বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারী ১১, ২০১০

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের এক বছর

বাংলাদেশের ইতিহাসের এক জঘন্যতম অধ্যায় পিলখানা হত্যাকাণ্ড গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটে যাওয়া এই নারকীয় ঘটনাটি গোটা জাতিকে ঢেকে দিয়েছিল রহস্যের এক জালে কিন্তু এর এক বছর পেরিয়ে গেলেও সেই জাল ভেদ করে বেরিয়ে আসতে পারেনি প্রকৃত সত্য মেজর জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, কর্নেল, লে. কর্নেল, মেজর ও ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার ৫৭ জন কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন এ ঘটনায় বিদ্রোহের সময় হত্যা ছাড়াও লুট, ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটে এত বিপুলসংখ্যক সেনাকর্মকর্তা প্রাণ হারাননি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসেও এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও একসাথে এত সেনাকর্মকর্তা হত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনার নজির নেই
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি যথারীতি শুরু হয় বিডিআর’র দরবার কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত এক আঘাতের মাধ্যমে দরবার অনুষ্ঠান রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী হট্টগোলে বিডিআর সদর দফতরের দরবার হলে সকাল পৌনে ৯টার দিকে সেনাবাহিনী থেকে ডেপুটেশনে আসা কর্মকর্তারা উপস্থিত হতে শুরু করেন কিন্তু সভা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে হঠাৎই শুরু হয়ে যায় ছন্দপতন অশুভ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু তখন থেকেই ছয়-সাতজন জওয়ান অস্ত্র নিয়ে হলে ঢুকে পড়ে হঠাৎই তাদের বেরিয়ে যেতে বলা হলে বিডিআর মহাপরিচালকসহ কর্মকর্তাদের সাথে কথাকাটাকাটি হয় পরিকল্পনামতো ষড়যন্ত্রকারীরা ঘটাতে চায় মহা হট্টগোলের সূত্রপাত তারা তুলে ধরে নানা অভাব-অভিযোগের কথা মহাপরিচালক আশ্বাসও দিয়েছিলেন তাদের সমস্যার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার তবুও ষড়যন্ত্রকারীরা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেই যাচ্ছিল হট্টগোলের সূচনা ঘটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে একসময় মহাপরিচালকের দেহরক্ষী বিশৃক্সক্ষলা সৃষ্টিকারীদেরকে দরবার হল থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করেন এরপরই শুরু হয় গুলি ছোড়া একের পর এক গুলির সঙ্কেত বুঝতে পেরে বাইরে অপেক্ষমাণ জওয়ানরাও অস্ত্র হাতে দরবার হলে ঢুকে ব্রাশফায়ার করতে থাকে একপর্যায়ে মহাপরিচালক নিজের কোমর থেকে অস্ত্র বের করে গুলি ছোড়েন হট্টগোলকারীদের উদ্দেশে কিন্তু ততক্ষণে পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণে ছিল না ষড়যন্ত্রের জাল এতটাই সূক্ষ্ম ছিল যে মুহূর্তের মধ্যেই তা পুরো পিলখানাজুড়ে ছড়িয়ে যায়, ভেঙে পড়ে চেইন অব কমান্ড ষড়যন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত নন এমন নিরীহ জওয়ানরা তখন অসহায় হয়ে পড়েন কেউ চাপের মুখে অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হন, কেউ পালিয়ে থাকেন আবার কেউ আতঙ্কে দিগি¦দিক ছোটাছুটি শুরু করেন অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র লুট করে ষড়যন্ত্রকারী জওয়ানরা হামলে পড়ে সেনাকর্মকর্তাদের অসহায় পরিবারগুলোর ওপরও অবিরাম গুলাগুলির শব্দ আর ষড়যন্ত্রকারীদের সরব তল্লাশি সৃষ্টি করে ভয়ঙ্কর আতঙ্কের ভীত সেনাসদস্যদের পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কে জড়োসড়ো হয়ে থাকেন কোয়ার্টারের বাসিন্দাদের মাঝে নেমে আসে শুমশাম নীরবতা আর আতঙ্ক কেবল ষড়যন্ত্রকারী জওয়ানদের দরজা ভাঙার শব্দ আর আকাশ ফাটানো গুলির আওয়াজই তাদের বুকে এসে বিদ্ধ হতে থাকে তীক্ষè ফলার মতো বিদ্যুৎ সংযোগবিচ্ছিন্ন অন্ধকার ঘরগুলোতে তখন নেমে এসেছিল ভুতুড়ে এক পরিবেশ মেঝেতে মুখ রেখে খাটের নিচে শুয়েছিলেন অনেক মহিলা শিশুদের মুখচাপা দিয়ে কান্না আটকে রাখেন তারা আর এভাবেই টানা ৩৪ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থেকে কেউ বের হতে পেরেছেন আবার অনেকেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে বাধ্য হন মৃত্যু হয়েছিল মেজর জেনারেল শাকিল আহমদের স্ত্রীরও
২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে জওয়ানদের বৈঠক শেষে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে বলে বাইরে থেকে ধারণা করা হয় কিন্তু পিলখানার অভ্যন্তরে তখনো চলতে থাকে জীবন্ত মানুষকে লাশে পরিণত করা আর লাশকে মাটিতে পুঁতে ফেলার হীন কাজ
আশা করা হয়েছিল ২৫ ফেব্রুয়ারিই হবে নারকীয় এই ঘটনার সমাপ্তি কিন্তু তা না হয়ে সারা দেশে বিডিআর শিবিরগুলোতে ছড়িয়ে যায় এ হট্টগোল এর ফলে সমাধানের জন্য প্রহর গুনতে থাকা দেশবাসীর উদ্বেগ আরো বাড়তে থাকে সরকার আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়ার নীতি গ্রহণ করে; অপর দিকে বিরোধী দলসহ বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠতে থাকে সেনা অভিযান পরিচালনা করার দ্রুত সেনা অভিযান না চালালে পিলখানায় লাশের সংখ্যা বাড়বে বলে তারা মত প্রকাশ করে ২৬ ফেব্রুয়ারি রক্তপাত এড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগ নেন সকাল থেকেই গোটা পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়, বিভিন্ন বাহিনীর প্রধান, পুলিশের প্রধান, দলের জ্যেষ্ঠ নেতা ও মহাজোটের নেতাদের সাথে বৈঠক করতে থাকেন প্রধানমন্ত্রী যমুনা বাসভবনে অবস্থান করে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা চালান অবশেষে ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টায় অবসান ঘটে রক্তক্ষয়ী এই হত্যাকাণ্ডের পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয় পুলিশ এর পর থেকে ধীরে ধীরে প্রকাশ হতে থাকে দীর্ঘ ৩৪ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির আসল রূপ ২৭ ফেব্রুয়ারি পিলখানার ভেতর গণকবর থেকে যখন সেনাকর্মকর্তাদের সারি সারি লাশ তোলা হয়, তখন স্তম্ভিত হয়ে যায় গোটা জাতি হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতা আরো প্রকাশ পায় এক দিন পর, যখন পোড়ানো তিনটি লাশের হাড়গোড় উদ্ধার হয় পিলখানার ভেতর থেকে ড্রেনের মুখ দিয়ে নোংরা পানির সাথে বেরিয়ে আসতে থাকে লাশ আর লাশ
দুই দিনের বিদ্রোহের শুরুতে প্রায় আট হাজার জওয়ান পিলখানায় ছিলেন বিডিআরে ডেপুটেশনে কর্মরত প্রায় এক শ’ কর্মকর্তা ছিলেন পিলখানার ভেতর বিদ্রোহ শুরুর প্রায় দুই ঘণ্টা পর সেনাকর্মকর্তাদের সবচেয়ে বড় অংশকে দরবার হলে ব্রাশফায়ারেরও পরে বিভিন্ন স্থান থেকে খুঁজে নিয়ে হত্যা করে ষড়যন্ত্রীরা ঘটনা শুরুর এক ঘণ্টার মধ্যেই প্রায় তিন শ’ সেনাসদস্য বিডিআর’র একটি গেটে অপারেশন চালানোর জন্য হাজির হন, কিন্তু এর জন্য অনুমতি মেলেনি সরকারের পক্ষ থেকে
পিলখানার অভ্যন্তরের পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হওয়ার পর থেকে দেশজুড়ে শুরু হয় গ্রেফতার অভিযান এ ঘটনায় সিআইডি সাত হাজার ৯২৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এদের মাঝে বেসামরিক ৪৩১ জন এক হাজার ৯৯০ জনকে গ্রেফতার করা হয় আনুষ্ঠানিকভাবে আর এক হাজার ৯৯৭ জনকে নেয়া হয় রিমান্ডে অন্য দিকে ঢাকার বাইরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৪০টি মামলায় এক হাজার ৭২১ জনকে গ্রেফতার করা হয় এসব মামলা হয়েছে ২৮ জেলার ৩৭টি থানা এলাকায় বিদ্রোহের সময় প্রায় চার হাজার ৪০০ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয় হত্যাসহ গুরুতর অপরাধে প্রায় ৬০০ জওয়ান সরাসরি জড়িত ছিল বলে সিআইডি প্রমাণ পায়
পিলখানা ট্র্যাজেডির তদন্তে সরকার প্রথমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি করে কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় একজন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি নিয়ে তদন্ত কমিটি করা হয় অপর দিকে সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি) লে. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে পৃথক সেনা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় সরকারি তদন্ত কমিটির রিপোর্টের বাছাইকৃত অংশ প্রকাশ করা হলেও সেনা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি ঘটনার তদন্তে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ও এফবিআই’র প্রতিনিধিরাও বাংলাদেশ সফর করেন
বিডিআর বিদ্রোহ ও পিলখানা ট্র্যাজেডির বিচার কোন আইনে হবে এ নিয়েও হয় দীর্ঘ বিতর্ক অবশেষে সরকার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পরামর্শ নেয় আপিল বিভাগ সিনিয়র আইনজীবীদের অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দিয়ে তাদের মতামতও গ্রহণ করেন আপিল বিভাগ মত দেন সেনা আইনে নয়, বিডিআর বিদ্রোহের বিচার হবে বিডিআর আইনেই এবং পিলখানা হত্যাযজ্ঞের বিচার হবে ফৌজদারি আইনে এরপর ঢাকার বাইরে ৪০টি স্থানে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার বিচারের জন্য ছয়টি বিশেষ আদালত গঠন করা হয় সব ক’টি আদালতের প্রধান হিসেবে বিডিআর’র ডিজি মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী দায়িত্ব পালন করছেন বিডিআর’র বর্তমান আইনে বিদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড বিদ্রোহের বিচার হচ্ছে বিদ্যমান আইনেই
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরে এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে যাওয়ার এক বছর পরও বিডিআরকে শক্তিশালী করে পুনর্গঠনকাজ জোরদার হয়নি কিন্তু বিডিআর’র নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ করার একটি প্রস্তাব বাস্তবায়নের চূড়ান্তপর্যায়ে রয়েছে এরই মধ্যে পোশাকও পরিবর্তন করা হয়েছে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে বিডিআর সংশ্লিষ্ট অনেক আইনকানুন কিন্তু স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি এ ঘটনার জন্য কারা দায়ী তা জনগণের সামনে স্পষ্ট করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো বেরিয়ে আসেনি ঘটনার আসল রহস্য

লেখাটি আমার ছদ্মনামে (তনয় হোসনেয়ারা) মাসিক কারেন্ট দিগন্তে প্রকাশিত

কোন মন্তব্য নেই: