শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ:
বন-বনানীতে ঘেরা ছোট্টশহর মারিসভিলে। বিশ্বের কয়জনই বা চিনতো একে? খোদ অস্ট্রেলিয়াবাসীর অনেকেই জানতোনা দক্ষিণাঞ্চলের ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যের এই শহরটিকে। পৃথিবীর অন্যান্য অনেক শহরের মতোই এখানকার বাতাসে ভেসে বেড়াতো জীবণের কলরোল। এর আগে নিভৃত এ জনপদের প্রাণের স্পন্দন কখনো আলোড়ন তুলেনি গোটা পৃথিবীর বাতাসে। কিন্তু হঠাৎ-ই এক ভয়ঙ্কর আগুনঝড় মারিসভিলেকে পরিচিত করে তুললো হতবিহহ্বল বিশ্ববাসীর কাছে। সেখানকার উত্তপ্ত বাতাস পৃথিবীর কানায় কানায় ছড়িয়ে দিলো শহরটির নাম। প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীবাসী পরিচিত হলো জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া এক অন্যরকম মারিসভিলে’র মতো আরো কয়েকটি এলাকার সাথে। মাত্র কদিন আগে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের মাধ্যমে মানুষকে নাড়া দিয়ে গেলো অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ ভিক্টোরিয়ায় সৃস্ট দাবানল। দীর্ঘস্থায়ী সে আগুনঝড় প্রাণের আর্তচিৎকারে ভারি করে তুলেছিলো ভিক্টোরিয়ার বাতাস। মুহুর্তের মাঝেই দাবানলের লেলিহান শিখা গোটা বিশ্ববাসীকে ভাসিয়ে দেয় চোখের জলে।
উষ্ণতা থেকে দাবানল
পৃথিবী সৃস্টির আদি উপকরণ কোনটি, আগুন, নাকি পানি? এ নিয়ে প্রাচীন দার্শনিকদের মাঝে ছিলো তুমুল বিতর্ক। দার্শনিক থেলিসের মতো কেউ কেউ বলেছিলেন যেহেতু পৃথিবীর তিনভাগ জল আর এক ভাগ স্থল, সেহেতু জলই হলো পৃথিবীর আদি উপাদান। আবার দার্শনিক এনাক্সিমেন্ডারের মতো কারো কারো ধারণা ছিলো যেহেতু আগুন বদলে দিতে পারে পৃথিবীর রূপ, সেহেতু আগুন থেকেই পৃথিবীর সৃস্টি। আগুনের কারণেই প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে পৃথিবী। প্রাচীন দার্শনিকদের এসব বিতর্কের সমাপ্তি না ঘটলেও আগুন যে একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক শক্তি তা অস্বীকার করার জো নেই। উষ্ণতা থেকেই আগুনের সৃস্টি। কি অদ্ভূত ব্যাপার! অদৃশ্য উষ্ণতাই হঠাৎ দৃশ্যমান হয়ে রূপ নেয় অগ্নিশিখায়! উষ্ণতা বাড়লো, তো শিখা লেলিহান হয়ে উঠলো। অপরদিকে উষ্ণতা কমতে থাকার সাথে সাথে গুটিয়ে যেতে থাকে শিখাগুলোও। ধিকিধিকি জলার পর দপ করে নেই হয়ে যায হঠাৎই। উষ্ণতার এই আকার-নিরাকারের জাদুকরী শক্তি আগুনকেতো প্রকৃতির শক্তিশালী উপাদান হিসাবে গণ্য করা হবেই। ছোট-বড় সকল পরিসরে পানি যেমন আশির্বাদ এবং অভিশাপ দুটোই, আগুনও ঠিক তেমনি।
আগুনের উৎপত্তি কিভাবে হয়? এর জন্য অবশ্যই প্রয়োজন দাহ্য পদার্থ, অক্সিজেন এবং অগ্নুতপাত হওয়ার মতো উষ্ণতা। দাহ্য পদার্থ এবং অক্সিজেনের উপস্থিতিতে যখন সেখানকার উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় তখনি জ্বলে উঠে আগুন। সেটা কখনো মানুষ ঘটায়, কখনোবা প্রকৃতির নিয়মেই ঘটে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে যে অপ্রতিরোধ্য আগুনের সৃস্টি হয় তাকেই বলে দাবানল। অবারিত দাহ্য পদার্থের ভান্ডার প্রাকৃতিক বনগুলোতেই সাধারণত দাবানলের সৃস্টি হয়। অপ্রত্যাশিতভাবে তৈরি হওয়া এ আগুন বনের গাছপালা, ঘাস এবং অসহায় জীবজন্তুকে পুড়িয়ে খাক করে দেয়।
যেসব বনাঞ্চলের আবহাওয়া সাধারণত গরম, শুকনো থাকে সেসব অঞ্চলেই দাবানল বেশি হয়ে থাকে। সেদিক থেকে অনাবৃস্টির অস্ট্রেলিয়ার কিছু কিছু এলাকা বছরের যেকোন সময়ই দাবানলের ঝুঁকিতে থাকে। ছোট পরিসরের আগুন অবশ্যই দাবানল নয়। কিন্তু ছোট পরিসর থেকেই অনেক সময় বড় পরিসরে গড়াতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় একই সময়ে একই বনের বিভিন্ন স্থান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে তা ছড়িয়ে এক হয়ে যায়। আর সে অবস্থাটাই হলো দাবানল।
দাবানলের উৎপত্তি নির্ভর করে জ্বালানির উপস্থিতি, আদ্রতা, বাতাসের গতি এবং বাতাসের কৌণিক গতির উপর। বনের যেসব অঞ্চলের উষ্ণতা আগুন জলে উঠার পর্যায়ে পৌঁছে সেসব অঞ্চলে একই সময়ে বা প্রায় কাছাকাছি সময়ে সৃস্টি হয় স্ফুলিঙ্গের। তারপর সময়ের ব্যবধানে সকল উৎসগুলো একাকার হয়ে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে লেলিহানগুলো। বিপুল পরিমাণ জ্বালানির উপস্থিতিতে শক্তিশালী আগুনের সৃস্টি হয়। ঘন ও বিন্য¯Í জ্বালানির উপস্থিতির চাইতে যথেস্ট জায়গা নিয়ে জ্বালানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলে সেখানে আগুন দ্রæত ছড়ায়। বনে সৃস্ট আগুন একটি উৎসের দাহ্য পদার্থগুলো যখন পুড়িয়ে শেষ করে, তখন শুকনো ডালপালা এবং পাতার মাধ্যমে তা ছড়াতে থাকে। লেলিহানগুলো দূরের দাহ্য পদার্থে ছড়িয়ে যেতে সক্ষম না হলেও তা নিভে যায়না। বরং সহজদাহ্য কিছু ঘাসের মাধ্যমে তা আরো দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এ কারণে দাবানলে জ্বলতে থাকা কোন বনের দিকে দূর থেকে লক্ষ্য করলে মনে হতে পারে আগুন বুঝি লাফিয়ে লাফিয়ে বিস্তার লাভ করছে।
অনেকদিন অনাবৃস্টির কারণে বনের গাছপালার আর্দ্রতা কমে গেলে শুষ্ক ও উত্তপ্ত বায়ু প্রবাহই সূত্রপাত ঘটায় দাবানলের। অবশ্য আগুনের এ চাদরের বিস্মৃতি নির্ভর করে বাতাসের আনুকুল্যতা কিংবা প্রতিক‚লতার উপর। অনুকুল বাতাস আগুনের শিখাকে লাফিয়ে লাফিয়ে নতুন জ্বালানি পুড়াতে সাহায্য করে। জ্বলতে সাহায্য করে অক্সিজেনের জোগান দিয়ে। একটি স্থানে আগুনের সূত্রপাত হলে তা থেকে অপরস্থানে সে আগুনকে বয়ে নেয়ার মূল দায়িত্ব পালন করে বাতাস। আর সেই সূত্রে আগুনকে সহজে বহন করে নিয়ে যায় সহজদাহ্য ঘাস। তবে আগুন ছড়ানোর চিরচারিত যে রীতি তা অনুযায়ী দাবানলের উৎস থেকে লেলিহানগুলো জিহ্বা বিস্তৃত করে দূরের জ্বালানির উৎসগুলোকে উত্তপ্ত করতে থাকে বিকিরণের মধ্য দিয়ে। আর যখন জ্বালানীগুলো দাহ্য হবার উপযুক্ত হয়, ততক্ষণে লেলিহানগুলোও সেখানে ছড়িয়ে যায় পূর্ণ উষ্ণতা নিয়ে। আগুনের স্বাভাবিক ধর্মের কারণেই দাবানলের বিস্তৃতি উপরের দিকেই বেশি ঘটে।
দাবানলসহ যে কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগই ইকোসিস্টেমের ক্ষতি করে। কোনো একটি নির্দিস্ট এলাকায় যত জীবিত বা মৃত বস্তু থাকে তারা সবাই ইকোসিস্টেমের উপাদান। দূর্যোগের কারণে প্রকৃতি তার স্বাভাবিকতা হারায়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, কোন কোন ক্ষেত্রে দূর্যোগও কাজ করে আশির্বাদ হিসাবে। দাবানল সেরকম একটি দূর্যোগ। বনে অনেক গাছ রয়েছে যেগুলোর বংশ বৃদ্ধিই হয়না দাবানল না হলে। দেবদারু তেমন একটি বৃক্ষ। দেবদারুর ফলের খোসা এতটাই শক্ত যে ভেতরে থাকা বীজের পক্ষে কোনো দিনই বাইরে আসা সম্ভব নয়। আগুনের তাপে এর শক্ত খোসা গলে গেলেই কেবল বীজের অঙ্কুর এবং বংশবিস্তার সম্ভব।
অস্ট্রেলিয়ার সেই আগুন ঝড়
প্রাকৃতিকভাবেই হোক বা মনুষ্য সৃস্টই হোক ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যের সেই আগুন ঝড়ের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার জন্য নেমে আসে এক অভিশাপ। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত স্থায়ী হওয়া এ আগুনঝড়ে সেখানকার উত্তপ্ত বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল প্রাণের আর্তচিৎকার। আবার একই সময়ে ভিন্ন চিত্র ছিল দেশটির কুই›সল্যান্ড এলাকায়। সেখানে ভারী মৌসুমি বৃষ্টিতে দেখা দিয়েছিল বন্যা। দুই অংশে দুই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেন নেমে এসেছিলো নরকের অভিশাপ।
তিনটি অঙ্গরাজ্যে ছড়িয়ে পড়া দাবানলে ৫০টিরও বেশি স্থানে একইসাথে চলতে থাকে অপ্রতিরোধ্য আগুনের ধ্বংসযজ্ঞ। প্রচন্ড বাতাসের উস্কানিতে ক্রমেই পরিধি বৃদ্ধি করতে থাকে দাবানলের লেলিহান জিভ। উত্তাপের ঢেউ পুড়াতে থাকে সংরক্ষিত বনভ‚মি, ন্যাশনাল পার্ক, খামার এলাকা এবং লোকালয়সহ ৪৫০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা। যার ফলশ্রুতিতে সেখানকার তাপপ্রবাহ ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছে গড়ে তোলে নতুন রেকর্ড। নিহত হয় ১৭৩ জন, আহত হয় ৬০০ জন, ছাই হয়ে যায় লোকালয়ের আশ্রয়। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ এ দাবানল ছড়িয়ে পড়ে তিনটি অঙ্গরাজ্যে। ধ্বংস হয়ে যায় কয়েকটি শহর ও ২,০২৯ টি বাড়িঘর। গৃহহারা হয় কয়েক হাজার মানুষ। সবচেয়ে বেশি তিগ্রস্ত হয় ভিক্টোরিয়া রাজ্য। নিহতদের সবাই সেখানকার বাসিন্দা। সেখানকার ৩০ হাজার হেক্টর বনাঞ্চল, কৃষিজমি ও বেশ কয়েকটি শহর থেকেই প্রথম উৎপত্তি হয় আগুনঝড়ের। আগুনের লেলিহান-শিখা ছিলো চারতলা ভবনেরও উঁচুতে। বিভীষিকাময় সে মুহুর্তে গোটা আকাশ ঢেকে যায় ছাইয়ে। হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নেয় কমিউনিটি হল, স্কুল ও অন্যান্য আশ্রয়কেন্দ্রে। কিন্তু দিকবিদিক ছুটে পালাতে ব্যস্ত বনের পশুপাখিরা পায়নি সে ধরনের কোন আশ্রয়ের খোঁজ। এদেরকে মুহুর্তেই ছাই হয়ে যেতে হয় আগুন ঝড়ের অভিশাপে। রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখা যায় হাজার হাজার ক্যাঙ্গারুর নিথর দেহ। ভয়াবহতম এ দাবানলে মারা যায় লাখ লাখ প্রাণী।
হাজার হাজার দমকল কর্মী, স্বেচ্ছাসেবক আপ্রাণ চেস্টা করে যায় দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। সহায়তার জন্য ছুটে আসে অস্ট্রেলিয়ান সেনাবাহিনী। কিন্তু প্রতিরোধ করা যায়নি প্রকৃতির ভয়ঙ্কর আক্রোশকে। অস্ট্রেলিয়ানরা এ দাবানলকে ‘স্থল সুনামি’ বলেও অভিহিত করছেন। দাবানল পরবর্তী পরিস্থিতিও দৃশ্যত এতটাই ভয়ঙ্কর ছিলো যে অ¯েট্রলিয়ার পুলিশ ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যের মারিসভিলে শহরটি বন্ধ করে দেয়। বেঁচে যাওয়া শহরবাসী তাদের বাড়িতে ফেরার জন্য শহরের চারদিকে ভিড় করলে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়। পুলিশের ভাষ্যমতে ধ্বংসস্ত‚পের সে বীভৎস পরিস্থিতি লোকজনকে আরো আতঙ্কিত করে দিতে পারে বলে শহর ছেড়ে যারা চলে গিয়েছিল তাদেরকে পরমুহুর্তেই ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
অপরদিকে একই সময়ে অস্ট্রেলিয়ার উপর নেমে আসে আরেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বণ্যা। বিজ্ঞানীরা বলেন, বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়ার কারণে এ দুর্যোগের সৃষ্টি হয়েছে। অ¯েট্রলিয়ার শীর্ষস্থানীয় জলবায়ু বিজ্ঞানী কেভিন হেনেসি বলেন, ১৯৫০ সালের পর থেকে অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বে তাপমাত্রা বাড়ার প্রবণতা যে অব্যাহত রয়েছে তা স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা বলতে পারি, ভিক্টোরিয়ায় যে দাবানলের ঘটনা ঘটেছে, এর পেছনে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। আর সেটি হয়েছে বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়ার কারণে।’ দেশের উত্তরে প্রবল বর্ষণজনিত সে বণ্যা এতটাই ভয়াবহ ছিলো যে, নদ-নদীগুলো প্লাবিত হয়ে কুমির ঢুকে পড়ে শহরে।
অস্ট্রেলিয়ায় সৃস্ট ভয়ঙ্কর এ দাবানল এবং বণ্যাকে প্রাকৃতিক দূর্যোগ হিসাবে দেখা হলেও এ নিয়ে সৃস্টি হয় কিছু বিতর্কেরও। উদ্দেশ্যম‚লকভাবে বনের শুকনো গাছপালায় আগুন লাগানো হয় বলেও সন্দেহ করে পুলিশ। ইসলামি জঙ্গিরা ‘জঙ্গল জিহাদ’ হিসেবে বনে আগুন লাগিয়েছে বলে কোনো কোনো মহল থেকে তোলা হয় অভিযোগ। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান পুলিশ তা একেবারেই নাকচ করে দেয়। আবার ১৩ ফেব্রুয়ারি আগুন লাগিয়ে দাবানল সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুলিশ এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে তাকে সন্দেহ করা হয় এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। শেষ পর্যন্ত দাবানল সৃস্টি করার পেছনে কাউকে দোষি সাব্যস্ত করা যায়নি। তবে একইসাথে আগুন-পানির এ তান্ডবকে অস্ট্রিলিয়ার জন্য অভিশাপ হিসাবে দেখছেন অনেকেই।
গ্রীসে সৃস্ট দাবানল
অস্ট্রেলিয়ায় সম্প্র্রতি যে দাবানল হয়ে গেলো, এর প্রায় দুই বছর আগে গ্রীসে সৃস্ট দাবানলটিও হতবাক করে দেয় বিশ্বকে। ২০০৭ সালে সৃস্ট এ দাবানলটি ছিলো মূলত চারটি পর্যায়ে। গ্রীসের বেশির ভাগ এলাকাতেই ছড়িয়ে পড়েছিলো ভয়ঙ্কর আগুনের লেলিহান। গ্রীসের পিলোপোনীস, আট্টিকা এবং ইভিয়া এলাকায় ২৮জুন থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলমান এ ভয়ঙ্কর দাবানলে মোট মৃতের সংখ্যা ৮৪ জন। এদের মাঝে জুনে ৯জন, জুলাই মাসে ৫ জন, আগস্টে ৬৭ জন এবং সেপ্টেম্বরে মারা যায় ৩জন। অপ্রতিরোধ্য আগুন ৬৭০ একর বা ২,৭১১ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিলো। সবচেয়ে বড় ক্ষয়ক্ষতি হয় আগস্টের শেষ সপ্তাহের দাবানলে। চারদিনব্যাপী স্থায়ী হওয়া এ দাবানল বিশাল আকারে এক সর্বগ্রাসী আগুনের চাদর হয়ে রাজধানী এথেন্সের উত্তরের ইভিয়া দ্বীপ থেকে শুরু করে দক্ষিণে পিলোপোনীস পর্যন্ত ঘিরে ফেলে। সেই সাথে শুষ্ক ও উত্তপ্ত বায়ু প্রবাহের কারণে বিভিন্ন স্থানে থেকে থেকে জ্বলতে থাকে আগুন।
গ্রীসে এ ভয়ঙ্কর দাবানল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিভিন্ন দেশ থেকে অগ্নি নির্বাপক বিমান এসে প্রচেষ্টা চালায়। প্রধানমন্ত্রী কস্টাস কারামানলিস দেশে জররী অবস্থার ঘোষণা দেন। সেনাবাহিনী যুদ্ধ-পদক্ষেপে কাজ করে। গ্রীক পুলিস এটি পরিকল্পি হতে পারে বলেও ধারণা করে। সেজন্য তারা ১২ ব্যক্তিকে গ্রেফতারও করে। ১ মিলিয়ন ইউরো পুরস্কার ঘোষণা করে দাবানল সৃষ্টিকারীর সন্ধান পাবার জন্য। অনেকেই অনুমান করেন এ-দাবানল একটি সংগঠিত কান্ড যার উদ্দেশ্য ছিলো গ্রীসের বন-সংরক্ষণ আইনে পরিবর্তন আনা।
