রবিবার, জুলাই ২৫, ২০১০

আলী আক্কাসের অবস্থা ভালো নয়

আলী আক্কাস একজন রিকশা চালক। গ্রামগঞ্জে নয়, একেবারে রাজধানীর অলি-গলি চষে বেড়ায় তার বাহন। দুইদিন হলো বাড়িতে এসেছে সে। এখন আড্ডা মারছে তোতা মিয়ার দোকানের সামনে। হাতে প্রায় শেষ হয়ে আসা একটি বিড়ি। মুখ থেকে গল গল করে বাতাসে উড়িয়ে দিচ্ছে ধোঁয়ার গুলতি। যথেস্ট মনযোগ দিয়ে টানছে। কারণ শেষের দিকে যে কোন সময় আগুন খসে পড়তে পারে। আর শেষ টান মানে সুখ টান। সতর্ক আলী আক্কাস সুখ টান থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাত্র নয়। অবশ্য আরও অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হতে চায়না সে, তবুও হতে হয়। এই যেমন তিনবেলা খেয়ে-পরে থাকতে পারা আর রোগ বালাইয়ে ঠিক-ঠাকমতো চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রাখে সে। কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে এসব মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হতে হয় তাকে, আর বাকিগুলো নাহয় বাদ-ই থাকলো। কেবল বিড়ির উপরই তার যত অধিকার খাটে, অন্য কোথাও নয়। অবশ্য ধোঁয়ার একেকটি গুলতির সাথে যে একটু একটু করে জীবনীশক্তিও বাতাসে ভেসে যাচ্ছে-এ তথ্যও তার অজানা নয়। সেই ছোটবেলায় শুনেছিলো ‘আই এম এ ডিস্কু ড্যান্সার/বিড়ি খাইলে হয় ক্যান্সার’। বিড়ি খেলে ক্যান্সার হয় এটা শুনতে শুনতেই বিড়ির প্রতি আগ্রহ জন্মে। আর তখন থেকেই শুরু, এখন পর্যন্ত ছাড়তে পারেনি। কোনো দিন পারবে কি না জানা নেই।
- কীগো আলী আক্কাস, এমুন চুপচাপ বইয়া রইছ কেরে? ডাহার (ঢাকার) কিছু খবর-টবর হুনাও আমরারে। দেশের অবস্তা (পরিস্থিতি) কবে বালা অইব?
তোতা মিয়ার কথার জবাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে। কিন্তু কাশির দমকে ভেতরেই আটকে থাকলো কথা। খুক্ খুক্ করে নয়, কাশির শব্দটা হলো খন্ খন্ ধরনের, একেবারে খনখনে বুড়োদের মতো। অথচ তার বয়স খুব হলে চল্লিশ কী বিয়াল্লিশ হবে।
- আরে, আরে থাউক। দেশের অবস্তা কউন লাগদনা। তোমার নিজের অবস্তাই দেহি বালা না। বিড়ি খাইতে খাইতে শইলডারে আঙরা বানায়া দিছ।
প্রচন্ড শ্বাসকষ্টের মাঝেও না হেসে পারলনা আলী আক্কাস। খা.....ক্ করে একদলা কফ নিক্ষেপ করল দূরে। কথা বলার আগে ছুঁড়ে ফেললো বিড়ির শেষ অংশটুকু।
- দেশের অবস্তাও আমার মতোই। আমি যেমুন কবে বিড়ি খাওয়া ছারতারাম (ছাড়তে পারব) জানিনা। আমরার দেশের অবস্তাও কবে বালা অইব জানি না।
- এইডা হিবার কিমুন ঢঙের কতা হুনাইলা?
- ঢঙের কতা না গো ঢঙের কতা না। ডাহা শহর অইল বাংলাদেশের রাজধানী। অইহানে বইয়া থাইক্কা পুরা দেশের ছবি দেহুন যায়। দেশের অবস্তা অহন বালা না। মানুষে মানুষে ভাগ অইয়া যাইতাছে। মানুষের পইসা খরচ অইতাছে নানান আজাইরা কামে। আর এইসব কামের ভোগান্তিও যাইতাছে মানুষের ওপরে দিয়াই।
- হঅ, সব কিছু কিমুন জানি আউলা-ঝাউলা (এলোমেলো) অইয়া যাইতাছে। সায় দিলো তোতা মিয়া।
- আউলা-ঝাউলার কতা আরঅ কও তুমি! নিজের মতঅ চলন-ফিরনেরও অহন স্বাধীনতা নাই। তোমার মুহঅ দাড়ি থাকলে পুলিশে তোমার দিকে বেকা অইয়া চাইবঅ। মাথার মইদ্যে টুপি থাকলে মাথা নুয়াইয়া চলুন লাগবঅ!
- হঅ, এইডা কইছঅ ঠিক কতা। পুরা আসায্য (আশ্চর্য) কারবার শুরু অইয়া গেছে। খালি তোমরার ডাহা শহরঅই না, আমরার গাঁও গেরামের মাইদ্যেও এইরহম অইতাছে। শান্তি কি পুরাপুরি আরায়া (হারিয়ে) যাইবগা নাকি?
- শান্তির আশা আর কইর না। শান্তির মা মইরা গেছে। দেশঅ অহন মানুষ গুম অইয়া যাইতাছে, খুন অইতাছে, আর জিনিসপত্রের দামতঅ বারছেই।
- দিন যাইতাছে আর আমরা দেহি অনিরাপদ আর কঠিন জীবনের দিকে আউ¹াইতাছি (এগিয়ে যাচ্ছি)! দীর্ঘশ্বাস ফেলল তোতা মিয়া।
- আমি কি আর সাধে কইলাম যে, দেশের অবস্তা আমার মতই!
নিজেকে নিয়ে আলী আক্কাসের হেয়ালি শুনে গলা ছেড়ে হেসে উঠল তোতা মিয়া। হাসল এতক্ষন চুপচাপ বসে থাকা ময়নাও। দেশের অবস্থা কেমন তা ওর বোঝার কথা নয়। তবে আলী আক্কাসের অবস্থা যে খুব একটা ভালো নয়, এটা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে ময়না।
২৫ জুলাই ২০১০

কোন মন্তব্য নেই: