শনিবার, মে ২৮, ২০১১

ইশকুল পালিয়ে


‘আজকালকার কিশোরদের ওপর পড়া লেখার যে চাপ, তা অনেকটা রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করার মতো’
ওমা, এমন কথা আবার কে বললো?
নিশ্চয়ই মহা ফাঁকিবাজ ধরনের কেউ হবে। পড়ালেখার চাপ আর রিমান্ড কি এক জিনিস হলো?
পড়ালেখাতো তুমিও করছো। তুমি কি রিমান্ডে আছো বলে মনে হয়?
কই নাতো দিব্যি স্বাধীন-ই আছো। সকালে আম্মুর ডাকে বিছানা ছেড়ে উঠছো। তারপর তড়িঘড়ি করে প্রাত কাজ সারছো, নাস্তা করছো এবং আম্মু কিংবা আব্বুর সাথে ইশকুলে যাচ্ছো। কাস শেষে আবার ঠিক ঠিকই বাসায় ফিরে আসছো। তারপর কয়েকজন টিচার আসছেন তোমাকে পড়াতে। ব্যস, এভাবেইতো দিন কেটে যাচ্ছে। একে কি রিমান্ড বলা যায়?
কে সেই বোকা লোকটা, যে কিনা এমন কথা বললো?
উহু, সেই লোকটা কিন্তু মোটেও বোকা নন। তাঁর নাম রকিব হাসান।
তিন গোয়েন্দা সিরিজের লেখক?
হ্যা, রকিব হাসান বলতে তো তাকেই বোঝায়।
এই সেরেছে রে। তাহলেতো বিশ্বাস না করে উপায় নেই। তিনিতো আর মিথ্যে বলার লোক নন। তাছাড়া কিশোর পাশা, মুসা আমান আর রবিন মিলফোর্ডের মতো বিচ্ছুরা যার কলমের ইশারায় উঠবস করে, তাকে আর যাই হোক বোকা বলা যাবে না।
রকিব হাসানের কাছে তোমাদের এই অতিপড়াপড়ির রুটিনটা রীতিমত রিমান্ডের মতোই মনে হয়। এই যে আম্মুর ডাকে ঘুম থেকে উঠছো, ইশকুলে যাচ্ছো, টিউটরের কাছে পড়ছো এসবকেই তিনি রিমান্ড বলেছেন। অর্থাৎ তোমাদের জীবনে এখন পড়া লেখার রিমান্ড চলছে আরকি। এবার নিশ্চয়ই ভাবছো, রকিব হাসানের কাছে হয়তো ইশকুল মানেই ছিলো আতঙ্ক? মোটেই তা নয়। তার কাছে ইশকুল ছিলো স্বপ্ন, আনন্দ আর যত দূরন্তপনার স্বর্গরাজ্য। সেইসময়ের ইশকুলগুলো এখনকার মতো ছিলো না। তোমরাতো পড়াপড়ির চাপে না সময় পাও খেলতে যেতে, না পারো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতে। তখনকার ইশকুল যদি এমন হতো, তবে হয়তো কিশোর রকিব হাসানের পড়ালেখাই করা হতো না। তাইতো এই বয়সে এসে পড়ালেখার রিমান্ডবন্দি তোমাদের জন্য বড় মায়া হয় তার। তোমরা কি এখন ইচ্ছে করলেই বেরোতে পারবে ডোংরা গাছের পাতার ভেতর টুনটুনির বাসা খোঁজার অভিযানে? একদমই পারবে না। এবার হয়তো মানবে যে, তোমাদের এখনকার অতিপড়াপড়িকে রিমান্ডের সাথে তুলনা করে ভুল করেন নি রকিব হাসান। শুনলে লোভ হতে পারে- রকিব হাসানদের ইশকুলবেলাটা ছিলো স্বপ্নের মতো। তিনি কেবল টুনটুনির বাসা-ই খুঁজেছেন এমন নয়, রীতিমত গুলতি নিয়ে পাখি শিকারেও বেড়িয়েছেন। ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিয়েছেন ডুব সাাঁতার দিয়ে। তাই বলে আবার ভেবো না, রোজ রোজ ইশকুল পালিয়ে কেবল হইরই করে বেড়াতেন। ইশকুল পালানোর রেকর্ড বলতে গেলে তার একদমই নাই। গুটিকয়েক যাও আছে তাও পড়ালেখার ভয়ে নয়। ইশকুলের পড়া তার কাছে কোন ব্যপারই ছিলো না। কারণ বছরের শুরুতে নতুন বই পাওয়ার পর পরই প্রায় সব পড়া শেষ হয়ে যেতো। তাই পিটুনির ভয়ে ইশকুল পালানোর প্রশ্নই উঠে না। তবে হ্যা, ইশকুল থেকে জানালা দিয়ে পালিয়ে আসার একটি ঘটনা আছে বটে- একবার কাসে বসেই তিনি খবর পেলেন বিরাট বিরাট গামলা ভরে মিষ্টি আসছে ইশকুলে। কি যেন কি উপলক্ষ্যে তাদেরকে মিষ্টি খাওয়ানো হবে। খবর শুনেতো কাসে শুরু হয়ে গেলো প্রচন্ড হট্টগোল। টেবিল চাপড়ানো, জোরে-জোরে কথা বলা, চেঁচানো ইত্যাদি আরকি। কিছুক্ষন পর ঠিকই দেখা গেল দফতরি মিষ্টি নিয়ে চলে এসেছে। সবাইকে বলল, যার যার খাতা থেকে একটা করে পাতা ছিঁড়ে নিতে। ফড়াত ফড়াত পাতা ছিঁড়তে লাগলো সবাই। কিন্তু রকিব হাসানের আর তর সইছিলো না। কিসের আবার ছেঁড়াছেড়ি, হাতে নিয়েই খেয়ে ফেলা যায়। আম্মাতো আর কাসে নেই যে হাত ময়লা কি না দেখতে আসবে। শুরু হলো মিষ্টি বিতরণ। সাথে করে একটা পিরিচ আর ছুরি নিয়ে এসেছে দফতরি। পিরিেিচ একটি করে রসগোল্লা তুলে রাখে, ছুরি দিয়ে কেটে দুই ভাগ করে, তারপর অর্ধেকটা রসগোল্লা আলগোছে তুলে এনে ফেলে দেয় ছেলেদের বাড়িয়ে দেয়া কাগজে। এই অর্ধেকটা করে রসগোল্লা বিতরণ করছে দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো রকিব হাসানের। তাকে যখন দিতে এলো, সাফ মানা করে দিলেন, খাবেন না।
হয়তো ভাবছো মিষ্টি খাওয়া-খাওয়ির সাথে আবার ইশকুল পালানোর সম্পর্ক কী? হ্যা সম্পর্কতো একটা আছেই। তাহলে পরের ঘটনা শোন- মিষ্টি খাওয়ার হইচইতো শেষ হলো। কিছুক্ষন পর পাশের ঘরে আবার শুরু হলো হট্টগােল। কী ব্যাপার? একটি ছেলে বলল, ‘আবার মিষ্টি নাকি?’। হলেও হতে পারে। তখন কম হয়ে গিয়েছিলো বলে আবার এনেছে। পরক্ষনেই গলা ফাটিয়ে চেঁচানোর শব্দ পেলেন। ঘটনা কী? কিছুক্ষন পরই খবর এলো ইশকুলের সব ছাত্রদেরকে কলেরার ইনজেকশন দেয়া হবে। এই ছিল তবে মিষ্টি খাওয়ানোর পেছনের কারণ! যথারীতি ভারিক্কি চালে কাসরুমে ঢোকল মেডিকেল টিম। ঢোকেই দরজা বন্ধ করে দিলো। প্রথম বেঞ্চের প্রথম ছেলেটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো তারা। গাঁইগুঁই করতে লাগল ছেলেটি। কিন্তু এতে কোন কানই দিলোনা ওরা। চামড়ায় সুচ ঠেকতেই আঁউ করে উঠল ছেলেটা। তারপর ভ্য্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। সিরিয়ালে দুই নম্বর ছেলেটাকে ধরতে যেতেই সে ঢুকে গেল বেঞ্চের তলায়।
এসব দেখে কি আর স্থির থাকা যায়? তার বুকেও তখন কাঁপুনি ওঠেছে। স্যার তাদেরকে অভয় দেয়ার জন্য বার বার বলছিলেন ‘কিছু না, কিছু না, পিঁপড়ের কামড়। টেরই পাবে না।’ কথার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য নিজেই শার্টের হাতা গুটিয়ে এগিয়ে গেলেন ইনজেকশন নিতে। সুচ ফোটানোর সাথে সাথে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তাঁর চেহারা বিকৃত করে ফেলার ভঙ্গি দেখেই সবাই আন্দাজ করে ফেলেছিলো, পিঁপড়ের কামড়টা বড় শক্ত কামড়।
ভয়টা আরো বেড়ে গেল তার। হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন, তিনি যেখানে বসে আছেন এর পাশের জানালাতে শিক নেই। জানালাটা অনেক বড় হলেও বেশ উঁচুতে। ওটা ডিঙাতে হলে বেঞ্চের ওপর উঠতে হবে। স্যার দেখে ফেলতে পারেন। সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার যেটি তা হলো, ওখান থেকে নিচে লাফিযে নামা। জানালার ঠিক নিচে রয়েছে একটি চওড়া ড্রেন। আর কাঁটাঝোপে ভরা। তবুও সেটা ইনজেকশনের চেয়ে ভালো মনে হলো। হঠাৎ তিনি বেঞ্চের ওপর উঠে দাঁড়ালেন। একলাফে জানালায় উঠে যা থাকে কপালে ভেবে দিলেন লাফ। নর্দমা ডিঙিয়ে পড়লেন ওপাশে। কাঁটার আঁচড় লাগল দু-এক জায়গায়। তবুও দিলেন ঝেড়ে দৌড়। বইখাতা সব কাসেই ফেলে এসেছেন। জানেন, এগুলো হারাবে না। দফতরি হয়তো অফিসঘরে রেখে দেবে।
এই হলো রকিব হাসানের ইশকুল পালানোর গল্প। আর যেদিন তিনি স্থির করতেন ইশকুলে যাবেন না, ব্যাস জোর করেও কেউ তাকে পাঠাতে পারতো না। কারণ সবাই জানতো একগুঁয়ে এ ছেলের ওপর জোর খাটবে না। ইশকুলে না গিয়ে কি করতেন সে সময়টুকু? চলে যেতেন পুকুরে মাছ ধরতে কিংবা টই টই করে ঘুরে বেড়াতে।
এতক্ষনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছে, তিনি টই টই করে ঘুরে বেড়িয়েছেন, মাছ ধরেছেন, গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করেছেন সবই মানলাম। তবে গোয়েন্দাগিরি করেছেন কখন?
খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন। যেহেতু তিনি তিনগোয়েন্দা সিরিজের লেখক, সেহেতো তার কিশোরবেলাটা গোয়েন্দাদের পালের গোদা হিসাবে কেটেছে এমন ধারণা হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর নিশ্চয়ই বেশ কয়েকজন চৌকষ চেলাপেলা তাকে ছায়ার মতো অনুকরণ করতো। সবার কাজ ছিলো কোথায় কার মুরগি চুরি গেছে, কবে কার ছাগল হারিয়ে ফেলেছে ইত্যাদি নানান ঘটনার খোঁজখবর রাখা। আবার নিজেদের তাগিদেই রহস্য উদঘাটনে আদাজল খেয়ে লাগতো সবাই। রকিব হাসানের নামের সাথে এমন ধরনের কল্পনাইতো মানানসই, তাই না?
হ্যা, তাই। তিনিও গোয়েন্দা ছিলেন। তবে মনে মনে গোয়েন্দা আরকি। দস্যু বাহরাম, শার্লক হোমস এগুলো নিয়মিত পড়তেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অনেকটা নিঃসঙ্গ। তাই কিশোরগোয়েন্দা দল গঠন করাও তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অবশ্য এমন কোন ইচ্ছেও ছিলো না তার।
কি সাঙ্ঘাতিক কথারে বাবা, ছোটবেলায় গোয়েন্দাগিরি করার সামান্যতম অভিজ্ঞতা নেই, অথচ বড় হয়ে কিনা লিখে ফেললেন গাদাগাদা রোমাঞ্চকর গোয়েন্দা কাহিনী!
এতে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। সব শিক্ষার জন্য বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়না। বই পড়ে পড়ে পৃথিবী ঘুরে আসা যায়। কাজেই তিনিও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন বই পড়ে। তাকে বাস্তবে গোয়েন্দাগিরি করে গোয়েন্দাসিরিজ লিখতে হয়নি।
রকি বীচের লোহালক্করের জঞ্জালের ভেতর থাকে গোয়েন্দাপ্রধান কিশোর পাশা। বাংলাদেশী বংশো™ভ’ত। ুদ্র জিনিসও বুদ্ধিদীপ্ত এ ছেলেটির দৃষ্টি এড়ায় না। যে জিনিস একবার দেখে সেটা মনে থাকে দীর্ঘদিন। তার মুদ্রাদোষ হলো গভীর চিন্তামগ্ন থাকলে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা। গোয়েন্দা সিরিজের দ্বিতীয় চরিত্র মুসা আমান। তাকে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা, লনের ঘাস ছাটা এসব কাজ প্রায়ই করতে হয়। শত্রুর পেটে আঘাত করতে তার জুড়ি নেই। তার মুদ্রাদোষ হলো কথায় কথায় ‘খাইছে’ কিংবা ‘ইয়াল্লা’ বলা। ভ’তে তার যত ভয়। তবে বিপদের মুহূর্তে সবচেয়ে সাহসী হয়ে উঠে মুসা। আর তিন গোয়েন্দার নথি গবেষক হিসেবে পরিচিত রবিন মিলফোর্ড। আয়ারল্যান্ডের বংশোদ্ভোত। তার কাজ হচ্ছে তিন গোয়েন্দার সকল কেসের রেকর্ড ব্যখ্যা বা নথি সংরক্ষণ করা। সে তিন গোয়েন্দার সবার মধ্যে সবচেয়ে কেতাদুরস্ত।
এ তিনটি চরিত্রের রোমাঞ্চকর গোয়েন্দাগিরিই তার লেখার উপজীব্য। এ তিনটি চরিত্রকে অনুসরণ করে তোমাদের মতো অনেকেই গোয়েন্দা দল গঠন করে ফেলেছে। কেউ হাতে অস্ত্র নিয়ে গোপন আস্তানাও গড়েছে। দূর্ঘটনার রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব নেয়ার জন্য এলাকার মুরব্বিদের ফুসলিয়েছে এমন কিশোরেরও অভাব নেই। কেউ কেউ আবার শখের গোয়েন্দা হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করতো। আবার অনেকেই প্রচন্ড আবেগ নিয়ে রহস্যের জট খোলার নতুন কৌশল শেখার আশায় দেখা করেছে স্বয়ং রকিব হাসানের সাথেও। তারপর তিনি ওদেরকে কি উপদেশ দিয়েছেন জানো?
তিনি বলেছেন ‘কল্পনাকে সবসময় বাস্তবের সাথে মেলাতে নেই।’

কোন মন্তব্য নেই: