলের মাঝে জীবনের সৌন্দর্য্য খুঁজে পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে- ‘আমি মনে করি, প্রতিটি ভালোর মাঝেই সৌন্দর্য্য লুকিয়ে আছে। কেবল সুন্দরটাকে উপলব্ধি করতে পারলেই হয়। আমি ভীষণভাবে এ উপলব্ধিটা করি রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি গানে। এই যেমন- আমারো পরানো যাহা চায়, গানটি সবার-ই পছন্দের। এর ভেতরও ফুলের অস্তিত্ব। গানটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে প্রকৃতি, বৃস্টি ও ফুল। এ ফুলের সৌরভেই রবীন্দ্রনাথ মনন আর চেতনার দরজা খুলে দিয়েছেন।’
ফাহমিদা নবীর প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ। দার্শনিক সক্রেটিস তার চিন্তা, চেতনা ও বোধ। আর ইতিহাসের চরিত্রগুলোর মাঝে ভালো লাগে রাজা অশোক ও চেঙ্গিস খানের মতো চরিত্রগুলোকে। তাই বলে এদের নৃশংসতাকে তিনি পছন্দ করেন এমন নয়। ইতিহাসের এই চরিত্রগুলোর নৃশংসতার আগে ও পরে এবং জীবনের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে প্রেম, ভালোবাসা। রাজা অশোক রাজ্য জয় করতে করতে একসময় কান্ত হয়ে নিজের মাঝে বোধ জাগ্রত করেছিলেন। তারপর রাজ্য জয় ছেড়ে দিয়ে মনের জয়ের উদ্দেশ্যে নেমে যান পথে। খুঁজে ফেরেন আত্মার শান্তি। ফাহমিদা নবীও জীবনকে সহজ ও সুন্দর করে দেখতে চান কেবল প্রশান্তির জন্য।

কণ্ঠশীলন
শুধু নিজের প্রশান্তি নয়, অন্যের মাঝে প্রশান্তির বীজ বুনে দেয়ার কাজটিও তিনি করেন। কিভাবে করেন? জানা যাক ফ্যন্সি’র কাছ থেকে। ফ্যন্সি চাকরি করেন বেসরকারি একটি ব্যংকে। টুক-টাক গান করেন, নিজের জন্য বা কারো অনুরোধে। ফাহমিদা নবীর গান তার খুব ভালো লাগে। টেলিভিশনে ফাহমিদা নবীর একটি সাাতকার দেখে তার সাথে যোগাযোগ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। কি ছিলো সেই সাাতকারে? ‘সাাতকারে ফাহমিদা নবী বলেছিলেন, তিনি সপ্তাহে দু’দিন ভয়েস গ্র“মিং কাস করান। যারা গান করেন, তাদেরকে কণ্ঠশীলন করান। পাশাপাশি গলার সাথে গানের ম্যচিং করার বিষয়েও প্রশিণ দেন। শুধু তাই নয়, তিনি বলেছিলেন সেখানে নাকি প্রতিটি ছাত্র’র চিন্তা, মেধা, মননসহ ব্যক্তিগত বিষয়গুলো ধরে ধরে আলোচনা করা হয়।’
তারপর মোহগ্রস্তের মতো ফাহমিদা নবীর কাছে ছুটে গেলেন ফ্যন্সি। ভর্তি হলেন একটি ব্যচে। ফলাফল কী হলো? আগের ফ্যন্সি ও পরের ফ্যন্সির মাঝে পার্থক্য দি দাঁড়ালো? ‘আগের চেয়ে আমার মনোবল বেড়ে গেলো। এখন মঞ্চে যখন দাঁড়াই, ভাবি আমিই দুনিয়ার রাজা। আমার ওপর কেউ নেই। মঞ্চের বাইরের আবেগ-অনুভূতি আমাকে স্পর্শ করতে পারে না। মাইক্রোফোনের সামনে কিভাবে দাঁড়াতে হয়, গান গাইতে হলে কখন কেমন এক্সপ্রেশন প্রয়োজন সবকিছু শিখেছি কাস থেকে।’
ফাহমিদা নবীর ভয়েস গ্র“মিং কাস শুরু হয়েছে ২০০৭ সালে। প্রতি শুক্র ও শনিবার তিনি কাস নেন মুহাম্মদপুরের একটি স্কুলে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ বিভিন্ন পেশাজীবিরা তার শিার্থী। দর্শনে পড়ালেখা করেছেন বলেই কি তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের দর্শন শেখান? ‘মোটেও না। আমি মূলত দর্শনের ওপর গুরুত্ব দেই নিজেকে নিজে চেনার জন্য। নিজের কাছে নিজে পরিস্কার থাকলেই কোন কাজে ঝামেলা নেই, মানসিক বিপর্যস্ততারতো প্রশ্নই ওঠে না। আমি ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে জাগতিক বিষয় নিয়ে কথা বলি। কেউ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকলে তার বোধের জায়গাগুলো জাগ্রত করে দেয়ার চেস্টা করি। আমি একটি কাস নেই মননের ওপর। এর মূল বিষয় হচ্ছে - স্বপ্ন শুধু দেখলাম বসে বসে, মাঠে নামলাম না। অর্থাৎ স্বপ্ন যদি দেখতে চাও, তবে স্বপ্নের পথে হাটো।’
তিনি মনে করেন সার্বিক সৌন্দর্য্য নিয়েই মানুসের সৌন্দর্য্য। সততার চোখ বা নিষ্পাপ ভেতরকে কেউ বাহ্যিক সেজেগুঁজে তৈরি করতে পারে না।
১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সাত বছর দুটি স্কুলে শিকতা করেছিলেন তিনি। তাই শিকতার নেশাটা একেবারে ছাড়তে পারেননি। তার স্বপ্ন একটি পূর্ণাঙ্গ সংগীত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। যেখানে গানের লাইব্রেরি থেকে শুরু করে বাদ্যযন্ত্রসহ সব আয়োজনই থাকবে।

এক যে ছিলো রাজা
এখন যিনি গানের মাস্টার, তিনি প্রথম গান শিখেছিলেন কোথায়?
পানির মতো সহজ জবাব- তার বাবার নাম মাহমুদুন্নবী। আর মাহমুদুন্নবী মানেই হলো গান, উপমহাদেশের নামকরা শিল্পী। সুতরাং তার মেয়ের ভেতর গান বাসা বেঁধেছিলো কিভাবে, এমন প্রশ্ন অবান্তর। মাহমুদুন্নবীর দুই কণ্যাই (ফাহমিদা নবী ও তার ছোট বোন সামিনা চৌধুরি) এখন খ্যতিমান শিল্পী।
মাহমুদুন্নবী ছিলেন গানের রাজা। সেই রাজার ছিলো তিন কন্যা নুমা (ফাহমিদা নবী), নোভা (সামিনা চৌধুরি) ও অন্তরা (তানজিদা নবী)। আর ছিলো এক পুত্র পঞ্চম (রেদয়ান চৌধুরী)। তাদের প্রাসাদ ছিলো ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে, ছায়া সুনিবীর শান্তির নীড়। প্রাসাদে ছিলো দারুন এক আম গাছ। তিন কন্যাকে নিয়ে রাজার ছিলো এক দু:খ, সুযোগ পেলেই ওরা আম চুরি করে খেয়ে ফেলতো। কি আর করা, কণ্যা বলে কথা। চুরি করেও বার বার পার পেয়ে যেতো।
এ তো গেলো এক দু:েখর কথা। রাজ্য চালান রাজা, তবুও যে তার দু:েখর সীমা নেই। কারণ রাণীর ভয়ে তাকে তটস্ত থাকতে হতো। রাণী সবসময় রাজার খাবারদাবারের ওপর খবরদারি করতেন। এটা খাওয়া যাবে না, ওটা খাওয়া যাবে না। বিশেষ করে মিস্টি খাওয়ার ওপর কড়াকড়িটা ছিলো বেশি। কি তাজ্জব কথা, রাজার ওপর খবরদারি! না না এ হতেই পারে না। যে কোন ওপায়ে মিস্টি খেতেই হবে। কি করা যায়, কি করা যায়। ছলে বলে কলা কৌশলে রাণীর চোখ এড়িয়ে তিন কন্যা আর এক পুত্রকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যেতেন প্রাসাদ থেকে। ছল করতেন- যেন হাটতে বেরিয়েছেন। কিন্তু তলে তলে ছিলো অন্য ফন্দি। বাসা থেকে কয়েক কদম হাটলেই মরণ চাঁদের মিস্টির দোকান। চারজনকে নিয়ে রাজা ঢোকে যেতেন সেখানে। মিস্টির অর্ডার দিতেন। তার পর প্লেটের পর প্লেট মিস্টি আসতো আর শেষ হয়ে যেতো। রাজকন্যারা খেয়ে দেয়ে কান্ত হয়ে গেলে তাদের প্লেটের মিস্টিও সাবার করে দিতেন রাজা।
আগেকার সেই রাজা এখন আর নেই। এমনকি রাজকন্যা-রাজপুত্ররাও সেই প্রাসাদে নেই। তবে আম গাছটি দাঁড়িয়ে আছে আগের মতোই। এ প্রাসাদে একসময় যাতায়াত ছিলো পার্শ্ববর্তী রাজ্যের অনেক রাজা ও রাণীদের। প্রতিদিন সন্ধ্যায় এখানে বসতো সুরের আসর। কারণ সেই রাজা ছিলেন সুরের রাজা। তার সুরের প্রাসাদ এলিফ্যন্ট রোডে থাকলেও আসল প্রাসাদ ছিলো খুলনায়। ফুলতলা বাসস্ট্যন্ডের সাথেই ছিমছাম একটি প্রাসাদ। আর রাজার বাবার মূল প্রাসাদ ছিলো ভারতের বর্ধমানে।
সেই রাজার রাণীর আসল প্রাসাদ ছিলো দিনাজপুরের গনেশতলায়। রাজকন্যা ও রাজপুত্ররা ঢাকায় পড়াশোনা করলেও বছরের প্রায় ছয় মাস কাটাতো নানাবাড়িতে। নানা-নানী, মামা, খালা, পাড়া-প্রতিবেশি, সিনেমা হল এসব নিয়েই ছিলো তাদের উচ্ছল জীবন। সেখানে ছিলো লাল রঙের সিমেন্টে বাঁধানো কলতলা, সিমেন্টের সোফা। মামারা নাটক তৈরি করতেন। কলতলাতে পারিবারিক নাটক মঞ্চস্ত হতো। বড় মামার (বাদল মামা) একটি নাটকের দলও ছিলো- নবরূপী নাট্যদল। সব মিলিয়ে নানাবাড়িতে ছিলো অসাধারন এক সাংস্কৃতিক পরিবেশ। তাদের পরিবারের শিাটাই ছিলো মূলত গান-বাজনা নিয়ে। তিন রাজকণ্যা আর এক রাজপুত্র’র খেলার সাথির কোন অভাব ছিলো না। ছয় খালা ও মামাদের মাঝে বেশ কয়েকজন ছিলো তাদের বয়সি। নানী মেহেরুন্নেসা ছিলেন তাদের বন্ধুর মতো। নাটক-রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লতা মুঙ্গেশকর এদের নিয়েই সারান মেতে থাকতো তারা। তারা একে অপরের সাথে কোন খেলনা জিনিস নিয়ে খুনসুটি করতো না। সুরের রাজ্যের রাজকন্যা ও রাজপুত্রদের খুনসুটি হতো গান, নাটক ও সাহিত্য নিয়ে। বুঝে ওঠার আগে থেকেই তারা রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার চরিত্রগুলোর সাথে পরিচিত হয়ে উঠেছিলো। ভাই-বোনদের মাঝে কেউ কেতকি চরিত্রকে সমর্থর্ন করতো, কেউ লাবন্যকে। তবে নায়ক অমিত রায়ের ব্যপারে সবারই এক কথা ‘অমিত হলো ভেজা বেড়াল’। ছোটবেলায় সংসারের কোন ঝুট-ঝামেলা তাদের স্পর্শ করতে পারতো না।

অত:পর বড় কণ্যা
সেই সুরের রাজার বড় কণ্যা নুমা একদিন বড় হয়ে ওঠলো। রাজার মতো সাহস নিয়ে সেও রাজত্ব করতে লাগলো। কিন্তু কিভাবে সে বড় হলো?
বড় হতে হলে পড়ালেখা করতে হয়। তাই সে ছোট থাকতেই পড়ালেখায় মন বসালো। ভর্তি হলো গ্রীণরোডের সান ফাওয়ার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। ওখানে একবছর পড়ার পর মুহাম্মদপুর অগ্রণী গার্লস হাই স্কুলে চলে এলো। থাকলো একেবারে দশম শ্রেণী পর্যন্ত। মাঝখানে কি ঘটলো?
ঘটলো অনেক কিছুই, বিশ্বস্ত ও কাছের বান্ধবি অর্চনা, শম্পা ও মুনসহ কয়েকজনকে নিয়ে গঠন করলো ভয়ঙ্কর এক বিচ্ছুবাহিনী। এ বাহিনীর কাজ ছিলো স্কুলজুড়ে দস্যিপনা করে বেড়ানো। এর ওর ব্যপারে নাক গলানো, কান গলানো ছিলো নৈমেত্তিক ব্যপার। গাছের লটকন চুরি করায় বিচ্ছু বাহিনী ছিলো সিদ্ধহস্ত। আর মাঝে মাঝে রোমাঞ্চের জন্য কাসে ফাঁকি দেয়ার পদ্ধতিও আবিষ্কার করতো- বিচ্ছুবাহিনীর সদস্যরা গবেষণা করে আবিষ্কার করে ফেলেছিলো যে, ইসলামিয়াত স্যর কাসে এসে একজনকে সূরা এখলাস জিজ্ঞেস করলে, তার পরের জনকে সূরা নাস জিজ্ঞেস করবে। তাই বিচ্ছুবাহিনীর সবাই সব সূরা না পড়ে ভাগাভাগি করে সূরা মুখস্ত করে আসতো।
এ তো গেলো দশম শ্রেণীর কথা। কিন্তু রাজার বড় কণ্যা এস.এস.সি পাশ করলো কোন স্কুল থেকে? ‘মুহাম্মদপুর গার্লস হাই স্কুল থেকে। আমাদের বাসা পরিবর্তন করার কারণে সেখানে চলে যেতে হয়েছিলো। এইচ.এসসি পাশ করি হলিক্রস কলেজ থেকে। তারপর দর্শনে অনার্স-মাস্টার্স করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।’

পথের ছবি
বড় কন্যা বড় হলো। গানে গানে যশ কুড়োলো। কিন্তু কোন পথে হেঁটে?
সে পথের ছবি আঁকতে গেলে শুরু করতে হয় প্রাসাদ থেকে। অর্থাৎ এলিফ্যন্ট রোডের সেই প্রাসাদ থেকেই পথের উৎপত্তি। তারপর সেই পথ বাঁক নিলো ওস্তাদ আমানুল্লাহ খানের (মারা যান ২০০৩ সালে) ভাঙা বাড়িতে। ১৯৭৫ সালের দিকের কথা- রাজকন্যা নুমা তখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। তাকে তালিম নিতে যেতে হতো আমানুল্লাহ খানের কাছে। মুহাম্মদপুরের একটি ভাঙা বাড়িতে থাকতেন তিনি। সেকি করুণ অবস্থা- একটিমাত্র ঘরে তিনটি খাট পাতা ছিলো। খুব কস্টে-সিস্টে সংসার চালাতেন।
পথের বাকি ছবিটা আঁকা যাক সরাসরি বড়কন্যার বর্ণনায়-
‘আমি প্রথম গান গেয়েছিলাম সত্তরের দশকের শেষের দিকে, তথা ১৯৭৭ সালে। বিটিভিতে আবদুল্লাহ আবু সাঈদের উপস্থাপনায় চতুরঙ্গ অনুষ্ঠানে গেয়েছিলাম কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা ও হ্যাপি আখন্দের সুরে এই অন্ধ করায় বসে।
গান গেয়ে আমার প্রথম উপার্জন ছিলো রেডিও থেকে। ১৯৭৭ সালে রেডিওর কলকাকলি অনুষ্ঠানে গেয়ে ২৫ টাকা পেয়েছিলাম। কিভাবে খরচ করেছিলাম সেটাও মনে আছে। ২৫ টাকা দিয়ে একটি বেতের র‌্যাক এবং ছয়টি গ্লাস কিনেছিলাম। তখন আমি মাত্র ৭ম শ্রেণীতে পড়ি। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় একেবারে ছোটবেলা থেকেই ছোট ভাই-বোনদের প্রতি যতœশীল ছিলাম আমি। তাছাড়া সংসার ও সংসারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের প্রতি আমার অন্যরকম নেশা ছিলো।’
১৯৭৭ সালের শেষের দিকেই আমি টেলিভিশন থেকে উপার্জন করি ১০০ টাকা। তখন বাবার সাথে ডুয়েট গেয়েছিলাম ‘আয় খুকু আয়’ গানটি। এই একশ’ টাকা দিয়ে মা আমার নামে একটি একাউন্ট খুলে দেন পূবালী ব্যাংকে।
প্রথম সলো এলবাম তুমি তুলনাহীনা প্রকাশ হয় ১৯৭৯ সালে। আর চলচ্চিত্রে প্রথম গাই ১৯৮৩ সালে ‘দূরদেশ’ ছবিতে। গানটি ছিলো- ভাইটি আমার তুমি কেঁদোনা, বোনটি আমার তুমি কেঁদো না। এর সুরকার ঊষা খান। এটি মূলত ছিলো একটি হিন্দী গানের সুর। গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকার ও ঊষা খান। আর বাংলা ভার্সন গেয়েছিলেন আমি ও সামিনা।’
পেশাগত প্রয়োজনের বাইরেও ফাহমিদা নবী কেবল নিজের আনন্দের জন্য গুনগুন করেন। আবার কারো অনুরোধেও গেয়ে শোনান। কিন্তু কোন গান গাইবেন, কেমন গান গাইবেন তা অধিকাংশ েেত্র নির্ভর করে পরিবেশ ও পরিস্থিতির ওপর। তবে সাধারণত মেলোডি গানই তার বেশি পছন্দ। যেমন- ‘তুমি কি সেই তুমি’ , রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’। সর্বোপরী গান গাওয়ার ব্যাপারে মনকেই প্রাধান দেয়ার চেস্টা করেন তিনি ‘মেলোডি গান আমার আত্মার গান। মেলোডিগুলো আমার ভেতর থেকে আসে। এছাড়া অন্যগুলোতে আমি অনুভবে প্রবেশ করতে পারি না।’ তবে কোন কোন সময় মনের চেয়ে শ্রোতার পছন্দটাকেই প্রাধান্য দিতে হয়।

মেঘ-জোসনার লুকোচুরি
ফাহমিদা নবী মনে করেন, প্রতিটি মানুষের জীবন প্রতি দশ বছর পর পর একেক দিকে বাঁক নেয়। অর্থাৎ মানুষের জীবনকে ভাগ করলে প্রতি দশ বছর করে আলাদা করতে হবে। এক অংশের জীবন অন্য অংশের সাথে মিলবে না। প্রতিটি অংশই আলাদা আলাদা। এমনকি পূর্ববর্তী অংশগুলোর দুঃখবোধ পরবর্তী অংশের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলবে না। আবার পূর্ববর্তী অংশের সুখবোধগুলোও পরবর্তী অংশে আন্দোলিত হবে না।
‘আমার জীবনও প্রতি দশ বছরে একটি করে অংশ হয়ে গেছে। যেমন জন্ম থেকে প্রথম দশ বছর পর্যন্ত এক রকম ছিলো, আবার পরবর্তী দশ বছর ছিলো অন্যরকম। সেটা কেটেছে কৈশোরের দূরন্তপনায়। জীবনের কৈশোরত্তীর্ণ ভাগটিতে এসে প্রচণ্ডভাবে মানুষকে ভয় পেতে আরম্ভ করি আমি। পরবর্তীতে ভেবে দেখলাম, সবাই-ইতো মানুষ। সবার ভেতরে বিশুদ্ধতা-অশুদ্ধতা দুই-ই আছে। সব মানুষের মাঝে হাসি আছে, কান্না আছে। তাহলে মানুষ কতটাই বা খারাপ হতে পারে! সুতরাং সিদ্ধান্ত নিলাম মানুষকে ভয় না করে জয় করতে হবে। তারপর আমার জীবনের পরবর্তী অংশটি কাটে মানুষ জয়ের অভিযানে।’
তবে তিনি তার জীবনের টার্নিং পয়েন্টগুলোর মাঝে বাবার মৃত্যুর সময়টাকে যেভাবে দেখেছেন, এখন তার মেয়ের বাবার মৃত্যুর সময়টাকেও মেয়ের জন্য সেভাবেই দেখছেন। ফাহমিদা নবীর স্বামী ছিলেন জয়নুল আলম বাবু। তিনি মারা যান গত সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ তারিখে। তিনি একসময় এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও মূলত ছিলেন একজন সৌখিন ফটোগ্রাফার। ১৯৮৭ সালে তাদের বিয়ে হয়েছিলো। ১৮ই সেপ্টেম্বর সারাদেশে ভ’মিকম্প হয়। এতে ভয় পেয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান।
বাবার মৃত্যু ও স্বামীর মৃত্যু এ দুটোই তার জীবনের বড় টার্নিং পয়েন্ট। পার্থক্য হলো একটির প্রভাব ছিলো সরাসরি তার ওপর। আর আরেকটির প্রভাব মেয়ের ওপর হয়ে তার নিজের ওপর পড়ছে। ফাহমিদা নবীর একমাত্র মেয়ের নাম আনমোল। বর্তমানে পড়ছেন আইন বিষয়ে। তার বিয়ের আংটি পরানো হয় আগস্টের ৯ তারিখ। বর তানভীর হাসনাত রোমান ভারতের ব্যাঙ্গালোর থেকে বিবিএ শেষ করে পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করছেন।

বোধ
জাকিয়া জেনিফার। ফাহমিদা নবীর এক অন্ধ ভক্ত। প্রায়-ই তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির একটি অংশ তিনি ফাহমিদার নামে লিখে দিতে চান। কি কারণ? ‘ম্যম-এর (ফাহমিদা নবীর) গাণ আমাকে পাগল করে দেয়। লুকোচুরি গল্প শুনে আমি যোগাযোগ করতে চাই ম্যম-এর সাথে। তারপর প্রথম যেদিন তার সাথে ফোনে কথা বললাম, সেদিন থেকেই মোহগ্রস্ত হয়ে গেলাম।’
জাকিয়া জেনিফারের বাবার বাড়ি হাজারীবাগে। ২০০৮ সালে বিয়ে হয় চকবাজারের ব্যবসায়ীর সাথে। বিয়ের পর স্বামী ও স্বামীর পরিবার তার পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়। এ থেকেই সূত্রপাত হয় পারিবারিক কলহের। ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে দু’জনের। তাই জেনিফার একসময় আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন- ‘ভাবলাম আত্মহত্যা করার আগে ম্যম-এর সাথে শেষবারের মতো কথা বলে নেই। ফোন দিলাম ম্যমকে। আমি যে আত্মহত্যা করবো এ কথা বলার ইচ্ছা ছিলো না, কিন্তু কিভাবে যেন বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। সাথে সাথেই ম্যাম ফোন কেটে দিলেন। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু কিছুন পরই তিনি ফোন দিলেন আমাকে।’
তারপর দীর্ঘ আলাপ জীবন ও জীবনের বোধ নিয়ে। অবশেষে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন। জেনিফার মনে করেন ফাহমিদা নবী-ই তাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। তার কারনেই পরবর্তীতে তিনি আবার সংসারি হতে পেরেছেন। জীবন সম্পর্কে নিজের বোধকে জাগ্রত করা এবং পরিবারের অন্যদের মাঝে জাগ্রত করানোর কাজটি তিনি ফাহমিদার কাছ থেকেই শিখেছেন। বর্তমানে তার পড়ালেখা করার েেত্রও স্বামীর পরিবার থেকে কোন বাধা নেই।
জাকিয়া জেনিফার ফাহমিদা নবীর কাছ থেকে শিখেছেন জীবনের কাছে কখনো হেরে যেতে নেই, বরং জীবনকে নিজের মতো করে গড়ে নিতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন মনোবল আর আত্মবিশ্বাস।

ফাহমিদা নবী

ডাক নাম
নুমা

জন্ম
৪ জানুয়ারি

বাবা
মাহমুদুন্নবী

মা
রাশিদা চৌধুরী

স্বামী
মরহুম জয়নুল আলম বাবু

সন্তান
আনমোল

প্রথম এলবাম
তুমি তুলনাহীনা-১৯৭৯

মোট এলবাম
১১টা সলো এবং অসংখ্য মিক্সড ও ডোয়েট।

কোন মন্তব্য নেই: