শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
[লেখাটি মাসিক অন্য দিগন্তে তনয় হোসনেয়ারা (আমার ছদ্মনাম) নামে ছাপা হয়েছে]
নীল রঙ্গেরএক জলজ চাদর, যার অভ্যন্তরে তলিয়ে আছে তিনচতুর্থাংশ পৃথিবী। এরই ফোকল গলে এখানে সেখানে অ¯িÍত্ব প্রমাণ করছে স্থলভাগ। আবার এ স্থলভাগের অভ্যন্তরেও জাল বিছানো রয়েছে সন্তরণরত চাদরের। মোট কথা এ চাদর অর্থাৎ পানির অ¯িÍত্ব পৃথিবীর সবখানেই। জীবণের জন্য পানি। কারণ পানি যেমন ধরে রেখেছে অথই সাগরের অসংখ্য জীবণকে, তেমনি সজিব করে রেখেছে স্থলভাগকেও। কোথাও বৃস্টির পশলা ভিজিয়ে দিয়ে যায় ভ’মি, কোথাও পাহাড়ি ঢল নেমে প্লাবিত করে নদী, আবার কোন ভ’খন্ড সজিব রাখে পেঁজা তুলোর মতো ঝরা তুষার। যেখানে জীবণের অ¯িÍত্ব রয়েছে, সেখানেই রয়েছে পানিরও অ¯িÍত্ব। বাতাসের ভেতর থেকেও আমরা যেমন বাহ্যিকভাবে ততটা ধরতে পারিনা এর গুরুত্ব, তেমনি পানিময় পৃথিবীতে পানিকে অনুভব করতে পারিনা ততটা। পানির উৎসের অন্যতম একটি হলো বৃষ্টি। বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত হয় মূলত আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র মাসে (জুন, জুলাই, আগস্ট)। আর এ বৃষ্টির উৎস হলো অজস্র পানির ফোঁটা নিয়ে ভেসে আসা মৌসুমি বায়ু। জলকণাপূর্ণ মেঘের এ তরঙ্গসীমা সাধারণত বাংলাদেশকে স্পর্শ করে জুনের প্রথম দিকে এবং ছেড়ে যায় সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে।
মৗসুমি বায়ু হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট মৌসুমে প্রবাহিত বায়ু। অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, এখনো এর উৎপত্তি নিয়ে পরিস্কার কিছু বলতে পারেননি কোন বিজ্ঞানী ও গবেষক। সাগরের দিক থেকে এটি ভেসে আসে এতটুকুই কেবল স্পস্ট। কিন্তু সাগরের কোন স্থান থেকে এর প্রবাহ শুরু হয় তা এখনো রয়ে এক গভীর রহস্যের আড়ালে। তবে মৌসুমি বায়ুর অভিযাত্রায় কিভাবে পানি সংযোজিত হয় এর ব্যাখ্যা রয়েছে । সাধারণত যে এলাকায় যখন মৌসুমি বায়ুর প্রভাব লÿ করা যায়, তখন বাতাসের ব্যাপক গতি থাকে। মূলত বাতাসের প্রচন্ড গতিই এর সাথে পানি সংযোজিত করে। বাতাসের প্রচন্ড প্রবাহে উথাল-পাথাল ঢেউ তুলে আন্দোলিত হয় সাগরের নীল চাদর। আর এর সঞ্চালনের ফলে উপরিভাগে সৃষ্টি হয় প্রচুর ফেনার। এই ফেনা সৃস্টি করে অসংখ্য বুদবুদের। একসময় বুদবুদগুলো ফেঁটে হাজার হাজার ুদ্র জলকনা মিশে যায় বাতাসের সাথে। অবশ্য অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে অনেক সময় পানি বাষ্পে রূপান্তরিত হয়েও ভেসে যায়। এ বাতাস যতই সমুদ্র উপক’লের দিকে আসতে থাকে ততই ধুলিকণার সাথে মিশতে থাকে পানির বিন্দুগুলো। পরবর্তীতে এ মিশ্রণ উঠে যায় বায়ু মন্ডলের উপরের দিকে। এর ফলে বাষ্প আরও ঘনীভ’ত হয়ে ধূলি মিশ্রিত কনার চারদিকে জড়ো হয় এবং পরবর্তীতে ফোঁটা ফোঁটা পানির সৃষ্টি করে। পানির এই ফোঁটাগুলো প্রথমে একত্রিত হয় এবং সৃষ্টি করে মেঘমালার। আর এই মেঘকে আপন প্রবাহে ভাসিয়ে বেড়ায় মৌসুমি বায়ু।
অনেক ভ’তত্ত¡বিদদের বিশ্বাস সর্বপ্রথম সৌসুমি বায়ু শক্তিশালী হয়ে এসেছিলো ৮ মিলিয়ন বছর আগে। তারা আরব সাগরে বাতাসের প্রবাহ থেকে এবং চায়না নিম্ন মালভ’মি অঞ্চল থেকে বাতাসে বয়ে আসা বালুকণাকে পরীÿা করে এ অনুমান করেন। তাছারা তাদের পরীÿার আওতায় ছিল চীনের বৃÿ ফসিল এবং দÿিণ চীনা সাগরের তলানি। এসব পরীÿা থেকে এটা মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে যে ১৫ থেকে ২০ মিলিয়ন বছর আগেও ছিল মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ ।
প্রবাহ
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিবছর একই সময়ে মৌসুমি বায়ু ভাসিয়ে নিয়ে আসে মেঘ। সেই সাথে নিচের ¯Íরে প্রবাহিত বায়ুতে ভেসে বেড়ায় অসংখ্য জলকণা। যার অস্তিত্ব এ অঞ্চলে অনুভব করা যায় । দÿিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এর প্রভাব বেশি থাকার কারণেই হয়তো সর্বপ্রথম মৌসুমী বায়ু হিসাবে এটি পরিচিতি পায় ভারত, বাংলাদেশ, পাকি¯Íানসহ আশপাশের দেশগুলোতে। বিশ্বের অন্যান্য যেসব স্থানে এ বায়ু প্রবাহিত হয় সেগুলোর মাঝে উলেøখযোগ্য হলো উত্তর আমেরিকা, দÿিণ আমেরিকা, সাব-সাহারান আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং পূর্বে এশিয়া।
এশিয়ার দÿিণাঞ্চলে ডিসেম্বর মাস থেকে মার্চের শুরুর সময় পর্যন্ত উত্তর পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত বায়ু উত্তরের মৌসুমি বায়ু হিসাবে পরিচিত। এ মৌসুমী বায়ুর চাপ বিরাজ করে সাধারণত দÿিণ পূর্ব এশিয়া এবং অস্ট্রেলেসিয়াতে। অস্ট্রেলেসিয়া এলাকার অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি দেশ অসিয়ানিয়া, নিউজিল্যান্ড, পাপুয়া নিউ গিনি এবং এর আশপাশে প্রশান্ত মহাসাগরের অন্যান্য দ্বীপ হয়ে এ বায়ু সরাসরি প্রবাহিত হয় অস্ট্রেলিয়ার দিকে।
দÿিণ-পশ্চিম অঞ্চলে প্রবাহিত হয় গ্রীষ্মকালীন মৌসুমিবায়ু। এটি জুন থেকে শুরু হয়ে থাকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ভারতীয় মরুভ’মি ও এর সাথে সংশিøষ্ট এলাকা, ভারতের উত্তরাঞ্চল এবং কেন্দ্রীয় এলাকাব্যাপী এ বায়ু প্রবাহিত হয়। এ অঞ্চলে গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপ থেকে উৎপন্ন চাপ সৃস্টি করে বায়ূ শূন্যতার। আর ভারত মহাসাগর থেকে ভেজা বাতাস বেপরোয়াভাবে ছুটে আসে এই শূন্যতা পূরণের জন্য। পরবর্তীতে এর প্রবাহ এসে বাড়ি খায় হিমালয়ে। সুউচ্চ হিমালয় অতিক্রম করে সেন্ট্রাল এশিয়ার দিকে যেতে না পারায় জলকণাসমৃদ্দ এ বাতাস উপরের দিকে বাঁক নিয়ে আবার ফিরে আসে উল্টো পথে। গমনের ¯Íর থেকে ফিরে আসার ¯Íরে তাপমাত্রা কম হওয়ায় জলকণাগুলো রূপান্তরিত হয় মেঘে। আর এ মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টিই ভিজিয়ে দিয়ে যায় ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান।
এ প্রবাহ জুন থেকে শুরু হয় এবং শেষ হয় সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে। এ অঞ্চলে মৌসুমি বায়ুর প্রবাহকে মূলত দুইভাগে ভাগ করা যায়। এর একটি প্রবাহ ছুটে আসে আরব সাগরের দিক থেকে এবং অপরটি আসে বঙ্গোপসাগর থেকে। আরব সাগর থেকে আসা মৌসুমি বায়ু পথমে আঘাত করে কেরালা রাজ্যের পশ্চিম দিকে। আর বঙ্গোপসাগর থেকে ভেসে আসা ভেজা বাতাস আঘাত হানে পূর্ব হিমালয়ে। এর ব্যাপ্তি বাংলাদেশসহ উত্তর পূর্ব ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গ। উত্তর পূর্ব দিক থেকে ছুটে আসে ভিন্ন এক বায়ুর প্রবাহ। এটি বিরাজ করে ভারত মহাসগর ও এর আশপাশের বায়ুমন্ডলে।
উত্তর আমেরিকর দিকে মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ লÿ্য করা যায় জুনের শেষ দিক কিংবা জুলাই এর শুরুর দিকে। আর এর ইতি ঘটে সেপ্টেম্বরে। ম্যাক্সিকোতেই সাধারণত এর চাপ বিরাজ করে বেশি। তবে তা মধ্যজুলাইয়ের দিকে বি¯Íার লাভ করে যুক্তরাষ্ট্রের দÿিণ পশ্চিম এলাকায়। আফ্রিকান মৌসুমি বায়ু আটলান্টিকের বিষুবরেখা থেকে যাত্রা শুরু করে ফেব্রæয়ারি মাসে । তা পশ্চিম আফ্রিকায় পৌঁছে জুনের শেষ দিকে। আবার অক্টোবরে দÿিণে হয় এর ফিরতি প্রবাহ। ইউরুপে মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ হয় শীতের সময়। এ বিষয়টি অবাক হওয়ার মতো হলেও ইউরুপের ÿেত্রে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা।
রহস্য
মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি ও প্রবাহ পৃথিবীর জন্য এক বিস্ময়। নির্দিস্ট মৌসুমে অজস্র জলকণাসমেত এর আবির্ভাব সজীব করে তোলে প্রকৃতি। কারণ এর প্রবাহে রয়েছে বিপুল পরিমাণ পানি। আর পানিই হলো জীবণের অনুষঙ্গ। কোথাও নোনা, কোথাও মিঠাপানি আবার কোথাওবা এগুলোর অদলবদলের কারনে ভারসাম্য বজায় রয়েছে জীববৈচিত্রের। প্রাাণের অ¯িÍত্ব টিকিয়ে রাখার অন্যান্য অনুষঙ্গগুলোর মতো পানির বিন্যাসও নিখুঁতভাবে করে রেখেছেন পরমসত্ত¡া। সৃস্টির সেরা জীব মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন মিঠা পানির। অবাক হতে হয়, পরম সত্ত¡ার অদৃশ্য ইশারায় ঠিকঠিকই বছরের নির্দিস্ট সময়ে বিপুল মিঠা পানির ভান্ডার ঝরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টি। তারপর রসে পরিপূর্ণ মাটিতে গজিয়ে উঠছে তৃণ, সবুজ হয়ে উঠছে পৃথিবী। প্রকৃতির আরেক রহস্য এই বৃষ্টি! স্বাভাবিক হিসাবেই প্রশ্ন জাগে, কিভাবেইবা সাগরের লবনাক্ত পানি আকাশে ভাসতে ভাসতে পরিণত হয় মিঠা পানিতে! মৌসুমি বায়ুর প্রবাহে লবণাক্ত সমুদ্র থেকে উঠে আসে বাষ্প। তারপর প্রকৃতির নিখুঁত নিয়মে বিশুদধ খাবার পানিতে পরিণত হয়ে ঝর ঝরিয়ে ঝরতে থাকে পৃথিবীর কল্যাণে। এ এক অপার রহস্য। অবশ্য লবণাক্ত পানিকে বিশুদ্ধ খাবার পানিতে পরিণত করা মানুষের পÿে সম্ভব। কিন্তু তা অনেক ব্যয় স্বাপেÿ। আরো বিস্ময় হলো, সাগর থেকে যে বাষ্প বাতাসের সাথে মিশে যায় তা কেবল এইচটুও, অর্থাৎ ডিস্টিল ওয়াটার। কিন্তু প্রকৃত ডিস্টিল ওয়াটার মানুষের পানের উপযোগী নয়। এইচটুও এর সাথে আরো বিভিন্ন উপাদান থাকলেই কেবল তা মানুষ খেতে পারে। অথচ সমুদ্রের নোনা পানি বিষ্ময়করভাবে বিশুদ্ধ হয়ে যখন পৃথিব বুকে ঝরে ফোঁটায় ফোঁটায়, তখন তা থাকে অন্যান্য উপাদানসমেত সম্পূর্ণ পান করার উপযোগী। কেবল তা-ই নয় এ বৃষ্টির পানিই হলো খাবারের জন্য সবচেয়ে বিশুদ্ধ। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে জীব ও জগতের এসব রহস্য ক্রমেই জানতে শুরু করেছে মানুষ। হয়তো ভবিষ্যতে এমন অনেক কিছুই উন্মোচিত হবে, যা আজকের দুনিয়ার ধারণার বাইরে। তবে অধুনা জ্ঞান-বিজ্ঞানের এ বিপ্লব শুরু হয়েছে আর কয়দিনই হলো। এইতো বিশ শতকের ভেতরইতো বিজ্ঞান কেবল উদ্ভাবন করতে পারলো বাতাস থেকেই যে বৃষ্টির সৃস্টি। কিন্তু পরমসত্ত¡ার জীবণনির্দেশিকায় এসব বিষয় উলেøখ করা হয়েছে বহু আগেই। পবিত্র কোরআনে রয়েছে:
“আমি বহনকারী বায়ুরাশি প্রেরণ করি: তারপর আকাশ থেকে বারিবর্ষণ করি ও তা তোমাদেরকে পান করতে দিই, তার ভান্ডার তোমাদের কাছে নেই।” (সূরা হিজর-১৫ঃ২২)।
৩টি মন্তব্য:
আপনি দারুন একটি বিষয়ে লিখেছেন।
আপনি দারুন একটি বিষয়ে লিখেছেন।
ধন্যবাদ সাইফ ভাই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন