রবিবার, আগস্ট ০২, ২০০৯

ইতিহাসের পদধ্বনি: প্রথম পর্ব


শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
মানব বসতির বিভিন্ন পর্যায়ে গড়ে উঠেছিলো সভ্যতম অনেক নগরী। নাগরিক সুবিধার বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল এ নগরীগুলো মানুষ গড়ে তুলেছিলো নিজেদের প্রয়োজনেই। নিজস্ব বুদ্ধিমত্তার যে আলাদা গুণ রয়েছে মানুষের মাঝে, এ কারণেই তাদের পÿে প্রকৃতির অনেক অনুষঙ্গকে নিজেদের মতো গড়ে নেয়া সম্ভব। কিন্তু এগুলো টিকিয়ে রাখাও কি মানুষের সাধ্যের ভেতর? নাহ, যদি তাই হতো তবে পৃথিবীতে গড়ে উঠা অনেক সভ্যতাই হারিয়ে যেতোনা সীমাহিন শূন্যে। প্রাচীন নগরীগুলোর মাঝে কোনটির স্থান এখন কেবল ইতিহাসের পাতায়। আবার কোনটির খবর হয়তো বর্তমান পৃথিবীর কেউ জানেইনা। অপরদিকে কালের ধূলোয় পুরনো অনেক নগরীই সৃস্টির পর থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ধরে রাখতে পেরেছে প্রাণশক্তি। এখনো প্রাণোচ্ছল সেই নগরীগুলোর শিরা উপশিরায় বিরাজ করে জীবণের উষ্ণতা। প্রকৃতি তার আপন নিয়মেই গিলে ফেলে সভ্যতম অনেক জনপদকে। আবার আপন নিয়মেই সময়ের সাথে টিকিয়ে রাখে কোন কোন নগরীর প্রাণ। প্রকৃতির এই নিয়মকে বেঁধে দিয়েছেন যে সত্ত¡া, তাঁর ইচ্ছার উপরই নির্ভর করে জীব, জগত, নগর এবং সভ্যতার উত্থান পতন। এ পরম সত্ত¡ার সাথে তুলনীয় নয় অন্য কোন কিছুই। কিন্তু তবুও কালের অভিযাত্রায় বিভিন্ন পৌত্তলিক নগরীতে পূজনীয় করে তোলা হয়েছিল অন্য কোন সত্ত¡াকে। অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, কালের স্রোতে ভেসে যাওয়া অসংখ্য নগরীর প্রায় সবই ছিলো পৌত্তলিকতায় পরিপূর্ণ। অন্যদিকে গড়ে উঠার পর হাজার হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে বেঁচে থাকা নগরীগুলোতে পাওয়া যায়না এতটুকু পৌত্তলিকতার ছুঁয়া। এমন কয়েকটি প্রাচীন শহরই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যেগুলো থেকে প্রতিনিয়ত ভেসে আসছে ইতিহাসের পদধ্বনি।

জাজিয়ানটেপ
কোথাও জলপাই বন, কোথাও ভিনেয়ার্ড কিংবা পে¯Íাবাদমের তরুবিথী আগলে রেখেছে প্রাচীন এ শহরটিকে। ভ’মধ্য সাগরের ১২০ কিলোমিটার পূর্বেই এর অবস্থান। অদূরে বয়ে গেছে ইউফ্রেটিস নদীর সরু একটি প্রবাহ সাকিরসুঁই। ইতিহাসের কোন এক ভাঁজে এ শহরটি গড়ে উঠেছিলো নাগরিক জীবণের উপযোগী হিসাবে। এখানকার প্রাচীন স্থাপনাগুলো এখনো শব্দ তুলে মাটি এবং মানুষের হৃদয় নিংড়ানো পললের। এখানে কান পেতে এখনো অনুভব করা যায় প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার স্পন্ধন।
পৃথিবীর প্রাচীনতম শহরগুলোর মাঝে জাজিয়ানটেপ হলো সবচেয়ে পুরনো। ধারণা করা হয় তুরস্কের এ শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো আজ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছরেরও (খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৫০) আগে। সময়ের স্রোতে প্রবাহিত হয়ে অনেক শহর গড়ে উঠলেও আবার এ স্রোতেই বিলীন হয়ে গেছে সেগুলো। কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন নগরী জাজিয়ানটেপ আজ পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছে প্রাণ শক্তি। একদিন যে নগরীতে স্পন্দন তুলেছিলো মানুষ, সেই নগরী এখনো আগলে আছে মানুষের কোলাহলকে। তুরস্কের দÿিণ পূর্বাঞ্চলের সবেচেয়ে বড় শহর এই জাজিয়ানটেপ। আরো মজার ব্যাপার হলো মেসোপটেমিয়া সভ্যতাকেও ধারণ করেছিলো এখানকার অধিবাসীরা। ঐতিহাসিক মেসোপটেমিয়া সভ্যতার দÿিণ পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত এনাটোলিয়া পর্যটন এলাকা। সভ্যতম এনাটোলিয়ার পশ্চিমেই জাজিয়ানটেপের অবস্থান। অতীতকে জানার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিয়ত মানুষ ছুটে আসছে এনাটোলিয়াতে। ভাবের জগতে ভর করে ভ্রমণে বেরিয়ে পরছে মেসোপটেমিয়ায়। আর তাদের ভাবনার উপকরণ হিসাবে কাজ করছে অসংখ্য প্রাচীনতম নিদর্শন। এগুলোর অনেক কিছুকেই প্রদর্শনের জন্য সংরÿনে রেখেছে জাজিয়ানটেপ জাদুঘর। শহরের বুকে মজবুত ভীত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন স্বাÿীগুলো পর্যটকদের কানে কানে বলে যাচ্ছে সময়ের কাহিনী। কেবল তাই নয় এর আয়তন, ছিমছাম আধুনিকতা, নান্দনিক বিন্যাস এবং জৌলুস যে কাউকে টেনে নিতে বাধ্য অতিত মেসোপটেমিয়ায়। আয়তনের দিক থেকে সমগ্র তুরস্কে এর অবস্থান ষষ্ঠতম। প্রাচীন এ শহরকে কেন্দ্র করে বর্তমান তুরস্কে জাজিয়ানটেপ নামে রয়েছে একটি প্রদেশ। প্রশাসনিকভাবে প্রদেশ জাজিয়ানটেপ পরিচালিত হয় দুটি কেন্দ্রীয় জেলার অধীনে। এর একটি সাহিনবে এবং অপরটি সেহিতকামিল। দÿিণ দিক থেকে জাজিয়ানটেপের সীমা সিরিয়ার সাথে। তবে সেদিকের এক অংশে রয়েছে কিলিস। উত্তরে আদিয়ামান, পূর্বে সানলিউরফা, দÿিণ পশ্চিমে হাটায়, পশ্চিমে ভ’মধ্য সাগর ও জাজিয়ানটেপের মাঝখানে ওসমানিয়া এবং উত্তর পশ্চিমে কাহরামানমারাসের অবস্থান।
ভৌগলিক ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জাজিয়ানটেপ প্রাচীন কাল থেকেই বন্ধুত্বপূর্ণ ও উদার শহর হিসাবে পরিচিত। আকর্ষণীয় নির্মাণশৈলী ও সভ্য মানুষের পদচারনায় ২১৩৮ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত এ শহরটি পরিণত হয়েছে জীবন্ত এক আধুনিক শহরে। ১৯১১ সালের এনসাইকোপিডিয়া ব্রিটেনিকার তথ্য অনুযায়ী ১৯ শতকের শেষের দিকে এর জনসংখ্যা ছিলো ৪৫,০০০ এর মতো। এর দুই তৃতীয়াংশ ছিলো মুসলমান। আর সর্বশেষ ২০০৭ সালের শুমারি অনুযায়ী মেট্রোপলিটন এরিয়ার লোকসংখ্যা ১,২৩৭,৮৭৪। এদের মাঝে সিরিয়ান ইহুদীদের সংখ্যাও উলেøখযোগ্য পরিমাণ। নানা সময় সিরিয়ান ইহুদীদের এনটেবি বংশীয়রা বি¯Íার লাভ করে। আর সেখানকার খ্্িরস্টানদের অধিকাংশই হলো আরমেনিয়ান।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসকের অধীনে থাকার কারণে জাজিয়ানটেপ গড়ে উঠেছে ভিন্ন এক মাত্রায়। এখানে রয়েছে নানান মানব গোষ্ঠী, ভাষা ও সংস্কৃতির ছুঁয়া। আর তাই সংস্কৃতি ভেদে এর নাম নিয়েও রয়েছে ভিন্নতা। জাজিয়ানটেপ নগরী প্রাচীন গ্রীক এবং রোমানদের কাছে দোলিখ নামে পরিচিত। যাকে তুর্কিরা দুলুক বলে থাকে। কুর্দিদের ভাষায় এটি দিলোক, আরাবীয়দের ভাষায় সেলজুকস এবং অটোমানদের কাছে এইনটেব নামে পরিচিত।
প্রাচীনতম এ নগরীর বয়স এবং ইতিহাস সন্ধানে মানুষের চেষ্টার শেষ নেই। কিন্তু এখন পর্যন্ত ইতিহাসের লেজ ধরে ধরে অন্ধকারে এগিয়ে চললেও নগরীর শুরুর সময়কালে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে এর কোন ইতিহাস পাওয়া না গেলেও অনুমান করা হয় তাউরুস পাহাড়ের উপর প্রতিষ্ঠিত অ্যান্টিওছিয়া আত তাউরুস নামক শহরের একটি অংশ ছিলো এটি। ইতিহাসের পথ ধরে যতদূর আগানো যায়, সে সময়টা ছিলো খ্রিস্টপূর্ব ১৮ শতকে প্রাচীন এনাটোলিয়ান সভ্যতার হিটিটিস সময়কাল। কারণ বর্তমানে এখানে সময়ের স্বাÿী হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন কেলøা ও স্থাপত্যগুলোর সাথে হিটিটিসদের বৈশিষ্ট্যের মিল পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে অসংখ্যবারই হাত বদল হয়েছে এর প্রশাসনিক ÿমতা। প্রথম নাগরিক সভ্যতার ধারক হওয়ার কারণেই নানা যুদ্ধ বিগ্রহ ও উত্থান পতনের স্বাÿী হয়ে আছে এই জাজিয়ানটেপ। সাত শতকের প্রথম দিকে আরবীয়রা এই অঞ্চলে আধিপত্য বি¯Íার করে। আরবীয় শাসনের সময় বিভিন্ন সময়ে এ অঞ্চল পূর্ব রুমানদের অধীনেও যায়। আব্বাসীয় শাসনের অবসানের পর জাজিয়ানটেপ টুলুনিভস, ইখসিডিডস এবং হামদানীডসদের শাসনের অধীনেও যায়। ৯৬২ খৃস্টাব্দে পূর্ব রুমানীয় অর্থাৎ বিজানটিন্সরা এ অঞ্চল দখল করে নেয় এবং ১০৬৭ খ্রীস্টাব্দে সেলজুকদের বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। তারা তুরস্কে সেলজুক সালতানাত প্রতিষ্ঠা করে। ১০৮৬ সালে এনাটোলিয়ান সেলজুকদের কাছ থেকে এর শাসন চলে যায় সিরিয়ান সেলজুকদের কাছে। প্রথম ক্রুসেড শুরু হলে ১০৯৮ সালে এটি ক্রুসেডারদের দখলে চলে যায়। এটি ১২৫০ সালে সেলজুক সালতানাতের পুন:প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত টিকে থাকে। সিলিসিয়ার আরমেনীয় রাজ্যের দ্বারা জাজিয়ানটেপ অধিকৃত ছিল ১১৫৫ থেক ১১৫৭ সাল পর্যন্ত এবং ১২০৪ থেকে ১২০৬ সাল পর্যন্ত। ১১৭২ সালে এ অঞ্চল অধিকার করে নূরউদ্দীন জঙ্গি। পরবর্তীতে ১১৮১ সালে তা ইতিহাসের প্রখ্যাত বীর সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর শাসনের অধীনেও ছিলো। ১২১৮ সালে রোমের সেলজুক সালতানাত পুন: অধিগ্রহণ করে জাজিয়ানটেপকে। জাজিয়ানটেপ মঙ্গোলীয়দের শাসনাধীন ছিলো ১২৬০-১২৬১, ১২৭১-১২৭২, ১২৮০-১২৮১ এবং ১২৯৯-১৩১৭ সাল পর্যন্ত। ইসলাম ধর্মে দীÿিত হওয়া ¯øাভদের অধীনে ছিলো ১২৬১-১২৭১, ১২৭২-১২৮০, ১২৮১-১২৯৯, ১৭১৭-১৩৪১, ১৩৫০-১৩৭৮, ১৩৮১-১৩৮৯ এবং ১৩৯৫-১৫১৬ সাল পর্যন্ত। ১৫১৬ সালে মার্জদাবিক এর যুদ্ধের পর অটোমানরা এ এলাকা অধিগ্রহণ করে।
সময়ের স্বাÿী জাজিয়ানটেপ মূলত দীর্ঘ বয়সের মহিমায়ই পরিচিত পুরো পৃথিবীতে। সেই সাথে আপন সৌন্দর্য এবং অর্থনৈতিক কারণেও রয়েছে এর খ্যাতি। তামার তার এবং ইয়ামেনী ¯িøপারের জন্য এ অঞ্চল প্রসিদ্ধ। তুরস্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ শিল্প এলাকাকে দÿিণপূর্ব এবং পূর্ব তুরস্কের বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে ধরা হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এ শহরটি সেজে উঠলেও আপন ঐশ্বর্যকে কখনো জলাঞ্জলি দেয়নি জাজিয়ানটেপ। ইতিহাসের অলিগলি দাবড়িয়ে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে পৃথিবী থেকে পর্যটকরা এসে ভীর করে প্রতিনিয়ত। তাই বেশ কিছু উন্নত পর্যটন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেখানে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো তুরস্কের অর্থনীতিতে রাখছে বড় একটি ভ’মিকা। জাজিয়ানটেপ থেকে উৎপাদিত পণ্যের মাঝে স্ট্রাইপড সিল্ক, কটন ফেব্রিক, চামড়া জাত পণ্য, জলপাই তেল, আঙ্গুর থেকে তৈরি মিষ্টি, তামাক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এখানকার উৎপাদিত পে¯Íাবাদাম পৃথিবীব্যাপি খ্যাত বলে জাজিয়ানটেপ তুরস্কে পে¯Íাবাদামের শহর হিসাবে পরিচিত।
জাজিয়ানটেপ থেকে উৎপাদিত গালিচার বেশ কদর রয়েছে বিশ্বে। গালিচা তৈরি এখানকার অনেকের ঐতিহ্যবাহী পেশা। প্রাচীন জাজিয়ানটেপের নারীরা পশম দিয়ে গালিচা বুনন করতো। তারা এ গালিচাকে নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়ে তুলতো। গালিচাকে তারা দেখতো কবিতার চিত্ররূপ হিসাবে। এর নকশাগুলোর মাঝে প্রস্তুতকারীরা ফুটিয়ে তুলে মানুষের রহস্যময় আচরণ। কখনো কখনো এসব গালিচায় থাকে ময়ূর, ঘাস খাচ্ছে এমন হরিণ, উঁচু সাইপ্রেস গাছ, অলঙকৃত ফুলদানি, জলাধার, সন্তরণরত হাঁস, রূপালি মাছ এবং লতাপাতা ও ফুলের ছবি। গালিচা কেবল সৌন্দর্যকেই ফুটিয়ে তুলেনা বরং এর নকশা ও প্রতিটি বুননের ভেতরে লুকিয়ে থাকে ভিন্ন এক রহস্য। যে কারণে যুদ্ধবিগ্রহের সময় একপÿ অপরপÿের অনেক কিছু তছনছ করে দিলেও গালিচাগুলোকে অÿত রাখতো। এসব গালিচার মূল্য হামলাকারীদের কাছেও ছিল অনেক। গালিচায় কখনো মৃত্যু, ধ্বংস, বিশৃঙ্খলা ফুটিয়ে তোলা হয়না। সৌন্দর্যকে বিকশিত করার এ মাধ্যমে অশুভকে দূরে রাখা হয়। নিষ্ঠুরতা, যাতনা ও বিষাদ একান্তই যদি তুলে ধরতে হতো তবে এসবের সাড়া দেয়া হতো সৌন্দর্যকে তুলে ধরার মাধ্যমে। প্রাচীন সব গালিচা প্রস্তুকারীই জানতো যে, সৌন্দর্যই হচ্ছে সব যাতনার নিরাময়। সৌন্দর্যপ্রিয় ও সৌখিন লোকেরা ছিলো এসব গালিচার ক্রেতা। ÿমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিদের প্রাসাদে শুভা পেত অসাধারণ এসব শিল্পকর্ম। সময়ের সাথে সাথে সব কিছু পাল্টালেও মানুষের সৌন্দর্যপ্রিয়তা একেবারেই পাল্টায়না। জাজিয়ানটেপের অধিবাসিদের সেই সৌন্দর্যপ্রিয়তা বংশপরম্পরায় এখনো রয়েগেছে অটুট। সে কারণেই আজো টিকে আছে সেখানকার গালিচা শিল্প। কেবল টিকে থাকা নয় বরং সমগ্র বিশ্বকে আহŸান করছে সৌন্দর্যের দিকে। গালিচা হলো সৌন্দর্য, অভিনন্দন, সানন্দে গ্রহণ ও উৎসবের প্রতীক। এখনো এ প্রতীকের সাথে থেকে জাজিয়ানটেপ মেতে উঠে আগের মতো উৎসবে।

http://blog.bibleplaces.com/uploaded_images/West_Jerusalem_aerial_from_north,_tb010703236-786405.jpg
জেরুজালেম
মানচিত্রের উত্তরে চিলতের মতো হয়ে এসে যেখানটায় শেষ হয়েছে মৃত সাগর, এর ৩৫ কিলোমিটার অদূরেই পবিত্রতম এক পাহাড়ি উপত্যকা জেরুজালেম। মুসলমান, খ্রিস্টান এবং ইহুদী ধর্মের জন্য পবিত্র এ উপত্যকাটি সভ্যতার ছুঁয়ায় গড়ে উঠেছে জুদিয়ান পাহাড়ের পাদদেশে। কেবল ধর্মীয় কারণে নয় ভৌগলিকভাবেও জেরুজালেমের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এক অবস্থান। প্রকৃতির অঢেল নিঃসর্গ যেন ঢেলে দেয়া হয়েছে এখানে। উপত্যকার পূর্ব দিকে যেমন পৃথিবীর রাহস্যঘেরা এক আশ্চর্য মৃত সাগর, তেমনি মাত্র ৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে এসে আছড়ে পরছে ভ’মধ্যসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালা। এরই মাঝে মানুষের বসতি। ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালে শহর হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো জেরুজালেম। আর একেই পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম শহর হিসাবে ধরা হয়। মানুষের বসতির প্রথম দিকে জুদিয়ান পাহাড়ের শ্যামল এ উপত্যকাটি কেমন ছিলো তা ধারণা করা না গেলেও অন্তত বাইবেলিয় সময়ের কথা বলা যায়। তখন বসতির ভেতর সবুজ নয়, বরং ছিলো সবুজের ভেতর বসতি। কোথাও দেখা যেতো কাঠবাদাম, কোথাও জলপাই আবার কোথাওবা পাইন বন। কিন্তু মানুষের শুধু শুধু প্রকৃতিকে ধ্বংস করার প্রবণতার ফলে আগের সেই সবুজ এখন আর টিকে নেই। তবে পৃথিবীর অন্যান্য অনেক নগরীর সাথে তুলনা করলে এর পরিমাণ অবশ্যই বেশি। এখনো এ শহরের পূর্ব দিক ঘিরে রেখেছে নির্মল জলপাই বন। ছোট বড় অসংখ্য উপত্যকার সমন্বয়ে ভ’খন্ডটির রয়েছে ভিন্ন এক আবহ, রয়েছে অসম্ভব নান্দনিকতা। পুরাতন শহরের দÿিণ অংশ ছাড়িয়ে রয়েছে কিডরুন উপত্যকা। তারপর আবার উঁচু হয়ে উঠেছে জলপাই পাহাড়। একই দিকে গভীর ও ঢালু উপত্যকা হিন্নুন। খ্রীস্টানদের ধারণা এ হিন্নুন থেকেই শুরু হবে পাপিদের পরলৌকিক শা¯িÍ। উত্তর পশ্চিম দিকে দামেস্ক গেটের কাছাকাছি আরেক উপত্যকা তাইরুপিয়ানের অবস্থান।
জেরুজালেম জুড়ে বছরের বারো মাসই থাকে নির্মল প্রকৃতির কোমল ছুঁয়া। এখানকার বাসিন্দারা অভ্য¯Í ভ’মধ্যসাগরীয় আবহাওয়ায়। তারা যেমনভাবে অভিবাদন জানায় গ্রীষ্মকে তেমনি শীতও এদের বরণীয়। এ উপত্যকায় গ্রীষ্ম আসে আলো ও আঁধারের উষ্ণতার ব্যবধান নিয়ে। আকাশে সূর্যের উপস্থিতিতে প্রচন্ড তাপে তাঁতিয়ে উঠে এরা। আবার সূর্য তলিয়ে গেলে ঠান্ডায় কেঁপে ওঠে এরাই। কখনো কখনো ঝর ঝর করে উপত্যকাকে ভিজিয়ে দিয়ে যায় বৃষ্টি। আবার এখানে মৃদু তুষার ঝরিয়ে আগমন ঘটে শীত মৌসুমের। পবিত্রতম এ উপত্যকায় প্রকৃতির সবই ঘটে স্বাভাবিক নিয়মে। কিন্তু যত অস্বাভাবিকতা কেবল এখানকার বাসিন্দাদের মাঝেই। কোথাও কোন অসঙ্গতি না থাকলে হয়তো ইতিহাসের প্রাচীন এ নগরী নিভৃতেই চলতো সময়ের পথ ধরে। পাহাড় গলে প্রবেশ করা সাগরের নির্মল বাতাস আবার নির্মলতা নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারতো জেরুজালেম থেকে। কিন্তু এখানকার প্রতিদিনের বাতাসে এখন নেই এতটুকু শান্তির লেশ, নেই কোন উদারতা। এখন ইজরাইলের করায়ত্তে থাকা জেরুজালেমের আকাশ বিদির্ণ করে ফাটে কামানের গোলা, বাতাসে বারুদের গন্ধ আর ভ’মিতে ভারি অস্ত্রের ঝনঝনানি। পাহাড় সাগরের মিতালিতে অবস্থান করলেও এখানকার বাসিন্দারা বিভক্ত। অনেকের চোখে ঘুম নেই, থালায় খাবার নেই, মাথা গোঁজার ঠাই নেই, জীবণের অধিকার নেই, নিজের স্বাধীনতা নেই। এ যেন পরিণত হয়েছে এক নেই উপত্যকায়।
এ উপত্যকা থেকে যারা নেই করেছে শান্তিপ্রিয় মানুষের ঘুম, তাদেরই বিষাক্ত নখর প্রতিনিয়ত দাগ কাটছে মানবতার বুকে। এখানকার দখলদারী ইহুদীদের বুনন করা জালে এখন বন্দি পুরো পৃথিবী। এ নগরীর অভ্যন্তরেই অবস্থান মুসলমানদের একসময়কার কেবলা মসজিদুল আকসার। অথচ আজ পবিত্রতম সেই স্থানে প্রার্থনার জন্য মুসলমানদের হাজারো বাঁধা। নিজের ভ’মিতে তাদের বসতি যেন কারাগারের বদ্ধ প্রকোষ্ঠে। ইজরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর তলøাশি ও নিষ্ঠুরতার আতঙ্ক তাদের তাড়া করে প্রতি মুহুর্তে। কিন্তু তবুও দখলদারিত্বের জীবণে নিজেদের পরিচিতি টিকিয়ে রাখার জন্য আল আকসা অভিমুখে ভেসে আসছে মানুষের স্রোত৷ পুরুষ, মহিলা, শিশু এরা সবাই মূলত পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনী মুসলমান৷ পশ্চিম তীরের অন্য যে কোন শহরের বা গাযার ফিলিস্তিনীদের জন্য পুরাতন জেরুজালেমের দরজা বন্ধ৷ আর পূর্ব যেরুজালেম থেকে ছুটে আসা মানুষের স্বাধীনতায় খড়গ বসাতে মসজিদের চারদিকে এবং প্রবেশ পথে থাকে ইজরাইলি সৈন্য ও পুলিশের কঠিন টহল৷ সন্দেহ হলেই দেখছে পরিচয়পত্র। অযথাই লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা, নির্যাতন, হত্যা, গুম প্রতিদিনের জন্য খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁচলে থাকা এ উপত্যকার মানবিয় বহি:প্রকাশ বড়ই কুৎসিত। অথচ এটি অন্যরকম এক বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আধুনিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্তে¡ও এখানে খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন এক আবহ। পৃথিবীর প্রাচীনতম এ নগরী তিনটি অংশে বিভক্ত। এক অংশ দ্রæত উন্নয়নশীল বাণিজ্যিক এলাকা পশ্চিম জেরুজালেম। অধিকাংশ আরবীয়দের বসবাস যেখানে সে অংশটি পূর্ব জেরুজালেম এবং যে অংশের কারণে ইতিহাসের পাতায় প্রাচীন নগরী হিসাবে স্থান পেয়েছে এ উপত্যকাটি সেটি হলো শহরের মূল ও পূরাতন অংশ। ইউনেস্কো পুরাতন জেরুজালেমকে ঘোষণা দিয়েছে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইট হিসাবে। জেরুজালেমের অর্থনীতির বড় একটি অংশ নির্ভর করে শহরের পুরাতন অংশের উপর। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা ছুটে আসে ইতিহাসের অনঢ় স্বাÿী এ অংশ এবং পশ্চিম দিকে নির্মিত দেয়ালের আকর্ষণে। এখানে এসে তারা ডুবে যেতে চায় অতীতে। কারণ এ নগরী গড়ে উঠেছে অসংখ্য শৈল্পিক সংস্কৃতির সংমিশ্রণে। কেবল তাই নয, পবিত্রতম জেরুজালেমে এখনো টিকে রয়েছে প্রাচীন অনেক প্রার্থনাগার। পুরো শহরে সিনাগগের সংখ্যা ১২০৪টি, চার্চ ১৫৮ টি এবং মসজিদ রয়েছে ৭৩টি। এগুলোই শহরের ৭৪৭,৬০০ জন বাসিন্দার প্রার্থনালয়। ২০০৭ সালের এ শুমারি অনুযায়ী এদের মাঝে ৬৪ শতাংশ ইহুদী, ৩২ শতাংশ মুসলিম এবং ২ শতাংশ ক্রিস্টান। ১২৫.১৫৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ নগরীতে ২০০৫ সালের শেষের দিকে বসতির ঘনত্ব ছিলো প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫,৭৫০.৪ জন। ইজরাইল ও ফিলি¯িÍন উভয় রাষ্ট্রই এ শহরকে রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করলেও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একে কোন দেশের রাজধানীর স্বীকৃতি দেয়না। অধিকাংশ রাষ্ট্র তেলআবিবকে ইসরাইলের এবং গাজাকে ফিলি¯িÍনের রাজধানী হিসাবে গণ্য করে।
একেশ্বরবাদী তিনটি ধর্মের জন্য জুদিয়ান পাহাড়ের উপত্যকায় গড়ে উঠা এ শহরটি পবিত্র হওয়ার কারণে একে বলা হয় পবিত্রতম শহর । আর জেরুজালেম শব্দের অর্থও হলো পবিত্র। প্রাচীন মিশরীয় রেকর্ডে জেরুজালেমের যে নাম পাওয়া যায় তা হলো ‘রুসালিমুন’ অথবা ‘উরসালিমুন’। গ্রীকরা এর পূর্বে ‘হাইক’ সংযোজন করে ‘হাইক্রোসালিমুন’ বলে ডাকে। । আরবদের কাছে এটি আল-কুদস বলে পরিচিত। এর সবগুলোর অর্থই হলো পবিত্র। হিব্রæ পান্ডুলিপি অনুযায়ী জেরুজালেম ৯৭০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত ছিলো হযরত দাউদ (আ.) এর শাসনের অধীন। তাঁর সময় এ শহরটি গড়ে উঠেছিলো বলে একে দাউদ এর শহরও বলা হয়। পরবর্তীতে এ অঞ্চলের শাসক হন তাঁর পুত্র হজরত সোলায়মান (আ.)। তিনিই এ নগরীতে আল আকসা মসজিদটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে ইতিহাসের ধারা বেয়ে গড়ে উঠেছে আজকের সভ্য নগরী জেরুজালেম।
পর্যায়ক্রমে এ উপত্যকায় ইহুদী, খৃষ্টান এবং মুসলমানরা জনবসতি গড়ে তোলে। জেরুজালেমকে রাজধানী করে গড়ে তোলা ইহুদীদের জুদাহ রাষ্ট্র একসময় বিধ্ব¯Í হয়েছিলো ব্যবলনীয় রাজা নেবুচাঁদনেজারের হাতে। পরবর্তীতে রোমানদের আক্রমনে আবারও ইহুদীরা বিতাড়িত হয় জেরুজালেম থেকে। সপ্তম শতাব্দীতে এলাকা মুসলমানদের আয়ত্তে¡ আসে এবং অটোম্যান সাম্রাজোর শেষ পর্যন্ত তা অুন্ন থাকে। তখন এখানে ইহুদীদের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। আজ যে ইহুদীরা মুসলমানদেরকে বিতাড়িত করার জন্য উত্তপ্ত করে রেখেছে জেরুজালেম ও ফিলি¯িÍনকে। সে ইহুদীরা মুসলিম শাসনের অধীনে সবসময়ই থেকেছে নিরাপদ। হজরত ওমর রা. এর খেলাফতের সময় দীর্ঘ ৫০০ বছর পর জেরুজালেমে বসতি গড়ার অনুমতি পায় তারা। কোথাও যখন ঠাঁই মিলছিলোনা তখন ইসলামের ২য় খলিফা আশ্রয় দিয়েছিলেন তাদের। এই জেরুজালেম স্বাÿী হয়ে আছে মুসলিম শাসকদের উদারতা ও স¤প্রীতির। ওমরের সময় মুসলিম সৈন্যরা অবরুদ্ধ করে রেখেছিলো জুদিয়ান পাহাড়ের এ উপত্যকা। কিন্তু খ্রীষ্টানদের দাবি ছিরো তারা খলিফা উমরের কাছে উত্মসমর্পণ করবেন। ইসলামের ২য় খলিফা হযরত ওমর (রা.)ও তাদের সাথে চুক্তি সম্পাদনের জন্য আরব থেকে রওয়ানা দেন সুদূর জেরুজালেমের উদ্দ্যেশে । তিনি সেখানে পৌঁছার পর সারা জেরুজালেম অবাক হয় দেখল বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকর্তা ওমর (রা.) গাধার দড়ি হাতে বিনয়ের সাথে হেটে শহরে প্রবেশ করছেন। আর গাধার পিঠে সওয়ার তারই ভৃত্য। কেবল তাই নয় ধর্মীয় স¤প্রীতি রÿার জন্য এ জেরুজালেমেই তিনি নজির রেখে গেছেন আরেক উদারতার। হযরত ওমর (রা.) জেরুজালেমের একটি বিখ্যাত চার্চ পরিদর্শনে ছিলেন। সেখানে নামাজের সময় হয়ে গেলে তিনি অন্য স্থানে গিয়ে নামাজ আদায় করেন। কারণ তাঁর শংকা ছিলো চার্চের ঐ স্থানে নামাজ আদায় করলে, তার স্বরণে পরবর্তীতে একে মসজিদে রূপান্তর করা হতে পারে। এ কারণেই এ চার্চের আশপাশে মুসলমানরা একত্রিত হয়ে যেন নামাজ আদায় করতে না পারে সেজন্য একটি ডিক্রিও জারি করেন।
মুসলমানরা ইহুদীদেরকে আশ্রয় দিলেও বিভিন্ন সময় তাদের মার খেতে হয়েছে অন্যদের হাতে। রোমানদের আক্রমণে বিধ্ব¯Í হবার পর ইহুদীরা ইউরোপের বিভিন্ন ভূখন্ডে ছড়িয়ে পড়ে এবং নির্বাসিত জীবন যাপন শুরু করে। তখন তারা কোন দেশেই মূলধারার জনগোষ্ঠীর সাথে একীভূত হতে পারেনি। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে ইহুদীরা সবেেত্রই ভূমিকা রাখলেও এদের জীবন পরিচালিত হতো মূলধারার বাহিরে। পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তারা বস্তিতে এবং শহরের উপকন্ঠে বাস করত। এই নির্বাসিত জীবন থেকে মুক্তির জন্য ইহুদীরা জায়নবাদী আন্দোলন গড়ে তুলে। জুদিয়ান পাহাড়ের আরেক নাম হলো জায়ন। এ পাহাড়ের উপত্যকা জেরুজালেমে তারা আবার একত্রিত হবার জন্য তাদের সংগ্রাম ছিলো বলে এ আন্দোলনের নাম দিয়েছিলো জায়নবাদী আন্দোলন। এ পাহাড়ের পাদদেশে সারা বিশ্ব থেকে ইহুদীরা এসে নিজেদের আবেগকে প্রশমিত করতো। নির্বাসিত জীবনে বিভিন্ন ভূখন্ডে তারা লালন করতে থাকে এ আন্দোলনকে। উনবিংশ শতাব্দিতে কিছুসংখ্যক ইহুদী ফিলি¯িÍনে ফিরে এসে জেরুজালেম, সাফেদ এবং ত্রিবেরীতে বসবাস শুরু করে। ধীরে ধীরে তাদের জায়নবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে এবং প্রতাপশালী বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে তাদের প্রভাব বাড়তে থাকে। এ কারণে ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে একটি সনদে বলায় হয় ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করা হবে একটি হবে আরবের আর একটি ইহুদিদের। এ সনদে বলা হয় জেরুজালেম স্বাসিত হবে সরাসরি জাতিসংঘের দ্বারা। এর ফলে শুরু হয় আরব আর ইহুদিদের মধ্যে সংঘর্ষের। তখন ইহুদি এই অবৈধ অভিবাসিরা সংঘটিত হতে থাকে পশ্চিমাদের সাহায্য সহযোগিতায়। কিন্তু ১৯৫৭ সালে ইহুদি, ফরাসী আর ব্রিটিশ সমন্বিত শক্তির কাছে পরাজিত হয় আরবরা। অবশেষে ১৯৬৭সালের ৬দিনের যুদ্ধে আরবরা পুরোপুরি পরাজিত হয় জায়নিষ্ট শক্তির কাছে। এর আগে জেরুজালেম এর পূর্বাংশ ছিলো জর্দানের অধীনে। পরবর্তীতে ইহুদিরা আরো অনেক অঞ্চল নিজেদের অধিকারে নিয়ে নেয়। আর একের পর এক গণহত্যা চালিয়ে অগ্নিগর্ভে পরিণত করে জেরুজালেমসহ পুরো ফিলি¯িÍনকে।

http://msnbcmedia4.msn.com/j/msnbc/Components/Photos/070331/070331_kirkuk_hmed_2p.hmedium.jpg
কিরকুক
আজ থেকে পাঁচ হাজার বছরেরও পূর্বে গড়ে উঠা শহর কিরকুক। এর অবস্থান বর্তমান ইরাকের উত্তরাঞ্চলে। রাজধানী বাগদাদ থেকে ব্যবধান ২৫০ কিমি। হ্যামরিন পাহাড়ের উত্তর দিকে প্রাচীন এ নগরবসতি ছুঁয়ে প্রবাহিত হয়েছে তিনটি নদী। পশ্চিমে টাইগ্রীস ও জ্যাব এবং দÿিণ পূর্ব দিক দিয়ে কলকলিয়ে বয়ে গেছে সিরওয়ান। এ প্রবাহগুলো কখনো অপেÿা করেনি কারো জন্য, যেমনভাবে অপেÿা করেনি সময়। যে পথের শেষ নেই সে পথ ধরেই সময়ের অফুরন্ত অভিযাত্রা। খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার সালে সেই যে সময়ের সাথে যোগ হয়েছিলো এই সভ্য নগরী, আজ অবধি সাথেই আছে। তবে এই ব্যবধানটুকুতে বয়ে গেছে পরিবর্তনের ঝড়, বদলে গেছে ভ’খন্ডের অনেককিছু। সভ্যতাকে ধারণ করে প্রবাহ ÿীণ হয়ে এসেছে টাইগ্রীস, জ্যাব এবং সিরওয়ানের। এখানকার নাগরিকদেরকে যেমনভাবে দোলা দিয়েছে ইতিহাসের সোনালি অধ্যায়, তেমনি কষাঘাতে পিষ্ট করেছে অন্ধকারের কালো। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির চক্রে কিরকুকের বাসিন্দারা বর্তমানে সোনালী কোন অধ্যায়ের স্বাÿী নয়, বরং পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে তারা ডুবে আছে কালো এক গহŸরে। এখানে গণতন্ত্র বিতরণ করার ছুঁতো ধরে দূর ভ’খন্ড থেকে উরে এসে স্বাধীনতা কেড়ে নেয় দখলদারিরা। কেবল তাই নয় প্রাচীন এ নগরীর সন্তানদের মাঝে জ্বেলে দেয় অভ্যন্তরিণ বিভেদের আগুন। সে আগুনে এখন প্রতিদিন জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে কিরকুক। এখানে শিশুদের ঘুম ভাঙ্গে গগণবিদারী বোমার শব্দে। বাতাসে ভাসে বারুদের গন্ধ। বিধ্বংসী তান্ডবে অতৃপ্তির বেদনা নিয়ে মাটিতে মিশে যেতে হচ্ছে হাজার হাজার বছরের পুরনো নিদর্শনগুলোকে।
পৃথিবীর প্রাচীন এ নগরবসতির প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে সভ্যতার অতিত। প্রাচীন বাসিন্দাদের আবেগ আর অনুভ’তির নিঃশ্বাসগুলো এখনো ভেসে বেড়ায় কিরকুকের বাতাসে। প্রাচীন এ নগরীর সুখ-দুখ এবং সংস্কৃতির মাঝে ডুবে থাকার ফুসরত নেই এখানকার বাসিন্দাদের। জীবণের অনিশ্চয়তায় তাঁরা ব্য¯Í জীবণের সন্ধানে। এখন তাদের কাছে মূল্যহীন মানবসভ্যতার হাজারো নিদর্শন। একসময়কার শহর রÿাকারী প্রাচীন দূর্গটি এখন আর তাদের টানতে পারেনা। অথচ একে পরিদর্শন করতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে পর্যটক। বর্তমানে বিপজ্জনক কিরকুকের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত এ দূর্গটির আকর্ষণ পর্যটকদের টানলেও অবশ্য হ্রাস পেয়েছে তাদের আগমন। এটি নির্মিত হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব ৮৮৪ এবং ৮৮৪ সালে। সেনা প্রতিরÿার জন্য রাজা ২য় আসরনাসির পাল এটি নির্মাণ করেছিলেন ১৩০ ফুট উঁচু করে। কিরকুকের অভ্যন্তরে রয়েছে এতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা কিশলা। ৬ একর ভ’মিতে নির্মিত এ স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়েছিলো শীতের সময় সৈন্যদের অবস্থানের জন্য। এ শহরের আরেক অ™ভ’ত ও আকর্ষণীয় স্থাপনা কায়সারিয়া মার্কেট। আল কায়সারিয়াহ প্রতিরÿা দুর্গের কাছেই অবস্থিত। অটোমান শাসনের সময় নির্মাণ করা হয়েছিলো আশ্চর্য এ স্থাপনা। এখানে রয়েছে ঘন্টা, দিন, মাস এবং বছরের প্রতীক। পুরো মার্কেটটিতে ৩৬৫টি তলা রয়েছে, যা বছরের সবগুলো দিনের প্রতীক বহন করে। ২য় তলায় ১২টি ছোট কÿ রয়েছে যেগুলো বছরের বারমাসের প্রতীক। মার্কেটে ২৪টি গলিপথ রয়েছে যেগুলো দিনের চব্বিশঘন্টার প্রতীক। আর সপ্তাহের ৭ দিনের প্রতীক বহন করছে এর সাতটি দরজা।
ঐতিহাসিক অসংখ্য স্থাপনা বুকে ধারণ করা এ নগরীটি মূলত প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো মেসোপটেমিযার উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারি উপজাতি হুরিয়ানদের সময়কালে। ককেশাস নৃগোষ্ঠীর হুরিয়ানদের রাজত্বকালে ভ’খন্ডটি পরিচিত ছিলো আরাপফা নামে। শব্দটির অর্থ হলো শহর। আসেরিয়দের পতনের পর কিরকুক পরিচিত ছিলো কুরকুরা নামে। গ্রীকদের অধীনে থাকার সময় এটি কারখা ডি-বেট ¯øখ নামে পরিচয় লাভ করেছিলো। ৭ম শতাব্দীতে এ এলাকা মুসলমানরা অধিকার করে। তখন আরব লেখকেরা একে কিরখেনি বলে উলেøখ করতো। কিরখেনি শব্দের অর্থ হলো নগররÿাকারী দূর্গ।
প্রাচীন আসেরিয়ান শহর অরপফা থেকে কিরকুকের সৃস্টি। কিরকুকের আদি অবস্থা অরফকা আসেরিয়ান শাসকরেদর অধীনে থাকলেও, এর রাজধানী ছিলো মিত্বানিয়ানদের অধীনে। ১৫০০ থেকে ১৩৬০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত আসেরীয় সকল শাসকরাই মিত্বানীয়দের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে। কিন্তু আবার খ্রিস্টপূর্ব ১৪ শতকে মিত্বানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে দেয় আসেরিয়রা। এতেই পতন ঘটে তাদের। কিরকুকে সভ্যতার এক বিপ্লব ঘটে যায় মূলত তখনই। খ্রিস্টপূর্ব ১০ম এবং ১১তম শতাব্দীতে আসিয়ান শাসনের অধীনে বিভিন্ন নাগরিক সুযোগ সুবিধার সমন্বয়ে সতেজ হয়ে উঠতে থাকে কিরকুক। আবার খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ট শতকে আসেরিয়া মেডেস ইউনিয়নের দখলে চলে যায়। ৭ম শতকে এ শহরটি আসে মুসলমানদের দখলে।
এ এলাকায় পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থান থেকে বসতির জন্য ছুটে আসে মানুষ। এদের মাঝে উলেøখযোগ্য অভিবাসন হয় আরব এবং তুরস্ক থেকে। মুসলমানদের শাসনের সময় আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন এখানে এসে বসবাস শুরু করে। ১৬ শতকের দিকে সাফাভিন শাসনের সময় তুর্কিদের আগমন ঘটে। শাহ প্রথম ইসমাইল শিয়া বিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সেখানে অবস্থানরত সুন্নীদের স্থানে প্রতিস্থাপন করতে থাকে শিয়াদেরকে। মূলত তখন থেকেই এ অঞ্চলে মুসলমানদের মাঝে গড়ে উঠে অভ্যন্তরিন বিভেদ। সময়ের বিবর্তনে জাতীয়তাবোধের উপর ভিত্তি করে মুসলমানরা ভাগ হয়ে যায় কুর্দী, তুর্কী, আরব প্রভৃতি দল ও উপদলে। তার পর থেকে এ বিভেদ কিরকুকসহ গোটা ইরাককে প্রতিনিয়ত পরিণত করে তুলছে অগ্নিগর্ভে। অটোমান বিশ্বকোষ প্রণেতা শামসুদ্দিন শামীর বর্ণনা অনুযায়ী ১৮৯৭ সালে কিরকুকের মোট বাসিন্দার তিন চতুর্থাংশ ছিলো কুর্দি, তুর্কী এবং আরব। ইহুদী ছিলো সাত হাজার ষাট জন এবং খ্রিস্টানের সংখ্যা ছিলো ৪৬০ জন। ১৯৫৭ সালের এক হিসাবে কিরকুকে বসবাসকারি কুর্দির সংখ্যা ছিল ১৭৮,০০০, তুর্কী ৪৮০০০, আরব ৪৩,০০ এবং খ্রিস্টানের বসবাস ১০,০০০। বর্তমানে পুরো শহরে ৮৫০৭৮৭ জনের বসতি।
কেবল ঐতিহাসিকভাবেই নয় কিরকুকের উপর নির্ভর করে ইরাকের অর্থনীতির বড় একটি অংশ। সমগ্র দেশের পেট্রোলিয়াম শিল্পের কেন্দ্র এই নগরী। এখানে রয়েছে ‘বাবা গুরগুর’ তেল ÿেত্র। দেশের সর্ববৃহৎ এ ÿেত্রটি আবিষ্কৃত হয় ১৯২৭ সালে। আর তেল উত্তোলন শুরু করে আরো সাত বছর পর ১৯৩৪ সাল থেকে। এক পেট্রোলিয়াম শিল্পের আশির্বাদেই সেখানকার বাসিন্দাদের জীবণ প্রকৃতি হওয়ার কথা মসৃণ ও স্বাচ্ছন্দময়। কিন্তু তা না হয়ে কাল হয়ে দাঁড়ালো এ শিল্পই। ইরাকের ভ’গর্ভ¯Í সম্পদ লুটেপুটে নেয়ার জন্য এখানে লুলুভ জিভ ডুবিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো। এতেই তারা শান্ত নয়, বরং নিষ্ঠুরভাবে মুছে দিতে চাচ্ছে এ নগরীর নিজস্বতাকে। নিজেদের মাঝে অসংখ্য বিভেদের দেয়ালের অ¯িÍত্ব থাকলেও সেখানকার একেশ্বরবাদি বাসিন্দারা অপেÿায় আছে পরিপূর্ণ এক স্বাধীনতার জন্য। সেইসাথে পৌত্তলিকতামুক্ত সন্তানদের অপেÿার প্রহর গুণে গুণে প্রতি রাতেই টাইগ্রীসের প্রবাহে অশ্রæ ঝরায় এ নগরী। এ কারণেই হয়তো একদিন কিরকুকে উদিত হতেও পারে স্বাভাবিক সূর্য।

কোন মন্তব্য নেই: