শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ:
দশ বছরের এক কিশোর। অন্যদের মত সাধারণ নয়, ঝাঁকড়া সোনালী চুলের এ কিশোর প্রতাপশালী এক রাজ্যের রাজপুত্র। রাজ্যে একটি ঘোড়া ছিল অদ্ভূত বৈশিষ্টের। এর মাথার আকৃতি ষাঁড়ের মত দেখতে। সুগঠিত পেশীর এই ঘোড়ার গায়ে প্রচন্ড শক্তি, প্রসস্ত দেহ, চওড়া পিঠ। তেজে টগবগ করত সারাক্ষণ। কেউ বাগে আনতে পারেনি একে। তাই রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন ঘোড়াটি বিক্রি করে দেবেন। একথা কানে যেতেই কিশোর রাজপুত্রের মন বিষন্ন হয়ে গেল। কারণ এ ঘোড়টির মধ্যে সে তার নিজের ছায়া দেখতো। কেন জানি কিশোর যুবরাজের ইচ্ছা হতো এর পিঠে সওয়ার হয়ে তীর বেগে ছুটে যাওয়ার। ইচ্ছা হত দিগন্ত ভেদ করে সকালের উদিয়মান সূর্যের লাল টকটকে গোলকের ভেতর মিলিয়ে যেতে। ঘোড়াটা বিক্রির ব্যাপারে সবকিছু যখন চূড়ান্ত, কিশোর রাজপুত্র আর তর সইতে পারলোনা। একলাফে অভিজ্ঞ সওয়ারীর মত চড়ে বসল এর পিঠে। সাথে সাথেই চিহি ডাক তুলে তাকে পিঠে নিয়ে ছুটলো উল্কার মত। অ™ভ‚ত তেজী এ ঘোড়ার পিঠে সেঁটে বসা ছোট্ট এ কিশোরকে মনে হয়েছিল একটি ধনুক। ঘটনা দেখেতো সবাই তাজ্জব। বাবা বুকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেলেন। উৎফুলø হয়ে সেদিন তিনি বলেছিলেন “আমার সন্তান, তুমি এ রাজ্যের বাইরেও সীমান্তকে সম্প্রসারণ কর। কেবল ম্যাকডোন তোমার জন্য যথেস্ট নয়।”
সত্যিই হল সেকথা। এই কিশোরই পরবর্তীতে দিগি¦জয়ী হয়েছিল, শাসন করেছিলো অর্ধেক পৃথিবী। ইতিহাস খ্যাত বীর আলেকজান্ডারই হলো সেই কিশোর এবং ম্যাকডোনের শাসক ফিলিপ-২ ছিলেন তার বাবা। মায়ের নাম অলিম্পিয়া।
ভালবাসার সেই ঘোড়াটি সবসময় তার কাছে প্রিয়-ই ছিলো। এর নাম ছিলো বুচিফালুস। যার অর্থ হল ষাঁড়ের মত মাথা। সকল অভিযানে ভালবাসার বুচিফালূসের পিঠে চড়ে ছুটতেন তিনি। আলেকজান্ডার এটিকে এমন ভালবাসতেন যে, ঘোড়াটি মারা যাবার পর এর নামে একটি শহরের নামকরণ করেছিলেন। যা বুচিফালুস বা বুচিফালা নামে পরিচিত। অনেকে মনে করেন বুচিফালুসের মৃত্যু হয়েছে ভারতের যুদ্ধে। আবার অনেকের ধারণা স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধ হয়ে ঘোড়াটি মারা যায়।
বাবা ফিলিপ এবং মা অলিম্পিয়া
আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট। যার জন্ম নিয়েই রয়েছে নানা কিংবদন্তী। বাবা ফিলিপ এবং মা অলিম্পিয়া আলেকজান্ডারের জন্মের পূর্বে অদ্ভূত ধরনের স্বপ্ন দেখতেন। ফিলিপ দেখেছিলেন, তিনি অলিম্পিয়ার গর্ভে সিংহের মোহর প্রতিস্থাপন করে দিয়েছেন। এ স্বপ্নটি নিয়ে রাজ্যের গণকদের সাথে কথা বললে তারা ভবিষ্যদ্বানী করেন, শীঘ্রই অলিম্পিয়ার গর্ভে একটি ছেলে সন্তান আসছে। এ সন্তানটি হবে সিংহের মত।
কিংবদন্তীর আলেকজান্ডার ৩৫৬ খ্রিস্টপূর্বে জন্মগ্রহণ করেন ম্যাকডোনের রাজধানী পেলাতে। তিনি ছিলেন ইতিহাসের অন্যতম সফল সেনানায়ক এবং সুকৌশলী যুদ্ধা। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছিলো তাঁর সাহস আর প্রতাপের কথা। বাবা ফিলিপ-২ এর মৃত্যুর পর পারস্য, এনাটোলিয়া, সিরিয়া, ফইনিসিয়া, জুদিয়া, গাজা, মিশর, ব্যক্ট্রিয়া, মেসোপটেমিয়া এবং ভারতের পাঞ্জাব পর্যন্ত তাঁর শাসন বিস্তৃত হয়।
ছোটবেলার শিক্ষক এরিস্টটলের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বুদ্ধিবৃত্তির এতটা প্রসার ঘটেছিল যে, তিনি সব কিছু পরিকল্পনা মাফিক করতেন। আলেকজান্ডারের বয়স যখন ১৩, তখন থেকে তিনি এরিস্টটলের ছাত্র হয়ে যান। নিয়মিত এরিস্টটলের কাছে তাত্তি¡ক ও ব্যবহারিক শিক্ষা নিতেন। এরিস্টটল তাকে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র, মানুষের আচরণবিধি, পশু পাখি জীব জন্তু ও শস্যসহ অনেক বিষয়ই ছিল তার শিক্ষনিয় বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। এরিস্টটলের কাছে এসব শিক্ষা পুঁথিবদ্ধ ছিলনা। আলেকজান্ডারের শরীর গঠনের জন্য নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন করার অভ্যাসও তৈরি হয় এরিস্টটলের মাধ্যমে।
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম দিক থেকেই আলেকজান্ডারের পরিকল্পনা ছিলো আরব উপদ্বীপে তাঁর সৈন্যবাহিণী এবং অর্থনৈতিক ব্যাপকতা প্রসারিত করবেন। পূর্ব-পশ্চিম সকল দিকের শাসক হবেন তিনি। সে কারণে প্রয়োজন একটি চৌকস সেনাবাহিনীর। সে লক্ষে কাজও করেছেন তিনি, বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন ভ‚মি ও আবহাওয়ায় সৈন্যদেরকে খাপ খাওয়ানোর জন্য ব্যাপকহারে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকদের অন্তর্ভুক্ত করে তিনি তার সেনাবাহিনী গঠন করেন। এসব কৌশল এবং পন্থা অবলম্বন করা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে কেবল এরিস্টটলের ছাত্র হওয়ার সুবাদে।
আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট সম্বন্ধে রয়েছে অনেক আলোচনা, পর্যালোচনা, সুনাম, দুর্নাম। প্রচলিত রয়েছে অনেক কাহিনী। উদার, হিংস্র কিংবা কৌশলী বিভিন্ন আখ্যায় আখ্যায়িত করা হয় তাকে। তার সম্বন্ধে ভাষ্য রয়েছে বাইবেলসহ নানা ধর্মগ্রন্থে, কালজয়ী বিভিন্ন সাহিত্যে। মুসলমান পন্ডিতদের কেউ কেউ মনে করছেন পবিত্র কোরআনে বর্ণিত জুলকারণাইন-ই হলো আলেকজান্ডার। আসলেই কি তাই!
ম্যাকডোনের সিংহাসনে আলেকজান্ডার
৩৩৯ খ্রিস্টপূর্বে আলেকজান্ডারের বাবা যখন ৫ম স্ত্রী কিউপেট্রা ইউরিডাইসকে বিয়ে করে আনেন তখন থেকে শুরু হয়ে যায় পারিবারিক দ্বন্দ। এর পেছনের কারণ হলো জাতিয়তাবাদী চেতনা। আলেকজান্ডারের মা অলিম্পিয়া ছিলেন এপিরাসের অধিবাসিনী। অপরদিকে ৫ম স্ত্রী কিওপেট্টা ছিলেন নিখাঁদ ম্যাকডোনের কণ্যা। এ জাতিয়তাবাদ নিয়েই শুরু হয়ে যায় রাজনৈতিক নানা চক্রান্ত। অলিম্পিয়া এবং কিউপেট্রার মাঝে চলতে থাকে ঠান্ডা লড়াই। কিউপেট্রা এবং তার পক্ষের লোকজন আলেকজান্ডারের উত্থানকে সহ্য করতে পারতনা। এপিরাসের কণ্যার গর্ভের সন্তান কখনো ম্যাকডোনের রাজার উত্তরাধিকারী হতে পারেনা। ম্যাকডোনের সিংহাসনে চাই নিখাঁদ ম্যাকডোনের সন্তান। এ যুক্তির পক্ষে সিংহাসনের উত্থরাধিকারী নিয়ে অলিম্পিয়াকে কোণঠাসা করার চেস্টা চলত। সম্ভবত এসব কারণেই পরবর্তীতে আলেকজান্ডারের ক্ষোভ জন্মেছিল এবং তার শাসনামলে তার বাহিনীতে বিভিন্ন অঞ্চলের সেনা অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল।
৪র্থ এবং ৫ম স্ত্রীর মাঝে ঠান্ডা লড়াই ফিলিপ পর্যন্ত গড়ায়, এ বিষয়টি নিয়ে আলেকজান্ডার ও ফিলিপের মাঝে বাক-বিতন্ডাও হয়। আলেকজান্ডারের একটি বেপরোয়া চিৎকারের জবাবে বাবা তাকে লক্ষ্য করে তলোয়ার ছুঁড়ে মেরেছিলেন। এর জের ধরেই মাকে নিয়ে আলেকজান্ডার ম্যাকডোন ত্যাগ করে এপিরাসে চলে যান। কিন্তু তার বোন থেকে যায় ম্যাকডোনেই। সেই বোনের নামও ছিলো কিওপেট্রা।
এর কিছুদিন পর ফিলিপ এবং আলেকজান্ডারের মাঝে আবার সমঝোতা হয় এবং সে আবার ম্যাকডোনে ফিরে আসে। কিন্তু মা থেকে যান এপিরাসে। ৩৩৮ খ্রিস্টপূর্বে বাবার অধীনে আলেকজান্ডার চীরুলিয়া যুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করেন। এতে ফিলিপ তাকে সেনাবাহিনীর একটি অংশের অধিনায়ক করে দেন এবং তার বীরত্বের জন্য উৎসবের আয়োজন করেন।
৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বে ফিলিপ তার মেয়ে ক্লিওপেট্রার বিয়ের অনুষ্ঠানে ঘাতকদের আক্রমণে মারা যান। কেউ কেউ মনে করেন বিয়ে সংক্রান্ত জটিলতা নিয়েই তাকে হত্যা করা হয়েছে। হয়তো মেয়ের সাবেক প্রেমিক কিংবা মেয়ের স্বামীর সাবেক প্রেমিকা ছিলো ঘাতক। আবার আরেকটি ধারণা রয়েছে যে, ফিলিপকে হত্যা করার পেছনে আলেকজান্ডার এবং অলিম্পিয়ার হাত রয়েছে। অবশ্য এ ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায় অনেক অনেক বছর পর ইতিহাসের গতি কারো কারো পছন্দমত বাঁক খায়নি এর কি নিশ্চয়তা? বরং ইতিহাসের অনেক ঘটনা বর্তমান বর্ণনায় উল্টো হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।
ফিলিপ-২ এর মৃত্যুর পর সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সুকৌশলী সেনানায়ক আলেকজান্ডার মাত্র ২০ বছর বয়সে আরোহণ করেন ম্যাকডোনের সিংহাসনে। সেনাবাহিনী মেনে নেয় তার আনুগত্য।
সেনাপতি হেফিশন
ব্যক্তিগত জীবন
আলেকজান্ডারের জীবনের দীর্ঘ সময়ের সাথী ছিলেন তার সেনাপতি হেফিশন। তাছারা হেফিশন ছিল তার একজন বড় বন্ধু। তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত হেফিশন-ই ছিল বাহিনীর ২য় ব্যক্তি।
আলেকজান্ডার বিয়ে করেন ২টি। প্রথম স্ত্রী ব্যক্ট্রিয়ার আদর্শ কণ্যা রুক্সানা। অপরজন পারস্যের রাজা দারিউস-৩ এবং তার স্ত্রী স্ট্যটেইরা-১ এর কণ্যা স্ট্যটেইরা-২। রুক্সানার জন্ম ৩৪১ খ্রিস্টপূর্বে। ব্যক্ট্রিয়ায় রুক্সানার জন্ম স্থান সম্বন্ধে অনেকের ধারণা তা বর্তমান আফগানিস্তান। আলেকজান্ডারের সাথে রুক্সানার বিয়ে হয় ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বে। অপর স্ত্রী স্ট্যটেইরার সাথে বিয়ে হয় ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বে। পারস্যের রাজা দারিউস-৩ আলেকজান্ডারের সাথে যুদ্ধে হেরে গিয়ে স্ত্রী, দুই কন্যা এবং মাকে রেখে পালিয়ে যান। এর কিছুদিন পর আলেকজান্ডার এবং তার সেনাপতি হেফিশন এক জাকজমক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দারিউসের দুই কন্যাকে বিয়ে করেন। আলেকজান্ডারের সাথে বিয়ে হয় স্ট্যটেইরা-২ এর এবং তার বোন ড্রিপটেইসকে বিয়ে করে হেফিশন।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর পরিবারে রাজ্যের হাল ধরার মত কেউ ছিলেননা। তার ভাই ফিলিপ এরিডাস তখন ছিল মানসিকভাবে অসুস্থ। অপরদিকে ছেলে আলেকজান্ডার-৪ এর জন্মই হয় তার মৃত্যুর পর। তাই বিশাল এ সাম্রাজ্যকে এক করে রাখা সম্ভব হয়নি। সেনাপতিদের মাঝে ভাগ হয়ে চারটি সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।
মৃত্যু ও কফিন
আলেকজান্ডারের মৃত্যু নিয়ে কয়েকটি ধারণা রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, তাকে বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলা হয়েছে। কারো মতে পূর্বের ম্যালেরিয়া রোগ আবার তাকে আক্রমণ করেছিল। আবার কেউ মনে করছেন কেবল মাত্র অতিরিক্ত মদ্যপান-ই তার মৃত্যুর কারন। ৩২৩ খ্রীস্টপূর্বের ২৯মে আলেকজান্ডার তার বন্ধুদের সাথে একটি অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত মদ্যপান করেন। তখন থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে যান। বিছানায় পতিত তরুণ শাসক তখন কথাও বলতে পারেননি। নির্দেশনা দিতে পারেননি জেনারেল ও সৈন্যদেরকে। এমনকি হাত উঁচু করাও তার পক্ষে সম্ভব ছিলনা। এভাবে কয়েকদিন মাত্র। ৩২৩ খ্রীস্টপূর্বের ১০ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন ব্যবিলনের নেবুচাড্্েরজার-২ এর প্রাসাদে। তার জীবনকাল ছিল ৩৩ বছরের চেয়ে ১ মাস কম।
বর্তমানে আলেকজান্ডারের কফিন সংরক্ষিত রয়েছে তুরস্কের ইস্তাম্বুল জাদুঘরে। এটি ১৮৮৭ সালে লেবাননের সিডন এর কাছাকাছি কোন একটি স্থান থেকে পাওয়া যায়। আলেকজান্ডারের দেহের ধারক মানুষের আকৃতির এ কফিনটি স্বর্ণের তৈরি। এটি বর্তমানে একটি প্রতীকি ঢিলা কাপড় দিয়ে ঢাকা রয়েছে। কফিনের পাশেই রয়েছে তার ব্যবহৃত অস্ত্রসস্ত্র।
আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি সম্পদ ও ক্ষমতার লোভে অভিযান চালাতেন। ÿমতার দম্ভ ও সম্পদের জন্য তিনি ছিলেন বেপরোয়া। কিন্তু এ কথাও প্রচলিত রয়েছে যে, সহযোগিদের প্রতি আলেকজান্ডারের শেষ অনুরোধ ছিল মৃত্যুর পর তার হাত দুটো যেন কফিনের বাইরে প্রসারিত করে রাখার হয়। যেন সবাই দেখতে পায় বিশ্ববিজয়ী বীর আলেকজান্ডার পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে শূন্য হাতে। বিশাল সাম্রাজ্যের কিছুই তিনি সাথে করে নিয়ে যেতে পারেননি।
বাইবেল এবং আলেকজান্ডার
বাইবেলে আলেকজান্ডারের প্রতীকি বর্ননা রয়েছে। এখানে আলেককজান্ডারের প্রতীক হিসেবে দুইটি শিং এর উলেøখ রয়েছে।
দানিয়েল ৮ঃ৫-৮ পদে রয়েছে “ ... পশ্চিমদিক হইতে এক ছাগ সম¯Í পৃথিবী পার হইয়া আসিল, ভ‚মি স্পর্শ করিল না, আর সেই ছাগের দুই চুর মধ্যস্থানে বিলÿণ একটা শৃঙ্গ ছিল। পরে দুই শৃঙ্গবিশিষ্ট যে মেষকে আমি দেখিয়াছিলাম, নদীর সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে, তাহার কাছে আসিয়া সে আপন বলের ব্যগ্রতায় তাহার দিকে দৌড়িয়া গলে। আর আমি দেখিলাম, সে মেষের কাছে আসিল, এবং তাহার উপরে ক্রোধ উত্তেজিত হইল, মেষকে আঘাত করিল, ও তাহার দুই শৃঙ্গ ভাঙ্গিয়া ফেলিল, তাহার সম্মুখে দাঁড়াইবার শক্তি ঐ মেষের আর রহিল না, আর সে তাহাকে ভ‚মিতে ফেলিয়া পদতলে দলিতে লাগিল, তাহার হ¯Í হইতে ঐ মেষটীকে উদ্ধার করে, এমন কেহ ছিল না। পরে ঐ ছাগ অতিশয় আত্মগরিমা করিল, কিন্তু বলবান হইলে পর সেই বৃহৎ শৃঙ্গ ভগ্ন হইল, এবং তাহার স্থানে আকাশের চারি বায়ুর দিকে চারিটী বিলÿণ শৃঙ্গ উৎপন্ন হইল। ..”
পরবর্তীতে ২১-২২ পদে বিষয়টি স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে “ ... তুমি দুই শৃঙ্গবিশিষ্ট যে মেষ দেখিলে, সে মাদীয় ও পারসীক রাজা। আর সেই লোমশ ছাগ যবন দেশের রাজা, এবং তাহার দুই চুর মধ্যস্থানে যে বৃহৎ শৃঙ্গ সে প্রথম রাজা। আর তাহার ভগ্ন হওয়া, ও তৎপরিবর্ত্তে আর চারি শৃঙ্গ উৎপন্ন হওয়া, ইহার মর্ম্ম এই, সেই জাতি হইতে চারি রাজ্য উৎপন্ন হইবে, কিন্তু উহার ন্যায় পরাক্রম-বিশিষ্ট হইবে না। ...”
পশ্চিম দিক থেকে আগত এই ছাগ বা ছাগলটি ছিল গ্রীক সাম্রাজ্যের প্রতীক এবং বড় বড় শিংগুলো ছিল আলেকজান্ডারের প্রতীক, যিনি তার ÿমতার সর্বোচ্চ শিখরে থাকার সময় অকালে মারা যান। পরবর্তীকালে এ সাম্রাজ্য তার চারজন সেনাপতির মাঝে ভাগ হয়ে যায়।
কাসপিয়ান গেট
পবিত্র কোরআন এবং আলেকজান্ডার
পবিত্র কোরআনে ‘আলেকজান্ডার’ নামে সরাসরি কোন ভাষ্য নেই। তবে কোন কোন মুসলিম পন্ডিতগণ মনে করেন সূরা কাহাফ্-এ বর্ণিত জুলকারণাইনই হলেন আলেকজান্ডার। আরব উপদ্বীপে জুলকারণাইন নামটি পরিচিত ছিল অল্প বয়সে অধিক ক্ষমতাধর শাসক হিসেবে। জুলকারণাইন শব্দটির অর্থ হল দুই শিং বিশিস্ট। এ নামকরনের কারণ সম্পর্কে বহু কথা রয়েছে। কেউ বলেন: তাঁর মাথার চুলে দু’টি গুচ্ছ ছিল, যেগুলো দেখতে শিংএর মত। বেউ বলেন: পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যদেশগুলো জয় করার কারণে জুলকারণাইন খেতাবে ভ‚ষিত হয়েছিলেন তিনি। কেউ এমনও বলেছেন যে, তাঁর মাথায় শিং এর মত দু’টি চিনহ ছিল। অনেকের ধারণা এগুলো ছিল ক্ষত চিনহ। কিন্তু কয়েকজন মুফাচ্ছির বলেছেন এটা নিশ্চিত যে, কোরআন স্বয়ং তাঁর নাম জুলকারণাইন রাখেনি; বরং ইহুদীরা এ নাম দিয়েছিল। ইসলামী পন্ডিতদের অনেকেই কোরআনে বর্ণিত জুলকারণাইনের বৈশিষ্টগুলোর সাথে আলেকজান্ডারের বৈশিষ্টের মিল খুঁজে পান। এর মাঝে উলেøখযোগ্য হলো আলেকজান্ডারও ‘দুই শিং বিশিস্ট’ হিসেবে খ্যাত এবং তিনি পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের দেশগুলো জয় করেছিলেন। তাছারা বাইবেলেও আলেকজান্ডারকে দুই শিংবিশিস্ট বলেই অভিহিত করা হয়েছে।
আলøাহতাআয়ালা বিভিন্ন সময় পৃথিবীর মানুষকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। এদের মাঝে মাত্র কয়েকজনের নাম কোরআনে উলেøখ রয়েছে। নবী হিসেবে জুলকারণাইন এর নাম উলেøখ নেই, আবার তিনি নবী ছিলেননা এমনটিও বলা হয়নি। তাই পন্ডিতদের কেউ কেউ বলছেন হয়তো জুলকারণাইন আলøাহ প্রেরিত নবীদের মাঝে একজন ছিলেন। হয়তো সে কারনেই নিপীড়িত মানুষ সাহায্য, সহযোগিতার জন্য তাঁর কাছে ছুটে আসত। অনুসরণ করতো তাঁর দিক নির্দেশনা। তিনি নবী ছিলেন কি ছিলেননা, সে বিতর্কে না গিয়ে জুলকারণাইন-ই হলেন আলেকজান্ডার পন্ডিতদের একাংশের এ ধারণা কিভাবে হলো, তা স্পস্ট হবে কোরআনের এ বর্ণনা থেকে
“ ওরা তোমাকে জুলকারনাইন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। বলো, ‘আমি তোমাদের কাছে তার কথা বয়ান করব।’ আমি তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম ও প্রত্যেক বিষয়ের উপায় ও পথনির্দেশ করেছিলাম। সে এক পথ অবলম্বন করল। চলতে চলতে সে যখন সূর্যের অ¯Íাচলে পৌঁছাল তখন সে সূর্যকে এক পঙ্কিল জলে অ¯Í যেতে দেখল এবং সে সেখানে এক স¤প্রদায়কে দেখতে পেল। আমি বললাম, ‘হে জুলকারণাইন! তুমি এদেরকে শাস্তি দিতে পার বা এদের সদয়ভাবে গ্রহণ করতে পার।’
সে বলল, ‘যে-কেউ সীমালঙ্ঘন করবে আমি তাকে শা¯িÍ দেব, তারপর তাকে প্রতিপালকের কাছে ফিরিয়ে আনা হবে ও তিনি তাকে কঠিন শা¯িÍ দেবেন। তবে যে বিশ্বাস করে সৎকর্ম করে তার জন্য প্রতিদান হিসেবে আছে কল্যাণ ও তার সাথে ব্যবহার করার সময় আমি সহজভাবে কথা বলব।’
আবার সে এক পথ ধরল। চলতে চলতে যখন অরুণাচলে পৌঁছল তখন সে দেখল তা (সূর্য) এমন এক স¤প্রদায়ের ওপর উঠছে যাদের জন্য সূর্যের তাপ থেকে আত্মরÿার জন্য আমি কোনো আড়াল সৃষ্টি করি নি। প্রকৃত ঘটনা এই, তার বিবরণ আমি ভালো ক’রে জানি।
আবার সে এক পথ ধরল। চলতে চলতে সে যখন পাহাড়ের প্রাচীরের মাঝখানে পৌঁছল তখন সেখানে সে এক স¤প্রদায়কে পেল যারা তার কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। ওরা বলল, ‘হে জুলকারণাইন! ইয়াজুজ ও মাজুজ পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করছে; আমরা কি তোমাকে কর এই শর্তে দেব যে তুমি আমাদের ও ওদের মধ্যে এক প্রাচীর গ’ড়ে দেবে?
সে বলল, ‘আমার প্রতিপালক আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তা-ই ভালো। সুতরাং তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য করো, আমি তোমাদের ও ওদের মাঝখানে এক মজবুত প্রাচীর গড়ে দেব। তোমরা আমার কাছে লোহার তাল নিয়ে আসো।’ তারপর মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা পূর্ণ হয়ে যখন লোহার ঢিপি দুটো পাহাড়ের সমান হল তখন বলল, ‘তোমরা হাপরে দম দিতে থাকো।’ যখন তা আগুনের মতো গরম হল তখন সে বলল, ‘তোমরা গলানো তামা নিয়ে আসো, আমি তা ওর ওপর ঢেলে দেব।’
এরপর ইয়াজুজ ও মাজুজ তা পার হতে পারল না বা ভেদ করতেও পারল না। সে (জুলকারণাইন বলল, ‘এ আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ। যখন আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রæতি পূর্ণ হবে তখন তিনি ওকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবেন, আর আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি সত্য।’
সেদিন আমি ওদেরকে দলেদলে তরঙ্গের আকারে ছেড়ে দেব, আর শিঙায় ফুঁ দেওয়া হবে। তারপর আমি ওদের সকলকেই একত্র করব। আর সেদিন আমি জাহান্নামকে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত করব অবিশ্বাসীদের কাছে, যাদের চু আমার নিদর্শনের প্রতি ছিল অন্ধ, আর যাদের শোনারও ক্ষমতা ছিল না।” (সূরা কাহাফ্ ৮৩-১০১)
জুলকারণাইন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়াতেন নির্যাতীত, বঞ্চিত, শাসকের হাতে শোসিত লোকদের মুক্তি দিতেন। আলেকজান্ডারের বেলায়ও ঘুরে বেড়ানোর এবং রাজ্য জয় করার ইতিহাস রয়েছে। কুরআনের বর্ননা অনুযায়ী অরুণাচলে, যেখান থেকে সূর্য উদিত হয় সেখানে ইয়াজুজ, মাজুজের হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য দেয়াল তুলে দিয়েছিলেন জুলকারণাইন। আর সে স্থানটি পাহাড়ের প্রাচীরের মাঝখানে। এই বর্ণনার সাথে মিলে যায় এমন একটি দেয়াল রয়েছে কাসপিয়ান সাগর উপক‚লে। ইতিহাসবিদদের দ্বারা স্বীকৃত যে এ দেয়াল তৈরি করেছিলেন আলেকজান্ডার। যা তৈরি করতে লোহা ও তামা ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে একটি তোরণ রয়েছে যেটি ‘কাসপিয়ান গেট’ বা আলেকজান্ডারের গেট নামে পরিচিত। দারিয়াল এবং ডারবেন্ট নামে দুটি শহরে এর ব্যপ্তি। দারিয়াল রাশিয়া এবং জর্জিয়ার সীমান্তে অবস্থিত। এটিকে বলা হয় কাজবেক পাহাড়ের পূর্ব প্রাম্ভ। ডারবেন্ট রাশিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত একটি শহর। কাসপিয়ান সাগরের দক্ষিণপূর্ব উপকূলে নির্মীত এ দেয়ালটি তোলা হয়েছে দুটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা যায়গ্রায়। এ পাহাড় দুটিকে বলা হয় পৃথিবীর ¯Íন। আলেকজান্ডার নির্মীত এ দেয়ালের উচ্চতা ২০ মিটার এবং এটি ৩ মিটার (১০ ফুট) পুরো। এ দেয়াল ভেদ করে শত্রæদের এগিয়ে আসা অসম্ভব। তাছারা কাসপিয়ান গেটে আলেকজান্ডার রেখেছিলেন নিñিদ্র পাহাড়া। যেন গ্রীকের শত্রæরা দেয়ালের এ পাশে কোনভাবেই আসতে না পারে। কুরআনে রয়েছে যে, ইয়াজুজ মাজুজের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য এ দেয়াল নির্মাণ করা হয়। ইয়াজুজ মাজুজ সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন এ নামে অত্যাচারী শাসক ছিলো। আবার কারো মতে প্রতিকী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে এ দুটি শব্দ। এ প্রতীক হতে পারে অত্যাচারী শাসক বা শাসকদের, যারা কাসপিয়ান সাগরের এ উপক‚র দিয়ে আক্রমণ ও লুণ্ঠন চালাত।
মুসলমান পন্ডিতদের পাশাপাশি পশ্চিমা অনেক পন্ডিতগণও আলেকজান্ডারকে জুলকারণাইন বলেই অভিহীত করেন। কারণ কুরআন এবং বাইবেলে বর্ণিত অনেককিছুর সাথেই সাদৃশ্য রয়েছে বর্তমানে প্রচলিত আলেকজান্ডারের ইতিহাসের। প্রশ্ন উঠতে পারে কুরআনে বর্ণিত জুলকারণাইন ছিলেন সু শাসক। কিন্তু সেই জুলকারণাইনকে কিভাবে আলেকজান্ডার ধরা হবে? কারণ আলেকজান্ডারের ব্যাপারে সুনামের চেয়ে দুর্নামের কথা-ই বেশি প্রচলিত রয়েছে। তাছারা আলেকজান্ডারের আস্তিকতার ব্যাপারে স্বীকৃতি থাকলেও অনেকে মনে করছেন তিনি ছিলেন অগ্নিপূজক। এর সঠিক জবাব হলো পবিত্র কোরআন ব্যতিত আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মগ্রন্থগুলো যদি সময়ের সাথে সাথে মানুষের খেয়াল খুশিমত পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে, তো একজন ব্যক্তি বা শাসকের চরিত্রও বিকৃত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক নয় তাদের দর্শন বিবর্তনের।
হাজার হাজার বছর পর বিতর্ক করে হয়তো দেখা যাবে আলেকজান্ডার আদৌ জুলকারণাইন ছিলেননা। আবার হয়তো আরো গভীর পর্যালোচনা করলে একথাটি দাঁড়িয়ে যাবে আলেকজান্ডার দ্যা গ্র্যাট ছিলেন জুলকারণাইন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন