রবিবার, অক্টোবর ১১, ২০০৯

হোজ্জ্বা কাহিনী

শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ

একবার হলো কি নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বাকে সবাই মিলে দাঁড় করিয়ে দিলো খুতবা দেয়ার জন্য। অথচ তিনি তেমন বক্তৃতা দিতে পারতেন না। মিম্বরে দাঁড়িয়ে কোনটা থেকে কোন কথা বলে ফেলেন, শেষতকে নাকি আবার লজ্জ্বায় পরতে হয়, এসব শংকাই কাজ করছিলো তার মনে। কিন্তু সবাই এমন করে ধরলো যে তাকে দাঁড়াতেই হলো। কিন্তু তিনিও কম যাননা। মনে মনে এঁটে নিলেন বিদঘুটে এক বুদ্ধি। প্রথমেই গলা খাঁকারি দিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন আমি এখন আপনাদের উদ্দেশ্যে কি বলবো তা কি আপনারা জানেন? সমস্বরে জবাব এলো, না আমরা জানিনা। তার পর তিনি কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, আমি কি বলবো তা যদি আপনারা নাই জানেন তবে সেটা বলে আর লাভ নেই। তারপর সোজা বেরিয়ে গেলেন মসজিদের বাইরে। মুসল্লিরাতো হা-হুতাশ। এত কষ্ট করে হোজ্জ্বাকে ধরে এনেও তার মুখ থেকে বক্তৃতা বের করানো গেলোনা! কিন্তু সহজেই তারা ছেড়ে দিতে রাজি নন। এঁটে নিলেন নতুন এক ফন্দি। অন্য একদিন আবার হোজ্জ্বাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বক্তৃতার জন্য দাঁড় করানো হলো মিম্বরে। তখনও তিনি সবার উদ্দেশ্যে আগের প্রশ্নটিই করলেন। উপস্থিত মুসল্লিরা এবার জবাব দিলেন, হ্যা আপনি কি বলবেন তা আমরা জানি। হোজ্জ্বা এবারও পেয়ে বসলেন সবাইকে। বললেন আপনারা যেহেতু জানেনই তবে আমার আর বলার কি প্রয়োজন। তারপর উপস্থিত সবার হা হয়ে যাওয়া মুখের সামনে দিয়েই বেরিয়ে গেলেন মসজিদ থেকে। কিন্তু তবু হাল ছাড়তে রাজি ছিলেননা তারা। ক্রমেই বুদ্ধি আঁটছিলেন কি করে কথার জালে আটকানো যায় হোজ্জ্বাকে। অবশেষে ঠিক করা হলো শেষবারের মতো আরো একবার চেস্টা করে দেখা যাক। বুদ্ধির বাকসো ওই বেটা হোজ্জ্বার দৌর কতটুকু তা তাদের দেখে নিতে হবেই। আগের মতোই আবার তাকে টেনে আনা হলো মিম্বরে। এবারও ঠিক আগের প্রশ্নটিই করলেন তিনি। মুসল্লিরা এর জবাব আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন। তাদের অর্ধেক লোক উত্তর দিলেন, হ্যা আপনি কি বলবেন তা আমরা জানি। আর বাকি অর্ধেক বললেন, না আমরা জানিনা। তারপর সবাই তাকিয়ে থাকলেন হোজ্জ্বার মুখের দিকে। ভাবলেন এবার নিশ্চয়ই কোন চালাকি করতে পারবেননা তিনি। চালাক হোজ্জ্বাকে ফাঁসানো গেলো ভেবে সবার মুখে ফুটে উঠলো তৃপ্তির হাসি। কিন্তু না হোজ্জ্বা কি এত সহজে হেরে যাবার পত্র নাকি! মুখ খুললেন তিনি। ধীরে ধীরে সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আমি আজ কি বলব এ কথাটি যারা জানেন, তারা দয়া করে বুঝিয়ে দিন যারা জানেননা তাদেরকে। বলেই আর দেরি করলেন না দ্রুত নেমে গেলেন মিম্বর ছেড়ে।
গল্পের শেষ এখানেই। কিন্তু গল্পের নায়ক নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বা যে এখানে বুদ্ধিমত্ত্বার পরিচয় দিয়েছেন তা কিন্তু একদম বুঝার বাকি নেই আমাদের। আর কেনইবা বুঝবোনা, সেই কবে থেকে হোজ্জ্বার সাথে আমাদের পরিচয়! দাদুর কাছে চুপি চুপি কত্তো শুনেছি হোজ্জ্বার গল্প, শুনেছি গুরুজনদের কাছে, কাসের পড়া ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কত্তো পড়েছি হোজ্জ্বা সংগ্রহ! আর হোজ্জ্বা মানেইতো হাসতে হাসতে একেবারে গড়াগড়ি অবস্থা। হ্যা নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বা ছিলেন সত্যিই একজন রহস্য পুরুষ। রাহস্যপুরুষ বলছি এ কারণে যে তাকে কখনো আমরা চিনেছি চালাক ও তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন হোজ্জ্বা হিসাবে আবার কখনো চিনেছি বোকা হোজ্জ্বা হিসাবে। কোন কোন কাহিনীতে তাকে আমরা দেখি যৌক্তিক ভ’মিকায়, কোনটিতে অযৌক্তিক ভ’মিকায়। কোনটিতে দেখি স্বাভাবিক আবার কোনটিতে তার ভ’মিকা থাকে একেবারেই অস্বাভাবিক। কোনটিতে বুদ্ধিসম্মন্ন একজন প্রগাঢ় হোজ্জ্বার চরিত্র ফুটে উঠে, আবার কোনটিতে তিনি থাকেন একেবারে গো-বেচারা বোকার ভ’মিকায়। উপরে চালাক নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বার পরিচয়তো পেলামই, এবার বোকা হোজ্জ্বার একটি পরিচয় পেলেই তার রহস্যময় চরিত্রটি আরো খোলাসা হয়ে ধরা দেবে।
http://www.english-for-students.com/images/HodjasDonkey.gif
কোন এক রমজান মাসের আগে সবার মাঝে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে রোযা রাখার জন্য। কিন্তু প্রতি রমজানেই রোযা রাখতে বেশ কষ্ট হয় হোজ্জ্বার। তাই এবার ঠিক করলেন যে, রোযা রাখবেন না। কিন্তু সমস্যা হলো রোযা না রাখলে লোকজনতো তাকে মন্দ বলবে। তাই কি করা যায, কি করা যায়, চিন্তাভাবনা করে বুদ্ধি ঠিক করলেন যে সবার সামনে তিনি রোযা রাখার ভান করবেন। আর চুপি চুপি ঠিকই খেয়ে নেবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও দেখা দিলো আরেক সমস্যা। কেউ যদি হঠাৎ তার কাছে জানতে চায় যে আজ কততম রোযা, তখন তিনি কি বলবেন? নিজে রোজা না রাখলেতো সঠিক হিসাবও দিতে পারবেন না। তছাড়া তখনতো আর ক্যালেন্ডারও ছিলোনা। অবশেষে হোজ্জ্বা ঠিক করলেন যে, যত রোযা যাবে তিনি ততটি পাথর একটা বাক্সে জমা করে রাখবেন। অর্থাৎ প্রতিদিন বক্সে একটা একটা করে পথর জমা হবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে পথরগুলো গুণে বলে দেয়া যাবে আজ কততম রোজা। তিনি ভাবলেন তার এই চালাকি কেউ ধরতে পারবেনা। কিন্তু সব প্ল্যান কি আর সব সময় সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়! এর মাঝেও লেগে গেলো গন্ডগোল। তার স্ত্রী খেয়াল করলেন যে হোজ্জ্বা প্রতিদিন একটি বাক্সে পাথর রাখছেন। স্বামিভক্ত স্ত্রী ভাবলেন নিশ্চয়ই হোজ্জ্বা কোন মহান কাজ করছেন। তাই তাকেও প্রতিদিন একটি করে পাথর এই বাক্সে রাখতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। অবশেষে বাক্সে পাথর রাখার দলে সামিল হলো তার ছেলে এবং মেয়েও। মোটকথা তারা সবাই বিপুল বিক্রমে পাথর জমাতে শুরু করল। এদিকে কি ঘটছে এসবের কিছুই কিন্তু হোজ্জ্বা জানেননা। বিপত্তিটা ঘটলো সেদিনই, এক ফাজিল প্রতিবেশি হোজ্জ্বাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলো যে, এখন পর্যন্ত কয়টা রোযা গেলো? অতিচালাক হোজ্জ্বা বললেন, "দাঁড়াও একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি"। তারপর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে বাক্স খুলে পাথর গোনা শুরু করলেন তিনি। কিন্তু তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো, যখন পাথরের সংখ্যা দাঁড়াল মোট ৯৬ টিতে। ভাবলেন এই কয়দিনেতো এত্তো পাথর হওয়ার কথা না। আবার নিজের হাতে যা গুণলেন তাও তো সত্যি। এসব সাত পাঁচ ভেবে তিনি ভাবলেন রোজার সংখ্যা কিছুটা কমিয়ে বলাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। অবশেষে প্রতিবেশির সামনে এসে তিনি বিপুল বিক্রমে জানিয়ে দিলেন যে ইতিমধ্যেই ৫৩ টি রোজা চলে গিয়েছে। প্রতিবেশিতো তাকে পাগল ঠাওরে নিয়ে বললেন "যান কি যা-তা বলছেন, এতো হতেই পারেনা!"। কি এতো বড়ো অপমান ভেবে গর্জে উঠলেন হোজ্জ্বা, "চোপরাও! আমি তো তাও কমই বলেছি, পাথর গুনলে তো আরো বেশিই পেতে"।
বোকা বা চালাক যাই হোকনা কেন রহস্যময় হোজ্জ্বার প্রচলিত এসব কাহিনীগুলো যেমনভাবে আমাদের হাসির খোড়াক তেমনি এসবের প্রায় সবগুলোতেই লুকিয়ে রয়েছে নীতি-নৈতিকতা কিংবা শিক্ষনীয় বিষয়। কৌতুহল জাগা স্বাভাবিক যে, কিভাবে সৃস্টি হয়েছিলো এসব কাহিনীর? এ প্রশ্নের জবাব স্পস্ট করে এখন পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। অনেকে অনুমান করছেন তার চরিত্রই ছিলো এরকম উদ্ভট, আবার অনেকের ধারণা মানুষ যেন হাসি-আনন্দের সাথে সাথে খুঁজে নিতে পারে শিক্ষার উপাদান তাই নিজের নামে তিনি তৈরি করেছেন এমন গল্পকথা। সে যাই হোক হোজ্জ্বা চরিত্র আমাদেরকে আনন্দ দিতে পেরেছে বলেইতো ছোট নেই বড় নেই সবাই আমরা তার সাথে পরিচিত। শুধু তাই নয় অবাক বিষয় হলো মধ্যপ্রাচ্য থেকে হোজ্জ্বা কাহিনীর সৃস্টি হলেও কালের বিবর্তনে হাসি-আনন্দের হিল্লোলে তা স্পর্শ করে গেছে সারা বিশ্বকে। আর এগুলোর শিক্ষনীয় ছিলো বলেই স্থায়িত্ব পেয়েছে এতকাল। শুরুতে উল্লেখিত গল্পটির শিক্ষনিয় বিষয় হলো বুদ্ধি থাকলে যে কোন পরিস্থিতিই সামাল দেয়া যায়। আর দ্বিতীয় গল্পটির দ্বারা আমরা বুঝতে পেরেছি, আসলে ফাঁকি দেয়ার চেস্টা কখনো সফল হয়না। তাই এ চেস্টা করা উচিত নয়। রোজা না রাখলে আল্লাহর কাছেতো জবাবদিহীতা রয়েছেই, সেই সাথে কোন না কোনভাবে মানুষের সামনেও তা প্রকাশ পেয়ে যাবে। হোজ্জ্বার এমন কিছু কাহিনী রয়েছে যেগুলো কেবলমাত্র কৌতুক হিসাবেই ধরা হয়। যেমন: একদিন হোজ্জ্বা নদীর তিরে বসে আছেন। তখন অপর পার থেকে এক লোক চিৎকার করে তাকে জিজ্ঞেস করলো, আমি কিভাবে নদীর ঐপার যাবো একটু বলে দিবেন কি? হোজ্জ্বা এর জবাবে বললেন, তুমি নদীর ঐপারেই আছো। শিক্ষনীয় এবং মজাদার এসব গল্পের সৃস্টি যেভাবেই হোকনা কেন বর্তমানে এগুলোর কোনটিতে হোজ্জ্বা উপস্থাপিত হয়েছেন প্রগাঢ় হিসাবে কোনটিতে বোকার ভ’মিকায়। আবার দেখা গেছে তিনি কখনো শাসকের বিরুদ্ধে কথা বলতেও ভয় পেতেননা। রাজসভা বা যে কোন অনুষ্ঠানে প্রবল বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে তিনি হার মানিয়ে দিতেন বাদশাহকেও। মোটকথা বর্তমানে হোজ্জ্বার উপস্থাপন রয়েছে নানা আঙ্গিকে। কিছু রয়েছে আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য সমন্বিত বর্ণনার মাধ্যমে। আবার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠিত গল্প, কবিতা ও বিভিন্ন ধারণার উপর।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে প্রচলিত রয়েছে নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বার বিভিন্ন কাহিনী। ইতিহাসের মজার এই চরিত্র হাসি আনন্দ মিশ্রিত ভালোলাগার এক আবেশ। নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বা নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে বুদ্ধিদীপ্ত কিন্তু কৌতুকমিশ্রিত এক চেহারা। অনেকটা কল্পিত এ চেহারার অধিকারীর মাথায় বিশাল এক পাগড়ি, তিনি চড়ে বেড়াচ্ছেন গাধার পিঠে করে। অথচ এ চরিত্রটি আসলেই কি বাস্তব, আর বাস্তব হলেও ঠিক কোন সময়টা ছিলো হোজ্জ্বার সময়কাল, কোথায় তার জন্ম এসব প্রশ্নের জবাব আমরা কয়জনইবা খুঁজতে যাই! হ্যা নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বা নামে সত্যি সত্যিই একজন ছিলেন। ঐতিহাসিক এই চরিত্রের জন্ম মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন এনাতোলিয়াতে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে এর অবস্থান। তিনি ১২০৯ সালে বর্তমান সিভরিহিসার জেলার হরতু গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সিভরিহিসার বর্তমান তুরস্কের একটি প্রদেশ। জন্মের পর থেকে কিছুদিন এ গ্রামেই ছিলো তার বসবাস। পরবর্তীতে তিনি আকসেহিরে চলে যান। তার শেষ জীবণ কাটে তুরস্কের প্রাচীন নগরী কোনিয়াতে। এ কোনিয়া নগরী থেকেই সৃস্টি হয় হোজ্জ্বার যতসব কাহিনী। অবশেষে তাঁর মৃত্যুও হয় এখানেই। ধারণা করা হয় তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন ১২৭৫ সালে।
http://englishcafecdn.englishcafe.com/files/images/ec_13203_1250540215.post.jpg
আমরা হোজ্জ্বার গল্প ও কাহিনীগুলোর সাথে পরিচিত হয়েছি আমাদের আগের প্রজন্মের কাছ থেকে শুনে, বই পড়ে এবং বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে। তবে মূলত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাঁধে ভর করেই হোজ্জ্বার পরিচয় ঘটেছে আমাদের সাথে। সময়ের যাত্রায় অনেক কিছুই পরিবর্তনশীল। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় সংস্কৃতি, সাহিত্য, জীবণপ্রণালী, লোক কথা, উপকথা প্রভৃতি। তেমনি তের শতকের চরিত্র নাসিরউদ্দিন হোজ্জ্বার সাথে এখন আমরা যেভাবে পরিচিত হচ্ছি, তিনি হয়তো ঠিক তেমন ছিলেননা। তবে প্রচলিত ধারণাগুলোর চাইতে যে একেবারে ব্যতিক্রম ছিলেন তাও নয়। একটু যে পরিবর্তিত, পরিবর্জিত বা পরিবর্ধিত হয়েছে তাও সময়ের স্বাভাবিক হিসাবেই। তার গল্প কাহিনীগুলো বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে যাওয়ায় এগুলোকে উপস্থাপন করা হয়েছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে। আর এ কারণেই বিভিন্ন সময় হোজ্জার কাহিনীর সাথে হয়েছে নানা সংযোজন বিয়োজন। বিভিন্ন ভাষায় এসব কাহিনীগুলো অনুবাদ হওয়ায় কোন কোন এলাকায় হোজ্জ্বার মতো স্বতন্ত্র চরিত্রেরও তৈরি হয়ে গেছে। অনেক এলাকায় নাসিরুদ্দীন পরিণত হয়েছে সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশে। এসব কারণেই হোজ্জ্বা একেক এলাকায় একেক নামে পরিচিত। নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বা নামে তিনি তার বসবাসের এলাকা তুরস্কে, বসনিয়ান এবং আমাদের বাংলাভাষাবাসিদের কাছে পরিচিত। কুর্দীদের কাছে তিনি মোল্লা নাসিরুদ্দীন। আরব এবং পারসিয়ানদের কাছেও তাই। আলবেনিয়ায় তাকে ডাকা হয় নাস্ট্রাদিন হোক্সা কিংবা শুধুমাত্র নাস্ট্রাদিনী নামে। আজেরীদের কাছে মোল্লা নাসিরুদ্দীন। উজবেকদের কাছে নাসিরুদ্দীন অফেন্দী অথবা শুধুমাত্র অফেন্দী নামে তাঁর পরিচয়। এসব এলাকা ছাড়াও তার কাহিনী-উপকাহিনীগুলো আরমেনিয়ান, বুলগেরিয়ান, গ্রীক, হিন্দি, ইতালিয়ান, পশতু, রুমানিয়ান, সারবিয়ান, উর্দু, বুলগেরিয়া প্রভৃতি লোক ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে। এসব এলাকায় অনেক ক্ষেত্রে তিনি তার প্রজ্ঞা এবং বিচারিক ক্ষমতার জন্য বেশ জনপ্রিয়। আবার চীনেও তিনি অফেন্দি নাসিরুদ্দিন নামে পরিচিত। বর্তমান চীনে তাকে নিয়ে বিভিন্ন রকমের মুভি, কার্টুন এবং উপন্যাসও রচিত হয়েছে। সময়ের সাথে সংস্কৃতি পরিবর্তিত হলেও কিংবদন্তী নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বার প্রবাহ স্তিমিত হওয়ার নয়। বরং তা আরো বিস্তার লাভ করছে প্রযুক্তির কল্যাণে। প্রযুক্তি ও প্রজন্মের কাঁধে ভর করে এভাবেই মানুষের কানে কানে বেঁচে থাকবে হোজ্জ্বা কাহিনী।

ইতিহাসের পদধ্বনি: দ্বিতীয় পর্ব







শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ







জুরিখ

মানুষের ভির নেই বললেই চলে, কিন্তু তবুও এটি একটি নগরী। ইতিহসের প্রাচীনতম এ নগরী হলো সুইজারল্যান্ডের জুরিখ। ইউরোপের অন্তর্ভূক্ত হলেও উরোপের অধিকাংশ নগরীর মতো দালনকোঠায় ঠাসা শহর এটি নয়। নির্জন, নি¯Íব্ধ প্রকৃতিতে সুশোভিত জুরিখের স্বীকৃতি রয়েছে জীবণের জন্য নিরাপদ শহর হিসাবে। প্রকৃতির অপর সৌন্দর্যের এ লীলাভ’মি নগরী হিসাবে গড়ে উঠেছিলো খ্রি:পূর্ব ৩০০০ সালে। তখন লিমাত নদীর চঞ্চল প্রবাহ আর তুষার ঝরা শীতল এ পাহাড়ি উপত্যকাতে উষ্ণতা বয়ে এনেছিলো মানুষ। নগরীটির গড়ে উঠার সময়কাল থেকে সঠিক ইতিহাস পাওয়া না গেলেও অন্তত এতটুকু বলা যায় যে, এটি একসময় ছিলো আত্মত্যাগী ধ্যানমগ্নদের নগরী।
জীবণ থেকে পালিয়ে বেড়ানো এ আত্মত্যাগীদের খুঁজে পাওয়া যায় যেমন ইতিহাসের নানান খাঁজে, তেমনি এদের অ¯িÍত্ব রয়েছে সভ্যতার আধুনিক স্পর্শের ভেতরও। তারা জীব ও জগতের মোহ ত্যাগ করে ছুটছে অপার রহস্যের পেছনে। পরম সত্ত¡ার সাথে আপন অ¯িÍত্বকে বিলীন করে দেয়াই তাদের ব্রত। কোলাহলহীন প্রকৃতির অঢেল সম্পদে সমৃদ্ধ বর্তমান জুরিখকে সামনে রেখেই অনুমান করা যায় পাঁচ হাজার বছর আগে এর রূপ ও নির্জনতা কেমন ছিলো। হয়তো শুরুর দিকে ধ্যান পাগল এসব আত্মত্যাগীরা দুঃখ জরাগ্র¯Í পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে সুখবোধে মিলিয়ে যেতে নির্জন এ স্থানটিকেই বেছে নিয়েছিলো তাদের জন্য। মনশ্চু থেকে রহস্যের পর্দা তুলে নিতে এ ভ’স্বর্গেই চলে তাদের সাধনা। তারপর হয়তো জীবণের প্রয়োজনেই ক্রমাগত জেগে উঠতে থাকে ধ্যান ভেঙ্গে। সেই সাথে জেগে উঠতে থাকে এ ভ’খন্ডটিও। যার পরিণতি বর্তমান ছিমছাম, আধুনিক ও অপার সৌন্দর্যের নগরী জুরিখ। এ জুরিখ নামটিই এর আদি নাম নয়। ধারণা করা হয় জুরিখ এর পূর্ব নাম ছিলো টুরিকম। ২য় শতকে সেখানকার বিভিন্ন সমাধির স্মৃতিফলকে ‘টুরিকম’ নামের অ¯িÍত্বই রয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে ‘টুরিকম’ নামটির বিবর্তন ঘটে বর্তমান জুরিখ-এ এসে পৌঁছেছে। ৬ষ্ট শতকে এটি ছিলো ‘জুরিখী’ এবং সবশেষে ১০ম শতক থেকেই ‘জুরিখ’ নামটি পরিচিতি পায়। রুমানদের সময়ে টুরিকম নামের এ শহরটি ছিলো গ্যালিয়া বেলজিকার সীমান্তে কর সংগ্রহের স্থান এবং এখান থেকে লিমাত নদীর উপর দিয়ে ভেসে যাওয়া পণ্যের নিয়ন্ত্রণও করা হত। ইতিহাসের পথ ধরে স্পস্টভাবে যতদূর জানা যায় এ অঞ্চলটি একসময় ছিলো রুমান শাসনের অধীনে। প্রতাপশালী রুমান শাসক চারলিম্যাগনির নাতি লুইস তার শাসনের সময় এ এলাকাটিতে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। বিশেষ করে তখন পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানো সন্ন্যাসীদের কল্যাণে লুইস অনেক ভ’মিকাই গ্রহণ করে। রুমান দূর্গগুলোর পাশে ক্যারোলিনজিয়া দূর্গ নির্মাণ এবং ৮৩৫ সালে জীবণবিমুখ ত্যাগীদের জন্য ফ্রাউমুনস্টার আশ্রম নির্মাণ ছিলো উলেøখযোগ্য। এ আশ্রমটি নির্মাণের পর জুরিখকে পুরোপুরিভাবে তাদের বসবাসের উপযোগী করে দেয়া হয়। তখন কেবল জুরিখ নয়, ইউরি, আলবিসের এলাকার বনভ’মিতেও তাদের পদচারণা আরো সহজ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১০৪৫ সালে জীবণবিমুখ আত্মত্যাগীদেরকে জীবণমুখী করতে সÿম হয় ৩য় হেনরি। তখন তাদের অনেককে মালিক করে দেয়া হয় বিভিন্ন বিপনীবিতানের। কাউকে নিয়োজিত করা হয় কর আদায়ের কাজে। বলা যায় তখন থেকেই কোন না কোন অর্থ উপার্জনের কাজে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকে তারা।

লিমাত এর প্রবাহ বয়ে গেছে যে ভ’খন্ডের বুক চির ধরিয়ে, এর উত্তর পশ্চিম অংশের শেষ থেকে শুরু হয়েছে জুরিখ লেক। এ লেকের দুই পাশেই পরিচ্ছন্ন অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান সৌন্দর্যের শহর জুরিখ। অসংখ্য সবুজ গাছের পাহাড় ঘেড়া এ নগরীটিই ক্যানটন জুরিখ (সুইজারল্যান্ডের প্রদেশকে বলা হয় ক্যানটন। ক্যানটন জুরিখ তেমনি একটি প্রদেশ) এর রাজধানী। নগরীটি এক দিকে যেমন সুইজারল্যান্ডের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র, তেমনি সংস্কৃতির রাজধানী । আর্ট গ্যালারির ছড়াছড়ি ইউরোপের অন্যতম প্রধান চিত্রকলা কেন্দ্র এখানে। শহরের ‘আর্ট মাইল’ হিসাবে পরিচিত একটি সড়ক রামিট্রাস। এর পাশে গায়ে গা লাগিয়ে অবস্থান একেকটি আর্ট গ্যালারির। জুরিখে জাদুঘরের সংখ্যা ৫০-এর বেশি।
জুরিখ নগরীর ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক কেন্দ্র হলো সৌন্দর্যের অপূর্ব বুননে বিন্য¯Í লিনডেনহোফ পাহাড়। পাহাড়টির ঠিক উত্তর দিকে রয়েছে সিটি পুলিশ স্টেশন, দÿিণে খুব কাছাকাছিই সেন্ট পিটার চার্চ, যাতে রয়েছে গোটা ইউরোপের সবচেয়ে বড়ো চার্চ ‘কক ফেস’। পশ্চিমে এর সীমা যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে সেখানে বানহোফস্ট্রেস বিপনী সরণি। মজার বিষয় হলো এর সড়ক ধরে হেঁটে গেলে পায়ের তলায় গড়াগড়ি খায় শত-সহস্র কোটি নগদ ডলার। শুধু তাই নয় মাটির নিচে রয়েছে কাড়ি কাড়ি মণিমাণিক, সোনাদানা সমেত বিশাল রতœভান্ডার। মূলত বিশ্ববিখ্যাত সুইস ব্যাংকগুলোর ভূগর্ভস্থ ভল্ট থাকার কারনেই সড়কেরই নিচে বিশাল এ রতœাগার। মাটির নিচেই শুধু নয়, ঐশ্বর্যের ছড়াছড়ি রাস্তার দু’পাশের বিপনীবিতানগুলোতেও। সবচেয়ে নামকরা সুইস ঘড়ি, বিশ্বখ্যাত চকোলেট, অলঙ্কার আর বিখ্যাত অনেক ব্র্যান্ড আর ডিজাইনার আইটেমের দোকান রয়েছে এখানে। কয়েকটি বড় শো রুমে দেখা যাবে চকচকে অস্ত্রধারী, ততোধিক ঝকঝকে চেহারার প্রহরী।
পাহাড়ের পূর্বদিকে স্বচ্ছ প্রবাহে বয়ে গেছে লিমাত নদী। নদী আর পাহাড়ের বন্ধন যেখানে এর ঠিক ৭০০ মিটার দÿিণ দিকেই লিমাতের সাথে সংযোগ ঘটেছে জুরিখ লেক এর। স্বচ্ছ স্ফটিকের মত পানিসমৃদ্ধ লেকের ধার থেকে আকাশের দিকে উঠে গিয়েছে যে পাহাড়, বহুদূরে তার মাথায় চিকচিক করে বরফ। আকাশের নীলও সেখানে ফুটে উঠেছে ভিন্ন এক বৈচিত্রে। সে নীলে চোখ তুলে তাকালে কোনও এক অপূর্ব প্রসন্নতায় ভরে যায় যে কারো মন। লেকের কোথাও উড়ে বেড়ায় কিংবা সাঁতার কাটে নানান প্রজাতির পাখি। কোথাও চারপাশে সবুজ পার্কেরমতো স্থান। পাহাড়ের মাঝখানে ছোট একটি উপত্যকার মতো রয়েছে যা পাবলিক স্কয়ার হিসাবে পরিচিত। লিমাত নদীর ধারে পুরনো জুরিখ সংরতি একটি এলাকা। এর আশপাশেই বিলাসি নগরী জুরিখ মেতে উঠে ভিন্ন এক বিলাসিতায়। প্রতি রাতে রেডমার্ক এ এলাকা ভেসে যায় নারী ও পুরুষের উন্মত্ততায়। লাল আলোকে কেন্দ্র করে আদিম আকর্ষণে অনেকেই ছুটে আসে নীল পরীর সন্ধানে।
পৃথিবীর অনেক নগরীগুলোতে মানুষের বসবাস গড়ে উঠার পর ধ্বংস করা হয়েছে প্রকৃতিকে এবং বিনস্ট করা হয়েছে সেকানকার সৌন্দর্য্য। কিন্তু জুরিখ এর ব্যতিক্রম। এখানে প্রকৃতি যেমনভাবে ঢেলে দিয়েছে সৌন্দর্য্য, তেমনি এখানকার বাসিন্দারা এগুলো বিনষ্ট না করে বরং গড়ে তুলেছে আরো মাধুরি মিশিয়ে। শহরের এখানে সেখানে শোভা পায় অসংখ্য ফোয়ারা। তাই জুরিখকে বলা হয় ফোয়ারার শহর। পুরো শহরে ছোটবড়ো মিলিয়ে ফোয়ারার সংখ্যা হবে হাজারের বেশি। প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়ে এগুলো জানান দেয় অন্যরকম এক ঐশ্বর্যের। ফোয়ারা নগরী জুরিখের সূর্য যখন আকাশের কোথাও তলিয়ে যাবার প্রস্তুতি নেয়, তখন হৃদয় ছুঁয়া বাতাস প্রকৃতিতে নিয়ে আসে ঠান্ডা এক আমেজ। আর সারাদিনের প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ, উষ্ণতার উঠানামা সবই ঘটে প্রায় সহনীয় পর্যায়ে। সেখানকার প্রকৃতির কোমল পরশে ভিন্ন এক আরামে পরিপূর্ণ হয়ে যেতে বাধ্য যে কারো মন। জুরিখের আবহাওয়া আদ্র। সেখানে বছরে পরিবর্তন হয় ৪টি ঋতুর। গ্রীষ্ম, শীত, বছরের তৃতীয় ঋতু(যা আমাদের দেশে শরৎ ও হেমন্তকাল) এবং বসন্ত। গ্রীষ্মে গড়ে তাপমাত্রা থাকে সর্বোচ্চ ২১-২৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ১০-১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। শীতে গড় তাপমাত্রা থাকে মাত্র ৪-৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আর তৃতীয় ঋতু ও বসন্তে সেখানকার আবহাওয়ায় বিরাজ করে মধ্যম মাত্রার ঠান্ডা। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এ শহরের সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দেয় তুষার পতন। হরহামেশাই পথে ঘাটে ছড়িয়ে থাকে ঝরা তুষারের ছিটেফোঁটা। সেখানকার আরামদায়ক এ আবহাওয়ার তুলনা কেবল হয় পৃথিবীর ভ’সর্গ ভারতের কাশ্মীর এলাকার সাথে। কাশ্মীরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ভারতের চলচ্চিত্রগুলোর শ্যুটিং করা হয় জুরিখসহ সুইজ্যারল্যান্ডের বিভিন্ন এলাকায়। কারণ স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে ভারতের দমন নীতির কারণেএ ভ’খন্ড শ্যুটিংয়ের জন্য নিরাপদ নয়।
প্রাচীনতম সভ্যতার বহি:প্রকাশ এ নগরী গড়ে উঠার পরও পৃথিবীতে সৃস্টি হয়েছে আরো অসংখ্য সভ্যতার। এগুলোর অধিকাংশর অ¯িÍত্বই বিলীন হয়ে গেছে কালের গর্ভে। কিন্তু আপন ঐশ্বর্য টিকিয়ে রেখে এখনও জীবণের জন্য নিরাপদ শহর হিসেবে টিকে আছে সৌন্দর্যের নগরী জুরিখ। ২০০৭ সালের শুমারী অনুযায়ী এ নগরীতে বসবাস ৩৫৮,৫৪০ লোকের। এদের মাঝে ৩০.৬ শতাংশ অধিবাসী সুইজারল্যান্ডের নাগরিক। তাদের অফিসিয়াল ও অধিকাংশ জনগণের ভাষা জার্মান। এদের মাঝে অনেকে জুরিখ জার্মান এবং অনেকে সুইস জার্মান ভাষায় কথা বলে। জার্মান হলো ৭৭ শতাংশ অধিবাসীর মাতৃভাষা। এছাড়া ইতালীয়ান ভাষায় কথা বলে ৪.৭ শতাংশ এবং অন্যান্য ভাষায় বলে ১ শতাংশ অধিবাসী। জুরিখের বাসিন্দাদের মাঝে বর্তমানে ক্যাথলিক খ্রিস্টানের সংখ্যা বেশি। তাছারা শহরের বাসিন্দাদের মাঝে একটি বড় অংশ নিজেদেরকে সকল ধর্ম মুক্ত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ তারা কোন ধর্মের অনুসারী নয়। তবে জুরিখের ইতিহাসে ভাবের পাগল আত্মত্যাগীদের বসতি এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন একেশ্বরবাদী ধর্মের অ¯িÍত্বের সন্ধান পাওয়া গেলেও পৌত্তলিকতার ছুঁয়া খুঁজে পাওয়া যায়না।

কোনিয়া
মসজিদ ও জাদুঘরের নগরী কোনিয়া। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানব বসতির সূচনা হওয়া এ নগরীতে রয়েছে বহু প্রাচীন মসজিদের অ¯িÍত্ব। আর বসতির ঘনত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে এর সংখ্যা। তাছারা এ নগরীতে রয়েছে বেশ কয়েকটি জাদুঘর। মূলত এ কারনেই কোনিয়াকে মসজিদ ও জাদুঘরের শহর বলা হয়। এক সময় এ নগরী ছিলো ইসলামের দূর্গ। এখানে বেড়ে উঠেছেন অনেক মুসলিম পন্ডিত। কোনিয়ার মাটিতে জন্ম হয়েছে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও ভাবান্দোলনের। এখানকার আধ্যাত্মিকতার আলো ছড়িয়ে গেছে পৃথিবীর অন্ধকারাচ্ছন্ন বিভিন্ন এলাকায়। ধারণা করা হয় বাংলাদেশের এক প্রান্তে শায়িত অলি হজরত শাহজালাল (রা.) এর জন্মও এ কোনিয়াতেই। সেখান থেকেই জ্ঞান আহরণের যাত্রা শুরু করে দীর্ঘ জীবণে আধ্যাত্মিকতা ও অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে তিনি আলোকিত করতে আসেন ভারতীয় উপমহাদেশকে। কারো কারো মতে হজরত শাহজালাল (রা.) এর জন্ম ছিলো ইয়েমনে। তবে অধিকাংশ মুসলিম পন্ডিতদের ধারণা ১২৭১ সালে তিনি তুরস্কের নগরী কোনিয়াতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন ইসলামি পন্ডিত, সুফি ও কবি জালাল উদ্দিন রুমীর সমসাময়িক একজন ইসলাম ধর্ম প্রচারকের পুত্র। বাংলাদেশে এ কথাটিই বেশি প্রচলিত রয়েছে যে তিনি ইয়েমন থেকেই সিলেটে এসেছিলেন। তবে ধারণা করা হয় ছোটবেলায় কিংবা প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে শাহ জালাল কোনিয়া থেকে ইয়েমনে চলে যান। তিনি বেড়ে উঠেন তাঁর মামা সাইয়েদ আহমেদ কবিরের কাছে। তাঁর কাছ থেকেই তিনি ইসলামের উপর অগাধ পান্ডিত্য অর্জন ও আধ্যাত্মিকতার ছুঁয়া পান। মোটামুটি ৩০ বছর তিনি মামার সান্নিধ্যে অধ্যয়ন ও আধ্যাত্মিকতায় ডুবে থাকেন। একদিন মামা সাইয়েদ কবির তাঁকে কিছু মাটি তুলে দিয়ে হিন্দু¯Íানের দিকে রওয়ানা হতে বলেন। সেইসাথে তিনি বলেন এই মাটির সাথে হিন্দুস্থানের যে অঞ্চলের মাটির মিল পাওয়া যাবে, সেখানেই যেন তিনি বসতি গড়েন। তিনি করলেনও তাই। দীর্ঘ সফরে রওয়ানা হয়ে যান হিন্দু¯Íানের উদ্দেশ্যে। সিলেট অঞ্চলের সাথে মামার দেয়া মাটির মিল পাওয়ায়, সেখানেই বসতি গড়ে তুলেন তিনি। এর উদ্দেশ্য ছিলো এ এলাকার নির্যাতিত, নিগৃহীত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তিনি জ্ঞানের আলো ছড়ালেন এখানকার বাসিন্দাদের মাঝে। যার ফলশ্রæতিতে সিলেটের মাটি পরিণত হলো পূণ্যভ’মিতে। এমনই অনেক মুসলিম সাধক তৈরি হয়েছিলেন কোনিয়ার মাটি থেকে। তারপর তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তকে আলোকিত করেছেন সত্যের আলো দিয়ে।
মুসলিম সুফিবাদ ও আধ্মাত্মবাদের দূর্গ পবিত্র ভ’মি কোনিয়া ধন্য হয়েছে হজরত শাহজালাল (রা.) এর বাবা জালালউদ্দিন রুমির স্পর্শে। পারস্যের এ কবি জীবণের শেষ পঞ্চাশটি বছর কাটিয়েছিলেন কোনিয়াতেই এবং এখানেই রয়েছে তাঁর সমাধিসৌধ। যা বর্তমানে মেভলানা জাদুঘর হিসাবে পরিচিত। রুমির অপর নাম মেভলানা। এ জাদুঘরে রুমির কবরের পাশেই রয়েছে তাঁর বাবা বাহাউদ্দিনের কবর। এ মাটি আলোকিত হয়ে উঠেছে ইবনে আরাবির মতো মুসলিম সুফিদের জ্ঞানের আলোতে। তিনি ১২০৭ সালে সেলজুক সরকারের আমন্ত্রণে সেখানে যান। এখানে বসবাস করেছেন ইতিহাসের রহস্যময় ব্যক্তি নাসিরুদ্দিন হোজ্জ্বা। ১৩ শতকের শেষের দিকে খুব সম্ভবত ১২৮৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এ মাটিতেই।
মুসলমান আধ্যাত্মবাদের এ ভ’মির অবস্থান প্রাচীন এনাতোলিয়া মালভ’মির কেন্দ্রে। ভ’মধ্য সাগর থেকে এর দূরত্ব ২৫০ কিলোমিটার এবং কৃষ্ণ সাগর থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ইতিহাস সন্ধানের উদ্দেশ্যে মাটি খনন করে দেখা যায় বর্তমান তুরস্কের প্রাচীন এ নগরী গড়ে উঠেছিলো তাম্র যুগের শেষের দিকে। অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালে। তবে এর ইতিহাস মোটামুটি স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বে হিটিটিস সময়কাল থেকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়কালে একে শাসন করেছেন বিভিন্ন শাসকরা। ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন নগরী জাজিয়ানটেপের মতো কোনিয়াও ছিলো মেসোপটিমিয়া সভ্যতার অংশ। জাজিয়ানটেপে বিভিন্ন শাসক গোষ্ঠির আগমন-প্রত্যাগমনের মতোইএখানেও ঘটেছে তাই। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সালের দিকে কোনিয়া নগরী চলে যায় সাগরে ভেসে আসা বণিকদের দখলে। খ্রিস্টপূর্ব ৮ শতকে কেন্দ্রীয় এনাতোলিয়ায় ফ্রেগেইনসরা তাদের রাজ্য স্থাপন করে।
৬৯০ খ্রিস্টপূর্বে এটি সিমেরিয়ানদের দখলে যায়। এর আরও পরে নগরীটি পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয় এবং পরসিয়ানদের হাতে থাকে ৩৩৩ খ্রিস্টপূর্বে আলেকজান্ডারের বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত। আলেকজান্ডার এক যুদ্ধে দারিউসকে পরাজিত করে তার সাম্রাজ্য আয়ত্বে নেন। পরবর্তীতে অর্ধেক পৃথিবীর শাসক আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য ভাগ হয়ে যায়। তখন কোনিয়া এলাকাটি অন্তর্ভূক্ত হয় আলেকজান্ডারের সামরিক অফিসার সেলুকাস এর শাসনের আওতায়। হেলেনিস্টিক সময়কালে নগরীটি শাসিত হয় পারগামন রাজাদের মাধ্যমে। সর্বশেষ পারগামন রাজা ৩য় আত্বালুস মারা যান এখানেই। ১০৭১ সালে সেলজুক তুর্করা এ এলাকা অধীনে নেয়। পরবর্তী ১০৯৭ সাল থেকে ১২৪৩ সাল পর্যন্ত কোনিয়া ছিলো রুম সালতানাতের রাজধানী। মূলত এ নগরীটি ব্যপকভাবে গড়ে উঠে ১২ শতকের শেষার্ধের দিকে। রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের কারণে ১২২০ সালে কোনিয়া পরিপূর্ণ হয়ে উঠে খারেজমিড থেকে আগত শরণার্থীদের দ্বারা। সেলজুক সময়কালের পর এ অঞ্চল শাসন করে অটোমানরা। স্বাভাবিকভাবেই নাগরিক সুবিধা ও অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দের জন্য বিভিন্ন অনুন্নত অঞ্চল থেকে মানুষ নগরমুখী হয়। এ প্রবণতার কারণেই মানবস্পন্ধনে ক্রমেই মুখরিত হয়ে উঠতে থাকে কোনিয়া। অটোমান সময়কালে ১৮৯৫ সালের এক হিসাবে এ নগরীর বাসিন্দা ছিলো পঁয়তালিøশ হাজার। এদের মাঝে ৪২,৩১৮ জন মুসলমান, ১,৫৬৬ জন আরমেনিয়ান খ্রিস্টান এবং ৮৯৯ জন গ্রীক খ্রিস্টান। তখন মসজিদের সংখ্যা ছিলো ২১ এবং চার্চ ৫টি। পরবর্তীতে ইটালিয়ান রেলওয়ে শ্রমিকদের জন্য ১৯১০ সালে একটি চার্চ নির্মাণ করা হয়। ১৯২৩ সালে গ্রীক-তুর্কি জনসংখ্যার আদান প্রদানের কারণে এটি কেবলমাত্র মুসলমানদের নগরীতে পরিণত হয়।
কোনিয়াতে তুরস্কের বৃহত্তর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি সেলকুক বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। এটি ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। নগরীটি একসময় সেলজুক সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল বলে সে সাম্রাজ্যের নামানুসারে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়। মূলত সেলজুক থেকেই সেলকুকের উৎপত্তি। কোনিয়া নগরীটি প্রাচীন হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এখানে রয়েছে অসংখ্য প্রাচীনতম নিদর্শন। আর এসব কারণেই কোনিয়া থেকে প্রতিনিয়ত ভেসে আসছে ইতিহাসের পদধ্বনি। এখানে রয়েছে প্রাচীন স্থাপনা আলাউদ্দিন মসজিদ। এটি নির্মিত হয়েছিলো ১২ এবং ১৩তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদের নামানুসারেই নামকরণ করা হয়েছিলো এর। ঐতিহাসিক এ স্থাপনার একভাগে মূল মসজিদ এবং অন্য ভাগে সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদসহ সেলজুক সালতানাতের বিভিন্ন ব্যক্তিদের কবর। কোনিয়াতে অবস্থিত প্রাচীন বিভিন্ন বিদ্যাপিঠ বর্তমানে অতীত নিদর্শনগুলোকে বুকে ধারণ করে জাদুঘর হিসাবে টিকে রয়েছে। এরকম জাদুঘর হলো ইঞ্চ মিনারাট মাদ্রাসা এবং কারাটায়া মাদ্রাসা।
মানুষের সন্তরণে সভ্যতা গড়ে উঠে মানুষের প্রয়োজনেই। এর কোনটি টিকে থাকে, কোনটি আবার হারিয়ে যায় সময়ের স্রোতে। আবার অ¯িÍত্ব টিকিয়ে রাখলেও অনেক সভ্যতা থেকে বিলীন হয়ে যায় অতীত অনেক শিল্প ও সংস্কৃতির ব্যবহারিক দিক। কিন্তু কোনিয়া এখনো জলাঞ্জলি দেয়নি তাদের অতীত সৌখিন শিল্প গালিচা বুনন। জাজিয়ানটেপের মতোই এ নগরীর গালিচাও বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তেমনি এ ভ’খন্ডটি সমাদৃত এখানকার আধ্মাত্বিক সাধক ও মুসলিম সুফিদের পান্ডিত্যের জন্য। তবে ধর্ম নিরপেÿ তুরস্কের বৈরি বাতাস বয়ে গেলেও একেবারে লন্ডভন্ড করে দিতে পারেনি একসময়কার ইসলামের দূর্গ এই নগরীকে। এখনো পরম যতেœ অতীতকে আগলে রেখেছে পবিত্র ভ’মি কোনিয়া।

গীজা
পিরামিডের নগরী গীজা। প্রাচীন এ নগরীতে অবস্থিত আশ্চর্য স্থাপনা গ্রেট পিরামিড গীজা। অনেকের ধারণা এ স্থাপত্যটি চাঁদের বুক থেকেও দেখা যাওয়া সম্ভব। এখানে রয়েছে মায়াবী এক স্থাপনা স্ফিংসসহ আরো অনেক পিরামিড। পিরামিডের কারণে বিশ্বব্যাপী এ ব-দ্বীপটি পরিচিত হলেও অনেকের ধারণা এটি পরিপূর্ণ এক মরু এলাকা। মূলত তা নয় মিশরীয় সংস্কৃতির গুরুত্বপূণৃ এ স্থানে রয়েছে ঘনবসতি। ২০০৬ সালের এক হিসাব অনুযায়ী গীজাতে রয়েছে ২,৬৮১,৮৬৩ জনের বসতি। নীল নদের পশ্চিম তেির অবস্থিত নগরী গীজার অবস্থান রাজধানী কায়রো থেকে ২০ কিলোমিটার দÿিণ পশ্চিম দিকে। বর্তমানে এটি গীজ গভর্ণরেটের রাজধানী। আরবি ‘গীজা’ শব্দের অর্থ ‘সীমান্ত’। আর এ কারণেই গ্রেট পিরামিড গীজাকে অবস্থানগতভাবে বলা হয় মাঝে এবং সীমান্তে।
মিশরের প্রাচীন এ মালভ’মিতে বসতির সূচনা শুরু হয়েছে ৫০০০ বছর আগে ফারাউ শাসকদের সময় থেকে। ধারণা করা হয় এ নগরীটি গড়ে উঠেছে খ্রিস্টপূর্ব ২৫৬৮ সালে। পিরামিড নির্মাণ ও এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পেশার উপর ভিত্তি করে এখানে বসতির শুরু হয়। আর ক্রমেই এতে আসতে থাকে নতুন নতুন পরিবর্তন। তবে নগরীটির জৌলুস ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় ১৮ শতকে এবং সা¤প্রতিক বিংশ শতাব্দীতে। এখানে রয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ২৬০১ থেকে ২৫১৫ সাল পর্যন্ত ফারাউ শাসক মেনকিউর, খাফরে এবং খুফুর স্মৃতি।
গীজাতে সারা বিশ্ব থেকে পর্যটকরা ছুটে আসে ‘গ্রেট পিরামিড গীজা’র আকর্ষণে। মিশরে পিরামিডের সংখ্যা ১০০ টিরও বেশি, এর মাঝে সর্বোচ্চ এবং শ্রেষ্ঠ পিরামিড হলো গীজা। মিশরের গীজা ব-দ্বীপে অবস্থিত পিরামিডগুলোর মাঝে এটি সর্ববৃহৎ এবং সর্বাধিক পরিচিত। তাই এ পিরামিডকেই বলা হয় গীজা। গীজাতে উলেøখযোগ্য আরো তিনটি পিরামিড রয়েছে, এগুলো হলো গ্রেট পিরামিড অব খেফরান, গ্রেট পিরামিড অব মেনকিউর এবং স্ফিংস। সিংহের দেহ ও মানুষের চেহারার আকৃতিতে নির্মিত স্ফিংস যেন এক বিশাল মায়াবী মানবপশু।
মিশরের এ ব-দ্বীপটিকে বলা যায় সমাধির দ্বীপ। কারণ পিরামিড সমাধিসৌধ হিসেবেই পরিচিত। প্রাচীন মিশরীয় প্রতাপশালী ফারাও শাসকরা মারা গেলে তাদের লাশ সংরÿণে রাখার জন্য নির্মাণ করা হতো পিরামিড। তাদের ধারণা ছিলো এর ভেতরই অতিবাহিত হবে মৃতের পরবর্তী জীবণ। আর দ্বিতীয় জীবন সুখে শান্তিতে অতিবাহিত করার জন্য এগুলো নির্মাণ করা হতো রতœাগারসমেত। এসব রতœাগারে লাশ রেখে আসার সময় তারা দিয়ে আসতো অনেক ধন-রতœও। তাছারা নিয়মিত সেখানে দেয়া হতো খাবার।
পিরামিড বলতে পৃথিবীব্যাপী যেটি পরিচিত সেটি হলো, মিশরের গীজায় অবস্থিত সবচেয়ে উঁচু পিরামিড গীজা। অন্যগুলোর মতো গীজার ভেতর কোন ফারাও রাজার মৃতদেহ নেই। আর স্বাভাবিকভাবেই এ কারণে কোন রতœাগারও নেই। কিন্তু অনেক চোরদের ধারণা ছিলো গীজার ভেতরও রয়েছে অঢেল রতœ ভান্ডার। এ কারণে বিভিন্ন সময় কাঙ্খিত সে রতœগুলোকে সরিয়ে ফেলার জন্য এতে অভিযান চালাতো তারা। কিন্তু এর ভেতরকার সুড়ঙ্গগুলোর বিন্যাস ও গতিপথ এতই জটিল ছিলো যে পথ হারিয়ে ফেলতো অনেক রতœ লুটেরা। গীজাকে সঠিক ব্যবস্থাপনায় নেয়ার আগে বহু চোর এবং কৌতুহলীদেরকে লাশ হতে হয়েছে এর ভেতর।
পৃথিবীর এই আশ্চর্য স্থাপনাগুলোকে বুকে ধারণ করে পর্যটন নগরী হিসাবে টিকে আছে গীজা। মিশরের অর্থনীতিতে বড় একটি অবদান রাখছে এই নগরীর আশ্চর্যতম আকর্ষণ।

জিয়ান

আদিম মানুষের একটি গোষ্ঠী ল্যানটিয়ান। বর্তমান পৃথিবীতে এই গোষ্ঠীকে নিয়ে সৃস্টি হয়েছে অনেক প্রশ্নের। সেই সাথে এদেরকে নিয়ে প্রচলিত রয়েছে অনেক কিংবদন্তি। কেউ কেউ এদেরকে মানুষ হিসাবে বিবেচনা করলেও নির্দ্বিধায় পুরোপুরি মানুষের আওতায় ফেলছেননা। কেওবা বলছেন এরা আদৌ মানুষ ছিলোনা। আবার কেউ তুলে ধরছেন বিবর্তনবাদের যুক্তি। ১৯৬৩ সালে চীনের ল্যানটিয়ান এলাকায় আদিম মানুষ ল্যানটিয়ানদের অ¯িÍত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমান ল্যানটিয়ানের ৫০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিম দিকেই চীনা সংস্কৃতির সমৃদ্ধ নগরী জিয়ান। অনেকেই ধারণা করছেন ইতিহাসের প্রাচীনতম এ এলাকায় বসতির সূচনা হয়েছে ল্যানটিয়ানদের মাধ্যমেই। পর্যায়ক্রমে তা এসে উপনীত হয়েছে আজকের জৌলুসপূর্ণ অবস্থায়। অনুমান করা হয় নগরী হিসাবে এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব ২২০৫ সালে। জিয়ান ঐতিহাসিকভাবে ‘চেঙ্গান’ নামে পরিচিত। এটি বর্তমান চীনের শাঞ্জি প্রদেশের রাজধানী। চাইনিজ শব্দ জিয়ানের অর্থ ‘শান্তি’।
জিয়ান সংস্কৃতি সমৃদ্ধ নগরী। খ্রিস্টপূর্ব ১১ শতকে এটি চীনের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক রাজধানী হিসাবে পরিচিতি পায়। তখনকার জউ শাসনের রাজধানী ছিলো বর্তমান জিয়ানের পশ্চিম অংশ ফেঙ্গ এবং হাউ এলাকা। পরবর্তীতে অর্থাৎ ২২১-২০৬ খ্রিস্টপূর্বের সময়কাল চীন ছিলো কীন শাসনের অধীনে। তখনও এ নগরীর রাজধানী ছিলো উত্তর পশ্চিম এলাকা জিয়ানায়াঙ্গ। এই জিয়ানায়াঙ্গই বিবর্তনে জিয়ান-এ এসে পৌঁছায়। খ্রিস্টপূর্ব ২০২ সালে হান শাসনের প্রতিষ্ঠাতা লিউ বগের সময়ও চাঙ্গান এর রাজধানী ছিলো এই নগরী। এখানেই তিনি নির্মাণ করেন চাঙ্গালী পেলেস। বর্তমান জিয়ানের উত্তর অংশে উয়িয়াঙ্গ প্যালেসটিও নির্মাণ করেন তিনিই। ২০০৫ সালের শেষের দিকের এক হিসাবে জিয়ানের লোকসংখ্যা ছিলো ৮.০৭ মিলিয়ন। যার ৫১.৬৬ শতাংশ ছিলো পুরুষ এবং ৪৮.৩৪ শতাংশ ছিলো মহিলা। জিয়ানের অধিবাসীদের অধিকাংশ হান চাইনিজ। যাদের পরিমাণ ৯৯.১ শতাংশ। শহরে মুসলিম হুই এর সংখ্যা ৫০,০০০।
প্রাচীন এ নগরীতে এখন রয়ে গেছে ইতিহাসের অনেক চাপ। নগরীর চারপাশ ঘিরে রেখেছে ঐতিহাসিক একটি দেয়াল। এখানে রয়েছে কীন শি হুয়ান্ডা এর সমাধি ফলক এবং তার সময়কার তৈরি টেরাকোটা আরমি। তাছারা এখনো কাঠামো টিকে রয়েছে জউ শাসনের অনেকের সমাধীসৌধের।


আসিয়ুট
কায়রো থেকে ৩৭৫ কিলোমিটার দÿিণে প্রাচীন নগরী আসিয়ুটের অবস্থান। ধারণা করা হয় এ এলাকা নগরী হিসাবে গড়ে উঠেছিলো ফারাও শাসকদের সময় ২১৬০ খ্রিস্টপূর্বে। বর্তমান মিশরের আধুনিক আসিয়ুট প্রদেশের রাজধানী এ শহরটি ৩১০০ খ্রিস্টপূর্বে ছিলো মিশরের একটি প্রশাসনিক বিভাগ। যাকে বলা হতো নোম। মিশরীয় খ্রীস্টানদের উলেøখযোগ্য পরিমাণের বসবাস এখানে।
নীল নদের পশ্চিম তীরের জৌলুসপূর্ণ এ নগরী মূলত একটি দ্বীপ। এর আকৃতি কলাসদৃম্য হওয়ায় ইংরেজীতে একে বেনানা দ্বীপ বলা হয়। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং মুক্ত আবহাওয়ার আকর্ষণে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন অবকাশ কাটানোর জন্য। শেফার্ড শাসনের সময়কালে এ দ্বীপটি প্রথম আবিষ্কার করেন রিকামাই।
বর্তমানে আসিয়ুট মিশরের কৃষিÿেত্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্র। এখানে রয়েছে বিখ্যাত বিদ্যাপিঠ আসিয়ুট বিশ্ববিদ্যালয়। যা মিশরের ৩য় বৃহত্তম একটি বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে ১৯০২ সালে নির্মাণ করা হয় আসিয়ুট ব্যারেজ। মিশরের প্রাচীন এ নগরীর উলেøখযোগ্য একটি প্রতিষ্ঠান হলো লিলিয়ান ট্রেশার এতিমখানা। যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী লিলিয়ান ট্রেশার। ১৯৬১ সালে তিনি আসিয়ুটেই মৃত্যুবরণ করেন। ৫ম শতকের গ্রীক কবি কলুনুস উঠে এসেছিলেন এ নগরী থেকেই। এখানকার বাসিন্দা ছিলেন মিশরের ২য় প্রেসিডেন্ট জামাল আবদাল নাছের।









লাক্সার

দÿিণ মিশরের নগরী লাক্সার। একটি উন্মুক্ত জাদুঘর হিসাবে এ নগরীর পরিচয় রয়েছে বিশ্বব্যাপী। অর্থাৎ পুরো লাক্সার শহরটিই একটি জাদুঘর। এর প্রতিটি অলি-গলিতে খুঁজে পাওয়া যায় ইতিহাস। নগরীর বাতাসে প্রতিনিয়ত ভেসে বেড়ায় ইতিহাসের পদধ্বনি। উন্মুক্ত জাদুঘরের এ শহরে রয়েছে অসংখ্য মনুমেন্ট, গীর্জা এবং সমাধিসৌধ। এখানকার আকর্ষণ নীল নদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত কিং ভ্যালী এবং কুইন ভ্যালী। খ্রিস্টপূর্ব ১৬ থেকে ১১তম শতকে সেখানকার রাজা এবং প্রতাপশালীদের সমাহিত করা হয়েছে এ কিং ভ্যালিতে আর তাদের স্ত্রীদের সমাধি রয়েছে কুইন ভ্যালিতে। আর এ কারণেই পৃথিবীর পর্যটকদের টেনে আনে ঐতিহাসিক এ স্থান।
লাক্সার নগরী বর্তমান মিশরের লাক্সার গভর্ণরেটের রাজধানী। ৪১৬ কিলোমিটার ব্যাপ্তীর এ নগরীতে ১৯৯৯ সালের হিসাব অনুযায়ী ৩৭৬, ০২২ জন লোকের বসবাস। মিশরের প্রাচীন নগরী থিবিস এর একটি অংশ লাক্সার। থিবিস হলো গ্রীক একটি নাম। মিশরের একটি নগরী হিসাবে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বে এটি শুরু হয়। ধারণা করা হয় লাক্সার নগড়ী হিসাবে গড়ে উঠেছিলো ২১৬০ খ্রিস্টপূর্বে। স্থানীয়ভাবে এটি পরিচিত ছিলো প্রধানতম নগরী হিসাবে। কোনসময় এটি পরিচয় পেয়েছে ‘রাজদন্ডের নগরী’ হিসাবে। আবার এটি বর্তমানে সমাধিসৌধের নগরী হিসাবেও পরিচিত। এ নগরীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় মূলত সা¤প্রতিক ১১তম শাসকের সময়। মূলত তখনই শহরটি সমৃদ্ধি লাভ করে। তখন থেকেই বৃদ্ধি পায় বাসিন্দাদের জীবণযাত্রার মান, সামাজিক অবস্থান এবং নগরীর জৌলুস। সেই সাথে এটি প্রজ্ঞা, শিল্প, ধর্ম এবং রাজনীতির কেন্দ্রও হয়ে উঠতে থাকে ক্রমেই।
লাক্সারের অর্থনীতি মিশরের অন্যান্য নগরীর মতোই। তবে এর বড় অংশ নির্ভর করে পর্যটন শিল্পের উপর। আর এখানকার উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম কৃষি। বাসিন্দাদের বড় একটি অংশই কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল।

লিসবন
ইতিহাসের প্রাচীনতম নগরী লিসবন। পর্তুগালের পশ্চিম অংশের এ নগরী ছুঁয়েই প্রবাহিত হচ্ছে টাগুস নদী। সভ্যতার ধুলিকণাকে সময়ের স্রোতে প্রবাহিত করে দিয়ে আপন প্রবাহে আটলান্টিক মহাসাগরে নিজেকে বিলীন করে দিচ্ছে এ নদী। বর্তমানে লিসবনের বড় পরিচয় হলো এটি পর্তুগালের রাজধানী। স্থানীয়ভাবে এর উচ্চারণ লিসবয়া। ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালে গড়ে উঠেছিলো নগরীটি। তবে সেই সময় থেকে এর ইতিহাস স্পষ্ট করে কিছুই বলা যায়না। প্র¯Íর যুগে এখানে বসতি ছিলো আইবেরিয়ানদের। এ আইবেরিয়ানদের অধিকাংশই তখন বসবাস করতো আটলান্টিক ইউরূপে। সম্ভবত তারা এ এলাকায় এসে বসতি স্থাপন করে।
মূলত লিসবন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সংস্কৃতিকভাবে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধিলাভ করে ক্রুসেডারদের অধিগ্রহণে যাবার পর থেকে। খ্রিস্টপূর্ব ১১৪৭ সালে ক্রুসেডাররা খ্রিস্টানদের বসতির জন্য দখল করে নেয় এ এলাকা । এর পর থেকে লিসবনের জৌলুস ক্রমেই বাড়তে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতকে নগরীটি অধিগ্রহণ করে মুরস। আর ৫ম শতকে অধিগ্রহণ করে জুলিয়াস কায়জার। পরবর্তীতে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ সালে লিসবন চলে যায় রোমানদের অধীনে।

বর্তমানে ৮৪.৮ বর্গকিলোমিটারজুড়ে ব্যাপ্ত লিসবন শহরের জনসংখ্যা ৫৬৪৫৬৭ জন। এর মাঝে পৌর এলাকার স্থায়ী অধিবাসী ২.৮ মিলিয়ন এবং ৩.৩৪ মিলিয়ন লোক ঘিঞ্জিভাবে বসতি স্থাপন করেছে নগরীর সীমান্তে। পর্তুগালের অর্থনীতিতে সম্পদে সমৃদ্দশালী এ নগরীর বড় অংশের অবদান থাকে। নগরীর পশ্চিম দিক মানসান্টু ফরেস্ট পার্কের সবুজ বেস্টনিতে ঘেরা। ইউরুপের বৃহত্তম এ পার্কটির ব্যপ্তি ১০ বর্গ কিলোমিটার।
ভ’মধ্যসাগরীয় আবহাওয়ার নগরী লিসবন স্থাপত্য শিল্পে সমৃদ্ধ। এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে রুমান, গোনিক, ম্যানুইলাইন, বারাকুই, পর্তুগীজ, আধুনিক, উত্তরাধুনীকসহ বিভিন্ন সময়কালের নানা আকর্ষণীয় স্থাপনত্য শৈলী। শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য প্রাচীন মনুমেন্ট আর ঐতিহাসিক স্থাপনা। যেগুলো থেকে প্রতিনিয়ত ভেসে আসছে ইতিহাসের পদধ্বনি।