আরো ভয়ঙ্কর খবর হলো, গ্রীসের ইতিহাস-খ্যাত অলিম্পিকের আদি স্টেডিয়ামে অবস্থিত যাদুঘরের আঙ্গিনাকে ঝলসে দেয় এর লেলিহান শিখা। বহু কসরত করে গ্রীসের মহত্তম এ প্রতœতাত্তি¡ক সংগ্রহ ও স্টেডিয়ামকে আগুনের হাত থেকে রক্ষা করা হয়।
বয়ে যাওয়া উত্তাপ
মানুষ আর গাছের জীবনপ্রণালী পরস্পর নির্ভরশীল। মানুষ অক্সিজেন নেয় গাছ থেকে আর গাছ নেই কার্বন ডাই অক্সাইড মানুষের কাছ থেকে। যা মানুষের জন্য বিষ, তাই আপন প্রয়োজনে নিজের মধ্যে টেনে নেয় গাছ। প্রকৃতির এই সুন্দর এবং গোছালো শৃঙ্খলার কারণেই টিকে আছে জীব ও জগতের ভারসাম্য। মানুষ যেমন জন্মায় এবং মৃত্যুবরণ করে। গাছেরও তেমন রয়েছে জন্ম এবং মৃত্যু। মানুষ, গাছ এবং সৃস্টির অন্যান্য অনুষঙ্গগুলোর মাঝে পরস্পর নিরবচ্ছিন্ন বন্ধনের মাধ্যমেই পর্যায়ক্রমে এগিয়ে চলেছে পৃথিবী। এগিয়ে চলার এ পথে প্রভাব ফেলছে কেবল সময়। সময়ই বদলে দিচ্ছে প্রকৃতির রূপ। দাবানল সময়েরই একটি অনুষঙ্গমাত্র। যেমনভাবে দাবানল মাইলকে মাইল বনভ‚মিকে পুরিয়ে খাক করে দিতে পারে, তেমনভাবে আবার প্রাকৃতিক নিয়মেই আবার জেগে উঠে সবুজ বন। পৃথিবীর গহীন বনভ‚মির এমন অনেক অঞ্চল রয়েছে যেগুলোতে মানুষের পায়ের স্পর্শ কখনো পরেনি। সেগুলোতেও সৃস্টির আদিকাল থেকেই বয়ে আসছে আগুনঝড়। এদের কোনটির উত্তাপ স্পর্শই করতে পারেনি সভ্য জগতকে, আবার কোনটির খবর বাতাসে ভেসে এসেছে মানুষের কানে। বিভিন্ন সময় পৃথিবীর বিভিন্ন বনভ‚মিতে বয়ে যাওয়া কিছু উত্তাপে উত্তপ্ত হয়েছে বিশ্ববাসী।
উত্তর আমেরিকা: উত্তর আমেরিকার আবহাওয়া দাবানলের ঝুঁকিপ্রবণ। সেখানকার সৃস্ট দাবানল সম্পর্কে খোঁজ নিতে গেলে ১৮২৫ সালে সৃস্ট মীরামিকি দাবানল থেকে শুরু করে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৫৮টি দাবানলের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যায়। উত্তর আমেরিকার আবহাওয়া অপেক্ষাকৃত শুষ্ক বলে এর বিভিন্ন এলাকায় ঘন ঘনই দাবানলের সৃস্টি হয়। ২০০৮ সালের ভেতরেই সেখানকার বনভ‚মিতে ঘটে যায় তিন তিনটি আগুন ঝড়ের ঘটনা। এগুলো হলো ট্রিগু দাবানল, ইভান্স রোড দাবানল এবং ক্যালিফোর্নিয়া দাবানল। এর আগের বছর ২০০৭ সালে উত্তর আমেরিকায় বয়ে যায় সাত সাতটি আগুন ঝড়।
অস্ট্রেলিয়া: ১৯৩৯ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় ১২টি আলোচিত দাবানলের সৃস্টি হয়। ১৯৩৯ সালের ১৩ জানুয়ারি ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যে ৪,৯৪২ একর এলাকাজুড়ে সৃস্ট দাবানলে প্রাণহানী ঘটে ৭৮ জনের। দিনটি শুক্রবার ছিলো বলে এটি বø্যাক ফ্রাইডে নামে পরিচিত। অবশ্যই একই কারণে ১৯৫৫ সালের দাবানলটি বø্যাক সানডে, ২০০১-২০০২ সালের দাবানল বø্যাক ক্রিস্টমাস এবং ২০০৫ সালে সৃস্ট দাবানল বø্যাক টুয়েসডে দাবানল হিসাবে পরিচিত।
১৯৬১ সালে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া, ১৯৬৭ সালে তাসমানিয়ায়া, ১৯৮০ এবং ১৯৮৩ সারে ভিক্টোরিয়া ও দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় সৃস্ট দাবানলও ছিলো অস্ট্রেলিয়ার জন্য অভিশাপ স্বরূপ। ১৯৯৪ সালে নিউ সাউথ ওয়ালেসে সৃস্ট আগুনে বিরান হয়ে হয়ে ৮,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা। অস্ট্রেলিয়ার জন্য আলোচিত ও ভয়ঙ্কর আরো দুটি দাবানল হলো ২০০৩ সালের ১৮ জানুয়ারিতে সৃস্ট ক্যানবেরা এবং ২০০৬ সালের মাউন্ট লুব্রা দাবানল।
ইউরোপ: ইউরোপের মাঝে দাবানল সবচেয়ে বেশি সৃস্টি হয়েছে গ্রীসেই। ১৯৯৫ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে গ্রীসের পেনটারী পাহাড়ি এলাকায় দাবানলের সৃস্টি হয়। যার স্থায়িত্ব ছিলো ৭ দিন। গ্রীসে ১৯৯৮, ২০০০ এবং ২০০৫ সালে সৃস্টি হয় আরো তিনটি দাবানলের।
১৯৭৫ সালে জার্মানীতে ৭৪.১৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে সৃস্ট আগুনে পাঁচজন অগ্নিনির্বঅপক কর্মী মারা যায়। ২০০ সালে ইতালী এবং ফ্যান্সের কিছু অংশের বনভ‚মিতে সৃস্টি হয়েছিলো আগুনের। ১৯৯২ সালের ২৬ আগস্ট পোল্যান্ডে এবং ২০০৩ সালের আগস্টে পর্তুগালের বনভ‚মিতে সৃস্টি হয় ভয়ঙ্কর আগুনঝড়ের। রাশিয়া এবং সুভিয়েত ইউনিয়নে ১৯২১ সাল এবং ১৯৩৫ সালের পর আর কোন উলেøখযোগ্য দাবানলের সৃস্টি হয়নি। ২০০৫ সালে স্পেনের ১৩২ বর্গ কিলোমিটার বনভ‚মিতে সৃস্ট দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে ১১ জন অগ্নিনির্বঅপক কর্মী প্রাণ হারায়।
দক্ষিণ আমেরিকা: দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়াতে ২০০২ সালে সৃস্টি হয়েছিলো দাবানলের
এশিয়া: এশিয়ার ভিতর দাবানলের সবচেয়ে ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা হলো ইন্দোনেশিয়ায়। সেখানে দাবানলের সৃস্টি হওয়া এখন বার্ষিক রীতিতে পরিণত হওয়ছে। তবে সেখানে সৃস্টি হওয়া কয়েকবারের দাবানরে কথা বিশেষভাবে উলেøখ করা যায়। ১৯৮২-৮৩ সালে ক্যালিমানটান এবং পূর্ব সুমাত্রার ৩৬,০০০ বর্গকিলোমিটার বনভ‚মি জুড়ে আগুন লেগে যায়। এই একই এলাকায় পরবর্তীতে আরো দাবানলের সৃস্টি হয় ১৯৮৭, ১৯৯৭, ১৯৯৯ এবং ২০০৫ সালে। তবে ক্যালিমানটান এবং সুমাত্রাতে ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতিবছরই ছোট খাট দাবানলের ঘটনা ঘটে আসছে। এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে উলেøখ করার মতো দাবানল প্রবণ অন্য কোন দেশ নেই। তবে ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল জাপানের ৩.৪ বর্গকিলোমিটার বনভ‚মিতে সৃস্ট আগুনের কথা উলেøখ করা যায়। যার স্থায়িত্ব ছিলো ১ দিন এবং এতে প্রাণ হারায় ১৮ জন অগ্নিনির্বঅপক কর্মী।
বিষাদের মূর্ছনা
কার্য কারণ তত্তে¡র ভিত্তিতে যদি বনভ‚মিতে সৃস্ট দাবানলের কারণ খোঁজা হয়, তবে সহজেই চোখে ভেসে উঠে এগুলো। যেমন- আগুনের বিস্তৃতির কারণে দাবানলের সৃস্টি। জ্বালানির উপস্থিতি এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে আগুনের সৃস্টি। কার্য কারণ তত্ত¡ অনুযায়ী সবই যথাযথভাবে মেলানো যায়। কিন্তু তবুও মাঝখানে থেকে যায় জগতের অপার এক রহস্য।
ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকা তাপ বনভ‚মির জ্বালানীর পানিগুলোকে ধীরে ধীরে শুকিয়ে প্রজ্জ্বলনের উপযোগী করে তোলার পর একটি নির্দিস্ট পরিমাণে তাপমাত্রা পৌঁছলে হঠাৎই সৃস্টি হয় স্ফ‚লিঙ্গের। এ স্ফ‚লিঙ্গের মাঝেই নিহীত যত রহস্য। হঠাৎই কিভাবে আকার পায় নিরাকার উষ্ণতা! এ পরিবর্তনকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন প্রত্যÿবাদীরা? অতীন্দ্রীয় কোন সত্ত¡াই কি তাহলে এই পরিবর্তনের কারণ? যে সত্ত¡ার মাঝে জীব ও জগতের সকল রহস্যই লুক্কায়িত?
এমন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো জগতের অসংখ্য উপাদানের নিগূঢ় রহস্যের তরঙ্গে কখনো ভেসে বেড়ালে যে সত্ত্বার কাছে গিয়ে আছড়ে পরতে হয়, তিনিই পরম সত্তা। সে সত্ত্বা থেকেই আগুন-পানি কখনো এসেছে মানুষের জন্য আশীর্বাদ হিসাবে আবার কখনোবা অভিশাপ নিয়ে। পরমসত্ত্বার সেই অভিশাপ আবিভর্‚ত হয়েছে নীতি-নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত জাতির জন্য, সৃস্টি হয়েছে গোটা পৃথিবীর পরবর্তী প্রজন্মের সচেতনার জন্য ভয়ঙ্কর কিছু নজির। নূহ্-এর প্লাবন থেকে শুরু করে পতঙ্গ বৃস্টি, রক্তবৃষ্টির মতো অসংখ্য অভিশাপের অনুভ‚তি ইতিহাসের পাতা বেয়ে নাড়া দিয়ে গেছে আমাদের। আমাদেরকে নাড়া দিয়ে গেছে সুনামির মতো ভয়ঙ্কর এক দূর্যোগ। বিশ্বের চোখের সামনে দিয়েই মানুষকে তুলোর মতো ভাসিয়ে নিতে পেরেছে যে সুনামী, গণগণে তাপে বনভ‚মিকে অঙ্গার করে দিতে পেরেছে যে দাবানল, পরম সত্ত¡ার সেই শক্তিগুলোর পক্ষে নিমিষেই বিরাণ করে দেয়া সম্ভব পুরো সভ্যতাকে। যেমনভাবে আগ্নেয়গিরীর উদগীরণের নিচে চাপা পরেছিলো সভ্য নগরী পম্পেই। গলিত লাভার চাদরে ঢাকা পম্পেই’র বাতাসে এখনো রয়ে গেছে সেই বিশাদের মূর্ছনা।
1 টি মন্তব্য:
ভালো লিখেছো
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন