মঙ্গলবার, জানুয়ারী ১২, ২০১০

গাজায় যুদ্ধাপরাধ : সফল হলো প্রপাগান্ডা


গাজায় যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে কেন্দ্র করে আলোচনার বাতাস বয়ে যাচ্ছে বিশ্বজুড়ে¦। জাতিসঙ্ঘ এ নিয়ে একটি রিপোর্টও তৈরি করেছে। গত ৬ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘের প্রধান বান কি মুন বলেছেন গাজায় যুদ্ধাপরাধ রিপোর্টটি নিরাত্তা পরিষদে পাঠানো হবে। গোল্ডস্টোনের তৈরি করা এ রিপোর্টে ইসরাইল ও হামাস উভয় পক্ষে যুদ্ধাপরাধী রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। তবে যুদ্ধাপরাধের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়েছে ইসরাইলকে। ৫ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদ ১১৪-১৮ ভোটে প্রস্তাবটি পাস করে। ৪৪টি দেশ ভোট দানের সময় অনুপস্খিত ছিল। ফিলিস্তিনের ইসলামিক দল হামাস শাসিত গাজায় ২০০৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ১৮ জানুয়ারি সেনা অভিযানে ইসরাইল বেপরোয়া ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এর প্রেক্ষিতেই জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মহলে শুরু হয়েছে তোড়জোর। যুদ্ধ আর অশান্তি প্রতিনিয়ত যে উপত্যকার সঙ্গী, সে উপত্যকার বাসিন্দাদের জন্য হঠাৎই দরদে উথলে উঠেছে ক্ষমতার বলয়গুলো। মানুষের অধিকার অুন্ন রাখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা। অমানবিক নির্যাতনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছেন যারা তারাও আজ গোটা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সাথে আওয়াজ তুলছেন গাজায় যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি নিয়ে। প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে কথা বলে গোপনে তাদের নেতৃত্ব ও স্পিরিটকে ভোতা করে দেয়ার পরিকল্পনা এটি কিনা তা অনুমান করা কঠিন। প্রকাশ্য শত্রুর চেয়ে বন্ধুবেশি শত্রুকে মোকাবেলা করা আরো কঠিন। জাতিসংঘে গাজার যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি আলোচিত হওয়ার আগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ ব্যাপারে ১১৭ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন তৈরি করেছিলো। গাজায় ২২ দিনের ইসরাইলি অভিযান নিয়ে তৈরি করা এ প্রতিবেদনে ইসরাইল যুদ্ধাপরাধ করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি হামাসের রকেট হামলারও সমালোচনা করে একে ‘যুদ্ধাপরাধ’ আখ্যা দেয়া হয়। ইসরাইলে রকেট ছুঁড়ে গাজার ফিলিস্তিনিদের বিপদ ডেকে আনার জন্য এমনেস্টি হামাস ও অন্যান্য সশস্ত্র ফিলিস্তিনি দলগুলোকে অভিযুক্ত করে। এখানেই সৃস্টি হয় যত প্রশ্নের। তাহলে কি ফিলিস্তিনি জনগণের সমর্থনপুষ্ট হামাসকে বেকায়দায় ফেলা এর উদ্দেশ্য? শেষ পর্যন্ত কি দেখা যাবে ইসরাইলের টিকিটিও ছুঁয়া গেলোনা কিন্তু হামাসকে আরো নিষ্ঠুরভাবে চাপিয়ে দেয়া হলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়?। আর এখানেই আশংকা থাকে বন্ধুত্বের ভেতর শত্রুতার। ইসরাইলের ওই অভিযানে ৩শ’ শিশু এবং কয়েকশ’ নিরীহ মানুষসহ অন্ততপক্ষে ১৪শ’ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে বলে জানায় অ্যামনেস্টি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধদল গাজা সফরের সময় ইসরাইলের সাদা ফসফরাস বোমাসহ অন্যান্য নিষিদ্ধ অস্ত্র ব্যবহারেরও প্রমান পায়। অ্যামনেস্টির গবেষক ডোনাটেলা রোভেরা বলেছেন, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এ ধরনের মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহারের ফলে ফিলিস্তিনিদের হতাহতের সংখ্যা বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক। ২২ দিনের আগ্রাসনে ইসরাইল অসংখ্যবার সাদা ফসফরাস বোমা নির্বিচারে ব্যবহার করেছে। আ্যামনেস্টির প্রতিনিধিদলের সাথে গাজা সফরকারী ব্রিটিশ অস্ত্রবিশেষজ্ঞ ক্রিস কোব স্মিথও ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনেন। ১০ জানুয়ারিতে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উত্থাপন করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। অ্যামনেস্টির রিপোর্টের পর জাতিসংঘ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং এতে তারা যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ বের করে। জেনেভাভিত্তিক জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে তৈরি করা ৫৭৫ পৃষ্ঠার এ সংক্রান্ত একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা রিচার্ড গোল্ডস্টোন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী গাজায় যুদ্ধাপরাধ করেছে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করেন। তাঁদের তদন্তের ক্ষেত্রে ইসরাইলের কোন সহযোগিতা পাননি বলেও উল্লেখ করেন তিনি। হামাসকে অভিযুক্ত করে বলা হয় ফিলিস্তিনের ইসলামি জঙ্গিরাও ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রকেট হামলা চালিয়েছে। পরবর্তীতে ইসরাইলের ক’টনৈতিক মিশন এক বিবৃতিতে গোল্ডস্টোনের তদন্ত মিশনের সমালোচনা করেছে। তদন্তে ইসরাইল কেন সহযোগিতা করেনি তারও ব্যাখ্যা দেয়া হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, জাতিসংঘের ওই তদন্ত প্রতিবেদন স্পষ্টতই পক্ষপাতিত্বমুলক। ইসরাইলের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ফিলিস্তিনের জঙ্গি গোষ্ঠী হামাস হাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। হামাস এর মুখপাত্র এ বিষয়ে বলেছেন, তারা রকেট ছুড়ে কোনো যুদ্ধাপরাধ করেননি। কারণ তারা কেবল আত্মরক্ষার্থেই রকেট ছোড়েন। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যে কারও আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। এ রিপোর্ট উপস্থাপনের পর এর উপর আসতে থাকে নানা মত। গত ১৫ অক্টোবর এ নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে আনুষ্ঠানিকভাবে বিতর্ক শুরু হয়। ইসরাইল-ফিলিস্তিন দীর্ঘ সঙ্ঘাতে এর আগেও নিহত হয়েছে হাজার হাজার ফলিস্তিনি। কিন্তু তখন কেমন ভ’মিকা রেখেছিলো জাতিসংঘ? আর কেমন ভ’মিকাইবা ছিলো মুসলিম অর্গানাইজেশনগুলোর? মুসলিম দেশগুলোর সর্ববৃহৎ সংগঠন ওআইসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৬৭ সালের আরব ইসরাইল যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। অথচ এর ভ’মিকা কতটুকু ছিলো ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠায়? একটি নিন্দাপ্রস্তাব পাশ করেই তার দায়িত্ব শেষ করেছে। ঘুম ভাঙ্গেনি আরব লীগের। তবে যে উদ্দেশ্য নিয়েই হোকনা কেন বর্তমানে জাতিসংঘের এ সাহসী উদ্যোগের কারণে কৌতুহল ঘিরে ধরেছে অনেককেই। বিশ্ববাসী অপেক্ষায় রয়েছে এর শেষ দৃশ্যের জন্য। তবে অনেকেই চেস্টা করছেন নাটকের চলমান অবস্থায় শেষ দৃশ্য অনুমান করার। ফিলিস্তিনি ভ’খন্ড, ইসরাইল এবং ইহুদিদের ইতিহাস নিয়ে বিশ্লেষণী দৃস্টিতে নাড়াচাড়া করলে ব্যাপারটা তাদের জন্য আরো সহজ হয়ে যেতে পারে। ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের সংঘাতের ইতিহাস বহু পুরনো। মুসলমান, খ্রিস্টান এবং ইহুদী ধর্মের জন্য পবিত্র ভ’খন্ড ফিলিস্তিন গড়ে উঠেছে সভ্যতার সমৃদ্ধ ছুঁয়ায়। কেবল ধর্মীয় কারণে নয় ভৌগলিকভাবেও এর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এক অবস্থান। এখানকার প্রকৃতির অঢেল নিঃসর্গের মাঝেই মানুষের বসতি। ফিলিস্তিনে বছরের বারো মাসই থাকে নির্মল প্রকৃতির ছোঁয়া। পবিত্রতম এ উপত্যকায় প্রকৃতির সবই ঘটে স্বাভাবিক নিয়মে। কিন্তু যত অস্বাভাবিকতা কেবল এখানকার বাসিন্দাদের মাঝেই। আর এ অস্বাভাবিকতার কারণ হলো ইসরাইল-ফিলিস্তিন বিবাদ। এ বিবাদের কারণে ফিলিস্তিনের আকাশ বিদির্ণ হয়ে ফাটে কামানের গোলা। বাতাসে বারুদের গন্ধ আর ভূমিতে ভারি অস্ত্রের ঝনঝনানি সেখানকার জন্য স্বাভাবিক। এ ভ’খন্ড থেকে যারা নেই করেছে শান্তিপ্রিয় মানুষের ঘুম, তাদেরই বিষাক্ত নখর প্রতিনিয়ত দাগ কাটছে মানবতার বুকে। এখানকার দখলদারী ইহুদীদের বুনন করা জালে এখন বন্দি পুরো পৃথিবী। বর্তমানে বলা যায় গোটা বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করছে ইহদিরা। এ নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রবিন্দু হলো ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটি। স¤প্রতি তারা তাদের রাষ্ট্রের ষাট বছর উদযাপন করল মহা ধুমধামে। বিশ্ব অর্থনীতিতে এদের এখন রয়েছে বিরাট আধিপত্য। এদের কথায় উঠবস করছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। এদেরই কারণে জ্বলছে ফিলিস্তিন। আর সে উত্তাপ ছড়িয়ে গেছে পৃথিবীর কানায় কানায়। অতীতে এদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ থাকা সত্তেও এরা সীমালংঘন করেছে। আর এখনো অব্যাহত রয়েছে সে ধারাবাহিকতা। বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে এদের প্রভাব, সাম্প্রতিক যুদ্ধাপরাধ বিতর্ক এবং এক্ষেত্রে তাদের ভ’মিকা সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা আমরা পেতে পারি ইতিহাস থেকে। খুব সম্ভবত ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বে হিব্রু ভাষায় কথা বলা জাতি এবং দণি সারবিয়রা সিরিয়ার সিনাই উপত্যকা থেকে ক্যরাভিয়ান মরুভূমির পথ ধরে ছড়িয়ে যায়। স্থায়ী আবাসহীন এ জাতির প্রথম বাস ছিল সিনাই উপত্যকায়। সিনাই থেকে মেসুপটেমিয়ার সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায় তারা। এরপর সেখানে প্রভাব বিস্তার করে ‘সারগান’ নামক একজনের নেতৃত্বে রাজ্যগঠন করে। সে রাজ্যের রাজধানী ছিল আকাদ। সেখান থেকেই মূলত এদের ইতিহাসের শুরু। ধীরে ধীরে তাদের প্রতাপ বারতে থাকে মধ্যপ্রাচ্যে। সিনাই থেকে আগতদেরকে দেখে আরো কিছু জাতিও মেসুপটেমিয়ায় চলে আসে। ধারণা করা হয় আব্রাহাম, তথা ইব্রাহিমের (আ.) সময়কাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ সালের দিকে। ইতিহাসের আদি উৎস থেকেই এই জাতির স্থায়ী কোন আবাস নেই। এ কারণেই হয়তো বাইবেলের পুরাতন নিয়মে ‘সৃস্টিতত্ত্ব’তে ইব্রাহীমকে (আ.) পরিভ্রমণকারী জাতির নেতা বলা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর পরবর্তী পুরুষ ছিলেন ইয়াকুব (আ.)। অন্য পরিভাষায় জেকব। ইয়াকুব বা জেকবের অপর নাম ছিল ইসরাইল। সেই ইসরাইল নাম থেকেই এই জাতির নাম হয়েছে বনি ইসরাইল। অর্থাৎ ইসরাইলের বংশধর। বর্তমানে তাদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের নামও ইসরাইল। এ এলাকাটি ৯৭০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত ছিলো হযরত দাউদ (আ.) এর শাসনের অধীন। পরবর্তীতে এ অঞ্চলের শাসক হন তাঁর পুত্র হজরত সোলায়মান (আ.)। এরপর ইতিহাসের ধারা বেয়ে পর্যায়ক্রমে এ এলাকায় ইহুদী, খৃষ্টান এবং মুসলমানরা জনবসতি গড়ে তোলে। জেরুজালেমকে রাজধানী করে ইহুদীরা গঠন করেছিলো জুদাহ রাষ্ট্র। তাও একসময় বিধ্বস্ত হয়েছিলো ব্যবলনীয় রাজা নেবুচাঁদনেজারের হাতে। পরবর্তীতে রোমানদের আক্রমনে আবারও ইহুদীরা বিতাড়িত হয় জেরুজালেম থেকে। সপ্তম শতাব্দীতে এ এলাকা মুসলমানদের আয়ত্ত্বে আসে এবং অটোম্যান সাম্রাজোর শেষ পর্যন্ত তা অুন্ন থাকে। তখন এখানে ইহুদীদের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। আজ যে ইহুদীরা মুসলমানদেরকে বিতাড়িত করার জন্য উত্তপ্ত করে রেখেছে ফিলিস্তিনকে। সে ইহুদীরা মুসলিম শাসনের অধীনে সবসময়ই থেকেছিলো নিরাপদ। মুসলমানরা ইহুদীদেরকে আশ্রয় দিলেও বিভিন্ন সময় তাদের মার খেতে হয়েছে অন্যদের হাতে। রোমানদের আক্রমণে বিধ্বস্ত হবার পর ইহুদীরা ইউরোপের বিভিন্ন ভূখন্ডে ছড়িয়ে পড়ে এবং নির্বাসিত জীবন যাপন শুরু করে। তখন তারা কোন দেশেই মূলধারার জনগোষ্ঠীর সাথে একীভূত হতে পারেনি। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে ইহুদীরা সবক্ষেত্রে ভূমিকা রাখলেও এদের জীবন পরিচালিত হতো মূলধারার বাইরে। পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তারা বস্তিতে এবং শহরের উপকন্ঠে বাস করত। এই নির্বাসিত জীবন থেকে মুক্তির জন্য ইহুদীরা জায়নবাদী আন্দোলন গড়ে তুলে। জুদিয়ান পাহাড়ের উপত্যকা জেরুজালেমে তারা আবার একত্রিত হবার জন্য আন্দোলন করত। জুদিয়ান পাহাড়কে কেন্দ্র করে তাদের সংগ্রাম ছিলো বলে এ আন্দোলনের নাম দিয়েছিলো জায়নবাদী আন্দোলন(জুদিয়ান পাহাড়ের আরেক নাম জায়ন)। এ পাহাড়ের পাদদেশে সারা বিশ্ব থেকে ইহুদীরা এসে নিজেদের আবেগকে প্রশমিত করতো। নির্বাসিত জীবনে বিভিন্ন ভূখন্ডে তারা লালন করতে থাকে এ আন্দোলনকে। উনবিংশ শতাব্দিতে কিছুসংখ্যক ইহুদী ফিলিস্তিনে ফিরে এসে জেরুজালেম, সাফেদ এবং ত্রিবেরীতে বসবাস শুরু করে। ধীরে ধীরে তাদের জায়নবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে এবং প্রতাপশালী বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে তাদের প্রভাব বাড়তে থাকে। এ কারণে ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে একটি সনদে বলা হয় ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করা হবে একটি হবে আরবের আর একটি ইহুদিদের। এ সনদে বলা হয় জেরুজালেম স্বাসিত হবে সরাসরি জাতিসংঘের দ্বারা। এর ফলে শুরু হয় আরব আর ইহুদিদের মধ্যে সংঘর্ষের। তখন ইহুদি এই অবৈধ অভিবাসিরা সংঘটিত হতে থাকে পশ্চিমাদের সাহায্য সহযোগিতায়। কিন্তু ১৯৫৭ সালে ইহুদি, ফরাসী আর ব্রিটিশ সমন্বিত শক্তির কাছে পরাজিত হয় আরবরা। অবশেষে ১৯৬৭সালের ৬দিনের যুদ্ধে আরবরা পুরোপুরি পরাজিত হয় জায়নিষ্ট শক্তির কাছে। তার পর থেকে জায়নিস্টরা একের পর এক গণহত্যা চালিয়ে অগ্নিগর্ভে পরিণত করে জেরুজালেমসহ পুরো ফিলিস্তিনকে। এর মাঝেই চলতে থাকে ফিলিস্তিনীদের অধিকার আন্দোলন। কিন্তু ২০০৬ সালের পর থেকে ফিলিস্তিনীরা দুটি প্রধান দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এদের একটি হলো ফাতাহ এবং অপরটি হামাস। এর মধ্যে ফাতাহ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু হামাসকে অনেকগুলো দেশই একটি সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করে। এর ফলেই ২০০৬ সালের নির্বাচনে হামাস সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হলেও তাদেরকে আন্তর্জাতিকভাবে কোনঠাসা করে রাখা হয়। আবার ফিরে আসা যাক বর্তমানে আলোচিত যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে। যুদ্ধাপরাধ কি? চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের ১৪৭ অনুচ্ছেদে যুদ্ধাপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যে, ”ইচ্ছাকৃত হত্যা, অত্যাচার অথবা অমানবিক আচরণ যেমন ইচ্ছাকৃত ভাবে শারীরিক আঘাত, আইনবিরোধী ভাবে কাউকে বন্দী করা অথবা জোরপূর্বক কোন ব্যক্তিকে নিষ্ঠুর কাজে নিয়োজিত করা অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে মানবাধিকার লংঘন করা, … কোন রকম কারণ দর্শানো ছাড়াই এবং অবৈধভাবে কারো সম্পদের বৃহৎ তি সাধন অথবা অপব্যবহার করা। ” যুদ্ধাপরাধের দায়ে অপরাধী হিসাবে কাউকে দায়ী করা যাবে পুরো দেশে অথবা দেশের সৈন্যদের সাথে সংগঠিত কার্যকলাপের জন্য। গণহত্যা, মানবতা বিরোধী অপরাধ, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সাধারণ মানুষ বা যোদ্ধাদের সাথে অমানবিক আচরণ – এসবই যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়ে। এগুলোর মাঝে গণহত্যা সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম অপরাধ। আর আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আত্মরক্ষার অধিকার সবারই রয়েছে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন বিবাদের সর্বশেষ ঘটনাগুলো ঘটেছিলো ২০০৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ দিন। ইসরাইলের দীর্ঘ এ অবরোধের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণের স্বাভাবিক জীবন ধারণের ন্যূনতম উপকরণ ও শক্তি নিঃশেষ করে দেয়া হয়। কিন্তু এতে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ স্পৃহা দমে যায়নি। অবরুদ্ধ অবস্থায় রসদ ও খাদ্য-পথ্য সংগ্রহের জন্য ফিলিস্তিনিদের তৈরি করা বিকল্প টানেল স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়া হয় বোমাবর্ষণ করে। এতে প্রাণ দেয় কয়েকজন প্রতিরোধ যোদ্ধা হামাস সদস্য। তখন পাল্টা জবাব হিসেবে হামাসও ছুঁড়তে থাকে রকেট। হামাস আত্মরক্ষার উদ্যোগ নিলো বলেই অপরাধ হলো। এ রকেট ছুঁড়ার ঘটনাটিকেই প্রপাগান্ডার প্রধান মসলা বানিযে ইসরাইল প্রচার করতে থাকে যে হামাস প্রথমে আক্রমণ করেছে তাই তাদের যুদ্ধ পরিচালনার অধিকার জন্মেছে। তারপর উন্মত্ত দানবের মতো তারা গাজাকে রূপান্তরিত করলো এক ধ্বংসের উপত্যকায়। ফিলিস্তিনের রক্তভেজা মাটিকে আবারো ভিজিয়ে দিয়ে গেলো তাজা রক্তের লাল। আর শেষ পর্যন্ত হামাসও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ায় সফল হলো ইসরাইলের প্রপাগান্ডা। জাতিসংঘ হেডকোয়ার্টারে দীর্ঘদিন লজ্জাবনত ছিলো যে শান্তির পতাকা তা এখন পতপত শব্দ তুলছে যুদ্ধাপরাধকে ইস্যু করে। এটি বিশ্ববাসীর জন্য আশার কথা। তবে এমন যেনো না হয় যে শান্তির পতাকাই শেষ পর্যন্ত গুড়িয়ে দিয়েছে ফিলিস্তিনের আত্মরক্ষার একমাত্র ভরসা।

কোন মন্তব্য নেই: